‘তুমি বলবে, সাজব।
বাগানে মালিনীরা গাঁথবে মালা
ঘরে দাসীরা বাটবে চন্দন। ’
নিজেকে সুন্দর দেখতে কে না চায়? হ্যান্স এন্ডারসনের রূপকথার তুষার কন্যার সত্ মা-ও আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করত ‘বল আয়না, কে সবচেয়ে সুন্দরী। ’ আবার ইউসুফ (আ.) মুগ্ধ হয়েছিলেন জুলেখা বিবির সৌন্দর্যে। কিইবা এই রূপের রহস্য! ইতিহাসের পাতা তন্ন তন্ন করে হাতড়ে বেড়ালে রূপ রহস্যের নেপথ্যে পাওয়া যায় সাজসজ্জার ইতিহাসও।
গ্রীক পুরাণের পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছে দেব-দেবীদের সৌন্দর্যের কথা। পারস্য উপকথার নার্গিস গ্রিক পুরাণে গিয়ে হয়েছে আত্মমগ্ন সৌন্দর্যপ্রেমী নার্সিসাস। তেমনি আমাদের পুরাণকথার সীতা, শকুন্তলা কিংবা উপন্যাসের কপালকুন্ডলা, রজকিনী সকলেরই সৌন্দর্যের ছিল ভিন্ন ভিন্ন মাত্রা। বাঙাল মুলুকের উপকথার চম্পাবতী, সোনাভান যেমন তেমনি মানিক বন্দোপাধ্যায়ের কালজয়ী কপিলা অথবা তারাশঙ্করের ঠাকুরঝি ও বসন্ত সকলেই রূপেগুণে অনন্যা ছিল। নিজের রূপকে অপরূপ করে সাজাতে কে না ভালোবাসে?
তবে রূপচর্চার ইতিহাসে খাঁটি দুধ, শিশির ঝরা ফুলের রেণুু, কাঁচা হলুদের নির্যাস, নিম পাতার রস, মেহেদির রং, গোলাপের সুগন্ধি, চন্দন কাঠ, রিঠা, ঘৃতকুমারী নয়তো কচি ডাবের শাস, অন্যান্য ফলের নির্যাস, গাছের ছাল-বাকলের রং সবার আগে এসে দাঁড়াবে এসব ছিল সৌন্দর্যচর্চার নিত্যব্যবহার্য উপাদান।
প্রকৃতির সন্তানরা যুগে যুগে সমৃদ্ধ হয়েছে প্রকৃতির ঔদার্যতায়। হাল আমলের পেডিকিওর, মেনিকিওর, নারিশিং আর ময়েশ্চারের মতো নাম হয়তো ছিল না, কিন্তু চর্চাটা ছিল সেই আদিকাল থেকেই।
মোগল সাম্রাজ্যের সেই সব মহিয়সী রূপসীদের রূপচর্চার কথা ভুলে গেলে চলবে না। সৌন্দর্যচর্চার অভিজাত রূপ তারাই বহন করে এনেছিলেন এই ভারতবর্ষে। ছিল তাদের সৌন্দর্যের অহংকারও।
সৌন্দর্যের অপার লীলাভূমি বাংলাদেশের অতীতের মতোই এ অঞ্চলে মানবীদের রূপচর্চার ইতিহাসও খুব প্রাচীন। তাদের হয়তো বা প্রযুক্তি ছিল না কিন্তু ছিল বুদ্ধিমত্তা। সৌন্দর্যচর্চার মূল উপাদান সংগ্রহ করত প্রকৃতি থেকে।
শকুন্তলার যে রূপ দেখে রাজা দুষ্মন্ত বলে উঠেছিলেন, ‘তোমার অধরে নবপল্লবশোভার আবির্ভাব, বাহুযুগল কোমল বিটপের মতো বিচিত্র শোভায় বিভূষিত, এরূপ রূপবতী আমার অন্তঃপুরেও নাই’ অথবা যে রূপে মুগ্ধ হয়ে তপোবনের প্রিয়াকে নিয়ে এ যুগের কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা লিখেছিলেন, ‘আগুন জ্বলে কামারশালায়, লৌহপিণ্ড গলে যায় যে রূপ জ্বালায়, যে-রূপে পুরুষমাত্র হয় অন্ধকূপ। ’ সে রূপ প্রস্ফুটিত হয়েছিল তপোবনে নিসর্গের ছোঁয়ায়।
কিংবা এই সব পৌরাণিক নারীর কথা বাদ দিয়ে যদি আমরা আকবরের প্রেয়সী যোধা বাঈয়ের কথা বলি, হালের হিন্দি চলচ্চিত্রের বদৌলতে আমরা দেখেছি কুসুম গরম দুধে গোলাপের পাপড়ি ছড়িয়ে স্নান করতেন তিনি। আরো পেছনের ইতিহাস টানলে দেখব মিসরে নীল নদের তীরে রাজকীয় হাম্মামে রানী হাতশেপসুতে স্নান করছেন উটের দুধ দিয়ে, যে দুধে জয়তুনের তেলের সঙ্গে নীল পদ্মের নির্যাস মিশিয়ে দিয়েছেন তাঁর দাসীরা।
যুগে যুগে বদলেছে অনেককিছুই কিন্তু বদলায়নি সৌন্দর্যের পিপাসা। শুধু নারী নয়; পুরুষদের মনেও লেগেছে সৌন্দর্যচর্চার প্রভাব, গ্লাডিয়েটরদের মতো শৌর্যবীর্য, সম্রাট অশোকের মতো নিষ্কলঙ্ক রূপ আজকালও সব পুরুষের কাঙ্ক্ষিত। ‘অশোকা’ চলচ্চিত্রের জয়জয়কার তো আমরা সেদিনই দেখলাম।
এই সব অপরূপ রূপচর্চার কাহিনি বিনির্মিত হয়েছে আধুনিক কালে। রূপাতৃষ্ণাকে শাণিত করার জন্যই জন্ম নিয়েছে বিউটি পার্লার। এমন কোনো পত্রিকা নেই যেখানে দুটি বাড়তি পাতা নেই রূপচর্চার জন্য। সেই পাতাগুলোতে থাকে রূপ আর সৌন্দর্যের সাতকাহন। পায়ের নখ থেকে মাথার চুলের অগ্রভাগ সবকিছুর রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন পরিচর্যা আর ভিন্ন প্রকাশ।
ফ্যাশন, রূপচর্চা আর স্বাস্থ্য-সচেতনতা সব একসূত্রে গাঁথা হয়ে তৈরি করছে অকৃত্রিম সুন্দর।
রূপ চির সতেজ ও সজীব রাখার প্রথম শর্ত পানি পান। সেটা পুরুষ নারী উভয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। প্রচুর পানি পান শরীরকে যেমন তরতাজা রাখবে তেমনি মসৃণ করবে ত্বক। বিশ্বব্যাপী ত্বকের যত্নে যখন নামি-দামি প্রসাধন সামগ্রীর ব্যবহার নজিরবিহীনভাবে বাড়ছে তখন বৃটিশ বিজ্ঞানীরা ত্বক সুন্দর রাখতে পানি নিয়ে একটি ভিন্নধর্মী তথ্য দিয়েছে।
তারা গবেষণায় দেখিয়েছেন, শুধুমাত্র পর্যাপ্ত পানি পানের ফলে ত্বকে পানির পরিমাণ স্বাভাবিক থাকলে ত্বকের সৌন্দর্য বেড়ে যায় এবং ত্বকের ভাঁজ কমাতে সাহায্য করে। পানি পান শুধু সুস্থ কিডনির জন্যই প্রয়োজন বলে মনে করা হতো এতকাল। পানি ত্বকের সৌন্দর্য রক্ষা এবং খাদ্য পরিপাকে ও এসিডিটি লাঘবে সহায়ক। তাই যারা ত্বক সুন্দর রাখতে চান তাদের উচিত প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ গ্লাস পানি পান করা।
এরপর কতশত প্রচেষ্টা রয়েছে নিজের গা বাঁচানোর জন্য।
গা মানে দেহ আর দেহের প্রকাশ আসলে ত্বকের সৌন্দর্যের ওপর নির্ভরশীল। আর আজকাল ত্বকের যত্নের ব্যাপারে নারী-পুরুষ উভয়েই সচেতন হয়ে উঠেছেন। নানারকম ক্রিম, তেল, সাবান, ফেসওয়াশ, পাউডার ইত্যাদির ব্যবহারও বেড়েছে অধিকহারে। রং ফর্সা করা, কালো দাগ ও ব্রন দূর করা কোনোকিছুই যেন আজকাল আর অসম্ভব নয়, এমনকি টাক মাথায় চুল গজানো সম্ভব। অথচ ত্বকের সৌন্দর্য বা যত্নের ব্যাপারে আমাদের ধারণা অনেকাংশেই ভুল।
স্বাস্থ্যসচেতন হলে ত্বক এমনিতেই সুন্দর থাকার কথা। ব্যক্তির চমত্কার ত্বক তার সুস্থতার পরিচায়ক। সুষম খাদ্য গ্রহণ, প্রচুর পানি পান ও নিয়মিত ব্যায়াম, অধূমপায়ী হওয়া—এসব সুন্দর ত্বকের পূর্বশর্ত।
বয়সের সঙ্গে সঙ্গে ত্বক কিছুটা হলেও মলিন হয়ে আসবে বা বুড়িয়ে যাবে—এটা স্বাভাবিক একটি প্রক্রিয়া। আমাদের ত্বকের রঙের ভিন্নতার কারণ মেলানিন নামক রঞ্জক পদার্থ।
মেলানিন কম থাকলে রং ফর্সা হয় এবং বেশি থাকলে কালো হয়। কিন্তু যাদের ত্বকে মেলানিন কম থাকে অর্থাত্ যাদের গায়ের রং ফর্সা তাদের ত্বকের নানারকম সমস্যা হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। ত্বকের বলিরেখা, কালো দাগ, রোদে পোড়া দাগ, এমনকি ক্যান্সারের ঝুঁকিও তাদের বেশি। ‘কালো মাইয়া কালো বরণ কইরো নাকো হেলা’ গানটি মাথায় রেখে রং ফর্সাকারী ক্রিমের পেছনে একদম ছোটা যাবে না। বরং ওই সব ক্রিমের রাসায়নিক প্রতিক্রিয়ায় ত্বকের কী অবস্থা করে, তা জানার জন্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেওয়া ভালো।
সঠিক ও পরিপূর্ণ খাদ্যাভ্যাসের মাধ্যমে খুব সহজেই ত্বকের লাবণ্য ফিরিয়ে আনা সম্ভব। ভিটামিন এ বা বিটা ক্যারোটিন ত্বকের জন্য অত্যন্ত জরুরি উপাদান। রঙিন সবজি ও ফলে থাকে বিটা ক্যারোটিন। এছাড়া ব্রনের চিকিত্সায় ভিটামিন এ সাপ্লিমেন্ট দেওয়া হয়। বাকি দুটি অ্যান্টি অক্সিডেন্ট অর্থাত্ ভিটামিন সি ও ভিটামিন ই জরুরি উপাদান ত্বকের জন্য।
ভিটামিন ই ত্বকের বলিরেখা দূর করে। এমনকি দীর্ঘদিন ব্যবহারে ত্বকের বলি রেখা পড়তে দেয় না। প্রতিদিন ৪০০ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন ই আমাদের প্রয়োজন।
রূপলাবণ্য ধরে রাখতে ভিটামিন সি অতুলনীয়। কাঁচা সবজি ও টক ফলে পাবেন ভিটামিন সি, প্রতিদিন ৫০০ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি আমাদের প্রয়োজন।
কিছু মাইক্রোনিট্রিয়েন্ট ত্বকের জন্য উপকারী এর মাঝে রয়েছে সিলিকন, সেলেনিয়াম এবং কপার। সিলিকন ত্বক কোষ তৈরিতে সাহায্য করে। তাই ক্ষতিগ্রস্ত ত্বকের জন্য সিলিকন প্রয়োজন। সিলিকন সবজি, খাদ্যশস্য ও সামুদ্রিক মাছে পাওয়া যায়। এছাড়া কপার ত্বকের কোলাজেন, ইলাস্টিন ও মেলানিন তৈরিতে সহায়তা করে বলে কপারও ত্বকের জন্য প্রয়োজনীয়।
আর সেলেনিয়াম অ্যান্টি অক্সিডেন্ট হিসেবেও কাজ করে, রোদে পোড়া ত্বককে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে সহায়তা দেয়।
রোদে পোড়া ত্বক, বলি রেখা, ব্রন যেকোনো সমস্যার জন্য আলফা হাইড্রক্সি ভালো কাজ দেয়। স্বাভাবিকভাবে নানারকম ফল যেমন—আনারস, কমলা, আপেল, আঙ্গুর এগুলোতে আলফা হাইড্রক্সি থাকে। ত্বকে যেকোনো ক্রিম ও লোশন ব্যবহারের আগে ডার্মাটোলজিস্টের পরামর্শ নিলে ভালো। তবে যেকোনো চিকিত্সকের পরামর্শ অন্ততপক্ষে নেয়া প্রয়োজন।
চটকদার বিজ্ঞাপনে উত্সাহী হয়ে ত্বকে কিছু ব্যবহারের আগে একটু সময় নেয়া উচিত, সহায়তা দরকার বিশেষজ্ঞের।
তবে যত যত্নআত্তি করা হোক না কেন ঋতুভেদে ত্বকের বদলে যাবার বিষয়টা মাথায় রাখতে হবে। তাই ভিন্ন ভিন্ন ঋতুতে চাই ভিন্ন রকমের চর্চা। ত্বক সবচেয়ে বেশি কষ্ট পায় বর্ষা আর শীতে। গ্রীষ্মকালে একটু গরম হলেও ত্বক রক্ষা করা তেমন বিষয় না, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকলে আর প্রচুর পানি খেলেই একদম তরতাজা গরমের ত্বক।
মৌসুমি ফলগুলোও খেতেই হবে।
বর্ষাকালে গাছাপালা সতেজ হলেও মানুষের ত্বকে রোগব্যাধি ছড়ানোর উপযুক্ত সময় এই ঋতু। সারাদিন একটা স্যাঁতস্যাঁতে ভাব ত্বক মন সব আর্দ্র করে দেয়। বেশি ক্ষতি হয় চুলের, ভেজা চুলে গন্ধও হয়ে যায়। সুস্থ পরিপাটি ও সতেজ থাকবার জন্য তাই চায় বাড়তি যত্ন।
বর্ষাকালে চুল খুব চিটচিটে হয়ে যায়। আর্দ্রতার কারণে চুলের একটি বড় সমস্যা হলো খুশকি। ভেজা আবহাওয়ায় মাথার স্ক্যাল্প বা তালুও আর্দ্র হয়ে পড়ে। চুলে ময়লা বেশি হয় ও আর্দ্রতার জন্য তা চুলের গোড়ায় জমে চুলকে আঠালো করে দেয়। বেড়ে যায় খুশকির প্রকোপ।
তাই বর্ষাকালে চুল সুন্দর রাখার মূল শর্তটিই হলো নিয়মিত চুল পরিষ্কার করা এবং অবশ্যই চুল শুকনো রাখা।
প্রতিবার বৃষ্টির পানিতে চুল ভিজে যাওয়ার পরই যত দ্রুত সম্ভব শ্যাম্পু করে চুল ধুয়ে ফেলুন। নিয়মিত শ্যাম্পু করুন চুলে, তারপর কন্ডিশনার ব্যবহার করুন। হেয়ার ড্রায়ারের চেয়ে ফ্যানের বাতাসেই চুল শুকিয়ে নেওয়া ভালো। চুল শুকানোর জন্য হেয়ার ড্রায়ার যদি ব্যবহার করতেই হয়, তবে চুলের দু-তিন ইঞ্চি দূরে ধরুন ড্রায়ার।
অতিরিক্ত তাপ চুলের জন্য ক্ষতিকর। মসুর ডাল ভিজিয়ে সেই পানি দিয়েও চুল ধুয়ে নিতে পারেন শ্যাম্পুর আগে। খুশকি থাকলে অবশ্যই অ্যান্টি-ড্যানড্রাফ শ্যাম্পু ব্যবহার করতে হবে।
চুলের সঠিক যত্নই একরাশ নির্জীব চুলে ফিরিয়ে দিতে পারে নতুন প্রাণ। ঋতুর পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের আবহাওয়া কখনো খুব গরম, সূর্যের তাপ, কখনো অঝোরধারায় বৃষ্টি আবার কখনো শীতের রুক্ষতা।
এই বিষয়গুলো মাথায় রেখে চুলের পরিচর্যা করলে চুল ঝলমলে সুন্দর হবেই। তাই গ্রীষ্ম বর্ষা যে ঋতু হোক না কেন, খুশকি থাকলে কোনো ছাড় নেই। নিয়ে নিতে হবে হট টাওয়েল ট্রিটমেন্ট। হালকা গরম পানিতে তোয়ালে ভিজিয়ে কিছুক্ষণ চেপে রাখতে হবে পুরো মাথায়। এরকম কয়েকবার করার পর খুশকি নরম হয়ে আসবে এবং পরিষ্কার করতে সুবিধে হবে।
ঝলমলে চুল পেতে বাজারে কিনতে পাওয়া যায় চুলের টোনার। বাসায়ও তৈরি করা যায়। পেঁয়াজের রস খুব ভালো টোনার। পেঁয়াজের রসে তুলা ভিজিয়ে পুরো মাথায় লাগিয়ে শ্যাম্পু করে ফেললেই দেখা মিলবে ঝলমলে চুলের। চুলে চিকচিকে ভাব আনতে চুল ধোয়ার পর এক মগ পানিতে একটা লেবুর রস মিশিয়ে চুলে দেয়া যায়।
লেবুর রসের বদলে সাদা ভিনিগারও ব্যবহার করা যেতে পারে। জবা ফুল পেস্ট করে লাগালে চুল মজবুত হয়, কালো হয়। শ্যাম্পুর কিছুক্ষণ আগে চুলে তেল ম্যাসাজ করে নিলে রক্ত চলাচল ভালো হবে আর চুল হয়ে উঠবে স্বাস্থ্যোজ্জ্বল।
ত্বক বলতে শুধু মুখমণ্ডল মনে করে বসে থাকলে একদম চলবে না। হাত-পায়ের কথাও মাথায় রাখতে হবে, অনেকেই কিন্তু নিয়মিত রূপচর্চা করলেও অবহেলা করেন নিজের হাত ও পা-কেই।
সৌন্দর্যের একটি অংশ হলো হাত-পা। সপ্তাহে ১ দিন বাড়িতে বসে নিজেই হাত-পায়ের যত্ন নিতে পারেন। বিশেষ করে বর্ষার এই সময়টাতে হাত-পায়ের যত্নে ম্যানিকিওর, প্যাডিকিওর জরুরি। পায়ের সৌন্দর্যের প্রধান ধাপ নখ ও গোড়ালি। সুন্দরভাবে মরা চামড়া তুলে নখের শেপ করে নেয়া উচিত।
এরপর গোড়ালিতে অয়েল বেইজ ময়েশ্চারাইজার দিয়ে ম্যাসাজ করে যারা নেইল পলিশ লাগাতে পছন্দ করে তারা এবার নখে নেইলপলিশ লাগিয়ে নিতে পারেন। তিন দিনের বেশি নেইলপলিশ লাগিয়ে রাখাটা ঠিক হবে না এবং রিমুভারের সাহায্যে নখের নেইলপলিশ তুলে নখের ওপর ম্যাসাজ ক্রিম লাগিয়ে নেয়াটা উত্তম। এতে নখের চাকচিক্যভাব বজায় থাকবে।
সৌন্দর্যচর্চায় প্রসাধনীর গুরুত্বও কম নয়। সেদিকে খেয়াল রেখে ভালো মানের প্রোডাক্ট বেছে নিতে হবে।
হাত-পা প্রয়োজনীয় অঙ্গ, তাই সমানভাবে সমানতালে এর সৌন্দর্যচর্চায় মনোযোগী হতে হবে। হাতের সৌন্দর্যে শ্যাম্পু, গোলাপজল, লেবুর রস, পানি মিশিয়ে ১০-১৫ মিনিট ডুবিয়ে রেখে নখের পাশগুলো ব্রাশের সাহায্যে পরিষ্কার করে নিতে হবে। এরপর ময়েশ্চারাইজার ক্রিম বা লোশন ১০ মিনিট ম্যাসাজ করলেই হাতের সৌন্দর্য বৃদ্ধি পাবে। এরপর চাইলে আপনার পছন্দ অনুযায়ী নেইলপলিশ দেয়া যেতে পারে। এভাবে নিয়মিত হাত ও পায়ের যত্ন নিন।
নিজেই নিজের রূপচর্চা করবেন কিভাবে এতক্ষণ তো সেই সব কথাই বলা হলো এবার আসুন কেমন করে সাজবেন উত্সব বা পালা-পার্বণে, সে হতে পারে পহেলা বৈশাখ কিংবা ঈদ। সৌন্দর্যের প্রথম শর্ত চুল। স্বাস্থ্যসম্মত চুল, একটা স্মার্ট হেয়ার স্টাইল আপনার পুরো গেটআপে পরিবর্তন আনতে পারে। চুল যদি বিভিন্ন স্টাইলে কাটা থাকে। চুলের সাথে মিলিয়ে পোশাক পছন্দ করাটাও জরুরি।
জিন্স, ফতুয়া অথবা এই ধরনের পোশাকের সঙ্গে ড্রায়ার বা আয়রন করে সেট করে নিন, স্পাইরাল বা কার্ল করে পিঠের ওপরে ছড়িয়ে রাখতে পারেন, অথবা মাথার সামনের অংশের চুল কিছুটা ফুলিয়ে হেয়ার ব্যান্ড বা পাঞ্চ ক্লিপ দিয়ে আটকে দেয়া যায়। আজকাল চুল বাঁধার স্টাইলের ক্ষেত্রে পাঞ্চ ক্লিপের ব্যবহার খুবই জনপ্রিয়, পোশাকের সঙ্গে মানানসই দেখে এগুলো ব্যবহার করতে পারেন, জিন্স, ফতুয়ার সঙ্গে আটসাঁট করে চুল না বাঁধলেই ভালো দেখাবে, আবার সালোয়ার কামিজের সঙ্গে আটসাঁট টানটান খোপা না বেঁধে খানিকটা ঢিলেঢালা করে এলোমেলো খোপা, ফ্রেঞ্চনট অথবা ফ্রেঞ্চ বেণী, সাধারণ বেণী হেয়ার কাট অনুযায়ী হেয়ার সেট, ব্লো, আয়রন, জিগজাগ আয়রন ইত্যাদি করা যায়। আবার অন্যদিকে যেমন শাড়ি পরে পছন্দ অনুযায়ী চুল সেট করে নিতে পারেন, চুলের ধরন ও দৈর্ঘ্য অনুযায়ী চুল সেটিং ক্লিপ আপ অথবা যেকোনো খোপা বাঁধতে পারেন। ছেলেদের জন্য স্বাভাবিক যেকোনো হেয়ার কাট মানাবে।
এবার আসুন সাজের কথায়, সাজটা হতে হবে পোশাক ও ব্যক্তিত্বের সাথে সামঞ্জস্য রেখে।
নিজেকে পরিপাটি ও আকর্ষণীয় করে সাজিয়ে তুলতে মেকআপ করার আগে ম্যাসাজ ক্রিম ও স্ক্রাব দিয়ে হালকা ম্যাসাজ করে ত্বকের উপযোগী যেকোনো হালকা প্যাক ব্যবহার করা উচিত। এর ফলে ফাউন্ডেশন, আইশ্যাডো, ব্লাশারের রং ত্বকের সঙ্গে ভালোভাবে মিশে যাবে। মেকআপের আগে কপাল থেকে চুল সরিয়ে নিয়ে বেঁধে নিন। প্রথমে ত্বকের ধরণ অনুযায়ী ক্লিনজার দিয়ে হালকা ম্যাসাজ করে একটা ভেজা তুলো দিয়ে মুখ, গলা ও ঘাড় মুছে নিন। এরপর তুলোয় টোনার নিয়ে মুখ, গলা ও ঘাড়ে লাগিয়ে নিন।
এরপর ত্বকের ধরণ অনুযায়ী ময়েশ্চারাইজার লাগিয়ে নিন। দিনে বা রাতের অনুষ্ঠান বা আপনি কোন অনুষ্ঠানে যাবেন সে অনুযায়ী ফাউন্ডেশন বেছে নিন। মুখে, চোখে, ঠোঁটে, গলায় একটা ভেজা স্পঞ্জ বা আঙুলের ডগা দিয়ে আলতো করে ভালোভাবে ফাউন্ডেশন মিশিয়ে নিতে হবে। যেন মুখের সব জায়গায় সমান ও সুন্দরভাবে মিশে যায়। এরপর ট্রান্সলুসেপ্ট পাউডার লাগিয়ে নিন বাড়তি পাউডার ব্রাশ করে ঝেড়ে ফেলুন।
পোশাকের সঙ্গে মিলিয়ে কনট্রাস্ট কালার আইশ্যাডো লাগিয়ে আইব্রোর ঠিক নিচে লাইট ও ব্রাইট কালার হাইলাইট লাগিয়ে নিন। হালকা করে আইব্রো এঁকে নিন। আই লাইনার লাগিয়ে নিন খুব সাবধানে। চিকন মোটা যেভাবেই লাগান না কেন তা যেন সুন্দর ও মসৃণ হয়। এরপর মাসকারা লাগিয়ে নিন।
লিপস্টিকের রঙের সঙ্গে মিলিয়ে এক শেড গাঢ় রঙের লিপ লাইনার দিয়ে ঠোঁটের আউট লাইন এঁকে নিন। আই লাইনার লাগিয়ে নিন খুব সাবধানে। চিকন মোটা যেভাবেই লাগান না কেন তা যেন সুন্দর ও মসৃণ হয়। এরপর মাসকারা লাগিয়ে নিন। লিপস্টিকের রঙের সঙ্গে মিলিয়ে এক শেড গাঢ় রঙের লিপ লাইনার দিয়ে ঠোঁটের আউটলাইন এঁকে নিন ।
লিপস্টিক লাগান এবং শেষে লিপগ্লস লাগিয়ে নিন। দিনের বেলায় আপনি যদি কাজল পরতে চান, কালো না পরে ব্রাউন কালার ভালো দেখাবে। হালকা কালারের ম্যাট লিপস্টিক লাগাবেন। ব্লাশারের ক্ষেত্রে হালকা রং বেছে নিন। আর রাতের বেলায় একটু ভারী ফাউন্ডেশন ব্যবহার করতে পারেন।
কালো, সবুজ, ছাই ইত্যাদি যেকোনো রঙের সমন্বয়ে সুন্দর করে আইশ্যাডো লাগাতে পারেন। আই লাইনার মাশকারা লাগাবেন দু গালে। খুব হাল্কা করে ব্লাশ লাগান, আর ব্লাশ লাগানোর জন্য ফ্ল্যাট ব্রাশ বেছে নিন। এতে ত্বকের ওপর ব্লাশ ভালো বসবে। রাতের অনুষ্ঠানের জন্য ব্রাইট কালারের লিপস্টিক ব্যবহার করুন।
মেকআপ করার ক্ষেত্রে পোশাকের ওপর অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়া উচিত। বিশ্বায়নের এ যুগে ফতুয়ার সঙ্গে ভারী মেকআপ না নেওয়াই ভালো। এ ধরনের পোশাকের সঙ্গে মেকআপ নিলে অবশ্যই যাতে ফিনিশিংটা ম্যাট হয়। শাইনি বা গ্লাস লুককে অবশ্যই এড়িয়ে যেতে হবে। সালোয়ার-কামিজের সঙ্গে দিনের বেলায় সাজে হালকা ধরনের মেকআপ নিতে হবে।
শাড়ির সঙ্গে মেকআপ একটু ভারী নিতে হবে। দিনের তুলনায় ফাউন্ডেশন একটু ভারী হবে। তবে যেন এর ফিনিশিং নিট হয়। এসব কিছুর পর বাকি থেকে যায় হাতে মেহেদি লাগানো। নারীর উত্সব, বিশেষ করে ঈদের সাজ অপূর্ণ থেকে যায় যদি মেহেদির রঙে তা না সাজানো যায়।
বাটা মেহেদি সবসময় অগ্রাধিকার যোগ্য। বাটা মেহেদি দু দিন আগে লাগিয়ে নিতে পারেন। আর টিউব মেহেদি একদিন আগে লাগানো ভালো। মেহেদি লাগানোর সময় লক্ষ রাখতে হবে যেন খুব বেশি সূক্ষ্ম বা ঘন জিজাইনের না হয়। বেশি সূক্ষ্ম ডিজাইনের মেহেদি তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যায় ফলে রংটা ভালোভাবে বসার সময় পায় না।
মেহেদির সঙ্গে রং মিলিয়ে নেইলপলিশ লাগালে হাত ও পায়ের সৌন্দর্য বাড়বে। মেহেদির সঙ্গে নেইলপলিশের রংটা একটু গাঢ় ও উজ্বল হওয়া উচিত। রূপ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ এবং নিজের করা ডিজাইনে সাজুন মেহেদি দিয়ে। যদি নিজের হাতে না পারেন সেক্ষেত্রে বন্ধু বা শহরজুড়ে থাকা বিউটি পার্লার তো আছেই। আর পার্লারে লাগানো স্পেশাল কালো মেহেদি খুবই আকর্ষণীয় হয়।
উত্সবে মেহমানদারি, ঘোরাঘুরি, হৈ-হল্লা শেষে আপনার শরীরের যেমন স্বস্তি দরকার তেমনি আপনার ত্বকের ও দরকার বিশ্রাম। মেকআপ করুন বা নাই করুন দিন শেষে আপনার ত্বককে পরিষ্কার করে নিন। ফ্রেশ শরীর সুস্থ মন আপনার সারাদিনের আনন্দকে ধরে রাখবে।
সাজিয়ে তুলুন নিজেকে যতখুশি, অন্যকেও সাজান। তবে যত সাজসজ্জা থাকুক না কেন, মনে রাখবেন প্রথমে দর্শনদারি নয় প্রথমে গুণবিচারি।
কারণ নিজের রূপ ধরে রাখা অন্যতম প্রথম গুণ। আর চমত্কার মোহনীয় সাজের শেষে, তুষারকন্যার যাদুর আয়নার সামনে গিয়ে জিজ্ঞেস করুন কে সবচেয়ে সুন্দরী। নিঃসন্দেহে আপনার নামটাই বলবে সে।
রবি ঠাকুরের সেই অমর বাণী ভুলবেন না যেন—‘আমি রূপে তোমায় ভোলাব না, ভালোবাসায় ভোলাব। / আমি হাত দিয়ে দ্বার খুলব না গো, গান দিয়ে দ্বার খোলাবো।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।