আমি একজন সাধারন মানুষ, জগড়া ফেসাদ এড়িয়ে চলি। কাওকে দিতে পারিনা, কিন্তু সকলের পরামর্শ নিতে পছন্দ করি। জীবন টাকে সাজাতে চায় অনেক সুন্দর করে ঢাকার তারেক হোসেন। জয়পুরহাটের কালাইয়ের কিডনি ব্যবসার মূল ব্যক্তি তারেকের নিয়োজিত দালালেরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে নগদ টাকার লোভ দেখিয়ে অভাবী মানুষদের কিডনি বিক্রিতে রাজি করান দারিদ্র্যমুক্তির মোহে গরিবেরা সম্মত হন কিডনি বিক্রিতে চুক্তি অনুযায়ী টাকা না পেয়ে, অঙ্গহানি করে বাড়ি ফেরেন অভাবীরা। শেষে তাঁদের মোহমুক্তি ঘটে।
দারিদ্র্যমুক্তি আর হয় না
উত্তরের জেলা জয়পুরহাটের কালাইয়ের ১৮ গ্রামের দুই শতাধিক দরিদ্র মানুষ নিজেদের কিডনি বিক্রি করে দিয়েছেন। গত পাঁচ বছরে এই বিপুল কিডনি বিক্রির ঘটনা ঘটেছে।
চলতি মাসের প্রথম থেকে এই এলাকায় অনুসন্ধান চালিয়ে প্রথম আলো জানতে পেরেছে, অধিকাংশ নারী-পুরুষই দালালদের দেখানো বড় অঙ্কের নগদ টাকার প্রলোভন আর বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) ঋণের চাপ থেকে মুক্তি পেতে কিডনি বিক্রি করেছেন। কিডনিজনিত পরবর্তী স্বাস্থ্যঝুঁকি এবং অনাত্মীয়ের কাছে টাকার বিনিময়ে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিক্রি যে শাস্তিযোগ্য অপরাধ, তা শুরুতে জানতেনই না তাঁরা। কিডনি বিক্রি করে অভাবী এই মানুষেরা মাত্র এক থেকে দেড় লাখ টাকা পেলেও আরও বড় অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয় দালালেরা।
অনুসন্ধানে এসব গ্রামে কিডনি কেনাবেচার শক্তিশালী দালাল চক্রের সন্ধান পাওয়া যায়। গতকাল পুলিশ ওই চক্রের অন্যতম তিন সদস্যকে গ্রেপ্তারও করেছে। চক্রের প্রধান মো. তারেক হোসেন ঢাকায় থেকে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন। আর স্থানীয়ভাবে সব দেখাশোনা করেন উপজেলার বহুতি গ্রামের আবদুস সাত্তারসহ কয়েকজন। গতকাল গ্রেপ্তার হওয়া সাত্তারও তাঁর একটি কিডনি বিক্রি করেছেন।
চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে সাত্তার প্রথম আলোকে বলেছিলেন, কয়েক বছর আগে ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে আত্মীয়ের চিকিৎ সা করাতে গিয়ে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় মো. তারেক হোসেনের। বিএসএমএমইউ ও বারডেম হাসপাতালকেন্দ্রিক কিডনি কেনাবেচার দালালি করেন তারেক। সাত্তার জানান, তারেকের প্রলোভনে পড়ে তিনি নিজের একটি কিডনি বিক্রি করে দেন। এরপর কিডনি কেনার জন্য তাঁকেই (সাত্তার) কাজে লাগান তারেক।
তবে গতকাল গ্রেপ্তার হওয়ার পর সাত্তার পুলিশের কাছে দাবি করেছেন, ঢাকায় চাকরি করার সময় ২০০৬ সালে নিয়োগকর্তার ছেলের জন্য সিঙ্গাপুরে গিয়ে কিডনি দেন তিনি।
এখন তিনি স্থানীয় একটি মাদ্রাসার কর্মচারী।
সাত্তারসহ একাধিক দালাল প্রথম আলোকে জানিয়েছিলেন, তারেক নিজেও এলাকায় গিয়ে মানুষকে টাকার লোভ দেখিয়ে কিডনি বিক্রিতে প্রলুব্ধ করেন।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও এলাকাবাসীর ভাষ্য অনুযায়ী, ২০০৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১৮ গ্রামের দুই শতাধিক অভাবী মানুষ অর্থের বিনিময়ে কিডনি বিক্রি করে দিয়েছেন। অঙ্গহানির তথ্যে সামাজিক-পারিবারিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন হওয়া এবং আইনি ঝামেলার ভয়ে অনেকেই বিষয়টি গোপন রাখছেন।
বোড়াই গ্রামের স্কুলশিক্ষক আবদুল আজিজ বলেন, ‘কিডনি হারানো লোকের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।
দালালদের মাধ্যমে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে ছড়িয়ে পড়ছে কিডনি বিক্রির ভয়ংকর তৎ পরতা। ’
ভেরেন্ডি গ্রামের ইউপি সদস্য জিয়াউর রহমান বাদশার দাবি, ১৮ গ্রামের অভাবী মানুষের শরীর পরীক্ষা করলে অর্ধেক মানুষেরই একটি করে কিডনি খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিডনি বিক্রি করে ঢাকা থেকে ফেরার পর দাতা নিজেই দালাল বনে যাচ্ছে।
১৮ গ্রাম: এ মাসের শুরুতে প্রথমে ক্রেতা সেজে কালাই উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে অনুসন্ধানে নামেন এই প্রতিবেদক। তাতে জানা যায়, অভাবী মানুষের সংখ্যা বেশি—এমন অন্তত ১৮ গ্রামে কিডনি কেনাবেচার শক্ত নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছেন স্থানীয় দালালেরা।
ঋণ থেকে মুক্ত হওয়া আর এককালীন মোটা অঙ্কের টাকা পাওয়ার লোভে অভাবীরা কিডনি বিক্রিতে রাজি হচ্ছেন।
যে ১৮টি গ্রামে কিডনি বিক্রির নেটওয়ার্কের সন্ধান পাওয়া গেছে সেগুলো হলো: উপজেলার মাত্রাই ইউনিয়নের ভেরেন্ডি, উলিপুর, সাতার, কুসুমসাড়া, অনিহার, পাইকশ্বর ও ইন্দাহার। উদয়পুর ইউনিয়নের বহুতি, জয়পুর বহুতি, নওয়ানা বহুতি, দুর্গাপুর, উত্তর তেলিহার, ভুষা, কাশীপুর, বিনইল ও পূর্ব কৃষ্টপুর এবং আহম্মেদাবাদ ইউনিয়নের রাঘবপুর ও বোড়াই।
কয়েকজন বিক্রেতা: সরেজমিনে কিডনি বিক্রি করেছেন, এমন অনেকের কাছে বিষয়টি জানতে চাইলে তাঁরা প্রথমে স্বীকার করতে চাননি। পরে কয়েকজন অর্থের বিনিময়ে কিডনি বিক্রির কথা স্বীকার করেন।
তাঁদের মধ্যে ১৪ জন প্রথম আলোকে অস্ত্রোপচারের জায়গার ছবি তুলতে দিতেও রাজি হন। তবে তাঁরা শুধু অস্ত্রোপচারের জায়গার ছবি তোলার অনুরোধ করেন।
প্রথম আলোর কাছে যাঁরা কিডনি বিক্রির কথা স্বীকার করেছেন তাঁরা হলেন: বহুতির আবদুস সাত্তার, আসিয়া বেগম, শুকুর আলী; জয়পুর বহুতির রুহুল আমীন, নাসির উদ্দিন, জহুরুল ইসলাম, মোশারফ হোসেন, মোকাররম হোসেন, ফোরকান আলী; ভেরেন্ডির আখতার আলম, জাহান আলম, শাহারুল আলম, মেহেরুল ইসলাম, সেলিনা বেগম, ফারুক হোসেন, মাহমুদা বেগম, আবদুল ওহাব, রেবেকা বেগম, সেকেন্দার আলী, জাহিদুল ইসলাম; সাতারের সৈয়দ আলী ও শহিদুল ইসলাম; উলিপুরের তোজাম্মল হোসেন (নরসুন্দর) ও আতিকুল ইসলাম; পূর্ব কৃষ্টপুরের ফরিদ হোসেন ও মুক্তার হোসেন; দুর্গাপুরের সাইদুর রহমান ও হেলাল উদ্দিন; রাঘবপুরের আফজাল হোসেন ও সেকেন্দার আলী; বোড়াইয়ের আইনুল ইসলাম, আকলাপাড়ার লুৎ ফর রহমান ও ইন্দাহারের এমদাদুল ইসলাম।
পরিবারের অনেকেই যখন কিডনি বিক্রেতা: ভেরেন্ডি গ্রামের সেলিনা বেগমের শ্বশুরবাড়ির প্রায় সব সদস্যই কিডনি বিক্রি করে দিয়েছেন। সেলিনা, স্বামী মেহেরুল, দেবর শাহারুল এবং শ্বশুর জাহান আলম ইতিমধ্যে কিডনি বিক্রি করে দিয়েছেন।
শাহারুলের স্ত্রীর কিডনি বিক্রির প্রক্রিয়া চূড়ান্ত বলে জানা গেছে।
একই গ্রামের জাহিদুলের পরিবারে জাহিদুল, ভাগনি রেবেকা, ভাগনিজামাই ওহাব কিডনি বেচেছেন। বহুতির রিকশাচালক মোশারফ হোসেন, তাঁর ছেলে জহুরুল ইসলাম এবং চাচাতো ভাই মোকাররম হোসেনও দালালদের মাধ্যমে কিডনি বিক্রি করে দিয়েছেন।
বহুতির ছাত্তারের পরিবারে ছাত্তার, স্ত্রী আসিয়া বেগম, ভাই শুকুর আলী ও রুহুল আমীন এবং ভাতিজা নাসির উদ্দিন কিডনি বিক্রি করেছেন।
কেন কিডনি বিক্রি: বিয়ের পর থেকে সংসারে অভাব লেগেই ছিল সেলিনা বেগমের।
স্বামী মেহেরুল দিনমজুর। বিয়ের এক বছরের মাথায় ভেরেন্ডি গ্রামের এই দম্পতির কোলজুড়ে একটি সন্তান এলে সংসারের খরচ আরও বেড়ে যায়। প্রথমে ধার-দেনায় সংসার চালানো। বছর খানেক আগে একটি এনজিও থেকে কিছু ঋণ নেন সেলিনা। স্বামীর অসুস্থতার কারণে বেশ কিছুদিন উপার্জন বন্ধ থাকলে ঋণের কিস্তি বকেয়া পড়ে।
স্বামীর চিকিৎ সার জন্য দাদন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে চড়া সুদে বড় অঙ্কের টাকা ধার নিতে হয় সেলিনাকে। এবার এনজিও আর দাদন ব্যবসায়ীর চাপে দিশেহারা সেলিনা আরেকটি এনজিও থেকে ঋণ নেন। দুটি এনজিও আর দাদন ব্যবসায়ীর কিস্তি দেওয়া সম্ভব হয় না। ঘরের টিন খুলে নেওয়াসহ মামলা দেওয়ার হুমকি দিয়ে যান দুই এনজিওর কর্মীরা। সেলিনা এবার আরেকটি এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে আগের দুই এনজিওর কয়েকটি কিস্তি শোধ দেন।
এভাবে ঋণের চক্রে দিশেহারা সেলিনা-মেহেরুল দম্পতি একসময় নিজেদের একটি করে কিডনি বিক্রি করে দেন। এর মধ্যে মেহেরুল সরাসরি আর সেলিনা দালালের মাধ্যমে কিডনি বিক্রি করেন।
প্রতারণা: মোটা অঙ্কের অর্থের লোভ দেখিয়ে কিডনি নিলেও ভুক্তভোগীদের কেউই ঠিকমতো টাকা পাননি। সিংহভাগ টাকাই হাতিয়ে নিয়েছে দালাল চক্র। ভেরেন্ডির শাহারুল আলম অভিযোগ করেন, তিন লাখ টাকার চুক্তি হলেও কিডনি নেওয়ার পর দালাল তারেক তাঁর হাতে মাত্র এক লাখ ৩০ হাজার টাকা ধরিয়ে দিয়েছেন।
সেলিনা বেগম বলেন, ‘অভাব থেকে মুক্তি পেতে স্বামী-স্ত্রী দুজনই কিডনি বিক্রি করে দিলেও দালালদের মাধ্যমে বিক্রি করে স্বামী মেহেরুল মাত্র দেড় লাখ টাকা পেয়েছেন। আমি পেয়েছি এর কিছু বেশি। ’ তিনি বলেন, ‘ওই টাকায় অভাব তো যায়ইনি, উল্টো কেউ এখন আর ভারী কাজ করতে পারি না। প্রায়ই অসুস্থ থাকি। ’
গৃহবধূ মাহমুদা বলেন, ‘সংসারে অভাব।
ভাতের কষ্ট। কয়েকটি এনজিও থেকে ঋণ নিয়েছিলাম। পরে বাধ্য হয়ে কিডনি বিক্রি করে দিই। ক্রেতা পরিচিত না হলেও আপন বোন পরিচয়ে তাঁকে কিডনি দিয়েছি। তিন লাখ টাকা চুক্তি হলেও দালাল তারেক ও জাহিদুল খেয়েছে বেশির ভাগ টাকা।
’
ভেরেন্ডির গৃহবধূ রেবেকা বলেন, ‘একাধিক এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে কিস্তি শোধ দিতে না পেরে নিজ গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে আসি। অভাবের সুযোগ নিয়ে দালাল রুহুল আমীন কিডনি বিক্রির জন্য পীড়াপীড়ি করেন। রুহুল আমীন ঢাকার দালাল তারেকের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেন। স্বামী-স্ত্রী দুজন মিলে ছয় লাখ টাকা চুক্তি হলেও কিডনি দেওয়ার পর দুজন মিলে পেয়েছি মাত্র লাখ দুয়েক টাকা। বাকি টাকা আত্মসাৎ করেছেন তারেক।
’
মিথ্যা হলফনামায় বিক্রি: মানবদেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কেনাবেচা করা প্রচলিত আইনে দণ্ডনীয় অপরাধ। তবে রক্তের সম্পর্ক, যেমন—মা-বাবা, ভাইবোন, পুত্র-কন্যা, আপন চাচা, ফুফু, মামা, খালা এবং রক্তের সম্পর্কের বাইরে শুধু স্বামী-স্ত্রীসহ ১২ সম্পর্কের আত্মীয়কে স্বেচ্ছায় কিডনি দান করা যায়। দাতার বয়স অবশ্যই ১৮ বছরের কম এবং ৬৫ বছরের বেশি হবে না। দিতে হয় সম্পর্কের হলফনামা।
কিন্তু কালাই থেকে ঢাকায় গিয়ে যাঁরা কিডনি বিক্রি করেছেন, তাঁরা অতশত বোঝেন না।
মিথ্যা হলফনামা তৈরি থেকে শুরু করে সবকিছুই ঠিক করে দালালেরা। কিডনিগ্রহীতা পূর্বপরিচিত না হলেও হলফনামায় রক্তের সম্পর্কীয় আত্মীয় বলা হয়।
সাতারের সৈয়দ আলী বলেন, ‘সামাজিকভাবে কোণঠাসা হওয়া এবং আইনের ভয়ে এখন অনেকে ভুয়া নাম-ঠিকানা ব্যবহার করে কিডনি বিক্রি করছেন। ’
বোড়াইয়ের আইনুল ইসলাম বলেন, ভুয়া ঠিকানা ব্যবহারকারীদের নাগরিকত্ব ও জাতীয় পরিচয়পত্রও জাল করা হয়। সবকিছুই ব্যবস্থা করেন দালালেরা।
তিনি বলেন, কিডনি বিক্রি করে আমি মাত্র দেড় লাখ টাকা পেলেও দালাল চক্র পেয়েছে দুই লাখ টাকার মতো। ’
দালাল চক্র: ঢাকায় বসে কিডনির ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছেন তারেক হোসেন ও সাইফুল ইসলাম নামের দুই ব্যক্তি। তাঁদের হয়ে এলাকায় লোক জোগাড়ের কাজ করছেন আরও কয়েকজন দালাল। তাঁদের মধ্যে বহুতি গ্রামের আবদুস সাত্তার স্থানীয়ভাবে দালাল সর্দার নামে পরিচিত। আরও আছেন বহুতির গোলাম মোস্তফা, ভেরেন্ডির আখতার আলম, জাহান আলম, ফারুক হোসেন, আবদুল ওহাব, জাহিদুল ইসলাম ও রেজাউল ইসলাম; সাতারের সৈয়দ আলী; নওয়ানা বহুতির মোকাররম হোসেন; জয়পুর বহুতির আবদুল মান্নান, রুহুল আমীন ও মোজাম।
বহুতি গ্রামের কৃষক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘সাত্তার একজন পেশাদার দালাল। সামান্য বেতনে মাদ্রাসায় পিয়নের চাকরি করেও কিডনি কেনাবেচার টাকায় তিনি পরিবার নিয়ে শহরে থাকেন। ’
তবে আবদুস সাত্তার বলেন, ‘অভাবে পড়ে নিজে কিডনি বিক্রি করেছি। এখন কিডনি কেনাবেচায় অন্যদের সহযোগিতা করি। এটাকে দালালি বলা ঠিক নয়।
মানবসেবার জন্যই এ কাজ করি। ’
আখতার আলম বলেন, ‘ঢাকার বারডেম ও বিএসএমএমইউর দেয়ালে তারেকের মুঠোফোনের নম্বর দেওয়া আছে। কিডনিসংক্রান্ত বিষয়ে প্রয়োজন হলে মুঠোফোনে যোগাযোগ করতে বলা হয়। ’ সম্প্রতি বারডেম হাসপাতালে গিয়ে দেয়ালে সেই নম্বর পাওয়াও গেছে।
গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘তারেক কিডনি কেনার জন্য নিয়মিত এলাকায় আসেন।
অর্থের লোভ দেখিয়ে মানুষকে রাজি করান। দালালদের মাধ্যমে দু-এক দিন পর পর কয়েকজনের চালান ঢাকায় নিয়ে যান। বিক্রেতাদের হাতে মাত্র এক লাখ থেকে দেড় লাখ টাকা ধরিয়ে দিয়ে বাকি টাকা হাতিয়ে নেন তারেক ও তাঁর সহযোগীরা। ’
তারেকের বক্তব্য জানার জন্য দুই সপ্তাহ ধরে তাঁর মোবাইলে ফোন করা হয়, কিন্তু তিনি ফোন ধরেননি। দালাল সাইফুলের মুঠোফোনেও যোগাযোগের চেষ্টা করে তাঁকে পাওয়া যায়নি।
শারীরিক সমস্যা: ভেরেন্ডি গ্রামের পল্লি চিকিৎ সক আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘কিডনি বিক্রি করে দিয়ে এসে অনেকেই এখন প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। তাঁরা ভারী কাজকর্ম করতে পারছেন না। কিডনিজনিত নানা সমস্যা নিয়ে লোকজন প্রতিনিয়ত চিকিৎ সা নিতে আসছেন। কিডনি বিক্রি করে যে সামান্য অর্থ পাচ্ছেন, এখন চিকিৎ সা করাতে গিয়ে কারও কারও তার চেয়েও বেশি অর্থ ব্যয় হচ্ছে। ’
বোড়াই গ্রামের কিডনি বিক্রেতা আইনুল ইসলাম বলেন, ‘কিডনি দেওয়ার পর থেকে শারীরিক নানা অসুস্থতায় কর্মহীন হয়ে পড়েছি।
অসুখ-বিসুখ লেগেই আছে। ভারী কোনো কাজ করতে পারি না। কোমরে ব্যথা করে। ’
ভেরেন্ডির সেলিনা বেগম বলেন, ‘শরীরের অসুখ-বিসুখ লেগেই আছে। ভারী কাজ করতে পারি না।
’
কিডনি ফাউন্ডেশনের প্রধান অধ্যাপক হারুনুর রশীদ বলেন, কিডনি দেওয়ার পর নিয়মমাফিক জীবনযাপন ছাড়াও বছরে কমপক্ষে দুবার কিডনিদাতার শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা প্রয়োজন। এটা না মানলে কিডনি দেওয়ার পর অসুস্থ হয়ে পড়ার ঝুঁকি থাকে।
কোথায় প্রতিস্থাপন: কিডনি বিক্রেতারা জানান, তাঁদের বেশির ভাগের অস্ত্রোপচার হয়েছে ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল, বারডেম, কিডনি ফাউন্ডেশন ও ইউনাইটেড হাসপাতালে।
জানতে চাইলে বিক্রেতারা জানান, কিডনি প্রতিস্থাপনে অস্ত্রোপচার-সংক্রান্ত কোনো নথি ও চিকিৎ সকদের ব্যবস্থাপত্র দেওয়া হয়নি হাসপাতাল থেকে। বিক্রেতারা জানান, অস্ত্রোপচারের পর কয়েক দিন চিকিৎ সা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হলেও তাঁদের হাতে হাসপাতালের কোনো কাগজপত্র দেওয়া হয় না।
হলফনামা থেকে শুরু করে যাবতীয় কাগজপত্র হাসপাতাল থেকে তুলে দেওয়া হয় সংশ্লিষ্ট দালাল বা কিডনিগ্রহীতাদের আত্মীয়স্বজনের হাতে।
বোড়াই গ্রামের কিডনি বিক্রেতা আইনুল ইসলাম বলেন, কিডনি ফাউন্ডেশনে তাঁর অস্ত্রোপচার হয়েছে। সপ্তাহ খানেক চিকিৎ সা দিয়ে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু কোনো কাগজপত্র বা ব্যবস্থাপত্র দেওয়া হয়নি।
ভেরেন্ডির মেহেরুল ইসলাম বলেন, ‘কিডনি প্রতিস্থাপনের অস্ত্রোপচারের পর বারডেম থেকে রিলিজ করে দেওয়ার সময় হাসপাতালের কোনো কাগজ আমার হাতে দেওয়া হয়নি।
ক্রেতাপক্ষের হাতে কাগজপত্র দেওয়া হয়ে থাকতে পারে। ’
সাতারের সৈয়দ আলী ও ভেরেন্ডির শাহারুল আলম বলেন, ‘হাসপাতাল থেকে সব কাগজপত্রই দেওয়া হয় দালালদের হাতে। ’
কিডনি ফাউন্ডেশনের প্রধান অধ্যাপক হারুনুর রশীদ বলেন, ‘কিডনিদাতা ও গ্রহীতার যাবতীয় তথ্য সংরক্ষণ করার কথা থাকলেও কোনো হাসপাতালেই রেকর্ড সংরক্ষণ করা হয় না। আমরা এটা করি। ’
হারুনুর রশীদ বলেন, ‘আমাদের কাছে যে তথ্য আছে, তাতে দেখা যায়, মা বা খুব কাছের আত্মীয়ের কিডনি নেওয়া হয় প্রতিস্থাপনের সময়।
অন্তত ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রে প্রতারণার কোনো সুযোগ নেই। কিছু ক্ষেত্রে রোগীপক্ষ মিথ্যা কথা বলে কিডনি দেওয়া-নেওয়া করতে পারে। কিন্তু সেই সংখ্যা চার বা পাঁচ বছরে এত বেশি হতে পারে না। ’
অধ্যাপক হারুন বলেন, ‘আমরা শুনেছি, একটি চক্র পার্শ্ববর্তী দু-একটি দেশে মানুষ নিয়ে কিডনির ব্যবসা করছে। এর তদন্ত হওয়া দরকার।
’
কিডনি ফাউন্ডেশনের রেকর্ড অনুযায়ী, গত বছর দেশে ১৬৮টি কিডনি প্রতিস্থাপিত হয়েছে। কিডনি বিক্রির জন্য জয়পুরহাটের একটি এলাকা থেকে এতগুলো লোক এভাবে ঢাকায় এসে থাকলে সেটা অত্যন্ত উদ্বেগের। কারণ, বছরে যে পরিমাণ কিডনি প্রতিস্থাপিত হচ্ছে, এই হিসাব ঠিক হলে ধরে নিতে হবে, সিংহভাগ কিডনিদাতাই জয়পুরহাটের।
অধ্যাপক হারুন বলেন, কিডনি বিক্রি করে জয়পুরহাটের এসব অভাবী মানুষের দারিদ্র্য থেকে মুক্তি মিলেছে কি না, তা নিয়ে গবেষণা চালানো যেতে পারে। কারণ, পার্শ্ববর্তী ভারত ও পাকিস্তানেও দরিদ্র শ্রেণীর মানুষ অভাব থেকে মুক্তি পেতে কিডনি বিক্রি করে।
কিন্তু অভাব থেকে তাঁদের মুক্তি মেলেনি।
বিএসএমএমইউর উপাচার্য প্রাণ গোপাল দত্ত বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে মাত্র ৭০ হাজার টাকায় কিডনি প্রতিস্থাপিত হয়। সুতরাং, এখানে ব্যবসা করার সুযোগ তুলনামূলক কম। তিনি বলেন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সনদ এবং ঢাকায় সরকারি সংশ্লিষ্ট আইন কর্মকর্তার সনদ পাওয়ার পর এখানে প্রতিস্থাপনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়। এ পর্যন্ত প্রায় ৫০০ কিডনি প্রতিস্থাপিত হয়েছে, মাত্র একটি ক্ষেত্রে কিছু বিতর্ক দেখা দিয়েছিল।
প্রাণ গোপাল দত্ত আরও বলেন, কালাইয়ের বিষয়টি জানার পর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ডিএনএ পরীক্ষায় নিকটাত্মীয় প্রমাণিত হলেই কেবল কিডনি নেওয়া হবে।
আইন আছে, প্রয়োগ নেই: আইন কমিশনের সদস্য মো. আবদুল মোবারক প্রথম আলোকে বলেন, ‘মানবদেহে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন, ১৯৯৯-এর ৯ ধারায় অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ক্রয়-বিক্রয় সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আইনে বলা হয়েছে, সুস্থ ও স্বাভাবিক জ্ঞানসম্পন্ন কোনো ব্যক্তি অন্যের দেহে সংযোজনযোগ্য কিডনি, হূৎ পিণ্ড, যকৃৎ , অগ্ন্যাশয়, অস্থি, চর্ম, টিস্যুসহ কোনো অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ক্রয়-বিক্রয়, বিনিময়ে কোনো সুবিধা লাভ, সেই উদ্দেশ্যে কোনো ধরনের বিজ্ঞাপন প্রদান বা প্রচারণা করতে পারবেন না।
একই আইনের ১০ ধারা অনুযায়ী, এ আইন লঙ্ঘন করলে সর্বনিম্ন তিন বছর থেকে সর্বোচ্চ সাত বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ড এবং কমপক্ষে তিন লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হবে। আইন অনুযায়ী, আত্মীয়ের মিথ্যা পরিচয়ে কেউ কিডনি বিক্রি করলে দাতা ছাড়াও ক্রেতা, সহায়তাকারী দালাল এবং কিডনি সংযোজনে জড়িত চিকিৎ সকদের ক্ষেত্রেও একই শাস্তি প্রযোজ্য হবে।
আইনে চিকিৎ সকের সনদ বাতিলেরও বিধান রাখা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট হাসপাতালে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দাতা ও গ্রহীতার রক্তের গ্রুপ ও টিস্যু টাইপসহ সব রেকর্ড সংরক্ষণ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে আইনে। শাস্তির বিধান অক্ষুণ্ন রেখে ২০০৯ সালে ভ্রাম্যমাণ আদালত আইনেও এটি সংযোজন করা হয়েছে বলে জানান আবদুল মোবারক।
বিএসএমএমইউর মেডিসিন বিভাগের ডিন এ বি এম আবদুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, প্রচলিত আইনে যে কেউ তাঁর রক্তের সম্পর্কে সম্পর্কিত আপনজনকে কিডনি দান করতে পারেন। তবে টাকার বিনিময়ে কিডনি বিক্রি করা কোনোক্রমেই আইনসিদ্ধ নয়।
তা ছাড়া কিডনিদাতাকে অবশ্যই শারীরিকভাবে সুস্থ হতে হবে। তিনি বলেন, একটি কিডনি নিয়েও কেউ কেউ দীর্ঘদিন ধরে স্বাভাবিকভাবে বেঁচে আছেন। কিন্তু অবশিষ্ট কিডনি বিকল হলে মৃত্যুর ঝুঁকি থাকে। স্বজনদের বাঁচাতে অনেকেই সেই ঝুঁকি নেন। কিন্তু অর্থের লোভে কিডনি বিক্রি করে দেওয়ার মতো ঝুঁকি নেওয়া উচিত নয়।
স্থানীয় প্রশাসন যা বলছে: কালাই উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মিনফুজুর রহমান বলেন, দালালদের খপ্পরে পড়ে ঢাকায় গিয়ে স্বেচ্ছায় অঙ্গহানি ঘটিয়ে এরা বাড়ি ফিরছে। অভাব তাড়াতে আত্মঘাতী পথ বেছে নিলেও মুক্তি মিলছে না কারোরই। উল্টো অল্প বয়সে অসুস্থ ও কর্মহীন হয়ে পড়ছে এসব মানুষ।
জয়পুরহাটের জেলা প্রশাসক অশোক কুমার বিশ্বাস বলেন, দালালদের খপ্পরে পড়ে কালাইয়ের এতগুলো মানুষ কিডনি বিক্রি করে থাকলে সেটা খুবই উদ্বেগের কথা। এ ধরনের তৎ পরতা বন্ধে যা যা করা দরকার, প্রশাসনের পক্ষ থেকে সবই করা হবে।
কিডনি বিক্রির ক্ষতিকর দিক তুলে ধরে গণসচেতনতা বাড়াতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেওয়া হবে। না বুঝে যাঁরা কিডনি বিক্রি করছেন, তাঁদের এ পথ থেকে ফেরাতে মসজিদের ইমামদের কাজে লাগানো হবে। দালালদের তৎ পরতা বন্ধে প্রয়োজনে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হবে।
Click This Link ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।