আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সন্ধিঃক্ষনের সময়গুলো......

কিছুটা আমার কিছুটা তোমার.. মেলেনা তো কিছু এখন আর! আমবশ্যার রাত,ঘুটঘুটে অন্ধকার চারপাশে,কিছুই দেখা যাচ্ছে না,পাশের গ্রামে বিদ্যুৎ এলেও হাবিবদের এই গ্রামে এখনো বিদ্যুৎ সেভাবে ঘরে ঘরে আসেনি,কয়েকটা বড় বড় বাড়ির গৃহস্থ্যরা নিজের খরচে এনেছে,হাবিবদের যে সে সামর্থ্য নেই তা না,কিন্তু থাকলেও হাবিবের মা আনবেন না,তবে আজকে রাতে হাবিবের কেন জানি খুব মনে হচ্ছিল,যে তাদের বাড়ীতে বিদ্যুৎ থাকা দরকার অনেক কষ্ট হচ্ছে কাজলীর। বাইরের খের-পালার এই ঘরটাতে শুয়ে শুয়ে এসবই ভাবছিল হাবিব। হঠাৎ হাবিবের মনে হল,তাকে কেউ ডাকছে,শোয়া থেকে উঠে বসল,তারপর আবার খেয়াল করল,তার ঘর থেকেই কেউ তাকে ডাকছে,দ্রুত বাতিটা জ্বালিয়ে সেদিকে গেল,বাইরে তার আওয়াজ পেয়ে ঘর থেকে বের হয়ে এলো তার শ্বাশুড়ী করিমন বেগম,অনেকটা কাঁদ কাঁদ গলায় বললেন, ;বাবা হাবিব,অবস্থা তো বেশি সুবিধার মনে হইতাছে না,সেই সকাল থেইকা নিয়া একই অবস্থায় আছে,এমন হইলে তো মাইয়াডা আমার মইরা যাইব,তুমি একটু ডাক্তার ডাকার ব্যাবস্থা কর বাবা... ভেতর থেকে কাজলীর ব্যাথায় কাতরানোর শব্দ শুনতে পেল হাবিব,বুকটা কেমন যেন করে উঠল... ;আম্মা আপনে ওর কাছে যান,আমি দেখি সেকান্দার ডাক্তাররে ডাইকা আনতাছি... বলেই বেরিয়ে গেল হাবিব,গ্রামের পথ তার উপর ঘুটঘুটে অন্ধকার,তারাহুরা করে হাটার ও তেমন সুযোগ নেই তার পরেও মোবাইলের আলো দিয়ে অনেক কষ্টে দৌড়ে ডাক্তার বাড়ী পৌছাল সে,রাত বাজে ১১টা,তার মানে গ্রামের সময় অনুযায়ী অনেক রাত এখন,তবুও আস্তে করে ডাক দিল,'ডাক্তার চাচা,ডাক্তার চাচা...'কিন্তু কোন সাড়া পেল না আরও বার কয়েক ডাকল,একটু পর দরজা খুলে বের হল একটা লোক। বল,''ডাক্তার সাব তো বাড়ীত নাই,পাশের গেরামে গেছে রোগী দেখতে কহন আইবো জানিনা''বলেই আবার ভেতরে চলে যেতে উদ্যত হল ঠিক তখন হাবিব বলে উঠল,'ডাক্তার চাচা,যখনই আসে তারে একটু বলবেন যেন হাবিবদের বাড়ীতে যাই,খুব জরুরী,নাইলে আমার বউ মইরা যাইব...''কথাটা বলতে অজান্তেই হাবিবের গলাটা কেঁপে উঠে যেন... লোকটা 'আইচ্ছা'' বলে ভেতরে চলে যায়,একেতো গ্রাম এলাকা তার উ্পর তেমন ডাক্তার ও নেই,আর সাধারনত দূরে কোথাও গেলে রাতে আর ফেরেন না। এখন কি হবে?ভাবতে ভাবতে বাড়ী ভেতর ঢুকে হাবিব,ঘরের কাছে আসতেই কিছুটা চেঁচামেচি শুনতে পায়,ভাল করে খেয়াল করে শুনে তার মা আর তার শ্বাশুরীর কথা কাটাকাটির শব্দ... ;দেখেন বেয়াইন,আমার বাড়ীতে এসব নক্তামী চলব না,আপনেরে আনছি আপনের মাইয়ারে দেহনের লাইগা,ডাক্তার ডাকনের লাইগা না, ;এইডা আপনে কি কন বেয়াইন,মাইয়াডা সেই সকাল থেইকা ব্যাথায় কাঁনতাছে আপনেরা কেউ তো একবার উকি দিয়াও দেখলেন না আর এহন কন ডাক্তার ডাকলাম কেন?মাইয়াডারে কি মইরা যাইতে কন? ;এই রহম ব্যাথা আমাগোও হইছে অনেক,আপনে আমাগোরে শিখাইয়েন না,আর ডাক্তার তো ডাকবেন ই,টেকা তো আর আপনের দেওন লাগবো না দিবো আমার পোলায়,আমার পোলার টেকা দেইখাইতো আপনার মাইয়ারে দিছিলেন... ;বেয়াইন,মাই্নসের জীবন-মরনের সময় আপনে টেকার হিসাব করেন!আইজকা যদি আপনের মাইয়ার এই অবস্থা হইতো তাইলে কি এমন করতে পারতেন? ;চুপ থাকেন আপনে,কথায় কথায় আমার মাইয়ারে টানবেন না... এবার হাবিব বাইরে থেকে শব্দ করল,শব্দ শুনে দুই মা ই বেরিয়ে আসল, হাবিবের শ্বাশুড়ী উৎকন্ঠার সাথে তাকাল ওর দিকে,হাবিব সেদিকে তাকিয়ে বলল,'ডাক্তার চাচা রোগী দেখতে পাশের গ্রামে গেছে ফিরা আসলেই আমাগো বাড়ীতে আসব''শুনে করিমন বেগম মাথা নিচু করে ঘরে চলে গেলেন,এবার হাবিবের মা কড়া চোখে হাবিবের দিকে তাকিয়ে বললেন,''তুই আমারে না জিগাইয়া ডাক্তার ডাকতে গেলি কোন সাহসে?আমি এহনো মরি নাই আমারে না জিগাইয়া এই বাড়ীতে কেউ পানিও খায় না আর তুই তোর ই ব্যারাইম্মা বউয়ের লাইগা ডাক্তার ডাকতে গেলি কোন সাহসে?' চুপ হয়ে থাকে হাবীব,কি বলবে?সে জানে তার মা কেমন মানুষ,দুনিয়া হাজার বদলালেও তার এখনো বদলান নি।

আর তাইতো বিয়ের সাত বছর পাড় হয়ে গেলেও বউকে রেখে হাবিব একাই ঢাকায় থাকে,মায়ের কথার অবাধ্য হবার সাধ্য এ বাড়ীতে কারো নেই। নিজের পছন্দে গরীব মাস্টারের ঘরের শিক্ষিত মেয়েকে বিয়ে করেছে বলে মা কখনোই কাজলীকে দেখতে পারেন না,ওর কোন কাজেই মা সন্তুষ্ট না,কিন্তু তারপরে কাজলী দিনরাত মাকে খুশী করার চেষ্টা করে কিন্তু বাড়ীর সবাই তা দেখলেও মায়ের ভয়ে কেউ তার স্বীকৃতি দেয় না। হঠাৎ প্রচন্ড শব্দে চিৎকার করে উঠল কাজলী,দ্রুত ঘরে ঢূকে হাবীব,কাজলীর দিকে তাকিয়ে চমকে উঠে সে,চোখ মুখ উল্টে মনে হচ্ছে এখনই মরে যাবে,ব্যাথায় প্রচন্ড ভাবে চিৎকার করতে থাকে সে,হাবীব পাশে যেয়ে বসে,দুই হাতে চেপে ধরে কাজলীর হাত,ওর দিকে তাকিয়ে কি যেন বলতে চায় কাজলী কিন্তু ব্যাথার যন্ত্রনায় বলতে পারেন না,হাবীবের মনে পড়ে অনেক দিন আগে পেপারে পড়েছিল, মানুষ নাকি সর্বোচ্চ এক সাথে শরীরের দুটি হাড় ভাঙ্গার ব্যাথা সহ্য করতে পারে কিন্তু একটা মেয়ে যখন মা হয় তখন তাকে বিশটির ও বেশি হাড় ভাঙ্গার মত ব্যাথা সহ্য করতে হয় । হাবীবের শ্বাশুড়ী হাবীবের সামনে বসে কাঁদতে কাঁদতে অনুরোধ করে কাজলীকে হাসপাতালে নিয়ে যাবার জন্য,হাবীব একবার কাজলীর দিকে তাকায়,তারপর মাথা নিচু করে কি যেন ভাবে,একটু পর হঠাৎ বলে উঠে,''আম্মা,আপনে দ্রুত সব কিছু গুছায় নেন আমি ভ্যান গাড়ী নিয়া আসতেছি''বলে বেরিয়ে যায় সে। অনেক অনুরোধ আর খোজাখুঁজি করে একটা ভ্যান নিয়ে সে যখন তার বাড়ীতে ঢুকে তখন তার মা মহা তুলকামাল কান্ড শুরু করে দিয়েছেন,কিন্তু হাবীব এবার আর কোনদিকে তাকালো না,সোজা ঘরে ঢুকে কাজলীকে নিয়ে বেরিয়ে এলো,পেছনে তার শ্বাশুড়ী ।

আজ প্রায় দশ দিন হতে চলল,কাজলী হাসপাতালে প্রায় মৃত অবস্থায় পড়ে আছে,ডাক্তার বলেছে বাসায় নিয়ে যেতে এ রোগী বাঁচবেনা,শুধু শুধু হাসপাতালে রেখে লাভ নেই,কিন্তু হাবীব মানেনি,এটা হতেই পারে না এভাবে কাজলী চলে যাবে এটা সে মানবে না,অনেক রিকোয়েস্ট করে হাসপাতালে রেখেছে কাজলীকে,ওদিকে বাড়ীতে মা মহা রেগে আছে একেতো মৃত বাচ্চা হয়েছি তার উপর বউ এতদিন ধরে হাসপাতালে,একবারের জন্য দেখতেও আসেননি তিনি,মায়ের কড়া নিষেধ তাই বাড়ীর কেউ ও দেখতে আসেনি,সারা দিন রাত ধরে হাবীব অনেকটা একাই হাসপাতাল আর বাসা ছোটাছুটি করছে,কিন্তু কাজলীর অবস্থার কোন উন্নতি নেই,জ্ঞান ফেরার কোন লক্ষনই নেই। ওর অজ্ঞান মুখের দিকে তাকালে নিজেকে খুব অপরাধী মনে হয় হাবীবের,অনেক স্বপ্ন আর সাধ নিয়ে এসেছিল ওর ঘরে কাজলী যার কোনটাই সে পূরন করতে পারেনি,আর এখন সে মরতে বসেছে তবুও সে কিছু করতে পারছে না। পনের দিন পর ডাক্তার কাজলীকে ডিসচার্য করে দিল,বললেন তার বাঁচার আশা আর নেই,এভাবে তাকে রেখে ্লাভ নেই শুধু শুধু কষ্ট পাচ্ছে তার চেয়ে তাকে তার মতো চলে যেতে দেয়াই ভাল। পাথরের মতো শক্ত হয়ে বসে রইল হাবীব। লাল শাড়ী পড়িয়ে হাত ধরে একদিন যাকে ঘরে এনেছিল আজ তারই লাশ নিয়ে যেতে হবে তাকেই...কেমন করে... হঠাৎ হাসপাতালের নার্স দৌড়ে ডাক্তার কে ডেকে আনলেন,ডাক্তার ও এসে দ্রুত হাতে আর অবাক চোখে কাজলীকে চেক করতে লাগলেন,কিছুক্ষন পর হাসিমুখে হাবিবের দিকে তাকিয়ে বললেন,'মিঃহাবিব,গুড নিউজ,আপনার দোয়া আল্লাহ শুনেছেন,আপনার স্ত্রী বেঁচে আছেন এবং ইশাআল্লাহ সূস্থ হয়ে উঠবেন... হাবিব অবাক হয়ে একবার কাজলীর দিকে আর একবার ডাক্তারের দিকে তাকাতে লাগল,কিছুক্ষন পর অজান্তেই সিজদায় পড়ে গেল যেন... [ঘটনাটা যখন আমরা চার ফ্রেন্ড শুনছিলাম মনে হচ্ছিল কোন রুপকথার গল্প শুনছি!!শুনা শেষে আমরা একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে বললাম,'আর যাই হোক আমাদের কপালে যেন এমন কঠীন শ্বাশুড়ী না জুটে! কাজলী ভাবি এখন ঢাকায় থাকেন,গিয়েছিলাম তাকে দেখতে আর অবাক হয়েছিলাম তার সুন্দর হাসিটা দেখে...এত মায়া ভরা হাসি এখনো মানুষ হাসতে পারে...?...] ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.