আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গাড়ি চালানোর লাইসেন্স পাওয়া কত সহজঃ ৩০০ থেকে ১০ হাজার টাকা ঘুষ দিয়ে ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়া যায়।

পৃথিবীর কাছে তুমি হয়তো কিছুই নও, কিন্তু কারও কাছে তুমিই তার পৃথিবী" ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের নবীনগর থেকে পাটুরিয়া অংশেই আছে ২৩টি বাঁক। এই ঝুঁকিপূর্ণ সড়কে বছরের পর বছর অবৈধ ড্রাইভিং লাইসেন্স দিয়ে গাড়ি চালিয়ে আসছেন জামির হোসেন। শেষে তাঁর বাসের সঙ্গে মাইক্রোবাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে নিহত হন চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ ও এটিএন নিউজের সিইও আশফাক মুনীর মিশুকসহ পাঁচজন। মানিকগঞ্জ গোয়েন্দা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আশরাফ-উল ইসলাম জানিয়েছেন, ২০০৮ সালের পর থেকেই জামির লাইসেন্সটি নবায়ন করেননি। দুর্ঘটনার পর গ্রেপ্তার হয়েছেন জামির।

২১ বছর ধরে ঢাকা-চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন মহাসড়কে মাইক্রোবাস চালাচ্ছেন সুবিদ মিয়া (৩৮)। তিনি অকপটেই স্বীকার করেন, ১৯৯০ সালের মার্চে বিআরটিএর মিরপুর অফিসে জালাল নামের এক দালালের মাধ্যমে এক হাজার ২০০ টাকায় তিনি ড্রাইভিং লাইসেন্সটি পেয়েছিলেন। এ জন্য তাঁকে কোনো পরীক্ষাও দিতে হয়নি। ২০০৮ সালের ২১ সেপ্টেম্বর সর্বশেষ নবায়নও করেছিলেন ওই জাল লাইসেন্সটি। এটি নিয়েই তিনি ছুটে চলেন সড়ক-মহাসড়কে।

তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) শুধু ঢাকার মিরপুর ও ইকুরিয়া অফিসেই চিহ্নিত ৪০০ দালালের মাধ্যমে প্রতিদিন গড়ে কম হলেও দেড় হাজার জাল ড্রাইভিং লাইসেন্স বের হচ্ছে। সম্প্রতি সরেজমিনে অনুসন্ধানে গেলে এসব অফিসে লাইসেন্স নিতে আসা চালক ও দালালরা জানান, বিআরটিএ অফিসের ভেতরে ও বাইরে একেকটি লাইসেন্সের জন্য এখন ৩০০ থেকে ১০ হাজার টাকা ঘুষ নেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠনের চাপে প্রতিদিন শত শত জাল লাইসেন্স বের হচ্ছে। বিআরটিএ মিরপুর অফিসের কমপক্ষে ২০০ 'গ্যাটিস'সহ ৩০০ দালাল এই সিন্ডিকেটের সদস্য। গ্যাটিস বেলাল মিয়া ও আতিক হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, নিয়ম মেনে লাইসেন্স করতে গেলে অনেক সময় লাগে।

এ কারণে সামান্য অর্থ দিলেই লাইসেন্স পাওয়া যাচ্ছে। এভাবে করালে পরীক্ষাও দিতে হয় না। ঘুষ দিয়ে ড্রাইভিং লাইসেন্স গ্রহণ : লাইসেন্সের ধরনভেদে ৩০০ থেকে ১০ হাজার টাকা ঘুষ দিয়ে ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়া যায়। সম্প্রতি মিরপুর ও ইকুরিয়া কার্যালয়ে গেলে দালাল ও চালকদের কাছ থেকে জানা যায়, শিক্ষানবিশ লাইসেন্সের জন্য ৩০০ থেকে ৫০০, থ্রি হুইলারের জন্য ৩০০-৫০০, হালকা যানের লাইসেন্সের জন্য তিন থেকে চার হাজার, মধ্যম শ্রেণীর জন্য চার থেকে পাঁচ হাজার, ভারী ও পিএসভির লাইসেন্সের জন্য ছয় থেকে আট হাজার, বিশেষ ব্যবস্থায় (সংগঠনের সুপারিশ) ছয় থেকে ১০ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়। লাইসেন্স নবায়ন ও নকল কপি তুলতে দিতে হয় ৫০০ থেকে তিন হাজার টাকা।

অবস্থা এমন যে নিয়ম মেনে লাইসেন্স নিতে এলেই পড়তে হচ্ছে বিপাকে। 'সোনার বাংলাদেশ' নামের একটি ব্লগ সাইটে একজন লিখেছেন, 'মোটরসাইকেল চালানোর লাইসেন্সের জন্য ২০০৭ সালে প্রথমে ২০০ টাকা জমা দিয়ে লারনার কার্ড (শিক্ষানবিশ লাইসেন্স) সংগ্রহ করলাম। চার মাস পর লিখিত পরীক্ষা দিলাম। পাস করলাম। এরপর ফিল্ড টেস্ট ও মৌখিক পরীক্ষায়ও পাস করলাম ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে।

এক হাজার ৩০০ টাকা জমা দিয়ে ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য আবেদন করলাম। লাইসেন্স দেওয়ার তারিখ দিল ২০০৯ সালের ৩০ মে। গেলাম বিআরটিএ অফিসে। বলল, আসে নাই। আবার ডেট দিল ছয় মাস পর।

এর মধ্যেই আমার রসিদটা হারিয়ে গেল। থানায় জিডি করলাম। তারিখ মোতাবেক আবার গেলাম। আবারও তারিখ বাড়িয়ে দেওয়া হলো। সেই তারিখে গেলাম।

পেলাম না। আবার তারিখ। অবশেষে আমি তিন বছরের মাথায় গত ১১ তারিখে ড্রাইভিং লাইসেন্সটা পেলাম। ' এই ব্লগার আরো জানান, এই লাইসেন্সের জন্য তাঁকে শতাধিকবার বিআরটিএ অফিসে যেতে হয়েছে। অন্যদিকে ট্রাফিক পুলিশ বারবার মামলা দিয়েছে।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) বিআরটিএ নিয়ে গবেষণাকারী রেজাউল করিম কালের কণ্ঠকে বলেন, '২০০৮ সালে আমরা মাঠ পর্যায়ে জরিপ করে দেখেছি, মোটরযানচালকদের ৬৪ শতাংশই ড্রাইভিং লাইসেন্স পেয়েছেন তিন থেকে ছয় মাস সময় ব্যয় করে। এখন এ অবস্থার আরো অবনতি হয়েছে। ' এ ধরনের ভোগান্তির বিষয়ে বিআরটিএ মিরপুর অফিসের সহকারী পরিচালক মোহসীন হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, জাল লাইসেন্স দেওয়ার বিষয়টি ধরা পড়ছে যখন লাইসেন্স নবায়ন করতে আসছেন চালকরা। মূল ভলিয়মে তাঁদের নাম ও ঠিকানায় কোনো লাইসেন্স ইস্যু হওয়ার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সড়ক বিভাগের সচিব মো. মোজাম্মেল হক খান বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, 'বিআরটিএতে গিয়ে হয়রানির শিকার হন বলে অনেকে বাধ্য হয়ে জাল লাইসেন্স নিচ্ছেন।

জাল লাইসেন্স কমানো গেলেই দেশে সড়ক দুর্ঘটনা কমবে। এই জালিয়াতি রোধে আমরা আরো আধুনিক লাইসেন্স দিতে উদ্যোগ নিচ্ছি। ' বিআরটিএর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তোফায়েল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'অভিযান চালালেই জাল লাইসেন্স ধরা পড়ছে। আর অবস্থা আরো খারাপ হচ্ছে এক শ্রেণীর পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের কারণে। অভিযান চালালে ম্যাজিস্ট্রেটদের হয়রানি করার চেষ্টা করা হয়।

গত ২১ আগস্ট গাবতলীতে জাল লাইসেন্স ধরা পড়লে গোটা এলাকায় অবরোধ তৈরি করে শ্রমিকরা। ' বিআরটিএর চেয়ারম্যান আইয়ুবুর রহমান খান বলেন, দেশে জাল লাইসেন্স ঠেকানোর ব্যবস্থা ও একই সঙ্গে জনভোগান্তি কমানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। কিছুদিনের মধ্যে ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য আবেদনকারীকে লাইসেন্স তৈরি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মোবাইল ফোনে এসএমএসের মাধ্যমে বার্তা জানিয়ে দেওয়া হবে। যেসব প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানে ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ কোর্স পরিচালনা করা হচ্ছে, সেসব প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষণ শেষে বিআরটিএর বিশেষ দল তাৎক্ষণিক পরীক্ষা করে লাইসেন্স দেবে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি সরকারিভাবে অধিক সংখ্যক দক্ষ ও প্রশিক্ষিত গাড়িচালক তৈরির লক্ষ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে গাড়ি চালনাবিষয়ক কোর্স চালুর উদ্যোগও নেওয়া হচ্ছে।

লাইসেন্স রাজনীতি : বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত ইউনিয়ন আছে ২১০টি। দেশের পরিবহন খাতটি দীর্ঘদিন ধরেই নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছে এই ফেডারেশন। বিপ্লবী শ্রমিক ফেডারেশনসহ আরো কয়েকটি ফেডারেশন এই ফেডারেশনের কারণে এখন কর্মকাণ্ডহীন। বিআরটিএ ও পরিবহন শ্রমিকদের কাছ থেকে জানা গেছে, সারা দেশে আধিপত্য বিস্তার করার লক্ষ্যে ফেডারেশন প্রায় দুই দশক ধরেই অদক্ষ চালকদের ড্রাইভিং লাইসেন্স দিয়ে আসছে। পরীক্ষা ছাড়াই এই সময়ে ফেডারেশনের কর্মকর্তাদের চাপে এক লাখ ৮৯ হাজার লোকের জন্য লাইসেন্স দিয়েছে বিআরটিএ।

এসব লাইসেন্স বাস, মিনিবাস, ট্রাক, মিনিট্রাক, কাভার্ড ভ্যান চালানোর জন্য দেওয়া হয়েছে। চট্টগ্রাম, টাঙ্গাইল, বগুড়াসহ ২৩ জেলার বিভিন্ন সংগঠনকে ফেডারেশনের আয়ত্তে রাখতে ফেডারেশন আরো প্রায় ২৭ হাজার লাইসেন্স নেওয়ার জন্য বিআরটিএকে চাপ দিচ্ছে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী খান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'দেশে গাড়ির তুলনায় লাইসেন্স কম। সরকার অতীতে অনেক দিন ধরে গাড়ি চালাচ্ছেন_এমন শ্রমিকদের লাইসেন্স দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। আমরা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে তবেই এসব লাইসেন্স দেওয়ার কথা বিআরটিএকে বলছি।

' তিনি আরো বলেন, 'বিআরটিএ এখন ঘুষের আখড়া। ওখানে সাধারণ মানুষ হয়রানির শিকার হচ্ছেন। আমরা চালকদের হয়রানি রোধেই লাইসেন্স দেওয়ার কথা বলছি। ' জানা যায়, বিআরটিএর উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা সব সময় ফেডারেশনের বিভিন্ন নেতাদের চাপের মধ্যে থাকেন। প্রধান কার্যালয় ছাড়াও স্থানীয় কার্যালয়গুলো থেকে স্থানীয় সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, প্রভাবশালী পরিবহন মালিক ও শ্রমিক নেতা, প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের একাংশের চাপের মুখে লাইসেন্স দিতে হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, 'চাপ দেন বড় নেতারা। না শুনলে বদলি, এমনকি প্রাণনাশেরও হুমকি দেওয়া হয়। ' তাঁরা আরো বলেন, 'গত ২০ বছরেই বিআরটিএতে ২১ জন চেয়ারম্যান বদল করা হয়েছে। ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকার ইকুুরিয়া, চট্টগ্রাম ও বগুড়ায় সংস্থার স্থানীয় কার্যালয়কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেট ভাঙার চেষ্টা করা হয়েছিল। ফল হয়নি।

' এদিকে জানা গেছে, কম্পিটেন্সি বোর্ডের সদস্যরা বিশেষ করে এর চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট) নিজ পেশায় ব্যস্ত থাকায় ড্রাইভিং পরীক্ষা চলাকালে সব সময় উপস্থিত থাকতে পারেন না। এ অবস্থায় পরীক্ষা শেষে বিআরটিএর স্থানীয় মোটরযান পরিদর্শক ড্রাইভিং টেস্টে উপস্থিত চালকদের তালিকা ও ফলাফলপত্রের কপি বোর্ডের কার্যালয়ে নিয়ে গিয়ে প্রয়োজনীয় স্বাক্ষর সংগ্রহ করে নেন। এটি নিয়ম বহির্ভূত। নিয়ম অনুযায়ী ড্রাইভিং টেস্ট গ্রহণস্থলেই তা করার কথা। জানা গেছে, পরীক্ষায় ফেল করেও লাইসেন্সপ্রার্থীরা দালালের মাধ্যমে মোটরযান পরিদর্শককে ১০০ থেকে ৫০০ টাকা ঘুষ দিয়ে পাস নম্বর পান।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।