অদ্ভুত উটের পিঠে ‘ঈশ্বর কণা’ মিলুক না মিলুক, কণা পদার্থবিজ্ঞান গবেষণায় এখন বসন্ত।
হিগস-বোসন এখনও পাওয়া যায়নি। যাবে কি না তা-ও নিশ্চিত নয়। কিন্তু ইতিমধ্যেই গবেষকরা পরিকল্পনা করেছেন, এখন যেখানে খোঁজা হচ্ছে হিগস-বোসন, সেই লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার-এর (এলএইচসি) চেয়ে অনেক বেশি ক্ষমতাবান যন্ত্র বানানোর। আর সেই যন্ত্র কত ক্ষমতাবান হবে, কিংবা, কী কী খুঁজে দেখবে, তা ঠিক করা হবে এলএইচসি থেকে পাওয়া তথ্য দেখেই।
মুম্বইয়ে কণা পদার্থবিজ্ঞানীদের আন্তর্জাতিক সম্মেলন ‘লেপ্টন-ফোটন ২০১১’তে বক্তৃতা দেওয়ার আগে এক সাক্ষাৎকারে আনন্দবাজার পত্রিকাকে
এ কথা জানালেন, হিগস-বোসন যে গবেষণাগারের যন্ত্রে খোঁজা হচ্ছে, সেই সার্নের (যার মানে এলএইচসি) ডিরেক্টর জেনারেল অধ্যাপক রলফ হয়্যার।
অধ্যাপক হয়্যার এখান থেকে কাল যাচ্ছেন কলকাতা। বক্তৃতা দেবেন ‘সাহা ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স’-এ (এসআইএনপি)। এসআইএনপি-র প্রেক্ষাগৃহে বিকেল চারটেয় ওই বক্তৃতার বিষয় ‘ডিপার আন্ডারস্ট্যান্ডিং অফ আওয়ার ইউনিভার্স অ্যাট দ্য এলএইচসি। ’ শুধু হিগস-বোসনের তদন্ত নয়, এলএইচসিতে বিপরীত দিক থেকে আলোর বেগে মুখোমুখি ছুটে আসা প্রোটন কণাদের সংঘর্ষে যা যা তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, সে সব বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান কী ভাবে বাড়াচ্ছে, তা-ই কলকাতায় বলবেন অধ্যাপক হয়্যার।
এসআইএনপি কর্তৃপক্ষ তাঁর বক্তৃতা শুনতে আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীদের। সাক্ষাৎকারে প্রসঙ্গটা তুলতেই অধ্যাপক হয়্যার বললেন, “হ্যাঁ, আমি চাই তরুণ-তরুণীরা আসুক আমার বক্তৃতায়। ওরা জানুক আমরা কী কী করছি এলএইচসিতে। সারা পৃথিবীর তিন হাজার বিজ্ঞানী কেন দিনরাত কাজ করে চলেছেন একটা গবেষণাগারে, কোন নেশা টানছে তাঁদের, তা সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে ছাত্রছাত্রীদের জানা উচিত। গবেষণাপত্র পড়া ছাড়াও গত দু’দিন ধরে এখানে চলল একাধিক বৈঠক।
উদ্যোক্তা ‘ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অন ফিউচার অ্যাক্সিলারেটর্স’ (আইসিএফএ) এবং ‘ইন্টারন্যাশনাল লিনিয়ার কোলাইডার স্টিয়ারিং কমিটি’ (আইএলসিএসসি)। কী কী আলোচনা হল আপনাদের বৈঠকে? প্রশ্নের উত্তরে অধ্যাপক হয়্যার বললেন, “এলএইচসি থেকে তথ্য সংগ্রহের কাজ চলবে কুড়ি বছর। তার পর সেটি পুরনো হয়ে যাবে। তাই বিজ্ঞানীরা অনেক দিন ধরেই ভাবছেন, আরও শক্তিশালী কোলাইডারের কথা। এদের একটির নাম, ইন্টারন্যাশনাল লিনিয়ার কোলাইডার (আইএলসি)।
আর অন্যটি হল কমপ্যাক্ট লিনিয়ার কোলাইডার (সিএলআইসি)। ”
কী রকম সে দু’টি যন্ত্র? অধ্যাপক হয়্যার জানালেন, “দু’টি যন্ত্রই এখন নকশা তৈরির পর্যায়ে। এখনও পর্যন্ত ঠিক হয়েছে, আইএলসি-তে এলএইচসি-র মতো বৃত্তাকার সুড়ঙ্গ থাকবে না। আইএলসি-তে হবে সরলরেখা বরাবর সুড়ঙ্গ। এটা লম্বায় হবে তিরিশ কিলোমিটার।
এলএইচসি-তে সংঘর্ষ হচ্ছে দু’টি প্রোটন কণার মধ্যে। কিন্তু আইএলসি-তে সরলরেখায় প্রায় আলোর বেগে মুখোমুখি ছুটে আসবে ইলেকট্রন এবং পজিট্রন কণা। সংঘর্ষ হবে এদের মধ্যে। ”
বৃত্তাকার পথের বদলে কেন কণাদের ছোটানো হবে সোজা পথে? অধ্যাপক হয়্যার বললেন, “বৃত্তাকার পথে কণাদের ছোটাতে গেলে ওদের শক্তিক্ষয় হয়। ফলে বাইরে থেকে ওদের শক্তি সরবরাহ করতে হয়।
সোজা পথে ছোটাতে গেলে সেই ঝামেলা নেই। ” আর এলএইচসি-তে সংঘর্ষ হচ্ছে প্রোটনের সঙ্গে প্রোটনের। আইএলসি-তে তবে কেন ইলেকট্রন-পজিট্রন সংঘর্ষ? অধ্যাপক হয়্যারের ব্যাখ্যা, “প্রোটন-প্রোটন সংঘর্ষ মানে কিন্তু কণার সঙ্গে কণার সংঘর্ষ নয়। আসলে একটা প্রোটন কণা মানে তিনটি করে কোয়ার্ক কণার সমষ্টি। তাই প্রোটন-প্রোটন সংঘর্ষ মানে একটা কোয়ার্কের ঝুলির সঙ্গে আর একটা কোয়ার্কের ঝুলির ঠোকাঠুকি।
সরাসরি পদার্থের সঙ্গে পদার্থের সংঘর্ষ নয়। এ ভাবে যদি দেখেন তা হলে বুঝবেন, ইলেকট্রন-পজিট্রন সংঘর্ষ কেন আরও ভাল। ইলেকট্রন বা পজিট্রন কণার কোনও উপাদান নেই। ওরা মৌলিক কণা। সুতরাং, ওদের মধ্যে সংঘর্ষ মানে সরাসরি পদার্থের সঙ্গে পদার্থের ঠোকাঠুকি।
এর ফলে যা যা মিলবে, সে সব খুঁটিয়ে দেখার কাজ অনেক ভাল এগোবে। ” কেন তা ভাল এগোবে? অধ্যাপক হয়্যারের উত্তর, “কারণ, যত দিনে আইএলসি তৈরি হবে তত দিনে এলএইচসি-র কাজ থেকে আমরা পদার্থে-পদার্থে সংঘর্ষের তথ্য বিশ্লেষণে অনেকটা পারদর্শী হয়ে উঠব। সে জন্যই বলছি, এলএইচসি-র তথ্য আমাদের আইএলসি-র পরিকল্পনা করতে সাহায্য করবে। ”
আর সিএলআইসি? অধ্যাপক হয়্যার জানালেন, এটিও হবে ‘লিনিয়ার কোলাইডার’। নকশায় যা অনেকটাই আইএলসি-র কাছাকাছি।
কারণ, ওতেও সংঘর্ষ হবে সেই ইলেকট্রনের সঙ্গে পজিট্রন কণার। তবে, এই যন্ত্রে সংঘর্ষে লিপ্ত কণাদের শক্তি হবে আইএলসি-র তুলনায় কম। তাতে কিছু এসে যায় না। কারণ, সিএলআইসি যন্ত্রে সংঘর্ষের ফলে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করবে অনেক বেশি গভীরে গিয়ে।
কোথায় বসবে আইএলসি বা সিএলআইসি যন্ত্র? এ প্রশ্নের উত্তর দিলেন, আইসিএফএ-র চেয়ারম্যান এবং জাপানিজ অ্যাক্সিলারেটর কেক (রিপিট কেক)-এর ডিরেক্টর জেনারেল ডক্টর আতসুতো সুজুকি।
বললেন, “সিএলআইসি-র ব্যাপারটা এখনও দূরে। তবে আইএলসি-র ব্যাপারে বিজ্ঞানীমহলে তিনটে জায়গা নিয়ে চিন্তচাভাবনা হয়েছে। আমেরিকা, ইউরোপ কিংবা এশিয়া মহাদেশের মধ্যে কোনও একটা জায়গায় বসানো যেতে পারে আইএলসি। আমেরিকায় হলে ফার্মিল্যাব-এ, ইউরোপে হলে সার্নে আর এশিয়ায় হলে জাপানের কেকে। তবে এ সবই ভাবনা।
আগে নকশা পাকা হোক। তারপর আমরা বিভিন্ন দেশের সরকারের কাছে যাব। আইএলসি বিশাল বাজেটের প্রকল্প। সুতরাং অতি অবশ্যই হতে হবে আন্তর্জাতিক প্রকল্প। অনেক দেশের সরকারকে অর্থসাহায্য দিতে হবে।
তাই জায়গা ঠিক হবে দেশে দেশে আলোচনার পর। ” তা হলে জায়গা নির্ধারণ আপনাদের হাতে নেই, সেটা ঠিক হবে রাজনৈতিক পর্যায়ে। তাই তো? “ঠিক বলেছেন”, মন্তব্য ডক্টর সুজুকির।
‘লেপ্টন-ফোটন ২০১১’-এর এক অধিবেশনে আজ বক্তৃতা দিলেন অধ্যাপক হয়্যার। বিষয় অবশ্যই ছিল ভবিষ্যতের অ্যাক্সিলারেটর প্রকল্প।
ওই অধিবেশনে সভাপতিত্ব করলেন কলকাতায় ‘ভেরিয়েবল্ এনার্জি সাইক্লোট্রন সেন্টার’-এর প্রাক্তন অধিকর্তা এবং অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের হোমি ভাবা অধ্যাপক বিকাশ সিংহ। এলএইচসি-র পরে আরও উন্নত অ্যাক্সিলারেটরের পরিকল্পনা প্রসঙ্গে রীতিমতো উৎসাহিত তিনি। আনন্দবাজারকে বললেন, “বড়, আরও বড় গবেষণার লক্ষ্যে এগিয়ে চলার নামই বিজ্ঞান। তবে, আমার মশাই ওয়ান পয়েন্ট প্রোগ্রাম। যে উদ্যোগই নেওয়া হোক, ভারত যেন তাতে দর্শকের ভূমিকায় না থাকে।
অ্যাক্সিলারেটর যেখানেই গড়ে উঠুক, আমরা যেন সেখানে শুধু আমাদের গবেষক পাঠিয়ে থেমে না থাকি। আমরা যেন গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে সেখানে উপস্থিত থাকি। তবে, আমাদের অংশীদারিত্ব যেন শুধু গবেষক আর যন্ত্রাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থাকে। গবেষণা এখন ভীষণ ভাবে আন্তর্জাতিক এবং জাতীয়। আন্তর্জাতিক কারণ, অনেক জায়গা থেকে অর্থসাহায্য প্রয়োজন।
আর জাতীয় কারণ, গবেষণার জগতে আপনার বাজারদর ঠিক হয় আপনার বৈজ্ঞানিক অবদানের ভিত্তিতে। এ দু’টো সত্য ভুলে গেলে বিপদ। ” ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।