আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অ্যারিস্টটলের নিখুঁত মানবী

ব্যাঘ্র যুগে শুধু মৃত হরিণীর মাংস পাওয়া যায় (গল্পে ১৮+ ট্যাগ প্রযোজ্য, কিন্তু সেটা একমাত্র কাহিনীর ভায়োলেন্সের কারণে, অন্য কোন কারণে নয়) গজারিবনের চকের কাছে আসমানির বাড়ি। আসমানির জামাই আছর নিজের ক্ষেতে ইরি বুনে, বেশ ভালই আয় হয়। কিন্তু জামাই সারাদিন ক্ষেতে খাটে, আসমানি ঘরের কাজ কাম সেরে কেমন একা একা বোধ করে। দুটো পিচ্চি মেয়ে আছে তার, কিন্তু তাও- নিজেকে এই সমাহিত পরিবেশে ঠিক মানিয়ে নিতে পারে না সে। তার বাপের বাড়িতে রাতেও মানুষে গমগম করে।

আর এখানে? রাত তো রাত, এলাকাটার চারিদিক দুপুরেই কেমন সুনসান, নিজঝুম হয়ে যায়। কারো সাথে গল্প করবে সে সুযোগও নেই, সবচে কাছের বাড়িটা সেই দিগন্তসীমায়। দু' একটা ছাই ফকিরও আসে না। আছর সারাদিন খেটে এসে আর কথা বলতে চায় না। পেটভরে মুসুরির ডাল দিয়ে ভাত খেয়ে ঢেঁকুর তোলে, তারপর লুঙ্গি ঢিলা করে হাতপা ছড়িয়ে দিয়ে আটটার মধ্যে ভোঁস ভোঁস করে ঘুমিয়ে পড়ে।

কখনো কখনো মর্জি হলে মেয়েগুলোকে একপাশে সরিয়ে দিয়ে আসমানিকে সোহাগ করে। সর্বোচ্চ সাড়ে আটটা পর্যন্ত, তারপর মেয়ে দুটোর একটা ট্যাঁ ট্যাঁ করে ওঠে। আছর মুখ ব্যাজার করে নিঃশব্দে বকতে বকতে বিছানার অন্য পাশে চলে যায়, মেয়েগুলোর একটা মায়ের বুক আঁকড়ে আরেকটা বাপের ওপর পা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। লোকটাকে আসমানির ভালই লাগে। তার বোনের জামাইয়ের মত বউকে ধরে পেটায় না, মাল খেয়ে এসে শরীরের ওপর বমি করে দেয় না।

বরঞ্চ দুই ঈদে শাড়ি-ব্লাউস দেয়। একটাই সমস্যা, মানুষটা খাটে বেশি, বলে কম। আর রেগে গেলে মানুষ থাকে না। একবার মতের অমিল হওয়ায় আসমানির বড় ভাইকে গরু পিটানোর লাঠি দিয়ে কি বাড়িগুলোই না দিয়েছিল! বড়ভাই তিনদিন বিছানায় পড়ে ছিল। আছরের দূর সম্পর্কের এক বোন ছাড়া আর কেউ নেই বলে রক্ষা, নইলে প্রতিদিন খিটখিটানি লেগেই থাকত।

ইস, বোনটা থাকলেই হত, আসমানির কথা বলার একটা সঙ্গী জুটত, কিন্তু তার বিয়ে হয়েছে শহরে, সে ভাইকে দেখতে আসার সময়ই পায় না। আসমানির বাড়িটা চকের কাছে, তাই সারাদিন গায়ে বাতাস লাগে। শীত কি গ্রীষ্ম কোন ব্যত্যয় নেই। পাতা পড়ে সারা উঠান সয়লাব হয়ে যায়। সকালে পাতা ঝেড়ে পরিষ্কার করলে বিকালেই দেখা যায় আবার একই অবস্থা।

তাই আসমানি বুদ্ধি করে তিন চারদিন পর পর উঠান পরিষ্কার করে। হাঁস-মুরগি ছেড়ে দেয় ভোরে, ওরা সন্ধ্যার আগে আগে আসমানির ডাকে এসে পড়ে। দুটো ত্যাড়া গেছো মুরগি আছে, এরা নিজে থেকে আসে না, কামরাঙ্গা গাছের ওপরে বসে কককক কককক করে। আসমানি ডাকতে ডাকতে যায়, 'আয় আয় তিতিতিতি...আয় নিচে আয়, রাইত অইয়া গেল তিতিতিতিতি... রাতে আছরকে আর মেয়েদুটোকে খাইয়ে নিজে খেয়ে আসমানি ঘুমিয়ে পড়ার চেষ্টা করে। কিন্তু কোন এক কারণে তার ঘুম আসে না।

প্রথমে চোখ বন্ধ করে হাত পা টান টান করে শুয়ে থাকে। নিজের হৃদপিণ্ডের দপদপানি শুনতে পায়। কিছুক্ষণ কাটে। আসমানি একটু এপাশ ওপাশ হয়। মাথার তেল চিটচিটে বালিশটা সরিয়ে ঘাড়ের কাছে সুবিধামত অবস্থানে নেয়।

হাত দিয়ে শাড়ির কাপড় ঠিকঠাক করে। বড় করে একবার শ্বাস ছাড়ে। মৃদু কাশি দেয়। নাক টানে। তারপর।

তারপর আছর ভোঁসভোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে। ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকে। রাতজাগা পাখির অস্পষ্ট ডানা ঝটপটানি শোনা যায়। কিটকিট করে কি এক পোকা ডাকে। এখানে ওখানে, চালের ওপর, উঠানে পাতা পড়ে।

খাটের নিচে ইঁদুর খচরমচর করে। ছোট মেয়েটা ঘুমের মধ্যে কেঁদে ওঠে। কখনো ব্যাঙ ডাকে, আবার কখনো ডাকে না। উঠোনের মাঝে একটা পাখি বসে মধুর স্বরে নিম...নিম... বলে ডাকে। এত গাঢ় নীরবতা আসমানির অস্থির লাগে।

সে শুয়ে থাকতে পারে না। মাথার পেছনে কেমন ঝনঝন করতে থাকে। একসময় বালিশে আর মাথা রাখতে পারে না, অদ্ভুত বিতৃষ্ণা নিয়ে আসমানি ছোট মেয়ের হাত সরিয়ে দিয়ে উঠে বসে। কলসি থেকে ঢেলে পানি খায়। বিছানায় শোয়া তার পরিবারকে দেখে।

আল্লাহর কাছে হাজার শোকর, এত ভাল জামাই, মিষ্টি দুইটা মেয়ে তার আছে। আসমানি যে ভাগ্য নিয়া আসছে, সেই ভাগ্য কয়জনের হয়? বড় মেয়েটা হাঁ করে ঘুমায়, তার মুখ দিয়া লালা পড়ে। আসমানি এগিয়ে গিয়ে শাড়ির খুঁটো দিয়ে তা মুছে দেয়। তার চোখমুখ মাতৃবাৎসল্যে কোমল হয়ে আসে। আল্লাহ, এগোরে যেন নজর না লাগে।

দেহো তো, কি সোন্দর কইরা ঘুমায়। 'ঘুমায়'? আসমানির মাথায় ছোটখাটো একটা বিস্ফোরণ ঘটে। আসমানির চোখে ঘুম নেই আর এরা ঘুমাচ্ছে? আসমানি ভাবে, আল্লা, কি স্বার্থপর! এগোরে বোঝা টাইনা কি লাভ হইব? কাইল আবার মরদটা উইঠা গপগপায়া খাবো, ভালবাইসা দুইটা কথাও কব না। বুজি না আমি? শহরে হাটের কথা কইয়া যাও, কয়, 'ধান বেচবার গেতাছি'! তুমি যে খারাপ মাইয়াগো কাছে যাও বুজি না আমি? আর মেয়া দুইডা সারাদিন পিছনে ঘুরঘুর করব, কানব, হাড়মাস জ্বালাইয়া খাব। এরে কোলে নিয়া খাওয়াও, ওরে পিঠে নিয়া ঘুরাও।

পিঠ চাপড়াইয়া চাপড়াইয়া ঘুম পাড়াও। ছোটলোকের বংশ! এক্কেরে বাপের লাহান! কয় বছর পরে তো সবটি বিয়া কইয়া মেলা দিবি, আমাকে খোঁজবি তহন? আমি মাগি তাইলে তোগরে টানুম ক্যা? আসমানি সাথে সাথে ঠিক করে ফেলে। কাল মহাজন মজনু মোল্লাকে গিয়ে ধরবে। দরকার হলে অনুনয় করবে, পায়ে ধরবে, তাও তার কাছে বিয়ে বসবে। লোকটা চামার, আবার দুইটা বিয়াও করছে, এবং আসমানির দিকে তার আগে থেকেই কু নজর।

ওইখানে অন্ততঃ সতীনদের সাথে সে ঝগড়া করতে পারবে, মজনু মোল্লা তার কাছে পিরিতের আলাপ করবে সেটা শুনতে পারবে। তখন আসমানির ঘুম আসবে, নিশ্চিত। কিন্তু তার আগে, এই অকৃতজ্ঞ পাষণ্ডগুলোকে আসমানি শায়েস্তা করে ছাড়বে। পাগলাটে লাল চোখে সে আশে পাশে তাকায়, বেড়ার ফাঁকে গোঁজা দা দেখতে পায়। তার ঠোঁটে অসুস্থ হাসি ফোটে।

হ্যাঁ, পেয়েছে, উপযুক্ত শাস্তির হাতিয়ার পেয়েছে আসমানি। শক্ত করে হাতে দা ধরে প্রথমে আছরের কাছে যায়। আলতো করে দা ধরে উবু হয়ে গলায় একটা পোঁচ দেয়। গলগলিয়ে তাজা রক্ত এসে আসমানির গলা আর বড় মেয়েটার ফ্রক ভিজিয়ে দেয়। বাঃ, দারুণ তো! এবার সে বড় মেয়েটাকেও করে, আর ওর গলার রক্ত উপচে ছোট মেয়েটাকে ভিজিয়ে দেয়।

আসমানি আনন্দে চীৎকার করে ওঠে। ওহো, কি সুন্দর! পরের মৃত্যুটা কার হবে তা উপচানো রক্তই বলে দিচ্ছে! এবার আসমানি ছোট মেয়েটার পাশে শুয়ে তার গলা কাটে। রক্ত গড়িয়ে আসমানির বুকে লাগে। সে একটু চিন্তিত হয়ে পড়ে। আসমানির পাশে তো আর জীবন্ত কেউ নেই! কিন্তু রক্তধারা তো বলছে আসমানির গলা কাটতে।

দু একবার ভেবে আসমানি মাথা নাড়ে। এত চিন্তা করে কি হবে? দেখাই যাক না! আসমানি রক্তাক্ত দা দিয়ে নিজের দু হাতের রগ কাটে। তারপর হাত ছড়িয়ে চিত হয়ে শোয়। অপেক্ষা করে। এবং কি আশ্চর্য, আসমানির ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসতে থাকে... পরদিন সকালে ঘুম ভাঙতেই আসমানি কাজে লেগে যায়।

হাঁস মুরগি ছাড়ে, উঠান ঝাট দেয়, ভাত চড়ায়, আর পিঠা বানানোর প্রস্তুতি নিতে থাকে। কিছুক্ষণ পর আছর হাতমুখ ধুয়ে বাইরে আসে, হাসিমুখে বলে, 'কি গো, সাত সকালে কি বানাও?' 'পিঠা, দ্যাহ তো কেমন হইছে?', আসমানি স্বামীর হাতে বানানো পিঠাভর্তি প্লেট তুলে দেয়। আছর প্রথমে এক কামড় দেয়, তারপর চোখমুখ উজ্জ্বল করে হুড়মুড়িয়ে খেতে থাকে। তার বিরতিহীন চোয়ালনৃত্যের মাঝে 'জব্বর', ''ভালা' ইত্যাদি কথা থেকে থেকে ভেসে আসে। আসমানি খুশি হয়ে হাসে, তারপর কপট রাগ দেখিয়ে বলে, 'হু, অইছে, আস্তে খাও।

পুলাপানডির লিগা কিছু থওন লাগবো না? আমি অগোরে ডাক দিতাছি খাড়াও। ' ---------------------------------------- তাকিয়ে-থাকা একটা দীপ জ্বলছে ছোটো ঘরে, একটি হাত এলিয়ে আছে কম্পমান বুকের কাছে ছিন্ন-স্মৃতি-সেলাই-করা শীতল কাঁথার 'পরে মনে পড়ার ইন্দ্রজালে ঝাপসা হ'লো দ্বার, আমার হাতে লাফিয়ে ওঠে তীক্ষ্ণ তলোয়ার। -বুদ্ধদেব বসু 'সমর্পণ' ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.