কিচ কিচ কুচ কুচ কাচ কাচ কোচ কোচ!!! যুবক মিরাজ বিখ্যাত গাইনি বিশেষজ্ঞ পারভিন নাহারের আধুনিক চেম্বারে বসে আছেন। মিরাজের মুখ আপাতত অনুভূতিশূন্য, ঐ ঘোলাটে চোখের আড়ালে কি খেলা করছে তা মিরাজ এবং স্বয়ং বিধাতা ছাড়া আর কেউ জানে না।
পারভিন নাহার হাসি হাসি মুখে বললেন, একটা খুশির খবর আছে। আমাদের এক্সপেরিমেন্ট সফল হয়েছে। আপনার স্পার্মের নির্দিষ্ট ক্রোমোজোম আমরা আলাদা করতে সক্ষম হয়েছি।
এখন আপনি ইচ্ছামত ছেলে কিংবা মেয়ে সন্তান নিতে পারেন।
মিরাজ অবিশ্বাসী দৃষ্টি হেনে বললেন, সত্যি?
হ্যাঁ সত্যি। এখন আমাদের ল্যাবরেটরি স্পার্ম থেকে ইচ্ছামত X কিংবা Y ক্রোমোজোম আলাদা করতে সক্ষম। ইচ্ছামত ছেলে বা মেয়ে সন্তান নেয়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। তো আপনিই বলুন, আপনারা কি সন্তান নিতে চান? ছেলে নাকি মেয়ে?
মিরাজ আনন্দিত মুখে বললেন, আমাকে একদিন সময় দিন।
সানন্দে।
মিরাজ বাসায় ফিরে বউকে সব কথা খুলে বললেন। বাসায় বয়ে গেল আনন্দের জোয়ার।
রাতে মিরাজ স্ত্রীকে নিয়ে ভাবতে বসলেন, কি সন্তান নিলে ভালো হবে।
প্রথমে মিরাজ ভাবলেন, ছেলেই ভালো।
কারণ বুড়ো বয়সে ছেলে নিজের কাছে রাখবে, যত্নআত্তি করবে। মেয়ে তো থাকবে পরের ঘরে, সে তো সেটা করতে পারবে না।
পরক্ষণেই নিজের চিন্তা নাকচ করে দিলেন মিরাজ। নাহ, মেয়েরাই বাবা মায়ের প্রতি বেশি কেয়ারিং হয়। অনেক ছেলেকেই দেখা যায় স্ত্রী সন্তান নিয়ে বাবা মা থেকে আলাদা হয়ে যেতে।
মেয়েরা এটা কখনো করে না। নাহ, মেয়েই ভালো।
একটু পরেই মিরাজের মাথায় চিন্তা এল, ছেলেই তো ভালো। কারণ ছেলে হলে তার নিরাপত্তা নিয়ে বেশি চিন্তা করতে হবে না, কলেজে যাওয়ার পথে ছেলেকে কোন বখাটের কবলে পড়তে হবে না, যখন তখন রেপ হবার ভয় থাকবে না, ফোন আর চিঠি দিয়ে বখাটেরা বিরক্ত করবে না। হুম, ছেলেই ভালো।
কিন্তু না! মিরাজ আবার ভাবলেন, ছেলে হলে যদি বখে যায়? যদি অল্প বয়সেই সিগারেট থেকে শুরু করে মদ গাঁজা খাওয়া শুরু করে? ছেলেদের তো কন্ট্রোল করা অনেক কঠিন, সেদিক থেকে মেয়েরা ঘরের মধ্যে থাকে, মেয়ে হলে বখে যাবার ভয় থাকবে না একদমই।
বড়ই কনফিউশনে পড়ে গেলেন মিরাজ। তার মন এবার বলতে লাগল, ছেলেদের শারীরিক শক্তি বা বুদ্ধি তো মেয়েদের থেকে বেশি। ছেলে হলেই শাইন করবে বেশি। ছেলেই ভালো।
মিরাজের মনের অপর অংশ বলে ফেলল, বলসে তোমারে! এখন মেয়েরা কত ইম্প্রুভড। সব ভালো ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মেয়েরা প্রতি বছর বেশি বেশি পরিমানে চান্স পাচ্ছে। কত ভালো ভালো পোস্টে মেয়েরা অবলীলায় ঢুকে যাচ্ছে। এমনকি দেশের গত বাইশ বছরের প্রধানমন্ত্রী, তারাও মেয়ে।
মিরাজের মন আবার বলল, ছেলের পিছনে খরচ কম হবে।
জামাকাপড় বেশি কিনে দেয়া লাগবে না, খাই খাই কম হবে।
মিরাজের মনের অপর অংশ বলল, তুমি কি নিজের সন্তানের সাথেও কিপ্টামি করবা? মেয়েদের তো একটু বেশি লাগবেই। আর সন্তানের জন্য খরচ করে যে কি সুখ সেটা তুমি খরচ না করে কিভাবে বুঝবা?
মিরাজের মনের প্রথম অংশ বলল, ছেলেদের চেহারা খারাপ হলেও যোগ্যতা থাকলেই ভালো বিয়ে হবে। ছেলে সুখে থাকবে। মেয়েদের চেহারা খারাপ হলে একদম বাঁশ।
মিরাজের মনের অপর অংশ বলল, আদিম যুগের মানুষের মত কথাবার্তা বোলো না। তোমার মেয়ে অসুন্দর হলে তার এমন কারো সাথেই বিয়ে হবে যে দেখার সৌন্দর্যকে পাত্তা না দিয়ে অন্তরের সৌন্দর্যকে সম্মান করে। আর মেয়েরা সুন্দর হলে ভাব থাকে বেশি, অসুন্দর হলে এতটা ভাব থাকবে না বিধায় স্বামীকে সে নিজের গর্বহীন ভালোবাসা নির্দ্বিধায় ঢেলে দেবে। আর দিন শেষে, মানুষ ভালবাসারই কাঙ্গাল। একটা ঠাট মারা সুন্দর বউয়ের চেয়ে যত্নবান অসুন্দর বউ যেকোনো ছেলেই পছন্দ করবে।
তাছাড়া অসুন্দর চেহারার অনেক মেয়েই নিজের যোগ্যতায় অনেক উপরে উঠে। সে শেষ পর্যন্ত তোমার মুখ উজ্জ্বলই করবে।
মিরাজ পড়ে গেলেন মহা কনফিউশনে। পাশ থেকে তার বউ মিটিমিটি হেসে বলল, কি ব্যাপার? কি ডিসিশান নিলা?
মিরাজ অনেক ভেবে মুখ গোমড়া করে বললেন, বউ, এই আবিষ্কার একটা ভুয়া আবিষ্কার। আসলে ছেলে আর মেয়ের মধ্যে কোন তফাত নাই।
আর আমি যদি নিজের চয়েজে ছেলে বা মেয়ে চাই-ও, সে ভবিষ্যতে খারাপ কিছু করে ফেললে নিজেই বারবার অনুতাপে ভুগব। দরকার আছে এত ঝামেলার? আমাদের বাপ দাদা পূর্বপুরুষদের সময় কি এই চয়েজ সিস্টেম ছিল? তারা কি সন্তান জন্ম দেন নাই? তারা কি সন্তান মানুষ করে সুখী হন নাই?
মিরাজের বউ চোখ নাচিয়ে বলল, তাহলে তুমি শেষ পর্যন্ত কি বলতে চাও?
মিরাজ বললেন, আমি বলতে চাই এটাই যে, স্রষ্টার উপর বাটপারি করা আমাদের পক্ষে ঠিক হবে না। লেট হিম ডিসাইড হোয়াট ইজ গুড ফর আস। সব দায়িত্ব তাঁর উপরই থাকুক। তিনি যা দেবেন তা-ই আমি মাথা পেতে নেব, তাতে ভবিষ্যতে আর নিজের ভুল ডিসিশনের জন্য অনুতাপ করতে হবে না।
মিরাজের বউ গম্ভীর দৃষ্টি হেনে বলল, এত কিছু বুঝি না। আমার বাচ্চা চাই। ছেলে নাকি মেয়ে তুমি বুঝবা।
মিরাজ বললেন, নাহ, আমিও বুঝব না। লেট ইট বি এ গ্যাম্বল।
আমাদের যেটা দেয়া হবে আমরা সেটাই মাথা পেতে নেব। ছেলে মেয়ে দুইটাই সমান। অনর্থক নিজেদের প্রয়োজনে একজনকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে আরেকজনকে কম গুরুত্ব দেয়া ঠিক হবে না।
মিরাজের বউ হাসল। মিরাজ অবাক হয়ে দেখলেন, তার আশেপাশের পৃথিবীটা কি ভীষণভাবে দুলছে।
বেডরুমের দেয়াল, খাট, আলো, মশারি, বউ – সব অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। সব অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে।
***
প্রফেসর মিরাজের মাথা থেকে ইন্টারফেস খোলা হয়েছে। তার আশেপাশে হতভম্ভ হয়ে এপ্রোন পরা কিছু মানব মানবী দাঁড়িয়ে আছে।
প্রফেসর মিরাজ বললেন, এটা কার প্ল্যান?
অল্পবয়সী এক তরুণী বলে উঠল, আমার, প্রফেসর।
প্রফেসর মিরাজ অবসন্ন হয়ে নিজের খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে হাত বুলোলেন। তিনি ও তার দল গত তিন মাস ধরে স্পার্ম থেকে X ও Y ক্রোমোজোম আলাদা করে ইচ্ছামত ছেলে কিংবা মেয়ে বাচ্চা নেবার পদ্ধতি আবিষ্কার করার পিছনে অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন। সব হিসাব ঠিক থাকলে আগামীকালই চূড়ান্ত সফলতা আসার কথা ছিল।
মূলত নিজের আগ্রহ থেকেই প্রফেসর মিরাজ ঘোষণা দিয়েছিলেন, কমপক্ষে এক হাজার মানুষের মস্তিষ্কে পরাবাস্তব স্টিমুলেশন দিয়ে দেখা হবে আসলেই তারা পদ্ধতিটা গ্রহণ করতে রাজি কি না। নিজের প্ল্যানের শিকার হয়েছেন তিনি নিজেই।
তাকে না জানিয়ে অনেকটা ফান করার জন্যই তার দল তার নিজের মাথায়ই পরাবাস্তব স্টিমুলেশন দিয়েছে। তিনি পরাবাস্তবে নিজের যৌবনে চলে গেছেন। আর গিয়েই পাকিয়ে ফেলেছেন ভজকট।
প্রফেসর মিরাজ আজ প্রমাণ পেলেন, তিনি নিজেই মন থেকে এই আবিষ্কার সমর্থন করেন না। নেহায়েত বিজ্ঞানীর স্বাভাবিক কৌতূহলবশত তিনি এই কাজে হাত দিয়েছিলেন।
তার বিজ্ঞানী সত্ত্বা আর প্রকৃত সত্ত্বা যে কতটা বিপরীতধর্মী, তার প্রমাণ আজ হাতে নাতে পেলেন প্রফেসর মিরাজ।
এই ঘটনার ঠিক পরদিন থেকে, মানুষের বিবর্তনের পথে প্রচণ্ড রকম আশা জাগানিয়া এই প্রজেক্ট, বাতিল ঘোষণা করা হল। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।