যা তুমি আগামিকাল করতে পার, তা কখনো আজ করতে গিয়ে ভজঘট পাকাবে না...
‘আমার মনে হয় আজ রাতে রওনা হওয়া ঠিক হবে না। গত রাতে আমাদের ড্রাইভার ঘুমিয়েছে মাত্র দুই ঘন্টা। তারপর ভোর সাড়ে চারটায় আমরা ঢাকা থেকে স্টার্ট করেছি। সারাদিন সে গাড়ি নিয়ে ছুটোছুটির মধ্যে ছিলো। এখন যদি রাতেই আবার গাড়ি নিয়ে ঢাকা রওনা দেই, অ্যাক্সিডেন্ট হতে পারে।
তারচেয়ে ড্রাইভার আজ রাতটা ঘুমাক। কাল ভোর বেলা আবার রওনা দেব, যেমনটা আজ ভোরে এসেছিলাম। ’
কেবল সড়ক দূর্ঘটনা নয়, অল্প সময়ে যতোটুকু দেখার সুযোগ হয়েছিল, তাতে করে মনে হয়েছে প্রতিটি খুঁটিনাটি বিষয় হিসেব করে চলার মানুষ ছিলেন তারেক মাসুদ। ২৯ জুলাই ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মিলনায়তনের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি যখন ঢাকা ফেরার পরিকল্পনা করছিলেন, কে কল্পনা করতে পেরেছিল এইটিই তার শেষবারের মতো বাড়ি ফেরা?
শৈশবে লেখাপড়া করেছেন মাদ্রাসায়। তারপর দেশে পড়ার পাট চুকিয়ে সোজা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে।
সেখানে লেখাপড়া করেছেন চলচ্চিত্র বিষয়ে। ফিরে এসেই হাত দিয়েছেন ছবি বানানোয়। দূর থেকে যতোটুকু দেখার সুযোগ হয়েছে, মনে হয়েছে শেকড়ের খোঁজ কেবল নয়, সেই শেকড়টি বিশ্লেষণের তাগিদ সম্ভবত তার বরাবরই ছিলো। আর সম্ভবত তারই ফল ‘মাটির ময়না’ বা ‘রানওয়ে’।
ইচ্ছে ছিল, কোনো একটি সিনেমার শুটিংয়ে তারেক মাসুদের কাছাকাছি থেকে তার কাজ দেখবো।
ইচ্ছে ছিল তার পোরট্রেইট তোলার। পোরট্রেইট ফটেগ্রাফির ক্ষেত্রে সম্ভবত সবচেয়ে বিখ্যাত নাম হলো ইউসুফ কার্শ। কানাডিয়ান এ ফটোগ্রাফার একবার বলেছিলেন, একজন মানুষের ক্ষেত্রে কখনো কখনো এমন একটি মুহূর্ত আসে যখন তার শরীর-মন-চেতনা-আত্মা সব এক জায়গায় ভর করে। এ বিষয়টি তখন মূর্ত হয়ে ওঠে মানুষটির তাকানোয়, শরীরের ভাষায়। পোরট্রেইট মানে বিশেষ এই মুহূর্তটিই ধারণ করতে পারা।
বরাবরই মনে হয়েছে তারেক মাসুদের বেলায় এই মুহূর্তটি আসতে পারে সিনেমা শ্যুট করার সময়ে। মনে হয়েছে, কোনো একটি বিশেষ সময়ে হয়তো তাকে ওইরকম পরিস্থিতিতে পাবো, যখন তার শৈশব, অভিজ্ঞতা, শিক্ষা, চেতনা সব এক হয়ে তাকে দিয়ে কাজ করিয়ে নেবে। ওইরকম ঘোর লাগা সময়ের অপেক্ষায় আমি ছিলাম।
এরই মধ্যে সুযোগ এলো শুটিং দেখার নয়, বরং তার সিনেমার প্রদর্শনীতে সঙ্গী হবার। ২৯ জুলাই ময়মননিসংহে সর্বশেষ সিনেমা রানওয়ের প্রদর্শনী হবে।
এই সিনেমাটির পার্টনার হিসেবে ছিল বিডিনিউজ। ফলে ‘নিজের টিম মেম্বার’ হিসেবেই নিয়ে গিয়েছিলেন। আমি গিয়েছিলাম সিনোমাটির প্রদর্শনীর রিপোর্ট করতে তো বটেই, পাশাপাশি মানুষটিকে আরো ভালোভাবে জানতে, তার কাজের ধরন সম্পর্কে বুঝতে।
আমার এক সহকর্মী, যিনি তারেক মাসুদের সঙ্গে আগেও একাধিক সফরে গিয়েছেন, তিনি সাবধান করে দিয়ে বললেন, তারেক ভাই কিন্তু প্রতিটি মিনিট হিসেব করে চলা মানুষ। উনি যদি বলেন ভোর পাঁচটায় রওনা দেবেন, উনি তা-ই দেবেন।
সময়ের হেরফের হবে না।
তার সময় সচেতনতার নমুনা পাওয়া গেল আগের রাতেই। মোবাইল ফোনে রাত ১১টা ৪২ মিনিটে মেসেজ পাঠালেন, ‘খুব দেরি হলে ভোর সাড়ে চারটায় রওনা হবো। মোবাইল ফোনটি খোলা রাখবেন। আপনাকে ডেকে তোলার জন্য চারটায় ফোন দেবো আমি।
’ উনি আক্ষরিক অর্থেই ভোর চারটায় ডেকেছিলেন।
আগের রাতে ঘন্টা তিনেক ঘুমিয়েছেন, ধারণা ছিলো মাইক্রোবাসে হয়তো খানিকটা ঘুমিয়ে নেবেন। সেটি না করে আলাপ শুরু করলেন তার নতুন সিনেমার পরিকল্পনা সম্পর্কে। বললেন, ‘আমি অবাক হয়ে ভাবি,পাকিস্তান আমলে ঢাকার সিনেমার প্রতিপক্ষ ছিলো চারটি। একদিকে দিলীপ কুমার-সায়রা বানু অভিনীত বম্বের সিনেমা, অপরদিকে উত্তম-সুচিত্রা নিয়ে টালিগঞ্জ, ওদিকে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় তৈরি হচ্ছে লাহোরের উর্দূ সিনেমা।
আর সবার ওপরে হলিউডি সিনেমা যেদিন আমেরিকায় মুক্তি পাচ্ছে সেদিনই মুক্তি পাচ্ছে ঢাকায়। চারটি মহা শক্তিধর ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে যুদ্ধ করে ঢাকার ছবি রূপবান তখন হাউজফুল চলেছে। আর এখন স্বাধীন বাংলাদেশে কোনো প্রতিপক্ষ ছাড়াই ঢাকার সিনেমা টিকতে পারবে না কেনো? আমার ইচ্ছে রূপবান সিনেমাটি আমি আবার তৈরি করবো। ’ বলেই প্রশ্ন করলেন, ‘এই সিনেমাটির মূল কাঠামো ঠিক রেখে নতুন বাস্তবতায় সিনেমাটি তৈরি করার প্ল্যান আপনার কেমন মনে হয়?’
মন দিয়ে তার কথা শুনছিলাম, প্রশ্ন শুনে তার দিকে তাকালাম। সূর্য তখন কেবল উঠছে, চলন্ত মাইক্রোবাসের জানালা গলে তার মুখের ডানপাশে এসে পড়েছে ভোরের আলো।
কিন্তু সেই আলোকে ছাপিয়ে তার চোখে তখন ভিন্ন এক আলো খেলছে। সে আলোর নাম স্বপ্ন, মনের ভেতরের চিন্তা-ভাবনাগুলোকে সিনেমার আকারে প্রকাশ করার স্বপ্ন।
চার ঘন্টায় ময়মনসিংহে পৌঁছেই তিনি সোজা গেলেন অডিটোরিয়োমে। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের নামে তৈরি এ অডিটোরিয়ামে ঢুকেই তিনি দর্শক সারিতে গিয়ে জোরে হাততালি দিলেন। তারপর সন্তুষ্ট হয়ে বললেন, ‘ইকো হচ্ছে না।
হলটি যথেষ্ট ভালো। ’
অডিটোরিয়াম, ব্যানার, প্রচারণা এসব কারিগরি বিষয়ের পাশাপাশি তিনি ফোনে একাধিক জনের সঙ্গে যোগাযোগ করে নিশ্চিত করলেন সলিমুল্লাহ বাবু এবং মেহেদী হাসান মোস্তফা নামের দুজন যেনো অবশ্যই দর্শক সারিতে উপস্থিত থাকেন। রানওয়ে সিনেমার পেক্ষাপট ২০০৫-০৬ সালে দেশব্যাপী ঢালাও বোমা হামলা। ওই সময়ে রোজার ঈদের পরদিন ময়মনসিংহ শহরে চারটি সিনেমা হলে বোমা বিষ্ফোরিত হয়। এই বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে এসেছে রানওয়ে সিনেমায়।
সলিমুল্লাহ বাবুর মালিকানাধীন অজন্তা হলটিও আক্রান্ত হয় হামলায় এবং বাবু বিষ্ফোরণে এক পা হারান। অপর দর্শক মেহেদী হাসান মোস্তফা এসেছিলেন তার বড় বোনের সঙ্গে সিনেমা দেখতে। ওই হামলায় মেহেদী আহত হন এবং বড় বোনটি ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান।
রানওয়ের প্রদর্শনী শেষে সলিমুল্লাহ বাবু এবং মেহেদী হাসান মোস্তফাকে মঞ্চে নিয়ে দর্শকদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়। এরপর অডিটোরিয়ামের বাইরে জমে ওঠে আড্ডা।
মাঝরাত পর্যন্ত চলা সে আড্ডায় একটি মুহূর্তের জন্যও মনে হয়নি এ লোকটি গত আঠারো ঘন্টা শ্রম দিয়েছেন সফল একটি প্রদর্শনীর জন্য।
পর দিন সকালে ঢাকা ফেরার পথে তারেক মাসুদ বলছিলেন, ‘জানেন, এই যে ময়মনসিংহে হাউজফুল প্রদর্শনী করলাম বা অন্য জায়গাতেও করছি, এতে যারা আসছে তারা সবাই কিন্তু এই ছবির বাস্তবতা জানে। এরা মৌলবাদী নয়, ধর্মান্ধ নয়। এরা সিনেমাটি দেখছে সেটিও খারাপ নয়, কিন্তু আমাদের পৌঁছানো দরকার এই সিনেমার মূল চরিত্রটির কাছে। এরা তো আমাদের মধ্যেই মিশে আছে।
এদের কাছেই সিনেমাটি পৌঁছে দেয়া দরকার সবার আগে। যারা অলরেডি কনভার্টেট তাদের নতুন করে কনভার্ট করার মানে হয় না। ’
মাদ্রাসায় লেখাপড়া শুরু করা তারেক মাসুদ সম্ভবত নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই বুঝতে পেরেছিলেন ‘কনভার্ট’ বিষয়টির গুরুত্ব। ফলে হয়তো নিজেই দায়িত্ব বোধ করেছেন ‘মাটির ময়না’ বা ‘রানওয়ে’ বানানোর। সেটি ছিলো তার এ যাত্রার প্রথম অর্ধেক।
দ্বিতীয় অর্ধেক সম্ভবত ছিলো প্রান্তিক দর্শকদের কাছে সেই সিনেমা পৌঁছে দেয়া।
মাইক্রোবাসেই তিনি বলছিলেন, মানুষকে সচেতন করা বা গোড়ামি থেকে বের করা একটি বিশাল কাজ। এটি একটি সিনেমার পক্ষে বা একজন নির্মাতার পক্ষে করা সম্ভব নয়। সময় লাগবে, সবার সহযোগিতা লাগবে।
অকস্মাত তার চলে যাওয়া সম্ভবত সেই পরিবর্তনে সবার সহযোগিতার ডাক দিয়ে গেলো নিঃশব্দে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।