আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কোরআনের আয়াত সম্পর্কিত বিভ্রান্তির জবাব। ( পর্ব ০১)

আগুন্তক কোরআন সম্পর্কে বিভ্রান্তি সৃষ্টি বা কোরআনের ভুল ধরার জন্য নাস্তিক এবং ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীরা কোরআনের কোন কোন সূরার একটি বা দুটি আয়াত ব্যবহার করে থাকে সম্পূর্ণ সূরা সম্পর্কে কোন ধারনা না দিয়ে। প্রকৃতপক্ষে তারা এর মাধ্যমে মানুষকে ধোঁকা দিতে চায় যা এককথায় চরম ধাপ্পাবাজি। সেধরনের কিছু আয়াত এবং সেসব আয়াতের প্রকৃত অর্থ আপনাদের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করবো। ১। আর তাদেরকে হত্যাকর যেখানে পাও সেখানেই।

(২:১৯১) এই আয়াতটি তুলে ধরে তারা বুঝাতে চায় যে ইসলাম কাফিরদের হত্যা করতে বলে যেখানেই তাদের পাওয়া যায় সেখানেই। কিন্তু আসলেই কি তাই? উনারা এই আয়তটির অংশবিশেষ মাত্র তুলে ধরেন, সম্পূর্ণ আয়াতটি এবং এর আগের এবং পরের আয়াত গুলো প্রকাশ না করে। আসুন সম্পূর্ণ আয়াতটি এবং এর আগের ও পরের আয়াত এবং সূরাটির নাজিল হওয়ার সময়কার ঘটনা সম্পর্কে জানার চেষ্টা করি। আর তোমরা আল্লাহর পথে তাদের সাথে যুদ্ধ করো, যারা তোমাদের সাথে যুদ্ধ করে, *১ কিন্তু বাড়াবাড়ি করো না। কারণ যারা বাড়াবাড়ি করে আল্লাহ তাদের পছন্দ করেন না।

*২ তাদের সাথে যেখানেই তোমাদের মোকাবিলা হয় তোমরা যুদ্ধ করো এবং তাদের উৎখাত করো সেখান থেকে যেখান থেকে তারা তোমাদেরকে উৎখাত করেছে। কারণ হত্যা যদিও খারাপ, ফিতনা তার চেয়েও বেশী খারাপ। *৩ আর মসজিদে হারামের কাছে যতক্ষণ তারা তোমাদের সাথে যুদ্ধ না করে, তোমরাও যুদ্ধ করো না। কিন্তু যদি তারা সেখানে যুদ্ধ করতে সংকোচবোধ না করে, তাহলে তোমরাও নিঃসংকোচে তাদেরকে হত্যা করো। কারণ এটাই এই ধরনের কাফেরদের যোগ্য শাস্তি।

তারপর যদি তারা বিরত হয় তাহলে জেনে রাখো আল্লাহ ক্ষমাশীল ও অনুগ্রহকারী। *৪ তোমরা তাদের সাথে যুদ্ধ করতে থাকো যতক্ষণ না ফিতনা নির্মূল হয়ে যায় এবং দ্বীন একমাত্র আল্লাহর জন্য নিদিষ্ট হয়ে যায়। *৫ তারপর যদি তারা বিরত হয় তাহলে জেনে রাখো যালেমদের ছাড়া আর করোর ওপর হস্তক্ষেপ করা বৈধ নয়। *৬ [২: (১৯০-১৯৩)] আয়াতগুলোর ব্যাখ্যা নিন্মরূপঃ *১> আল্লাহর কাজে যারা তোমাদের পথরোধ করে দাঁড়ায় এবং আল্লাহ প্রদত্ত জীবন বিধান অনুযায়ী তোমরা জীবন ব্যবস্থার সংস্কার ও সংশোধনকরতে চাও বলে যারা তোমাদের শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং তোমাদের সংশোধন ও সংস্কার কাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার জন্য জুলুম-অত্যাচার চালাচ্ছে ও শক্তি প্রয়োগ করছে, তাদের সাথে যুদ্ধ করো। এর আগে মুসলমানরা যতদিন দুর্বল ও বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত ছিল, তাদেরকে কেবলমাত্র ইসলাম প্রচারে হুকুম দেয়া হয়েছিল এবং বিপক্ষের জুলুম-নির্যাতেনর সবর করার তাকীদ করা হচ্ছিল।

এখন মদীনায় তাদের একটি ছোট্ট স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবার পর এই প্রথমবার তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হচ্ছে, যারাই এই সংস্কারমূলক দাওয়াতের পথে সশস্ত্র প্রতিরোধ সৃষ্টি করছে অস্ত্র দিয়েই তাদের অস্ত্রের জবাব দাও। এরপরই অনুষ্ঠিত হয় বদরের যুদ্ধ। তারপর একের পর এক যুদ্ধ অনু্ষ্ঠিত হতেই থাকে। *২> অর্থাৎ বস্তুগত স্বার্থ লাভের উদ্দেশ্যে তোমরা যুদ্ধ করবে না। আল্লাহ প্রদত্ত সত্য সঠিক জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পথে যারা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে না তাদের ওপর তোমার হস্তক্ষেপ করবে না।

যুদ্ধের ব্যাপারে জাহেলী যুগের পদ্ধতি অবলম্বন করবে না। নারী, শিশু, বৃদ্ধ ও আহতদের গায়ে হাত ওঠানো, শত্রু পক্ষের নিহতদের লাশের চেহারা বিকৃত করা, শস্যক্ষেত ও গবাদি পশু অযথা ধ্বংস করা এবং অন্যান্য যাবতীয় জুলুম ও বর্বরতামূল কর্মকাণ্ড “বাড়াবাড়ি” এর অন্তর্ভুক্ত। হাদীসে এসবগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়েছে। আয়াতের মূল বক্তব্য হচ্ছে এই যে, একমাত্র অপরিহার্য ক্ষেত্রেই শক্তির ব্যবহার করতে হবে এবং ঠিক ততটুকু পরিমাণ ব্যবহার করতে হবে যতটুকু সেখানে প্রয়োজন। *৩> এখানে ফিতনা শব্দটি ঠিক সেই অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, যে অর্থে ইংরেজীতে Persecution শব্দটি ব্যবহার করা হয়।

অর্থাৎ কোনো ব্যক্তি বা দল প্রচলিত চিন্তাধারা ও মতবাদের পরিবর্তে অন্য কোন চিন্তা ও মতবাদকে সত্য হিসেবে জানার কারণে তাকে গ্রহণ করে নিয়েছে এবং সমালোচনা ও প্রচারের মাধ্যমে সমাজে বর্তমান প্রচলিত ব্যবস্থার সংশোধনের প্রচেষ্টা চালিয়েছে, নিছক এ জন্য তার ওপর জুলুম-নির্যাতন চালানো। আয়াতের মূল বক্তব্য হচ্ছে: নরহত্যা নিঃসন্দেহে একটি জঘন্য কাজ কিন্তু কোন মানবিক গোষ্ঠী বা দল যখন জরপূর্বক নিজের স্বৈরতান্ত্রিক ও জুলুমতান্ত্রিক চিন্তাধারা অন্যদের ওপর চাপিয়ে দেয়, সত্য গ্রহণ থেকে লোকদেরকে জোরপূর্বক বিরত রাখে এবং যুক্তির পরিবর্তে পাশবিক শক্তি প্রয়োগে জীবন গঠন ও সংশোধনের বৈধ ও ন্যায়সঙ্গত প্রচেষ্টার মোকাবিলা করতে শুরু করে তখন এস নরহত্যার চাইতেও জঘন্যতম অন্যায় কাজে লিপ্ত হয়। এই ধরনের গোষ্ঠি বা দলকে অস্ত্রের সাহায্যে পথ থেকে সরিয়ে দেয়া যে সম্পূর্ণ বৈধ ও ন্যায়সঙ্গত তাতে সন্দেহ নেই। *৪> অর্থাৎ তোমরা যে আল্লাহর ওপর ঈমান এনেছো তিনি নিকৃষ্টতম অপরাধী ও পাপীকেও মাফ করে দেন, যদি সে তার বিদ্রোহাত্মক আচরণ পরিহার করে, এটিই তাঁর গুণ-বৈশিষ্ট। এই গুণ-বৈশিষ্ট তোমরা নিজেদের মধ্যে সৃষ্টি করো।

----------আল্লাহর চারিত্রিক গুণ-বৈশিষ্টে নিজেদেরকে সজ্জিত করো, রসূলের এ বানীর তাৎপর্যও এটিই। প্রতিশোধ স্পৃহা চরিতার্থ করার জন্য তোমরা যুদ্ধ করবে না। তোমরা যুদ্ধ করবে আল্লাহর দ্বীনের পথ পরিষ্কার ও সুগম করার জন্য। কোন দল যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহর পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে ততক্ষণ তোমরা তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে কিন্তু যখনই সে নিজের প্রতিবন্ধকতার নীতি পরিহার করবে তখনই তোমরা তার ওপর থেকে হাত গুটিয়ে নেবে। *৫> ইতিপূর্বে ‘ফিতনা’শব্দটি যে অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে এখানে তার থেকে একটু স্বতন্ত্র অর্থে তার ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়।

পূর্বাপর আলোচনা থেকে পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে যে, এখানে ‘ফিতনা’ বলতে এমন অবস্থাকে বুঝানো হয়েছে যখন ‘দ্বীন’ আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন সত্তার জন্য নির্দিষ্ট হয়ে যায় এবং এ ক্ষেত্রেযুদ্ধের একমাত্র উদ্দেশ্যই হয় ফিতনাকে নির্মূল করে দ্বীনকে একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট করে দেয়া। আবার ‘দ্বীন’ শব্দটির তাৎপর্য অনুসন্ধান করলে দেখা যায়, আরবী ভাষায় দ্বীন অর্থ হচ্ছে “আনুগত্য” এবং এর পারিভাষিক অর্থ হচ্ছে জীবন ব্যবস্থা। এমন একটি জীবন ব্যবস্থা যেখানে কোন সত্তাকে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বলে মেনে নিয়ে তার প্রদত্ত বিধান ও আইনের আনুগত্য করা হয়। দ্বীনের এই ব্যাখ্যার মাধ্যমে একথা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, সমাজে যখন মানুষের ওপর মানুষের প্রভুত্ব ও সার্বভৌম কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় এবং আল্লাহর বিধান অনুযায়ী জীবন যাপন অসম্ভব হয়ে পড়ে তখন সমাজের এই অবস্থাকে ফিতনা বলা হয়। এই ফিতনার জায়গায় এমন একটি ব্যবস্থার সৃষ্টি করা ইসলামী জিহাদের লক্ষ্য যেখানে মানুষ একমাত্র আল্লাহর বিধানের অনুগত থাকবে।

*৬> বিরত হওয়ার অর্থ কাফেরদের নিজেদের কুফরী ও শির্ক থেকে বিরত হওয়া নয়। বরং ফিতনা সৃষ্টি করা থেকে বিরত হওয়া। কাফের, মুশরিক, নাস্তিক প্রত্যেকের নিজেদের ইচ্ছামত আকীদা-বিশ্বাস পোষণ করার অধিকার আছে। তারা যার ইচ্ছে তার ইবাদাত-উপাসনা করতে পারে। অথবা চাইলে কারোর ইবাদাত নাও করতে পারে।

তাদেরকে এই গোমরাহী ও ভ্রষ্টতা থেকে বের করে আনার জন্য উপদেশ দিতে হবে, অনুরোধ করতে হবে। কিন্তু এ জন্য তাদের সাথে যুদ্ধ করা যাবে না। তবে আল্লাহর যমীনে আল্লাহর আইন ছাড়া তাদের বাতিল আইন কানুন জারীর করার এবং আল্লাহর বান্দাদেরকে আল্লাহ ছাড়া আর কারোর বান্দায় পরিণত করার অধিকার তাদের নেই। এই ফিতনা নির্মূল করার জন্য প্রয়োজন ও সুযোগ মতো মৌখিক প্রচারণা ও অস্ত্র উভয়টিই ব্যবহার করা হবে। আর কাফের ও মুশরিকরা এই ফিতনা থেকে বিরত না হওয়া পর্যন্ত মু’মিন তার সংগ্রাম থেকে নিশ্চেষ্ট ও নিবৃত্তহবে না।

আর “যদি তারা বিরত হয় তাহলে জেনে রাখো জালেমদের ছাড়া আর কারোর ওপর হস্তক্ষেপ বৈধ হবে না। ” – একথা থেকে এই ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, বাতিল জীবন ব্যবস্থার পরিবর্তে সত্য জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবার পর সাধারণ লোকদের মাফ করে দেয়া হবে। কিন্তু নিজেদের শাসনামলে যারা সত্যের পথ রধ করার জন্য চূড়ান্ত পর্যায়ে জুলুম-নির্যাতন চালিয়েছিল সত্যপন্থীরা তাদেরকে অবশ্যি শাস্তিদান করতে পারবে। যদিও এ ব্যাপারে ক্ষমতা করে দেয়া এবং বিজয় লাভ করার পর জালেমদের থেকে প্রতিশোধ না নেয়াই সৎকর্মশীল মু’মিনদের জন্য শোভনীয় তবুও যাদের অপরাধের তালিকা অনেক বেশী কালিমা লিপ্ত তাদেরকে শাস্তি দান করার একান্তই বৈধ। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেও এই সুযোগ গ্রহণ করেছেন।

অথচ তাঁর চেয়ে বেশী ক্ষমতা ও উদারতা আর কে প্রদর্শন করতে পারে? তাই দেখা যায়, বদরের যুদ্ধের বন্দীদের মধ্য থেকে উকবাহ ইবনে আবী মূঈত ও নযর ইবনে হারিসকে তিনি হত্যার নির্দেশ দিয়েছেন। মক্কা বিজয়ের পর সতের জন লোককে সাধারণ ক্ষমার বাইরে রেখেছেন এবং তাদের মধ্য থেকে চারজনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন। উপরোল্লিখিত অনুমতির ভিত্তিতে তিনি এই পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করেছেন। আয়াতগুলো এবং এর ব্যাখ্যা বুঝলেই একথা পরিস্কার হয়ে যায় যে উনারা যে অভিযোগ করেন তা আসলেই ভিত্তিহীন। আর উনারা চালাকি করেই আয়াতটির আগের এবং পরের আয়াতগুলো এড়িয়ে যান যা একরকম ধোঁকাবাজি।

তাই সবাইকে অনুরোধ করছি শুধুমাত্র কোরআনের একটি দুটি আয়াতের অর্থ দেখেই কোরআনকে ভুল ভাববেন না। সম্পূর্ণ সূরা এবং সম্পূর্ণ কোরআন পড়েই সিদ্ধান্তে আসা উচিত। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।