ষাট দশকের শেষার্ধ, তখন সময়টা এমন ছিল যে পূর্ব পাকিস্তানীদের জীবনে খুব কম সময়ই উৎসবের উপলক্ষ্য আসতো। সব সময় এক আতংকে সময় কাটতো সবার, এই বুঝি পাকিস্তানি শাসকরা আমাদের অধিকার, আমাদের দাবী ছিনিয়ে নিয়ে চিরতরে নিস্তব্ধ করে দিবে আমাদের মুখ। তারপরও এ সময় কিছু ব্যাপার এদেশবাসীর উৎসবের উপলক্ষ্য নিয়ে এসেছিল তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে চন্দ্র বিজয়ী তিন নভোচারীর স্বস্ত্রীক ঢাকা ভ্রমণ। নভোচারীত্রয় বিশ্বভ্রমনের ১৭ টি দেশের অংশ হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানে আগমন করেন।
১৯৬৯ সালের ২৭শে অক্টোবর, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকা নগরী এক উৎসবমুখর বেশ ধারন করে।
সারা পূর্ব পাকিস্তান থেকে হাজার হাজার নারী পুরুষের ঢল নামে ঢাকায়। তৎকালীন কুর্মিটোলা বিমান বন্দর ও ঢাকায় প্রবেশের মুল রাস্তায় প্রায় ১০ লক্ষাধিক লোকের সমাগম ঘটে। রাস্তার দু-পাশে নারী-পুরুষ, ছেলে, বুড়ো সমানে ভিড় করতে থাক।
দুপুর ১২টা ১৫ মিনিটের সময় মার্কিন বিশেষ বিমানটি এ্যাপোলো-১১ মিশনের নভোচারী ও চন্দ্রবিজয়ী বীর নেইল আর্মস্ট্রং, এডউইন অলড্রিন ও মাইকেল কলিন্স এবং তাঁদের স্ত্রীদের নিয়ে যখন বিমান বন্দরে অবতরণ করেন,তখন প্রতিরক্ষা বাহিনীর আবেষ্টনী ভেদ করে জনতা বিমানের দিকে দৌড়াতে শুরু করে। তিন চন্দ্র বিজয়ী ও তাঁদের স্ত্রীরা বিমান থেকে বেরিয়ে আসলে জনতা তুমুল ও মুহুর্মুহু করতালির মাধ্যমে তাঁদের অভিনন্দন জানায়।
নভোচারীরাও হাত তুলে এ অভিবাদনের জবাব দেন। বিমান বন্দরে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা রঙীন পোষাক পরিধান করে তাঁদের ফুলের তোড়া দ্বারা বরণ করে নেয়। বিমান বন্দরে শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তি, উচ্চ পদস্থ সরকারী কর্মকর্তাবৃন্দ এবং বহু সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থানরত বহু মার্কিন নাগরিকও বিমান বন্দরে এসে উপস্থিত হন।
বিমান বন্দরটিকে নভোচারীদের ছবি ও প্রতিকৃ্তি এবং পাকিস্তান ও মার্কিন পতাকায় সুসজ্জিত করা হয়।
একটি বিরাট ব্যানারে লেখা ছিল, “আপনাদের এ সাফল্যে সমগ্র মানবজাতি গৌরবান্বিত। ” বিমান বন্দর হতে একখানা খোলা সেভ্রোলেট গাড়ীতে নভোচারীত্রয় এবং অপর একখানা গাড়ীতে মিসেস কলিন্স ও মিসেস অলড্রিনকে নিয়ে শোভাযাত্রা সহকারে শহরের প্রায় ন’মাইল রাস্তা পরিভ্রমণ করা হয়। রাস্তার মোড়ে মোড়ে ছেলেরা ঢোল বাজিয়ে তাঁদের অভিনন্দন জানায়। কেউ ফুলের তোড়া, কেউ ফুলের পাপড়ি, কেউবা অভিনন্দন লিখিত শব্দমালা চলন্ত গাড়ীর প্রতি নিক্ষেপ করে তাঁদের অভিনন্দন জানায়।
দীর্ঘ শোভাযাত্রা শেষে অতিথীরা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে (বর্তমান শেরাটন) পৌছেন।
সেখানে এক সাংবাদিক সম্মেলনে তাঁরা ভাষণ দেন। গভীর আনন্দের সহিত তাঁরা সাংবাদিকের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন। মহাশূন্যচারীদের আগমন উপলক্ষে তাঁদের চাঁদে অবতরণ এবং পরবর্তী বিভিন্ন কার্যক্রমের উপর একটি চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। এ সময় নভোচারীদের স্ত্রীরাও স্থানীয় বিশিষ্ট মহিলা ও মহিলা সাংবাদিকদের সাথে এক বৈঠকে মিলিত হন।
ঢাকা টেলিভিশন (বর্তমান বাংলাদেশ টেলিভিশন) সাধারনত সোমাবার বন্ধ থাকলেও এদিন মহাশূন্যচারীদের আগমনের দৃশ্য সরাসরি প্রচারের জন্য বিশেষ অধিবেশনের ব্যবস্থা করে।
বিকেলে পূর্ব পাকিস্তান সরকার নভোচারীদের এক সম্বর্ধনা ও প্রীতিভোজের আয়োজন করে। গভর্ণমেন্ট হাউসে ৬জন বিউগল বাদকের নিনাদের মধ্য দিয়ে মহাশূন্যচারীদের আগমনীবার্তা ঘোষনা করা হয়। অনুষ্টানে উপ-মহাদেশের ঐতিহ্যবাহী জাঁকজমক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। পূর্ব পাকিস্তানের বিশিষ্ট রাজনীতিক ও ব্যবসায়ীবৃন্দ ছাড়াও শ্রমিক ও ছাত্রনেতৃবৃন্দও অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। উক্ত অনুষ্ঠানে মহাশূণ্যচারীগণ তৎকালীন গভর্নর জনাব আহসানের সাথে উপহার ও শুভেচ্ছা বিনিময় করেন।
জনাব আহসান এ অনুষ্ঠানে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানেরও প্রতিনিধিত্ব করেন। অনুষ্ঠানে ঐতিহ্যবাহী খাবারের সাথে অন্যতম আকর্ষন ছিল এ্যাপোলো-১১ রকেটের মডেল সন্নিবেশিত বিরাটকার একটি কেক। চন্দ্রবিজয়ী নভোচারী ও তাঁদের স্ত্রীদের সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে গভর্ণর আহসান বলেন, “এ বিরাট সাফল্য বিজ্ঞান ও কারিগরী বিজ্ঞানের বিজয় এবং একটি মহান সমাজের সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও বিপুল আকারে মানবিক ও বৈষয়িক সম্পদের সমুন্নয় সাধনেরই ফলশ্রুতি। ” গভর্ণর পূর্ব পাকিস্তান ভূগোল সমিতির পক্ষ হতে মহাশূণ্যচারীদের একটি স্বর্ণপদক প্রদান করেন। পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রপ্রদানদের বাণী সম্বলিত যে ফলকটি মহাশূণ্যচারীগণ চন্দ্রতরীতে করে চাঁদে নিয়ে গিয়েছিলেন, তার একটি রেপ্লিকা তারা গভর্ণরের মাধ্যমে প্রেসিডেন্টকে উপহার দেন।
পাকিস্তানের জনগণের জন্য ফেলে আসা ফলকের একটি প্রতিকৃতিও তারা আহসানের নিকট প্রদান করেন।
মাত্র একুশ ঘন্টা ঢাকায় অবস্থানের পর চন্দ্রমানবরা পরদিন মঙ্গলবার সকাল সাড়ে আটটায় তাঁদের বিশেষ বিমানযোগে ব্যাংককের পথে ঢাকা ত্যাগ করেন। বিমান বন্দরে বহু লোকজন ও সরকারী কর্মকর্তাবৃন্দ তাঁদের বিদায় অভিবাদন জানান। এ সময় অনেকের চোখের কোণে জলের চিলিক দেখা যায়। স্বল্পসময়েই তারা এদেশের জনগণের হৃদয়ের মণি কোঠায় স্থান করে নেন।
তথ্যসূত্র; এই পোষ্টটি তৈরী করতে ১৯৭০ সালে প্রকাশিত গাজীউর রহমান লিখিত ‘ রকেট ও চন্দ্র বিজয়ের ইতিকথা’ নামক তথ্যবহুল বইয়ের যথেষ্ট সাহায্য নেয়া হয়েছে। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।