ঢাকায় ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশের দাবিগুলো তুলে ধরুন
গতকাল ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদাম্বরম দু’দিনের সফরে ঢাকায় এসেছেন। তার এ সফরকে আগামী মাসে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের প্রস্তুতির অংশ মনে করা হচ্ছে। তিনি যৌথ সীমান্ত ব্যবস্থাপনা, অপদখলীয় ভূমি এবং ছিটমহল হস্তান্তরসহ দ্বিপক্ষীয় বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে আলোচনা করবেন এবং গত বছরের জানুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লি সফরকালে স্বাক্ষরিত সন্ত্রাস ও সন্ত্রাস দমন বিষয়ক তিন চুক্তির দ্রুত বাস্তবায়নের দাবি জানাবেন। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে অবশ্য কোনো বিষয়েই সমাধান পাওয়ার আশা প্রকাশ করা হয়নি। বরং আগেই জানিয়ে রাখা হয়েছে, মিস্টার চিদাম্বরম যেখানে দিল্লি চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য চাপ ও তাগিদ দেবেন, সেখানে আমাদের কর্তাব্যক্তিরা ভারতের প্রধানমন্ত্রীর জন্য অপেক্ষায় থাকবেন।
আমরা মনে করি, সবকিছু মনমোহন সিংয়ের জন্য ঝুলিয়ে রাখার পরিবর্তে সরকারের উচিত ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকেও কিছু দায়িত্ব পালনের সুযোগ করে দেয়া। কারণ পি চিদাম্বরম সাধারণ কোনো মন্ত্রী বা নেতা নন, ভারতের রাজনীতিতে নীতি-নির্ধারক হিসেবে তার বিশেষ অবস্থান রয়েছে। তিনি কেবলই ‘আর সহ্য করা হবে না’ ধরনের ঘোষণা দিয়ে হাসির পাত্র হন না। তার প্রতিটি কথারই যথেষ্ট ওজন রয়েছে। তিনি কোনো বিষয়ে কিছু বললে ভারতের প্রশাসন নড়েচড়ে বসে।
এজন্যই তার কাছে বাংলাদেশের দাবিগুলো তুলে ধরা দরকার। বড়কথা, এসব দাবির কোনোটিই অযৌক্তিক কিছু নয়। সীমান্ত সমস্যার কথাই ধরা যাক। বাংলাদেশের সঙ্গে স্থল সীমান্ত অচিহ্নিত অবস্থায় ঝুলিয়ে রেখেছে ভারত। অপদখলীয় এলাকা এবং ছিটমহলগুলো নিয়ে বিরোধেরও মীমাংসা হয়নি ভারতের কারণে।
কোনো কোনো সমস্যা এমনকি চুক্তি হওয়ার পরও অমীমাংসিত অবস্থায় রয়ে গেছে। যেমন ১৯৭৪ সালের মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির ভিত্তিতে নিজে বেরুবাড়ির দখল বুঝে নিলেও আজ পর্যন্ত ভারত বাংলাদেশকে তিনবিঘা করিডোর বুঝিয়ে দেয়নি। ভারতের নীতি-নির্ধারকদের কূটকৌশলে মুজিব-ইন্দিরা চুক্তিকে ভারতের লোকসভা এখনও অনুমোদন করেনি। বিষয়টিকে বরং আইনের প্যাঁচ কষে উচ্চ আদালতে নিয়ে ঝুলিয়ে রেখেছে ভারত। এর ফলে বেরুবাড়ি বাংলাদেশের হাতছাড়া হয়ে গেছে।
সীমান্তকে বন্ধুত্বের এলাকা বানানোর পরিবর্তে ভারত মৃত্যুর উপত্যকা বানিয়ে রেখেছে। বাংলাদেশকে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে অবরুদ্ধ করার পাশাপাশি বিএসএফকে দিয়ে প্রায় প্রতিদিনই বাংলাদেশীদের হত্যা করছে ভারত। ফেলানিদের ঝুলিয়ে রাখা হচ্ছে কাঁটাতারের বেড়ায়। সুতরাং অযথা লজ্জা পাওয়ার অভিনয় না করে চিদাম্বরমের কাছে এসব কথা উপস্থাপন করা দরকার। কিন্তু তেমন কোনো ইচ্ছা বা পরিকল্পনার লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না।
আমাদের সরকার বরং সমস্যার সমাধান হওয়ার আগেই সীমান্তের বিভিন্ন অঞ্চলে ভারতকে নতুন করে মাপজোখ শুরু করার সুযোগ করে দিয়েছে। ফলে জনগণের প্রতিবাদ প্রতিরোধের রূপ নিতে শরু করেছে, যা শেষ পর্যন্ত দু’দেশের সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
প্রসঙ্গক্রমে সন্ত্রাস দমনের বিষয়টিকেও সামনে আনা দরকার। কারণ খবরে বলা হয়েছে, মিস্টার চিদাম্বরম প্রধানত শেখ হাসিনা ও মনমোহন সিং স্বাক্ষরিত দিল্লি চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশের ওপর চাপ দেবেন। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, দীর্ঘ দেড় বছর অতিক্রান্ত হলেও সাধারণ মানুষ দূরে থাকুক, বিরোধী দলগুলো তো বটেই, সংসদ সদস্যরাও পর্যন্ত জানে না দিল্লি চুক্তির মধ্যে আসলে ঠিক কী রয়েছে।
এর কারণ চুক্তিটির ব্যাপারে প্রথম থেকেই রাখঢাক করে এসেছে সরকার। অথচ নিয়ম ও আইন হলো, কোনো দেশের সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুমোদনের জন্য অবশ্যই জাতীয় সংসদে পেশ করতে হবে। স্বাক্ষরের আগে চুক্তির খসড়া পেশ করার কথাও বলা হয়েছে। এত যে বিতর্কিত মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি, তাকেও সংসদকে দিয়ে অনুমোদন করিয়ে নেয়া হয়েছিল। সরকার চুক্তির বিস্তারিত প্রকাশও করেছিল।
অথচ বর্তমান সরকার তেমন চিন্তার ধারেকাছেই যাচ্ছে না।
কথা শুধু এটুকু নয়। দেখা যাচ্ছে, ভারতের দিক থেকে সময়ে সময়ে চুক্তির নানা ব্যাখ্যা হাজির করা হচ্ছে। সন্ত্রাস দমনের নামে বাংলাদেশের ভেতরে যৌথ অভিযান চালানোর দাবিও জানাচ্ছে ভারত। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ভারতেই যে অনেক বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে এবং সবার আগে ভারতের অভ্যন্তরেই যে অভিযান চালানো দরকার সে কথাটা কিন্তু কখনও বলছেন না দিল্লির কর্তাব্যক্তিরা।
তাদের যত মাথাব্যথা শুধু বাংলাদেশকে নিয়ে। এ বিষয়টিও সরকারের উচিত খোলাসা করা। সেইসঙ্গে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে দরকার ট্রানজিট ও কানেক্টিভিটি সংক্রান্ত চুক্তির বিস্তারিত প্রকাশ করা। এজন্য ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরকে চমত্কার উপলক্ষ হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। চিদাম্বরমের কাছে সীমান্ত সমস্যা সংক্রান্ত সব দাবিও তথ্যের ভিত্তিতে ও ইতিহাসের আলোকে এমনভাবে তুলে ধরা উচিত, যাতে তিনি সমাধানের ব্যাপারে ভারতের পক্ষে উদ্যোগ নিতে ও নেতৃত্ব দিতে পারেন।
আমাদের ধারণা, ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশের প্রতিটি দাবির যথাযথ মূল্য দেবেন এবং সেগুলোর সমাধান করার মাধ্যমে ভারতকে সত্যিকার অর্থে বন্ধু রাষ্ট্রের অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত করবেন। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।