মেঘমুক্ত নীলাভ দিঘীর কবোষ্ণতা খুঁজছে মন!
হাসানের কাছ থেকে প্রথম ব্যাপারটা শুনে ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিল না।
শওকত পাপেট শো করে?
ঠিক পাপেট শো না, হাসান বিভ্রান্ত্রের মত জবাব দেয়, ওটাকে কী বলে, ওর হাতে একটা পুতুল থাকে, সেটা কথা বলে ওর সাথে।
ভেন্ট্রিলোকুইজম!! রুমী বিস্ময় ধ্বনি করে।
দারুন ব্যাপার তো! আমাদের মধ্যে কেউ একজন ভেন্ট্রিলোকুইস্ট, একদমই অবিশ্বাস্য।
হাসানের হতভম্ভ মুখ দেখে বোঝা গেল শব্দটার সাথে ও পরিচিত নয়।
রুমী ওর কাছে ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করলো-
ভেন্ট্রিলোকুইজম বেশ দুর্লভ বিদ্যা। সহজ কথায় এটা হল শব্দকে ছুড়ে দেয়া, এমন ভাবে যাতে মনে হয় যিনি বলছেন তার মুখ থেকে নয়, আশপাশের কোথা থেকে শব্দটা আসছে, যেমন ধর হাতে ধরা পুতুলের মুখ থেকে হতে পারে।
আচ্ছা, আমিতো ভেবেছিলাম পাপেটের গলাটা বোধহয় পর্দার পেছন থেকে কেউ দিচ্ছে-হাসান মনে করার চেষ্টা করে। সপ্তাহখানেক আগে ওর একটা শো ছিল, ইচ্ছা ছিল শো শেষে ওর সাথে দেখা করবো। ধরতেই পারলাম না-চট করে কই যেন চলে গেল শো শেষ হওয়া মাত্রই।
ব্যাটা মনে হয় ভাল বিজি এসব নিয়ে।
পুরনো বন্ধুরা অনেকদিন পর একসাথে একই ছাদের নীচে, চট করে যেন ফিরে গেছি বছর দশেক আগের সেই কলেজের দিনগুলোতে, ক্যাফেটেরিয়ার আড্ডামুখর সময়ে। জহিরের বিয়ে উপলক্ষ্যে আসা, নইলে এ্যাদ্দিন পর সবার সাথে দেখা হওয়াটা অকল্পনীয়।
ভেন্ট্রিলোকুইজম আমাদের দেশে এখনো অতটা পরিচিত হয়ে উঠেনি, হাতে গোনা দুএকজন ভেন্ট্রিলোকুইস্ট আছে, তাও নন-প্রফেশনাল,শখের বশে বা মানুষকে চমকে দেয়ার জন্য প্রাকটিস করে। তাই শওকতের মত সাদামাটা একটা ছেলে-ভেন্ট্রিলোকুইস্ট হয়ে রীতিমত শো করে বেড়াচ্ছে সেটা আশ্চর্যের কথা তো বটেই তবে আমাদের বিস্ময়টা ছিল অন্য জায়গায়।
শওকত ইন্টার পরীক্ষার সময় ভীষণ টাইফয়েডে পড়ে,অনেকদিন ভোগায় ওকে । জ্বরটা সারবার আগে ওর একটা স্থায়ী ক্ষতি করে দিয়ে যায়। তারপর থেকে ওর যে কাজটি করতে সবচেয়ে কষ্ট হত তা হল ‘কথা বলা’ । ও বাকশক্তি হারিয়ে ফেলে প্রায়!
তা হঠাৎ তুই ওর হদিস পেলি কই? রুমী জিজ্ঞেস করে।
হাসান বললো, গ্রামের বাড়ির এক ছেলের সাথে দেখা সেদিন, ছেলেটাই খোঁজ দিল।
তোরা হয়তো ভুলে গেছিস, শওকতের আর আমার হোম ডিস্ট্রিক্ট একই।
ব্যাপারটা আসলেই আমরা ভুলে গেছিলাম।
আজকেও শো আছে নাকি?
হাসান ঘড়ির দিকে তাকাল, সন্ধ্যা সাতটা এখন, তারমানে ঠিক দু’ঘন্টা পরে লাস্ট শো, জায়গাটা উত্তরার কাছে, যেতে চাইলে খুব দেরি করা যাবে না।
অনুষ্ঠানও প্রায় শেষের দিকে, তাই আমরা দ্রুত সিধান্ত নিলাম। শওকতের শো দেখার লোভই জয়ী হল, জহির থেকে বিদায় নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম তিনজন।
হাসান ওর গাড়ি করে আমাদের পৌঁছে দেবে শুধু, ওর আবার রাতেই চিটাগাং ফিরতে হবে।
যেতে যেতে শওকতকে নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। হাসান বললো, হঠাৎ করে ওর বাবা মারা যাওয়ার পর ওদের অবস্থাটা চট করে পড়ে যায়, সংসারে অবশ্য তেমন কেউ ছিল না, বোন দুটোর আগেই বিয়ে হয়ে গেছলো, কাকীমা আর ওর এক ছোট ভাই ছিল। বোবার মত হয়ে যাওয়ায় টিউশনীটাইপ কিছু যে করবে তারও উপায় ছিল না, পরে বেশ কিছুদিন এক পরিচিত লোকের ফার্মেসীতে বসতো, পড়াশোনার পাট ততদিনে চুকে গেছে। পরে শুনলাম প্রাকটিস করে করে কথা বলার সমস্যাটাও দূর করে ফেলেছে।
রুমী বললো, এতকিছু জানি না, ওর সাথে আমার তেমন মাখামাখি ছিল না, যতদূর দেখেছি মনে হয়েছিল বেশ আত্মপ্রত্যয়ী ছিল, আমার এখন যেটা মনে হয়, নিজের অক্ষমতাকে একহাত দেখে নেয়ার জন্যই এমন এক পেশা বেছে নিল যেখানে কন্ঠস্বরের মুন্সিয়ানাটা থাকতে হয় সবচেয়ে বেশি।
ওদের কথা শুনতে শুনতে কিছুদিন আগে টিভিতে দেখা এক ভেন্ট্রিলোকুইস্টের শো এর কথা মনে পড়লো। এক কমেডিয়ানের হাতের পুতুল কথা বলছে সেজন্য নয়, সে কথোপকথোন যথেষ্ট উপভোগ্য ছিল বলেই দেখছিলাম। তবে আমার সন্দেহ হচ্ছিল কোন বুজরুকি আছে কিনা, কারন পুতুলটা কথা বলার সময় লোকটার চোয়াল একদমই নড়ছিল না।
ঠোঁট না নাড়িয়ে কথা বলা কি আদৌ সম্ভব? আমি স্বগোতক্তি করলাম।
‘ব্যাপারটা আসলে তা নয়, রুমী ব্যাখ্যা করা শুরু করলো, আসলে যে সব শব্দ ঠোঁট দিয়ে উচ্চারণ করা লাগে, ভেন্ট্রিলোকুইস্ট সেগুলো এড়িয়ে যায়। যেমন ধর, প ফ ভ ভ ম এইসব বর্ণগুলোর জন্য ঠোঁট নাড়াতে হয়, ইংরেজীতে ল্যাবিয়াল সাউন্ড p f b v m এগুলো তারা অন্য কিছু দ্বারা রিপ্লেস করে বলে। যেমন ধর, তুই একটা বোকা- এটাকে কোন ভেন্ট্রিলোকুইস্ট বলবে ‘ তুই একটা গোকা’ । আর কন্ঠস্বরের রেজোন্যান্স বেশি থাকে বলে এসব ছোটখাট ব্যাপার ধরাই পড়ে না। মূলত হরবোলাদের মত নানা স্বরে কথা বলাই আসল ক্রেডিট, মুখ না নাড়ানোটা প্রাকটিস করলে সবাই পারবে।
শো শুরু হবার মিনিট পাঁচেক আগে আমরা পৌঁছালাম। টিকেট কেটে ঢুকতে বেগ পেতে হল না, হাউসফুল হওয়ার মত জনপ্রিয় হয়ে উঠে নি হয়তো এখনো। হাসানকে বিদায় দিয়ে আমি আর রুমী সিট নিয়ে বসে পড়লাম।
মূলত ম্যাজিক শো ছিল, বেশ ক’জন বিদেশী ম্যাজিশিয়ানও পারফর্ম করছিলো দেশী ম্যাজিশিয়ানদের পাশাপাশি । বেশ আনন্দই পাচ্ছিলাম, অনেকদিন পর এই ধরনের কোন শো দেখছি কিনা, নিজের অজান্তেই হাততালি দিতে দিতে হাত ব্যথা করে ফেললাম।
হঠাৎ করেই মঞ্চে শওকত ঢুকলো। অনেকদিন পর দেখলেও চিনতে মোটেও সমস্যা হল না। আগের চেয়ে অনেক রোগা হয়েছে, চোখের নীচে বয়সের ছাপ। হাতে একটা কাঠের পুতুল, এক বাচ্চা ছেলের মত মুখের আদল , কোট-টাই পরা। নীচের চোয়ালটা যে নাড়াচাড়া করা যায় তা ভাল করে দেখেলেই বোঝা যায়।
চেয়ার পেতে বসেই কথোপকথোন শুরু হয়ে গেল। শওকত পুতুলটার উদ্দেশ্যে বলল, ‘গিলু, সবাইকে শুভেচ্ছা জানাও!’
একটা মিহি চিকন স্বর বেড়িয়ে এল পুতুলের গলা থেকে-
কেন? শুভেচ্ছা জানাবো ক্যান?
এটাই নিয়ম, লোকদের সাথে দেখা হলে প্রথমে তাই করতে হয়!
ওটাতো তোমাদের মানুষের নিয়ম, আমি কি মানুষ?
তোমাকেও মানুষ হতে হবে, সবাই তো মানুষ হতে চায়, জানো না? কাঠের পুতুল পিনোকিও ও তো মানুষ হতে চেয়েছিল- মনে নেই?
পিনোকিওকে আমি ঘৃণা করি, খালি মিথ্যা বলে নাক লম্বা করা ছাড়া ও আর কীই বা পারে!
তুমি মিথ্যা বল না?
বয়েই গেছে, আর আমি মানুষ হতে চাই না, বরঞ্চ চাই তুমিও আমার মত পুতুল হয়ে যাও।
এইভাবে বাক-বিতন্ডা চলতে থাকে, হাততালি আর হাসির হুল্লোড়ে কখনো কথোপকথোন ঢাকা পড়ে যায়।
পাশ থেকে রুমী আমাকে স্মরণ করিয়ে দেয়, লক্ষ্য করে দেখিস, অন্যান্য কথোপকথোন থেকে এটা একটু আলাদা। দু’জন মানুষ কথা বললে প্রায়ই যেটা হয়, একজনের কথার সাথে আরেকজনর কথা ওভারল্যাপ হয়।
কিন্তু ভেন্ট্রিলোকুইস্ট একাই দু’জনের কথা চালিয়ে যায় বলে দুটো স্বরে যথেষ্ট গ্যাপ থাকে । পেশাদারিত্বের সাথে সাথে অবশ্য এই গ্যাপটা কমে আসে।
ব্যাপারটা বলে রুমী শো এর মজাটা কিছুটা নষ্ট করে দিল। আমি পুতুল আর শওকতের কন্ঠস্বরের গ্যাপ এর দিকে খেয়াল করা শুরু করলাম কথা না শুনে। এবং বুঝলাম দুটো গলার মাঝে যথেষ্ট গ্যাপ আছে, তারমানে হয়তো শওকত এখনো অতটা উঁচুদরের ভেন্ট্রিলোকুইস্ট হতে পারে নি।
মোটামুটি একটা উপভোগ্য শো শেষ করে শওকত মঞ্চ ছাড়লো। আমরাও সাথে সাথে ওকে ধরতে বেড়িয়ে গেলাম।
ম্যাজিশিয়ানদের রেষ্টরুমে ঢুকতে গিয়ে ব্যর্থ হলাম, সেখানে ফাজিল টাইপ এক দাড়োয়ান দাঁড়ানো। আমরা শওকতের বন্ধু বলেও সুবিধা করা গেল না। বলল,
‘আপনারা যত বড় তাবেদারই হন লাভ নাই, বাইরের মাইনষের এইখানে ঢোকা নিষেধ,যান গা’
কথা শুনে রুমীর মাথায় রক্ত চড়ে গেল ।
ও আগে থেকেই যথেষ্ট শর্ট-টেম্পারড, দাড়োয়ানের সাথে প্রায় মারামারি বাধিয়ে বসলো।
চেঁচামেচিতে অবশ্য কাজ হল, ভেতর থেকে ভদ্রস্থ এক লোক এসে ক্ষমা চাইল। সে জানালো শো শেষ হওয়া মাত্রই শওকত তার রুমে চলে গেছে। শওকত যে হোটেলে উঠেছে তিনি তার ঠিকানা দিলেন।
হোটেলটা বেশি দূরে ছিল না।
রিসিপশনিষ্ট বলল, উনি কারো সাথে দেখা করবেন না বলে রেখেছেন।
দেখুন, আমরা পুরনো বন্ধু, আপনি রুমে একটা ফোন দিন, আমরা কথা বললেই বুঝবে। ফোনে কাজ হল। আমি ভিতরে ভিতরে অসহিষ্ণু হয়ে উঠছিলাম, এখনই সেলিব্রেটিদের মত ভংচং শুরু করলো শওকত ।
ওর রুমে ঢুকে চমকাতে হল।
আজকের দিনটা যথেষ্ট ঠান্ডা এমনিতেই, এই ঠান্ডার মধ্যেও ও ফুল এসি ছেড়ে রেখেছে। হঠাৎ করে মনে হল যেন উত্তরমেরুতে গিয়ে পড়লাম। ঘরে একটা মাত্র শেড ল্যাম্প জ্বালানো। শওকতের মুখভঙ্গি তাই ভাল বোঝা গেল না, এতদিন আমাদের দেখে ও উচ্ছ্বসিত না কিছুটা বিরক্ত।
কুশল বিনিময়ের পর শওকত জিজ্ঞেস করলো, তা শো কেমন দেখলি?
অসাধারন, তুই এমন একটা শো করছিস, ব্যাপারটা বিশ্বাস করতেই কষ্ট হচ্ছিল।
কেন? হঠাৎ ওর কন্ঠস্বর গম্ভীর শোনাল
আমি বললাম,না মানে, তোর স্পিচে একটা সময় সমস্যা ছিল- সেটা সেরে উঠবার পর তো আর কথা হয় নি তোর সাথে!
তা হঠাৎ তোরা এখানে? খোঁজ পেলি কই।
জহিরের বিয়ের কথা বলতেই মনে হল ওর চোখমুখ আরও শক্ত হয়ে গেছে।
তোরা জানিস কলেজে থাকতে জহিরের সবচেয়ে কাছের বন্ধু কে ছিল?
ও কি বলবে ব্যাপারটা অনুমান করে ফেললাম, জহিরের সাথে একসময় ওর খুব মাখামাখি ছিল।
ওর সমস্যাটা হবার পর একটা সময় সব বন্ধুদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তবে যোগাযোগের ইচ্ছাটা ওর তরফ থেকেই ছিল না বলে আমাদের মনে হয়েছিল।
কাল কোথায় শো করছিস- পরিবেশ হালকা করার জন্য আমি বলি।
সকালের ফ্লাইটে ইন্ডিয়া যাচ্ছি। ওখানে আগামী একসপ্তাহ শো আছে।
রুমী বলল, তা তোর হঠাৎ এ ইচ্ছা জাগলো ক্যান, ভেন্ট্রিলোকুইস্ট হবার?
বোবা হওয়ার পরপরই। থমথমে গলায় ও জবাব দিল।
ওর জবাবে আমরাও বিস্ময়ে বোবা হয়ে গেলাম,বাকশক্তিহীন হবার পর ভেন্ট্রিলোকুইস্ট হবার চিন্তা খোঁড়া হবার পর দৌড়ে চ্যাম্পিয়ন হবার মতই নয় কি?
আমাদের অবাক হয়ে যাওয়াটা মনে হয় শওকত এনজয় করলো, ওর মুখে এক ধরনের রহস্যময় হাসি দেখা দিল।
‘ভেন্ট্রিলোকুইজম নিয়ে তোরা কদ্দুর জানিস’
আমরা খুব বেশি কিছু জানি না হয়তো, রুমী বলল। তারপর ও আমাকে যা বলেছিল তাই রিপিট করলো।
হঠাৎ হাই তোলার ভঙ্গি করে শওকত ওকে থামিয়ে দেয়-
মধ্যযুগের উইচ হান্টের নাম শুনেছিস, যখন ম্যাজিশিয়ানদের ধরে ধরে পুড়িয়ে মারা হত।
শুনেছি, রুমী বলল, হাজার হাজার মানুষকে ধরে ধরে মারা হয়েছে।
সংখ্যাটা আসলে লাখে গিয়ে ঠেকেছিল, আবহাওয়া খারাপ হলেও দোষ হত যাদুকরদের।
তাদের শাস্তি দেয়ার জন্য রীতিমত রাষ্ট্রীয় আইনও ছিল।
আইন?
এটা পরিচিত উইচক্র্যাফট অ্যাক্ট নামে, সে উইচহান্টে শুধু ম্যাজিশিয়ানদেরই নয়, ভেন্ট্রিলোকুইস্টদেরও ধরা হত, যদিও আপাতত দৃষ্টিতে ভেন্ট্রিলোকুইস্ট মোটেও ম্যাজিশিয়ান নয়।
কিন্তু যারা আসল ব্যাপারটা জানতো তারা বুঝতে পেরেছিল, ভেন্ট্রিলোকুইজমও ব্ল্যাক ম্যাজিকের মতই নিষিদ্ধ কিছু।
কিন্তু…রুমী বলে উঠে। শওকত সাথে সাথে হাত তুলে ওকে থামিয়ে দেয়।
‘ হ্যাঁ,অনেকের ধারনা এটা সাধারণ কিছু, প্রাকটিসের সাথে সম্পর্কিত, তাই যে কেউ ভেন্ট্রিলোকুইস্ট হতে পারে, এমনকি যে কেউ হচ্ছেও। কিন্তু সবাই প্রকৃত অর্থে ভেন্ট্রিলোকুইস্ট নয়।
আসল ব্যাপারটা অনেক বড় কিছু। এর মধ্যে স্পিরিচুয়াল ইন্সপায়ারিং আছে। আধ্যাত্মিক প্রেরণা।
মূলত এটা একটা রিলিজিয়াস প্রাকটিস। ধর্মসংক্রান্ত আচার।
কথা শুনে আমার আমার মাথা ঘুরছিল,কন্ঠস্বরে এমন একটা গাম্ভীর্য শওকতের যে অবিশ্বাসও করতে পারছিলাম না।
রুমী বলল, আমিও এ ধরনের কথা যে শুনি নি তা না,ভেন্ট্রিলোকুইজম শব্দের মানে তো উদর থেকে কথা বলা, ধারনা করা হত মৃত আত্মা তাদের উদরে স্থান নিত এবং কথা বলতো।
এক্সাক্টলি,শওকত দাঁড়িয়ে যায়, ল্যাটিন venter এবং loqui থেকে এসেছে শব্দটা।
Venter মানে উদর আর loqui মানে কথা বলা।
কিন্তু ব্যাপারটা তো ভেন্ট্রিলোকুইস্টদের ভন্ডামি ছিল পুরোটাই, তাই না?
মোটেও না, শওকতের দৃষ্টি দিয়ে যেন আগুন ঝরে, তাঁরা ছিল বিশেষ ক্ষমতাবান, সত্যি সত্যিই মৃতের আত্মা তাদের দেহে স্থান নিত। তাদের কথা তোমাদের ওই ইতিহাসের পাতায় নয়, একেবারে ধর্মগ্রন্থে আছে!
ধর্মগ্রন্থে?
হ্যাঁ, Septuagiant বাইবেলের নাম শুনেছিস, হিব্রু বাইবেলের সবচেয়ে প্রাচীন গ্রীক অনুবাদ। সেখানে ভেন্ট্রিলোকুইস্টদের কথা বলা আছে, গ্রীকরা একে বলতো gastromancy অর্থাৎ উদর থেকে ভবিষ্যতবানী করা।
আমরা চুপ হয়ে গেলাম, বিস্ময়ের পাশাপাশি শওকতের তেজদীপ্ত কন্ঠস্বরে যেন বশ হয়ে রইলাম।
আমি বাকশক্তিহীন হয়ে যাওয়ার পর সবচেয়ে বড় আঘাতটা কি ছিল জানিস? হঠাৎ প্রসংঙ্গ পাল্টে শওকত আমাদের জিজ্ঞেস করলো। রুনু আমাকে ছেড়ে চলে যায়!
কি বলবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। রুনুর সাথে শওকতের ভাব ছিল জানতাম, হয়তো সেটা প্রেমের সম্পর্ক ছিল। কিন্তু বাকহীন হওয়ার পর রুনু ওকে ছেড়ে চলে যায় এ ধরনের কোন ঘটনা জানা ছিল না।
তোরা রুনুর খবর জানিস?
আমাদের কারে জানা ছিল না।
জানতাম, জানবি না। হঠাৎ মনে হল ওর মুখে সামান্য হাসির মত।
আমি এত কাঁচা কাজ করি না।
মানে? রুমী চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায়, তুই ওর কিছু করেছিস?
তেমন কিছু না, আমার আলমারীতে আর একটা পাপেট আছে। একটা মেয়ে পাপেট।
এখনও ভাল কথা বলতে পারে না, তবে হ্যাঁ, দিন দিন শিখছে।
পুরো ব্যাপারটা আসলে কী বুঝে উঠতে পারলাম না,তবে শীতল ঘরে আধো আলো অন্ধকারে ওর হিসহিসে গলায় বলা কথাটা শুনে আমি শিউরে উঠলাম, খুব অশুভ কিছু ঘটছে বলে মনে হল।
রুমীর কী হল কে জানে,হঠাৎ ক্ষেপে উঠলো মনে হল, চেঁচিয়ে বলল, ‘তুই রুনুকে খুন করেছিস?
শওকত দৃঢ় স্বরে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, মোটেও না, আমি খুনী নই। শুধুমাত্র মাত্র একজন মূলধারার ভেন্ট্রিলোকুইস্ট।
তবে…, শওকত মুখের ক্রুর হাসিটা বজায় রেখে যোগ করে, ওভাবে বেঁচে থাকার কোন মানে হয় না।
এটা ওর প্রাপ্য ছিল। একটা পারফেক্ট পানিশমেন্ট, পানিশমেন্ট অব গোল্ডেন রুলস, ব্যালান্সড প্রতিশোধ।
ব্যালান্সড প্রতিশোধ?
নিশ্চয়ই। সত্যিকার অর্থেই। ও একটা প্রাইভেট মেন্টাল ক্লিনিকে আছে, ওভাবেই বেঁচে থাকবে অপ্রকৃতিস্থ হয়ে যতদিন বাঁচবে।
ওর আত্মাটা ওর দেহে নেই আর !
মাথামুন্ডু কিছুই বুঝলাম না। তারপরও মুখ দিয়ে প্রশ্নটা বেড়িয়ে গেল, আত্মা ছাড়া মানুষ বেঁচে থাকে?
আমি তো আত্মা গ্রহনের ঈশ্বরপ্রেরিত দূত নই। যে উপায় আমরা সেটা করি, তাতে আত্মার উল্লেখযোগ্য একটা অংশ দেহে থেকে যায়। আর বাকীটা... আর বাকীটা নিয়ে কি করা হয় শওকত শেষ করে না।
শওকত ঠিক পাগল না আমাদের বোকা বানাচ্ছে বুঝতে পারছিলাম না।
তারমানে আজকে যে ডামি নিয়ে তুই শো করলি,এটাও কোন মানুষের আত্মা বহনকারী? রুমী জিজ্ঞেস করে।
প্রশ্নটার জবাব না দিয়ে ও উল্টো আমাদের প্রশ্ন করে,বোবা হওয়ার পরপরই আমি ভেন্ট্রিলোকুইস্ট হতে চেয়েছিলাম কেন জানিস?
কারন হল- ডাক্তার আমাকে বলে দিয়েছিল আমি আর কোনদিন স্বাভাবিক হতে পারবো না। শুনে সেইদিনই সমীরদের আন্ডার কন্সটার্কশনড ছয় তলা বাড়ির ছাতের কিনারায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম, কিন্তু সাহসে কুলায় নি বলে ফিরে এসেছি।
পরে একদিন এক সাধকের খোঁজ পাই,ল্যে পিপলরা বলে প্রেতসাধক, মূলত ব্লাক ম্যাজিশিয়ান। যে সে মানুষ তার কাছে যাওয়ার সাহস পেত না, গেলেও কল্কে পেত না।
আমাকে কেন যেন ফিরিয়ে দিল না, আমার চোখের ক্ষোভ বোঝার ক্ষমতা তার ছিল।
একনজর আমাকে দেখে বলল, তুই বোবা, কিন্তু তোর আত্মাটা বোবা না। সেটা দিয়ে বকবকাতে পারবি, কিন্তু সেটা আত্মহত্যার সামিল। চলে যা, দরকার নাই।
আমি তখন মরিয়া, পড়ে রইলাম যতক্ষণ না রাজী হয়।
একটা ডামি পুতুল বানিয়ে নিয়ে গেলাম কয়েকদিন পর। তারপর যা করেছেন তখন বুঝি নাই, অনেকদিন পর সেই পদ্ধতিটা আমিই আত্মস্থ করি।
কি করেছে?
কি করেছে সেটা তোদের জেনে কাজ নেই।
এরপর থেকে কথা বলে ডামিটা,আর আমি মুখ মিলাই!
রিভার্স ভেন্ট্রিলোকুইজম! রুমী বিস্ময় ধ্বনি করে।
তারচেয়েও বেশী কিছু।
আমার শরীরটাও ডামির নিয়ন্ত্রনাধীন। আমার আত্মাটা আসলে ওখানেই বসানো।
বলতে বলতে শওকত ধপ করে পড়ে যায়, সোফায় এলিয়ে পড়ে। আর এতক্ষণ লক্ষ্য করিনি, পাপেটটা সোফারই একপাশে বসিয়ে রাখা। অন্ধকারে ভালো বোঝা যায় না।
হঠাৎ মনে হল ওটা ঘাড় ঘুড়িয়ে আমাদের দিকে তাকাল। মুখটা হা করা, বড় করে। চোখদুটো জ্বলজ্বলে, চোখের ভুল কিনা জানি না। মনে হল মুখের ভেতর লালচে কিছু। কথা বলতে জিহ্বা লাগে মনে পড়লো আমার।
তীক্ষ্ণ একটা শীতল কন্ঠ বেড়িয়ে এল, গা হীম করা-
‘তোরা চলে যা, বেড়িয়ে যা এক্ষুণি। নইলে বিপদ। ভীষণ বিপদ। ‘সে স্বরে এমন কিছু ছিল যা অগ্রাহ্য করার সাধ্য আমাদের ছিল না । রুম থেকে কীভাবে ছুটে বেড়িয়ে গেছি নিজেরাই জানি না।
হোটেল থেকে নেমে দৌড়ে এক সিএনজি ধরি। দুজনেরই মুখ থমথমে। এ ধরনের কোন অভিজ্ঞতা হবে কেউ তা কষ্মিনকালেও ভেবেছিলাম!
পারফেক্ট পানিশমেন্ট, রুমী হঠাৎ বিড়বিড় করে বলে।
শওকত পারফেক্ট পানিশমেন্টের কথা বলেছিল মনে আছে?
মানে কি এর? আমি ওর কথায় আবারও বিভ্রান্ত হই।
এর মানে eye for an eye, tooth for an tooth, হাজার বছর আগের হাম্বুরাবী আইনেও যেটা ছিল,অনেকগুলো একেশ্বরবাদী ধর্মেও যে বিধান আছে,ব্যালান্সড প্রতিশোধ,সবচেয়ে পারফেক্ট শাস্তি বিধান, চোখের বিনিময়ে চোখ,দাঁতের বিনিময়ে দাঁত…আত্মার বিনিময়ে আত্মা।
শওকতের আত্মা, রুনুর আত্মা।
হঠাৎ করে আজকের রাতটাকে কেমন দু:স্বপ্নের মত মনে হয়।
(চলবে)
▌দ্বিতীয় পর্ব ▌ ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।