বেশ কিছুদিন দেশের বাইরে ছিলাম। ইস্তাম্বুল, মাদ্রিদসহ আন্দালুসিয়ার কয়েকটি ঐতিহাসিক শহর এবং পর্তুগালের রাজধানী লিসবন (লিসবুয়া) ঘুরে ব্রিটেনে কয়েক দিন কাটিয়ে দেশে ফিরেছি। পর্তুগাল ও স্পেন এখনো অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। ব্রিটেনে থাকাকালে হাউস অব কমন্সে নর্থ লুটনের এমপি ক্যালভিন হপকিনসের আমন্ত্রণে পার্লামেন্ট ভবন পরিদর্শন এবং হাউসে সিরিয়ার বিদ্রোহীদের অস্ত্রায়ণ ও ন্যাটোর ভবিষ্যৎ নিয়ে উত্তপ্ত আলোচনা শুনি। ক্যালভিন পিটার হপকিনস লেবার পার্টির এমপি।
তাঁর বহু ভোটার বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত। সে কারণে তিনি বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আগ্রহ দেখিয়েছেন।
আমার সফরকালে পর্তুগালের রাজধানী লিসবনে এবং স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদে বহু বাংলাদেশির সঙ্গে সময় কাটানোর সুযোগ হয়েছিল। যেহেতু আমার চেহারা পরিচিত এবং নির্বাচন কমিশনে পাঁচর বছর দায়িত্ব পালন করেছি, সেহেতু দেশের পরিস্থিতিতে আলোচনায় আগ্রহী ছিলেন। লিসবনে অনেক বাংলাদেশিই দুই যুগের বেশি সময় ধরে রয়েছেন।
প্রথম দিকে যেনতেনভাবে থাকলেও বর্তমানে প্রায় ছয়-সাত হাজার বাংলাদেশি মোটামুটিভাবে, ব্রিটেন বাদে, ইউরোপের অন্যান্য শহর থেকে গড়পড়তা ভালো আছেন বলে জানিয়েছেন। লিসবনে তাঁদের প্রায় সবাই কাপড় থেকে অন্য দ্রব্যাদির পাইকারি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। তাঁরা বলেছেন যে ইউরোপীয় মন্দার আগে যথেষ্ট সচ্ছল ছিলেন। মন্দার কারণে ব্যবসায় ভাটা পড়লেও একেবারে খারাপ নয়। অনেকের নিজস্ব দোকান রয়েছে।
বিদেশে নিজেদের অর্থনৈতিক অবস্থা অনেক ভালো হলেও প্রায় সিংহভাগ প্রবাসী দেশের আগামী দিনের রাজনীতি ও রাজনৈতিক দলগুলোর সংঘাতময় পরিস্থিতি নিয়ে শঙ্কিত। যাঁদের সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছে, তাঁদের সিংহভাগই বর্তমান শাসক দলের অনুসারী। অনেকে বৈদেশিক শাখার সক্রিয় সদস্যও, যদিও আইনগতভাবে বৈদেশিক শাখা থাকার কথা নয়। তাঁদের উৎকণ্ঠা আগামী নির্বাচন নিয়ে। তাঁরা শাসক দলের ক্রমাগত জনপ্রিয়তা হারানোর কারণগুলো বুঝতে পেরেছেন।
নির্বাচনের আগেই তাঁরা গাজীপুরে ভরাডুবি হবে আঁচ করতে পেরেছিলেন। তাঁদের একটি প্রশ্ন, শাসক দল এমন অবস্থায় কেন পড়েছে? কোনো কোনো মন্ত্রীর যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। হেফাজতে ইসলাম এবং বিরোধী দলের সঙ্গে সরকার বা সরকারি দলের আচরণই ছিল অপ্রত্যাশিত। তাঁদের প্রশ্ন ছিল, এর পরে কী? যার উত্তর আমার কাছে ছিল না।
একই ধরনের মন্তব্য পেয়েছিলাম স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদে, যেখানে প্রায় ১০ হাজার বাংলাদেশির নিবাস।
সিংহভাগই স্প্যানিশ নাগরিক। মূলত রেস্তোরাঁ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। স্পেনের অর্থনৈতিক অবস্থা পর্তুগালের চেয়ে কিছুটা ভালো। পর্তুগালের বর্তমান কোয়ালিশন সরকারের প্রধান শরিক সোশ্যাল ডেমোক্রেটরা অর্থনৈতিক মন্দার কারণে যে ধরনের চাপের মধ্যে রয়েছে, তাতে আগাম নির্বাচনের সম্ভাবনা রয়েছে। দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর থেকে বেশ বিপাকে রয়েছে শাসক দল।
এ অভিযোগ উত্থাপন করেন পার্টির সাবেক ট্রেজারার। তিনি অভিযোগ করেন যে তাঁর এক কালের পার্টি ঠিকাদারদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের ঘুষ নিয়েছে। তাঁর মতে, ২০ বছর ধরে এ দল এ দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। যদিও দল থেকে এ অভিযোগ খণ্ডন করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। এ নিয়ে মাদ্রিদে প্রায়ই বিক্ষোভ হচ্ছে।
এসবের কারণে স্পেন অর্থনৈতিক মন্দাভাব কাটিয়ে উঠতে পারছে না। এমনই ভাষ্য বাংলাদেশিদের।
মাদ্রিদেও যেসব বাংলাদেশি রয়েছেন, তাঁরা বয়সে তরুণ হলেও দেশের রাজনীতির সঙ্গে পরোক্ষভাবে জড়িত। সরকারি দলের সমর্থকই বেশি। তাঁদের সিংহভাগ দেশে সরকারি দলের ব্যর্থতা নিয়ে উদ্বিগ্ন।
তাঁরা বাংলাদেশের রাজনীতি ও রাজনৈতিক দলগুলোকে ওই সব দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন এবং রাজনৈতিক দলের গণতান্ত্রিক মনোভাব ও আচরণের অনুকরণে দেখতে চান। এটি বড় চাওয়া নয়। এসব তরুণ বাংলাদেশির সঙ্গে আমার আলোচনা এবং সাক্ষাতে মনে হয়েছে যে তাঁরা সব দলের সমর্থক, দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ নিয়ে বীতশ্রদ্ধ। এমন অবস্থা ব্রিটেনেও প্রত্যক্ষ করেছি। তবে ব্রিটেনে তরুণ বাংলাদেশি এবং প্রবীণদের চিন্তাচেতনার মধ্যে অনেক তফাত।
তরুণেরা স্থানীয় রাজনীতিতে যুক্ত হতে চান। দেশের রাজনীতি নিয়ে বিদেশে বিভাজনে অনেকেই বিরক্তি প্রকাশ করেছেন। সুখের বিষয় এই যে ব্রিটেনে জন্মগ্রহণকারী বহু তরুণ সেখানকার রাজনীতিতে নিজেদের জায়গা করে নিতে তৎপর। উদাহরণস্বরূপ শেখ রেহানার মেয়ে টিউলিপ, যিনি বর্তমানে একজন কাউন্সিলর এবং আগামী নির্বাচনে লেবার পার্টির মনোনয়ন লাভ করেছেন। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ লেবার পার্টির এমপি রুশনারা আলী অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন তরুণ ব্রিটিশ বাংলাদেশিদের স্থানীয় রাজনীতিতে যুক্ত হতে।
তবে ব্রিটেনে ব্রিটিশ বাংলাদেশি তরুণদের মধ্যে কিছুটা পরিবর্তন লক্ষণীয় হলেও আগের প্রজন্ম এবং সদ্য ব্রিটেনে আগত ব্যক্তিদের মধ্যে দেশের রাজনৈতিক সংঘাতকে বিদেশে টেনে নেওয়ার প্রবণতা কমেনি। পরিবর্তন হয়নি চিন্তাচেতনায়। আমার অবস্থানকালে ব্রিটেনে প্রধানমন্ত্রীর আগমনের সময় বিরোধী দলের অঙ্গসংগঠন কর্তৃক কালো পতাকা প্রদর্শন সেখানকার ব্রিটিশ বাংলাদেশি তরুণ প্রজন্ম সহজভাবে নেয়নি। বিদেশে এ ধরনের বিকৃত রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিচয় শুধু বাংলাদেশিরাই দিয়ে থাকেন। উপমহাদেশের অন্য কোনো দেশের বিদেশে অবস্থানরত নাগরিকদের মধ্যে দেশের রাজনীতি নিয়ে এত উত্তেজনা দেখা যায় না।
২
ব্রিটিশ লেবার পার্টির নর্থ লুটনের এমপি ক্যালভিন হপকিনসের কথা বলেছিলাম। ব্রিটেনে হাউস অব কমন্সের অনেক এমপির বিরুদ্ধে অতিরিক্ত ভাতা গ্রহণের এবং বাসাবাড়ির অতিরিক্ত ভাড়া তোলাসহ অন্যান্য বিষয়ে প্রচুর অভিযোগ উঠেছে। এমনকি অনেকের বিরুদ্ধে তদন্তও চলমান, এমন পরিস্থিতিতেও ক্যালভিন হপকিনসের সততার প্রশংসায় সবাই পঞ্চমুখ। লেবার পার্টির এই এমপি লন্ডনে নয়, নর্থ লুটনে থাকেন এবং পার্লামেন্টে ট্রেনে চড়ে যাতায়াত করেন। এর আগে ব্রিটেনে সফরের সময় এমন এক ট্রেনেই ক্যালভিনের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল।
যাহোক, ক্যালভিন হপকিনস আমাকে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক অচলাবস্থার কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। আমার উত্তর শুনে তিনি বললেন যে গণতন্ত্রে আস্থার অভাব থাকলে সে গণতন্ত্র কার্যকর হতে পারে না। তিনি আরও বললেন যে তাঁদের দেশেও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সরকারি দলের পরাজয়কে সরকারের বিরুদ্ধে জনগণের অনাস্থারই বহিঃপ্রকাশ বলে ধরে নেওয়া হয়। তাঁর মতে, ব্রিটেনে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ফলাফলই সরকারি দলের ভবিষ্যৎ বলে দেয়। অনেক সময় এসব নির্বাচনের ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে সরকারি দল মধ্যবর্তী অথবা আগাম নির্বাচন দিয়ে থাকে।
দুদিন পরে ছিল গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন। তাই তিনি গাজীপুর সম্বন্ধেও জানতে চেয়েছিলেন।
এই ব্রিটিশ এমপি, যিনি সংগত কারণেই বাংলাদেশের রাজনীতির কিছুটা খোঁজখবর রাখেন, জানালেন যে বাংলাদেশে আগামী নির্বাচনে সব দলের বিশেষ করে প্রধান দুই দলের যেকোনো একটির অংশগ্রহণ না থাকলে সে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না। পৃথিবীর সব গণতান্ত্রিক
দেশে সব দলের অংশগ্রহণেই নির্বাচন হয়ে থাকে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে আস্থার অভাব রয়েছে, তা দূর করতে হলে সব দলকে একত্রে কাজ করতে হবে।
তবে সব দেশে এ ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকাই থাকে মুখ্য।
আমি জানতে চেয়েছিলাম স্থানীয় উন্নয়ন অথবা স্থানীয় সরকারের সঙ্গে ব্রিটেনে এমপিদের সম্পৃক্ততা কতখানি। তিনি বললেন, কোনো এমপির এতে সম্পৃক্ততাই নেই। স্থানীয় উন্নয়ন স্থানীয় সরকারের বিষয়। স্থানীয় সরকার নিজেদের মতো চলে, যেখানে এমপিদের হস্তক্ষেপ অথবা পরামর্শ দেওয়ার সুযোগ নেই।
স্থানীয় উন্নয়নের দায়িত্ব অথবা কোনো ধরনের আর্থিক বরাদ্দ এমপিদের দেওয়া হয় না। তিনি হেসে বললেন যে ওই ধরনের বরাদ্দ দিলে প্রতিদিন একজন করে এমপিকে দুর্নীতির অভিযোগে পদত্যাগ করতে হতো। তবে তিনি জানালেন যে প্রত্যেক সংসদীয় এলাকায় এমপিদের জন্য নির্ধারিত অফিস ও স্টাফ রয়েছে, যার খরচ সরাসরি সরকার বহন করে। এমপিদের ভাতা, ভ্রমণভাতা এবং দ্বিতীয় আবাসস্থলের ভাতা দেওয়া হয়। আর দ্বিতীয় আবাসস্থলের সচরাচর লন্ডনে থাকার জন্য ভাড়া নিয়েই যত কেলেঙ্কারি।
আমার জিজ্ঞাস্য ছিল ব্রিটেনে নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থার কথা। তিনি জানালেন, হালে পার্লামেন্টের মেয়াদ পাঁচ বছরের জন্য নির্ধারিত করা হয়েছে। তবে নির্বাচন তা মধ্যবর্তী হোক অথবা পূর্ণ মেয়াদে হোক, পার্লামেন্ট অবলুপ্ত হওয়ার পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তত্ত্বাবধানে প্রায় ১৫ থেকে ২০ দিনের মধ্যেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। পার্লামেন্ট বহাল রেখে নির্বাচনের নজির নেই। ব্রিটেনে নির্বাচন কমিশন শুধু নীতি প্রণয়ন এবং দলের নিবন্ধন ইত্যাদি করে থাকে।
নির্বাচন কমিশন আইন ও নীতি অনুযায়ী স্থানীয় কাউন্সিলর নির্বাচন করে থাকে। নির্বাচন কমিশন তদারকির দায়িত্বে থাকে মাত্র।
ব্রিটেনে নির্বাচন একটি নৈমিত্তিক ব্যাপার। তেমন উত্তেজনা সৃষ্টি হয় না। ব্রিটিশ নাগরিকদের অনেকে ভোট প্রদানেও তেমন উৎসাহী হন না।
ভোট প্রদানের হারও আমাদের তুলনায় অনেক কম।
৩
পৃথিবীর প্রায় সব গণতান্ত্রিক দেশে ব্রিটিশ পদ্ধতিতেই নির্বাচনকালীন সরকার গঠিত হয়, বিশেষ করে যেসব দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থার অভাব নেই এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো শক্ত ভিতের ওপর প্রতিষ্ঠিত। তবে আমাদের দেশে যেহেতু আস্থার অভাব রয়েছে, যার বহু যৌক্তিক কারণও রয়েছে, সেখানে ব্রিটিশ পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে হলে সব দলের মতামতের ওপর ভিত্তি করেই করতে হবে। সরকারের একক সিদ্ধান্ত হিতে বিপরীত হবে। বিশেষ করে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বলতার কারণে এ আস্থার অভাব আরও প্রকটভাবে দৃশ্যমান।
দুঃখজনক যে আমাদের দেশে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে যেভাবে গড়ে উঠতে দিতে যে ধরনের রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রয়োজন, সেখানে বেজায় ঘাটতি রয়েছে। সে ঘাটতি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আমাদের দেশের রাজনীতি বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে আবদ্ধ থাকবে। কাজেই আগামী নির্বাচনের আগেই অবিশ্বাসের ক্ষেত্র সংকুচিত করতে হবে। বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন কেমন হবে তা শুধু বাংলাদেশের বিষয়ই নয়, সমগ্র বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলো তাকিয়ে থাকবে এ নির্বাচনের দিকে। তেমনটাই আমার মনে হয়েছে এ স্বল্প সময়ের ভ্রমণে।
এম সাখাওয়াত হোসেন: সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও কলাম লেখক।
hhintlbd@yahoo.com।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।