আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

লাশ নম্বর ১৬!

আমি লাশ নম্বর ১৬ বলছি। আগে আমার নাম ছিল। পরিচয় ছিল। কিন্তু সর্বগ্রাসী আগুন আমাকে পুড়ে কয়লা বানিয়ে দিয়েছে। আগুনের তাপে আমার শরীরের সব মাংস গেছে ঝলসে।

আপনারা কেউ চিতার আগুনে কোনো লাশ পুড়ে যেতে দেখেছেন কিনা জানি না। চিতার আগুনে লাশ নাকি 'জ্যান্ত' হয়ে ওঠে! আসলে আগুনের প্রচণ্ড তাপে শরীর মৃত শরীরও বেঁকে যায়। তখন দেখে বিভ্রম জাগে। মনে হয় লাশটা নড়ছে। একবার ভাবুন, শুধু একবার ভাবুন, আমাকে পোড়ানো হয়েছে জ্যান্ত লাশ হিসেবে।

আমি বেঁচে ছিলাম। বেঁচে থেকেই দেখেছি কীভাবে আগুনের সমুদ্র গিলে খাচ্ছে আমাকে। এর চেয়ে ভয়ংকর পরিণতি আর কী হতে পারে মানুষের! এর চেয়ে যদি বাসের তলে চাপা পড়তাম! কিংবা কেউ যদি গুলি করে খুন করত আমাকে! আমি লাশ নম্বর ১৬ বলছি। আমাকে বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়েছে জুরাইনে। আমার মতো আরও অনেকের লাশ এভাবে মাটিচাপা পড়েছে।

কবরে শুয়ে শুয়ে আমি দেখছি, কীভাবে আমাদের দেশের হাজার কোটি টাকার মালিক পোশাক শিল্পের কর্তাব্যক্তিরা মাটিচাপা দেওয়ার তোড়জোড় করছেন এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড। তারা অপেক্ষায় আছে, কিছুদিন পেরিয়ে গেলেই আবার ঠান্ডা হয়ে যাবে সব। ফ্যাক্টরির আগুন নিভে এসেছে। মানুষের ক্ষোভের আগুনও নিভে যাবে একদিন। আমাদের শোকের আয়ু যে মাত্র কয়েক ঘণ্টার।

টিভিতে আমাদের পুড়তে দেখার খবর দেখে আপনিও তো দিব্যি রাতের খাবার খেয়েছেন। পরদিন সকালে হিন্দি গানের সুর ভাঁজতে ভাঁজতে করেছেন গোসল। অফিস করেছেন। স্ত্রীর সঙ্কে খুনসুটি করেছেন। আপনার ছোট্ট বাচ্চাটির সঙ্গে খেলেছেন কিছুক্ষণ।

কেউ জানেনি, জানতে চায়নি আমার স্ত্রী আছে কিনা। বাচ্চা আছে কিনা। আমিও এমন পরম মমতায় আমার সন্তানকে কোলে তুলে নিতাম কিনা। কারো কাছে মানুষ আমার কোনো অস্তিত্ব এখন নেই। আমি লাশ নম্বর ১৬।

কিন্তু আমার মৃত্যু আছে, মরণ নেই। আমি আবার এসেছিলাম। আজ বিজিএমইএ ভবনে, আমাদেরই রক্ত-হাড় শুষে নেওয়া টাকায় গড়ে ওঠা সুরম্য অট্টালিকার সামনে আমি আবার এসেছিলাম। সাদা কাফনের সামনে শুয়েছিলাম। ঠাঠা রোদ উপেক্ষা করে কয়েক শ মানুষ এসেছিলেন সেখানে।

প্রথমে অনেকেই মনে করেছিলেন, এ বুঝি কোনো সার্কাস। অনেকের মুখে দেখেছি কৌতুকের হাসি। কিন্তু ধীরে ধীরে সেই হাসি উবে গেছে। শুয়ে থাকার সময় মানুষের কথা আমার কানে ভেসে আসছিল। তাদের হৃদয়ে স্পন্দিত প্রতিবাদের সুর আমি অনুভব করছিলাম।

না, বিজেএমইএর কোনো কর্তাব্যক্তি আসেননি এখানে। এসির আরামদায়ক উষ্ণতায় নিরাপদ দূরত্ব থেকে এই 'মশকরা' দেখেছেন। মানুষের প্রতিবাদের উত্তাপ তাই তারা টের পায়নি। ওরা জানে না, ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরির মতো ভয়ংকর কিছু আর পৃথিবীতে নেই। একবার মানুষের মনের এই পুষে রাখা ক্ষোভের আগুন উসকে গেলেই কিন্তু সমূহ বিপদ।

সেই প্রতিবাদের আগুনে তারাও একদিন পুড়বে নিশ্চয়ই। পুড়ে খাক হবে আমার মতোই। চেনা যাবে না তাদের চেহারা। পরিচয় বলতে থাকবে শুধুই একটি নম্বর। আমি লাশ নম্বর ১৬, আমার কবরে এখনো এই পাপীদের স্থান করে দেওয়ার মতো যথেষ্ট জায়গা... (Rajib Hasan) ।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।