সাইফ শাহজাহান
রণেশ মৈত্র
সিলভার বার্ডেট
শাহজাহান মাহমুদ
পঞ্চাশের দশকের পূর্ব বাংলার গণআন্দোলনে, বিশেষত ছাত্র আন্দোলনে বেশ কিছু শব্দ বা শব্দগুচ্ছ তুমুল আলোড়ন তুলেছিল। এগুলো হলো, ‘সিলভার বার্ডেট কোম্পানি’, ‘পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি,’ ‘সিয়াটো চুক্তি,’ ‘সেন্টো চুক্তি,’ ‘বাগদাদ চুক্তি’ প্রভৃতি। হাজারো কণ্ঠে উচ্চারিত স্লোগানের আওয়াজে পরিণত হয়েছিল, ‘সিলভার বার্ডেট কোম্পানির চুক্তি বাতিল কর,’ ইত্যাদি। এর মধ্যে প্রথমোক্তটি বাদে অর্থাৎ ‘সিলভার বার্ডেট কোম্পানির চুক্তি বাতিল কর’Ñ এই স্লোগানটি বাদে অপর স্লোগানগুলো ষাটের দশকেও সর্বত্র উচ্চারিত হতো দেশজুড়ে। আর ‘সিলভার বার্ডেট কোম্পানির চুক্তি বাতিল কর’ স্লোগানটি ঐ পঞ্চাশের দশকেই হারিয়ে যায়Ñ কারণ তার প্রয়োজনীয়তা ঐ দশকেই নিঃশেষিত হয়।
আর এই স্লোগানগুলোর মূল উদগাতা ছিল বামপন্থীরাÑ অর্থাৎ পঞ্চাশের দশকে, ‘পূর্ব-পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের’ নেতা-কর্মীরা। ১৯৫৭ সালে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠিত হওয়ার পূর্বপর্যন্ত বস্তুত ছাত্র ইউনিয়নকেই সাম্রাজ্যবাদ, সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর সঙ্গে অসম এবং জাতীয় সার্বভৌমত্ব হরণকারী নানাবিধ চুক্তি ও সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে এককভাবেই আন্দোলন-সংগ্রাম গড়ে তুলতে হয়েছে। এ ছাড়াও তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগও নিষ্ঠার সঙ্গে সোচচার ছিল এ সকল প্রশ্নে। তবে, সময় সময় এ আন্দোলনে ছাত্র ইউনিয়ন তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ এবং এমনকি, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগকেও সম্পৃক্ত করতে পেরেছিল।
সিলভার বার্ডেট কোম্পানির সঙ্গে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড (তখন মাধ্যমিক শিক্ষার জন্য পূর্ববাংলায় একটিই মাত্র বোর্ড ছিল) এক চুক্তি স্বাক্ষর করে মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যবইগুলোর একটি বড় অংশের ছাপানোর দায়িত্ব এককভাবে ঐ কোম্পানিকেই অর্পণ করে।
ঐ কোম্পানিটি একটি বৃটিশ কোম্পানি ছিল বলে মনে পড়ে। অত বই এককভাবে ছাপার অধিকার পাওয়ার অর্থ ছিল ঐ বিদেশি কোম্পানিটি বিপুল পরিমাণ লভ্যাংশ বিদেশে পাচার করবে অথচ বোর্ড যদি নিজেই ছাপে অথবা যদি দেশীয় প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলোকে এ দায়িত্বটি দিতো তবে লভ্যাংশের টাকাটা দেশের মাটিতেই থেকে যেতো। জাতীয় স্বার্থের এই দেশপ্রেমিক-চিন্তা থেকে ছাত্র ইউনিয়ন এই চুক্তির বিরোধিতা করে এবং তা বাতিলের দাবি জানায় সমগ্র পূর্ববাংলা জুড়ে। পাবনাতেও ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে ঐ দাবিতে তুমুলভাবে সোচ্চার হয়েছিলামÑ যতদূর মনে পড়ে ১৯৫৩ সালে। তখন আমার একান্ত প্রিয় সহকর্মী শাহজাহান মাহমুদ আরও অনেকের মত এই আন্দোলনকে অত্যন্ত আপন মনে করে নিয়েছিল।
এর মধ্যে আবার শাহজাহান মাহমুদ ছিল অত্যন্ত ব্যতিক্রমী। ঐ দাবির আন্দোলন ছাড়াও ঐ সময়ের বন্দি মুক্তি আন্দোলন, শিক্ষার নানা দাবিতে আন্দোলন, মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে বিভিন্ন আন্দোলনÑ যখন যে আন্দোলন নিয়েই মিছিল, মিটিং, সমাবেশের আয়োজন পাবনাতে করা হতো, সেই দাবিগুলোর সপক্ষে স্লোগান তোলা, বক্তৃতা করা, পোস্টারিং করা ইত্যাদি যাই করা হোক না কেনÑ ‘সিলভার বার্ডেট কোম্পানির চুক্তি বাতিল কর’Ñ এই স্লোগানটি প্রাসঙ্গিক-অপ্রাসঙ্গিক যাই হোক না কেন, অবশ্য অবশ্যই তুলে ফেলতো বন্ধুবর শাহজাহান মাহমুদ। তাই এক পর্যায়ে আমরা বড় রসিকতা করে শাহজাহান মাহমুদের নাম দিয়েছিলাম ‘সিলভার বার্ডেট শাহজাহান মাহমুদ’। যতদূর ধারণা হয়, তৎকালীন আমাদের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সহকর্মী পাবনা ছাত্র ইউনিয়নের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা নেতা আবদুল মতিন (বর্তমানে দৈনিক জনকণ্ঠের সম্পাদকীয় বিভাগে কর্মরত) এই নামটি দিয়েছিল। আর আমরাÑ অর্থাৎ আমি, কামাল লোহানী, খালিদ হাসান, জয়নুল আবেদীন, মোজাম্মেল হক, নূরুদ্দিন আহমেদ, আনোয়ারুল হক, পরেশ দে, আলী নওয়াব খান, হাবিবুর রহমানসহ প্রায় সকল ছাত্র ইউনিয়ন নেতাই তখন তাকে ঐ নামে ডাকতাম।
মনে হতো, শাহজাহান মাহমুদ তাতে গর্বিতই হতোÑ তাই এই নামটি সে যেন মেনেই নিয়েছিল। আমাদের সবার ছাত্রজীবন শেষ হওয়ার বেশ কিছুদিন পর পর্যন্তও ঐ আন্দোলনের স্মৃতি হিসেবেই অনেকটা, শাহজাহান মাহমুদকে ঐ নামেই ডাকতাম এবং সে সাড়াও দিতো। পরে অবশ্য স্বভাবতই আমাদের সবার বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঐ নামে না ডেকে তাকে তার আসল নামেই আমরা ডাকতাম।
এই শাহজাহান মাহমুদের কথাই আজ লিখতে বসেছি। সে আর বেঁচে নেই।
প্রায় ১৮ বছর আগে, ১৯৮১ সালের কোন একদিনে (তারিখটা ২৯ নভেম্বর ১৯৮১) শাহজাহান মাহমুদ তার একমাত্র শিশুপুত্র-সন্তান, কিছু আÍীয়স্বজন এবং বিপুল সংখ্যক সহকর্মীকে ছেড়ে পরলোকে চলে যায়। আর, নিষ্ঠুর এক ‘সামাজিক স্বাভাবিকতার’ শিকার হয়ে আমরা সবাই যেন তাকে যথারীতি ভুলে বসে আছি। আর করারই বা কি আছে? যতদিন বেঁচে থাকবো- ততদিন মনের মণিকোঠায় তাকে অত্যন্ত যতেœর সঙ্গে স্থান দিয়ে রাখতে পারলেই মনে করবো যথেষ্ট। কোনও বড় নেতা, কোনও কেন্দ্রীয় নেতা, কোনও এমপি, কোনও মন্ত্রী, কোনও বড় আমলাতো শাহজাহান মাহমুদ ছিল না। তাই তার জন্য আমরা ভাববোই বা কেন? সমাজই বা তাকে মনে রাখবে কেন? প্রচলিত বাস্তবতায় এটিই সত্য- তা সে যতই নিষ্ঠুর হোক না কেন।
তবুও আনন্দ লাগবে যদি রাধানগরের যুগীপাড়ার হালের অধিবাসীরা একটু উদ্যোগ নিয়ে কোনও একটা ছোট রাস্তা বা একটি ক্লাব বা একটি পাঠাগারও শাহজাহান মাহমুদের নামে গড়ে তোলেন, তবে বড়ই যথার্থ একটি কাজ হয়। এ কাজে আমরা দু’ চারজন আজও যারা তার আজীবন বন্ধু ছিলাম সামান্য হলেও আন্তরিক সহযোগিতা দেবো- প্রকাশ্যে এই লিখিত প্রতিশ্র“তিও দিয়ে রাখলাম এই নিবন্ধটি লেখার সুযোগে।
কেন মনে রাখবো শাহজাহান মাহমুদকে? শুধুই কি এ কারণে যে সে ছাত্র ইউনিয়ন এবং তার পরবর্তী জীবনে ন্যাপ করতো? হ্যাঁ, এগুলোও ফ্যাক্টর। তবে সবার চাইতে বড় ফ্যাক্টর যেটি তা হলো তার নির্মল নিঃস্বার্থ দেশপ্রেম, সৎ সাধারণ জীবনধারা ও সকল চাওয়া-পাওয়ার ঊর্ধ্বে থেকে, চরম দারিদ্র্য ও নানা বেদনাদায়ক পরিস্থিতিকে নীরবে অথচ দৃঢ়ভাবে মোকাবিলা করেই জীবনটি কাটিয়ে দিয়েছে। ‘মানুষ মানুষের জন্য’ এ কথাটি যে কত গভীরভাবে আÍস্থ করতে পেরেছিল শাহজাহান মাহমুদÑসাম্প্রদায়িকতাকে যে কত বেশি ঘৃণা করতো শাহজাহান মাহমুদÑ তা শুধুমাত্র আমরা যারা ঐ কৈশোর-যৌবনের সন্ধিক্ষণে এক মহান কর্মযজ্ঞের ব্রত নিয়ে একাÍ হয়ে গিয়েছিলাম- বিষয়টি তারাই শুধু জানি।
আজ প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে নব নব প্রজš§ চলে আসছে- জুড়ে নিচ্ছে স্বভাবতই পুরাতনদের পরিত্যক্ত স্থানÑ তাই আমাদেরই নীরবতা ও নিষ্ক্রিয়তা বা উদাসীনতার ফলে এই নতুন প্রজš§Ñ যারা ঐ পাবনা শহরের রাধানগরের যুগীপাড়ার নব প্রজš§সমূহের সন্তানÑ তারা জানতেও পরছে নাÑ কে ছিল শাহজাহান মাহমুদÑ আর কেনই বা সে স্মরণীয়। তাদেরকে জানানো জন্য আর নিজের বিবেকের তাড়ানায়Ñআজকের এই লেখাটি।
শাহজাহান মাহমুদের জš§স্থান চৌহালি থানার হাটঘোরজান গ্রাম। স্কুল শিক্ষক প্রয়াত পিতা তমিজ উদ্দিন মুন্সীকে ১৯৪২ সালে সপরিবারে ঐ গ্রাম ছেড়ে পাবনা শহরে চলে আসতে হয়Ñ রাধানগরের যুগীপাড়ায় বাসা ভাড়া নিয়ে পরিবার-পরিজনসহ প্রচণ্ড আর্থিক টানাটানির মধ্যে নতুন জীবন শুরু করতে বাধ্য হতে হন ঘোরজান গ্রামের পৈতৃক বাড়িটি নদী ভাঙনের শিকার হয়ে যমুনার অতলে তলিয়ে যাওয়ায়। সেই অবধি চরম দারিদ্র্য ছিল শাহজাহান মাহমুদের আমৃত্যু নিত্যসঙ্গী।
পাবনার রাধানগর মজুমদার একাডেমী থেকে ১৯৫১ সালে শাহজাহান মাহমুদ ম্যাট্রিক পাশ করে প্রথম বিভাগে ইংরেজি ও উর্দুতে লেটার মার্কসসহ। এর পরই অর্থাৎ একই বছরে শাহজাহান মাহমুদ পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে আইএ-তে ভর্তি হয়। ১৯৫১ সালে আমরা যখন ছাত্র ইউনিয়ন গঠন করি তখনই শাহজাহান মাহমুদ তাতে সম্পৃক্ত হয়Ñ যুক্ত ছিল ১৯৫৭ সাল থেকে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সঙ্গেও আজীবন। যদিও নানা কারণেই তার রাজনৈতিক জীবন সত্তরের দশক থেকেই তেমন একটা সচল থাকতে পারেনিÑ ধারাবাহিকতা রক্ষিত হয়নি। অন্য কিছু নয়, এর জন্য তার জীবন সংগ্রামের কঠিন-কঠোর পরিস্থিতিগুলোই ছিল দায়ী।
সর্বক্ষণ দেশের কাজে যুক্ত থাকার অদম্য আগ্রহ এ সকল প্রতিকূলতা তাকে দমিত করে রাখলেও, চিন্তায় ও মননে শাহজাহান মাহমুদ ছিল একজন সার্বক্ষণিক রাজনীতিকÑ একজন নিষ্ঠাবান বামপন্থী।
১৯৫৩ সাল। মুসলিম লীগের প্রাদেশিক সম্মেলন পাবনাতে। বাহান্নর ভাষা আন্দোলনে গুলি চালনার পর থেকে তারা এমনই গণবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল যে পূর্ব বাংলার কোথাও তারা জনসভা করতে সাহস পাচ্ছিল না। কেন জানি না, তারা বেছে নিয়েছিল পাবনাকে ঐ সম্মেলনের জন্য।
সম্মেলনের তারিখ ১৫ ফেব্র“য়ারিÑ পাবনার ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রলীগ মিলে আমরা সিদ্ধান্ত নিলামÑ নূরুল আমিন খুনী মুখ্যমন্ত্রীÑ তাকে আমরা আসতে দেবো না পাবনা। ঐ সম্মেলনে যে সকল মুসলিম লীগ নেতা আসবার কথা এবং এসেছিলেনও তারা হলেন নূরুল আমিন, খান আবদুল কাইউম খান, সরদার আবদুর রব নিশতার প্রমুখ। নূরুল আমিনসহ নেতারা এসে সার্কিট হাউসে পৌঁছে গেলেন সকাল ১০টা স্থলে ভোর ৭টায়। অর্থাৎ ১০টার আয়োজিত বিক্ষোভ ও কালো পতাকা মিছিল এড়াতে। নেতাদের পৌঁছে যাওয়ার খবর পেয়ে আমরা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে সার্কিট হাউসের সামনে দীর্ঘসময় বিক্ষোভ দেখাই।
আবার বিকেলে, সম্মেলনের নির্ধারিত সময় (বেলা তিনটা) ও নির্ধারিত স্থান জিন্নাহ পার্কে (বর্তমানে পাবনা স্টেডিয়াম) আমরা পুনরায় বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে যাবার পথে সশস্ত্র মুসলিম লীগ গুণ্ডাদের অতর্কিত আক্রমণে ৮/১০ জন ছাত্র নেতা ও কর্মী গুরুতর আহত হন। ফলে বিক্ষোভ মিছিল সকল ব্যারিকেড ভেঙ্গে ঢুকে পড়ে সম্মেলন স্থলে। হইচই, চিৎকার, স্লোগান, চেয়ার টেবিল, প্যান্ডেল ভেঙ্গে ফেলাÑ সবই করলো হাজার হাজার বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা। কোনও নেতা বক্তৃতা করা তো দূরের কথাÑ সবাই পেছন দিয়ে গাড়িতে চড়ে ব্যাপক পুলিশ প্রহরায় পালিয়ে যেতে বাধ্য হলেন। প্রতিবাদে পরদিন সমগ্র শহরে সকাল-সন্ধ্যা পূর্ণ হরতাল আহবান করলাম।
পরদিন ১৬ ফেব্র“য়ারি ছাত্রলীগ নেতা শামসুদ্দোহাকে একজন মুসলিম লীগ নেতা বেদম প্রহার করলো সকালে পথিপার্শ্বস্থ এক চায়ের দোকানে চা খাওয়ার সময়। সঙ্গে সঙ্গে আগুনের মত খবর ছড়িয়ে পড়লো সারা শহরে। হাজারো হাজারো মানুষ ছুটলো ঐ মুসলিম লীগ নেতা ডাক্তার মোফাজ্জল হোসেনের বাড়ি অভিমুখে। বিক্ষুব্ধ জনতা ইট পাটকেল ছুঁড়ছে ঐ বাড়ি লক্ষ্য করে। ডাক্তার মোফাজ্জল হোসেনসহ পরিবারের সকল সদস্য ঘরের সকল দরজা-জানালা বন্ধ করে ভীতসন্ত্রস্ত অবস্থায় থাকতে থাকতে আকস্মিকভাবে একটু জানালা খানিকটা ফাঁক করে বন্দুক থেকে গুলি ছুঁড়ে বসে জনতার ওপর।
কয়েকজন পুনরায় আহত হয়। বিক্ষুব্ধ জনতা তখন বাড়িটি পুড়িয়ে দেওয়ার পাঁয়তারা করছে। আমরা ছাত্রনেতারা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করলেও গুলি ছোঁড়ার চরম উস্কানির পর তা দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছিল। হঠাৎ লরিকে লরি পুলিশ এসে নেমে পড়ে জনতার প্রতি ব্যাটন চার্জ ও গণগ্রেফতার শুরু করে।
লরি বোঝাই আটক নেতৃবৃন্দ ও সাধারণ বিক্ষোভরত মানুষ নিয়ে তারা জেলখানায় চলে যায়। আবার তাদের নামিয়ে রেখে ঘটনাস্থলে চলে আসে গ্রেফতারের লক্ষ্যে। আমরা তখন স্লোগান তুলি, ‘চল চলÑ জেলে চল, লীগশাহী খতম কর। ’ চারিদিক থেকে পুলিশ ঘেরাও করে ফেলে বেদম লাঠিচার্জ- বেপরোয়া গ্রেফতার- ১৪৪ ধারা জারি ইত্যাদির মাধ্যমে ওদের হাতের সকল অস্ত্রই নির্মমভাবে প্রয়োগ করতে শুরু করলে মিছিল ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। ঐ অবস্থায় বহু কষ্টে গ্রেফতার এড়িয়ে আমরা কয়েকজন অন্যত্র সটকে পড়ে সিদ্ধান্ত নেইÑ পরদিন পুনরায় হরতাল করা হবে।
সকল বন্দীদের মুক্তির দাবিতে, গুলি চালনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত ও ১৪৪ ধারা প্রত্যাহারের দাবিতে। শহরের পরিস্থিতি থমথমেÑ একদিকে হরতালÑ অপরদিকে ক্ষিপ্ত পুলিশ বাহিনী সারা শহরে দিনভর গ্রেফতার চালাচ্ছিল নির্বিচারে।
এমত অবস্থায় সিদ্ধান্ত তো নিলাম পর দিন হরতালের কিন্তু কার্যকর করি কিভাবে? প্রচার করি কিভাবে? সন্ধ্যায় গেরিলা কায়দায় কয়েক গ্র“পে বিভক্ত হয়ে কখনো এ মোড়, কখনও সে-মোড় হরতালের সপক্ষে স্লোগান দিয়েই কেটে পড়া। একইভাবে রাত ১০টা অবধি পাড়ায় পাড়ায় প্রচার। এ ক’দিনই সকল ভয়ভীতি উপেক্ষা করে সকল কাজে যে কর্মীটি খেয়ে না খেয়েÑ আদৌ না ঘুমিয়ে কাজ করে চললোÑ নানা জায়গায় নানা কর্মী ও নেতার গ্রেফতারের খবর আমাদের গোপন আস্তানায় পৌঁছে দিলোÑ তার নাম শাহজাহান মাহমুদ।
শুধু তাই নয়, কোথায় থেকে কাগজ-কলম জোগার করে পোস্টার লিখে গোপনে দেয়ালে দেয়ালে সেঁটে দিয়েছে হরতালের সপেক্ষেÑ সে-ও আমাদের শাহজাহান মাহমুদ অসম সাহসিকতার সঙ্গে আমরা না বলতেই।
সে যুগের সকল আন্দোলনেই শাহজাহান মাহমুদকে এই ভূমিকায় পাওয়া যেতো। সকল বন্দী-বন্ধুর বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে কার পরিবার কেমন আছে সে খোঁজও নিতো সে। জেলখানায় আটকদের কোন খবর পাওয়া গেলে তা-ও সে পৌঁছে দিতো তার বাড়িতে। নিজেও দু’ দু’বার জেল খেটেছে বিনা বিচারে।
বইতে পড়েছিÑ মুখেও শুনতাম ঈড়সৎধফবষু ভববষরহম নামক দু’টি শব্দ। এই ফিলিং যার মজ্জাগত ছিল তারও নাম শাহজাহান মাহমুদ।
আইউব খান সামরিক আইন জারি করার পর সকল দল বেআইনী হলোÑ সকল রাজনৈতিক কার্যকলাপ নিষিদ্ধ হলো। অনেকে গ্রেফতার হলেনÑ চুপিসারে সটকে পড়লো শাহজাহান মাহমুদ। বেশ কিছুদিন পর আবার উদয়ও হলোÑ সাবধানে থাকতে বলতেই সে জানালো, সাহাপুর হাই স্কুলে সে শিক্ষকতা করছে।
চাকরি নিয়েছে। আশ্বস্ত হলাম। কিন্তু অতিশয় আবেগপ্রবণ শাহজাহান মাহমুদÑ ভরসা কি? আবার না ছেলেদেরকে নিয়ে মিছিল করে বসে। নিষেধ করতেও সাহস পাই নাÑ হয়তো তাতে উল্টো ফল হবে। যা হোক, ঐ চাকরি করাকালেই ঈশ্বরদীতে বিয়ে করে ষাটের দশকে ঘর বেঁধেছিল শাহজাহান মাহমুদ।
কিছুকাল পর, সম্ভবত রাজনৈতিক কারণেই তার চাকরি চলে যায়। আর্থিক অনটন বাড়ে। স্বভাবতই স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্কে চিড় ধরে। উপার্জনের তাগিদ সে বোঝে কিন্তু তার রাজনৈতিক নিষ্ঠার কারণে, দেশপ্রেমের কারণেই যে সে আজ বেকারÑ স্ত্রী কেন একথা বুঝবে নাÑ কেন সে তার রাজনৈতিক মতাদর্শ অনুযায়ী কষ্টকে বরণ করে নেবে না এই ছিল তার অভিযোগ। স্ত্রী যে বেশি কিছু চায় নাÑ মোটামুটি খেয়ে পরে বেঁচে থাকার মত রোজগার সে করুকÑ এটুকু দাবিও যেন অযৌক্তিক ছিল শাহজাহান মাহমুদের কাছে।
অনেকবার উভয়কে বুঝিয়েছি। উভয়েই এসে অভিযোগ করতো ডাকতো দু’জনেই আমাকে রণেশদা বলে। কখনও কখনও বুঝাতে সক্ষম হলেও সে বুঝ বেশিদিন টেকেনি। বনিবনার অভাব ঘটলো। পরে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় দু’জনার।
কিন্তু ইতিমধ্যে তাদের একমাত্র সন্তান শুচি কিছুটা বড়ও হয়েছে। বিব্রতবোধ করেও কিশোর ছেলে শুচি ক্ষুব্ধই শুধু হতো তার বাবার প্রতি নিতান্ত স্বাভাবিকভাবেই।
উপার্জনের পথ শেষ পর্যন্ত ধরেছিল শাহজাহান মাহমুদ। কি পথ? একজন প্রতিভাশালী শিল্পী ছিল। দোকানের সাইনবোর্ড, নেমপ্লেট ইত্যাদি লিখতো।
কিন্তু টাকা পেতো কি? ব্যবসায়ীরা বেজায় ফাঁকি দিতো। পেশাদার শিল্পী যে কাজে তখন ৫০ টাকা চাইতোÑ শাহজাহান মাহমুদ সেক্ষেত্রে ২০ টাকার বেশি চাইতো না। পেতো আরও কম। ফলে রংতুলির দামও তার অনেক সময় উঠতো না। মনে পড়ে আমি যখন জেল থেকে এলএলবি পাস করে বেরুই তখন কি না খুশি হয়েছিল শাহজাহান মাহমুদ।
বড় যতœ নিয়ে নিজে থেকেই একটি সুন্দর নেমপ্লেট লিখে এনে আমার বাসায় টাঙিয়ে দিয়েছিল। ন্যাপেরও দু’বার বিরাটকার সাইনবোর্ড লিখে দিয়েছিল সে একেবারে বিনে পয়সায়। জোর করেই রংতুলি কিনে দিয়েছিলাম। আর চা খাওয়ার নামে কখনও কখনও দু-এক টাকা। কিন্তু মজুরি বলে প্রত্যাখ্যান করতো ঐ সাইনবোর্ড লেখার পারিশ্রমিক না-ও একথা বললে।
এক পর্যায়ে সে খানিকটা মস্তিস্ক-বিকৃতিতেও ভোগেÑ স্ত্রী চলে যাবার পর। আর এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে সর্বদাই সে আওড়াতো ‘কমরেড মানে মজুর পার্টির লোক, কমরেড মানে কৃষক পার্টির লোক, কমরেড মানে বিরাট হƒদয়, অগ্নিগর্ভ চোখ। ’
হ্যাঁ, শেষ জীবনে শাহজাহান মাহমুদের চোখও রক্ত লাল হয়ে পড়েছিল। বিনিদ্র রাত পর পর কাটাতে গিয়ে। সম্ভবত স্ত্রী বিরহে, কিশোর (আসলে শিশু) সন্তান শুচির কথা ভেবে।
অনেক দিনই তো আমার বাসায় আসতোÑ আমি জেলে থাকলেওÑ বাইরে থাকলেও। আমার স্ত্রী পূরবী তার বড়ই প্রিয় বৌদি ছিল। পূরবী শাহজাহান মাহমুদের মধ্যে পেয়েছিল শাহজাহান ভাইÑ যেন তার আপন একটি ভাইকে। তাই সে এলেই তার জন্য খাবারÑ তা ঘরে যাই থাকুকÑ খাওয়াবেই তাকে। শাহজাহানও খেতো পরম তৃপ্তিতেÑ আমাদের পরিবারেরই একজন হয়ে।
না, শুধু তাই নয়, অধিকার সম্পন্ন একজন হয়ে।
আজ তার ছেলে শুচি মানুষ হয়েছেÑ হয়েছে সাংবাদিক। শুচির সন্তানও হয়েছেÑ সে বিয়ে করেছে। কিন্তু দেখে যেতে পারলো না বন্ধু শাহজাহান মাহমুদ তার বংশ তার আকাক্সিক্ষত মতাদর্শ রক্ষার দায়িত্ব তুলে নিয়েছে তারই একমাত্র সন্তান শুচি। পরম তৃপ্তি পেয়েছি আমাকে লেখা শুচির চিঠি পেয়ে।
তাতে সে তার মৃত পিতা সম্পর্কে লিখেছে, ‘আব্বা বেঁচে থাকতে মনে হতো তিনি যেন আমার স্বাভাবিক বিকাশের অন্তরায়Ñ অথচ আব্বা মারা যাবার পর হাড়ে হাড়ে ঠিকই বুঝেছি পিতা কি জিনিস! আমি এখন পিতা হয়েছিÑ পিতা হবার পর আমি আরো বেশি করে ফিল করিÑ আমার আব্বা পৃথিবীর একজন তুলনাহীন বাবা ছিলেন’Ñ ইত্যাদি।
বস্তুতই শাহজাহান মাহমুদ একজন তুলনাহীন দেশপ্রেমিক, তুলনাহীন বন্ধু, তুলনাহীন স্বামী এবং পিতা। এক কথায়, সে ছিল অতুলনীয় বিপ্লবী একজন।
শ্রীরণেশ মৈত্র, সাংবাদিক, গণফোরাম কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা, শাহজাহান মাহমুদের অগ্রজপ্রতিম রাজনৈতিক সহযোদ্ধা, নেতা।
ড. মোহাম্মদ রওশন কামাল
শাহজাহান মাহমুদ
আমাদের পান্নু মামা
সে অনেক দিন আগের কথা, সম্ভবত ১৯৫১ উত্তর কাল।
তখন স্কুলে পড়তাম- পঞ্চম বা ষষ্ঠ শ্রেণীতে। এতদিন আগের কথা মনে থাকার কথা নয়, কিন্তু কিছু কিছু কথা বিশেষ কোনও মানুষের কথা কেন যেন মন থেকে মুছে ফেলা যায় না। মনে পড়ে কোনও এক ইংরেজ কবির কথা ‘আমাদের মধুর সংগীতগুলো আমাদের বেদনার গাঁথা’। এখানে পান্নুমামার জীবনের কি এমন দুঃখের কথা যা মনে থাকতে পারে? সেই কথাই বলব।
পান্নুমামা থাকতেন আমাদের রাধানগরের বাসা থেকে মাত্র ২/৩ শত গজ দূরে।
তার ভগ্নীপতির ছেলে (সহকারী অধ্যাপক মুহম্মদ আব্দুস সাত্তার বাসু) বাসার বাইরের ঘরে। ১০/১২ ফুটের দৈর্ঘ্য প্রস্থের ঘরে। অবস্থান ছিল বর্তমানের পুরাতন ‘পাওয়ার হাউস’ থেকে উত্তরে মাত্র কয়েক গজ দূরে। মাঝ খান থেকে চলে গেছে পাকা রা¯তা। সেই স্বল্পপরিসর ঘরে থাকলেও, ঘরটা ছিল বইয়ে ঠাঁসা।
বলতে লজ্জা নেই যে সে সময় আমাদের সমাজে লেখাপড়া জানা লোকের সংখ্যা ছিল হাতে গোনা মাত্র কয়েকজন। আমাদের মত হাতে গোনা যে কয়জন পড়া লেখায় আগ্রহী ছিলাম তাদের সম্ভবত একমাত্র প্রশ্রয়ের স্থান পান্নুমামার ঘর। সেখানেই তার সঙ্গে পরিচয়, ঘনিষ্ঠতা এবং তার মতের সঙ্গে পরিচয়। কি আনন্দ, আগ্রহ এবং একাšত আপন করে কঠিন জিনিসগুলি সহজ, সরল ভাবে আমাদের বুঝাতেন এবং সেই কারণে তার কথাগুলি এখনও মনে দাগ কেটে আছে। তবে একথা সত্য যে তার কথার মূল জিনিসটা বোঝার মত বুদ্ধি হয়নি।
তার নানান কথার মধ্যে ঘুরে ফিরে চলে আসত সমাজতšেত্রর কথা, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা, কথা থাকত কেমন করে হতদরিদ্রদের ভাগ্য উন্নয়ন করা যায়। সেই কারণে তারা চাইত সকলের জন্য শিক্ষা। কেননা তার পড়াশুনা ছিল অত্যšত গভীর।
স্কুল জীবনের শেষে এবং কলেজ পর্বের প্রারম্ভে সাক্ষাৎ আর সেই থেকে সখ্য গড়ে ওঠে আর ব্যক্তিত্বের সঙ্গে তিনি ছিলেন আমার অত্যšত শ্রদ্ধেয় আমিনুল ইসলাম বা বাদশা ভাইয়ের সঙ্গে। পাবনা বাজারের মধ্যে রূপছায়া স্টুডিও-র উত্তরে একটা ছোট্ট বইয়ের দোকান বইঘর।
এতটাই ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে যে বাদশা ভাইয়ের বইয়ের দোকানে না গেলে দিনটাই ভালো যেত না। সেখানে মাঝে মধ্যে বই কিনতো সাধারণ আকর্ষণীয় গল্পের বই। কিন্তু বাদশা ভাই কিছু বই বেছে বেছে দিতেন পড়ার জন্য। প্রায়ই সেগুলি তার দোকানে বসেই পড়ে ফেলতাম। সে বই সবই ছিল সমাজতšেত্রর ওপর।
নিজে ছিলেন নিবেদিত প্রাণ ‘ন্যাপ’-এর একনিষ্ঠ কর্মী। এই সূত্রেই যোগাযোগ ছিল তাদের দু’জনের মধ্যে। আর আমরা যারা কম বেশি লেখা পড়া পছন্দ করতাম ঐ দু’জনের কাছ থেকে নানান জীবনধর্মী জ্ঞানের কথা শুনতাম। এর মাঝে ঘটে গেল ভাষা আন্দোলন। সেখানে পান্নুমামাকে নতুন রূপে দেখলাম।
রাত জেগে নানান ফেস্টুন লেখার কাজ করতেন এবং রাতের আঁধারে সেগুলি নানান নির্দিষ্ট স্থানে লাগিয়ে দিতেন। এগুলি এত গোপনে স¤পাদন করতেন যে আমাদের মতো দু’একজন ছাড়া কেউ তা জানতও না। এতে আমাদের স¤পৃক্ততা ছিল অত্যন্ত কম।
এই প্রসঙ্গে আর একটি কথা না বললে পান্নুমামা ও বাদশা ভাইকে জানা যাবে না। তাদের জীবনযাত্রা এবং পোশাক-আশাক ছিল অত্যন্ত সাধারণ।
বিশেষ করে পান্নুমামার অবস্থা ছিল অনাথের মতো। তার তেমন কোনও আয় ছিল বলে জানা নেই। বাদশা ভাইয়ের বইয়ের দোকানের জন্য অবস্থা সম্ভবত কিছুটা ভালো ছিল। কিন্তু তাদের কর্মপদ্ধতি সঙ্গে এখনকার রাজনীতির নেতাদের কোনও মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। তারা বিশেষ করে পান্নুমামার সমবয়সীরা গ্রামে-গঞ্জে গিয়ে স্কুলে ছেলেদের এবং বাচচাদের প্রাথমিক শিক্ষা দেওয়ার কাজে নিজেদের নিয়োজিত রাখতেন।
তাদের উদ্দেশ্যে ছিল মহৎ এবং সেই সঙ্গে তারা জানতেন গ্রামের ছেলেদের শিক্ষিত না করতে পারলে দেশের যেমন উন্নতি হবে না, সেই সঙ্গে তাদের রাজনীতির কথাও তাদের কাছে (ছেলেদের কাছে) পৌঁছানো যাবে না। এই যে মহৎ উদ্যোগ এর ভেতরের মূল্য এখনও আমরা বুঝতে পারি না। বর্তমানের রাজনৈতিক নেতাদের দেখলে মনেই হয় না যে তারা আমাদের এই গরিব দেশের জনগণের কোনও কাজে লাগবে। অতীতে একদল পান্নুমামা নিজেদের অভাবের মধ্যে মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে কাজ করত। তার বিপরীতে বর্তমানে দেখি বিলাসিতার নানা উপকরণ।
দামী গাড়ি আর নতুন নতুন মহামূল্যবান পোশাকআশাক।
ফিরে যাই আবার পান্নুমামার কথায়। এই নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তি এতটাই সমাজ পরিবর্তনে বিশ্বাসী ছিলেন যে নিজের পরিবারের জন্য কিছু করা তো দূরের কথা কিছু রেখেও যাননি। নিজের কাজের ধারা ছিল গোপনে এবং লোকচক্ষুর অবর্তমানে। তা তো তার সম্বন্ধে আমাদের মতো কিছু ভক্ত ছাড়া অন্যরা তেমন কিছু জানে না।
রাতের অন্ধকারে বা নিভৃত পল্লীগ্রামে তাদের কর্মপদ্ধতি নিবেদিত ছিল। সেই সাথে আমিনুল ইসলাম বাদশা ভাই। যেহেতু দু’জনই ‘ন্যাপ’-এর একনিষ্ঠ কর্মী ছিলেন তাই দু’জন দু’জনকে চিনতেন। দুয়ের মধ্যে আমাদের মতো কিছু ভক্ত একটা ক্ষীণ যোগসূত্র ছিলাম। এই লেখার সমাপ্তি টানার সময় বলতে দ্বিধা নেই যে, পান্নুমামার মতো নির্লোভ আÍত্যাগী তৈরি করতে না পারলে বিলাসে গা ভাসানো নেতাদেরই জš§ হবে প্রকৃত জনদরদী নেতার দেখা মিলবে না।
পান্নুমামার শেষ অংক আমার জানা নেই। দেশের অশনি সংকেতের পূর্বেই জাপান সরকারের শিক্ষা মšত্রণালয়ের ‘স্কলারশিপ’ নিয়ে ১৯৭০-এর অক্টোবরে টোকিওর উদ্দেশ্যে রওনা হই। সেই সঙ্গে পান্নুমামাও আমার মনের বাইরে চলে যান। তারপর সবটাই ছিল নিজকে নিয়ে আর ¯ত্রী সন্তানকে নিয়ে। ১৯৭৭ সালে দেশে ফিরে দেখলাম স¤পূর্ণ আলাদা এক সমাজ।
সেখানে পান্নুমামার রাজনৈতিক কর্মীদের কোনও স্থান ছিল বলে মনে পড়ে না। ‘স্বার্থপর-মানুষ’ এর সমাজে তারা অপাঙক্তেয় মানুষ। এইতো সেদিন, আমাদের রাজনৈতিক আর সামাজিক নেতাদের পোশাকের বাহার আর চাকচিক্য দেখে নতুন করে পান্নুমামাকে আবিষ্কার করলাম। তাকে দেখেছি নেহায়েত যেটুকু না হলে জীবন ধারণ করা যায় না তার বেশি না কিন্তু কাজ ছিল বহুগুণ বেশি। কাজই তাদের ধর্ম ছিল।
এখনকার নিত্য নতুন পোশাক, নকশা কাটা পাঞ্জাবি এবং তার সংখ্যাধিক্য। বড় বড় গাড়ি (পাজেরো-কমপক্ষে)। দেখে মনে হয় পান্নুমামার মতো সাদামাটা লোকগুলো তখন ছিল বলে হয়তোবা আমরা কিছু শিখতে পেরেছি। এই দেশজ বিলাসিতার সঙ্গে যেন পান্নুমামারা হারিয়ে গেছেন। তাদের মতো দেশদরদী, দেশভক্ত বোধহয় আর হবে না, আসবে না।
তবে পান্নুমামা এবং তার সমমনা ব্যক্তিত্বের জন্য প্রচণ্ড আগ্রহে অনাগত ভবিষ্যতের দিকে প্রত্যাশা নিয়ে অপেক্ষা করতেই থাকব। তবে সংশয় হয় বর্তমানের বিশিষ্ট পণ্ডিত, গবেষকরা যেভাবে ‘শো বিজনেসের’ মানুষে পরিণত হচেছ, তাতে পান্নু মামারা আর আসবে কি?
ড. অধ্যাপক রওশন কামাল, অধ্যাপক, ইবাইস বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
অধ্যাপক মুহম্মদ আব্দুস সাত্তার বাসু
শাহজাহান মাহমুদ
হারিয়ে যাওয়া এক সংগ্রামী
’৫০ দশকে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের ছাত্র ও পাবনার ছাত্র আন্দোলনের একনিষ্ঠ ও নির্ভীক কর্মী শাহজাহান মাহমুদ আজ বিস্মৃতপ্রায়। অকাল মৃত্যু তাকে সবার কাছ থেকে আড়াল করে দিয়েছে। কিন্তু সমসাময়িককালের ছাত্র বন্ধুদের মনের মণি কোঠায় তিনি অমর হয়ে আছেন। এখনো স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন, সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী আন্দোলন কিংবা সমাজতন্ত্রের পক্ষে সোচ্চার হওয়ার ঘটনা সামনে আসলে শাহজাহান মাহমুদের নাম চলে আসে।
তিনি ছিলেন অকুতোভয়। হুলিয়া, জেল জুলুম, অত্যাচার-নির্যাতন তাকে দমিত করে রাখতে পারেনি। নীতির প্রশ্নে তিনি কখনো আপোস করেনি। এমন একজন সংগ্রামী মানুষকে অকালে হারাতে হয়েছে।
শাহজাহান মাহমুদ যাঁর পিতৃ প্রদত্ত নাম ছিল ছাইফ উদ্দিন ওরফে পান্নু মিয়া।
তার জš§ হয় ৩১ শে আশ্বিন ১৩৩৮ সনে (১৯৩১ ইং) সিরাজগঞ্জ জেলার চৌহালী থানার হাট ঘোরজান। যমুনা তীরবর্তী একটি গ্রাম। বাল্যকালে গ্রামের স্কুলে লেখাপড়া করেছেন। পিতা তমিজ উদ্দিন মুন্সী ছিলেন ঐ গ্রামের লেখাপড়া জানা ব্যক্তি। তিনি ছিলেন এন্ট্রাস পাশ।
পোরজনা স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। তার ৮ম সন্তান শাহজাহান মাহমুদ।
যমুনা নদীর ভাঙ্গন তাদেরকে গ্রাম ছাড়া করে। ভাঙ্গনজনিত কারণে গ্রাম নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলে ১৯৪২ সালে পরিবারের অন্য সদস্যদের সাথে তিনিও চলে আসেন পাবনা শহরে। রাধানগর গ্রামে মরহুম ডা. মাহবুব আলীর বাড়ির পাশে এক ভাড়া করা বাসাবাড়িতে ওঠেন তারা।
পরে তার ভগ্নীপতি মরহুম ওয়াকিল উদ্দিন-এর ক্রয় করা এক বাড়িতে পরিবারসহ উঠে আসেন। সেই বাড়িটি তাদের স্থায়ী বাসস্থান হয়ে যায়।
পড়াশোনার প্রতি তার ছিল প্রবল আগ্রহ। গ্রাম থেকে এসে এক বছর স্কুলে তিনি পড়তে পারেননি। পরে ভর্তি হন আর. এম একাডেমীতে পিতৃ প্রদত্ত নাম পরিবর্তন করে নাম নেন শাহজাহান মাহমুদ।
১৯৫০ সালে তার ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেয়ার কথা ছিল। তাদের শহরে আশ্রয় খোঁজা, বড় ভাইদের চাকুরির সংস্থান না-হওয়ায় তার পড়াশোনা ব্যাহত হয়। তিনি সে বছর পরীক্ষা দিতে পারেননি। পরের বছর অর্থাৎ ১৯৫১ সালে তিনি ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেন আর, এম একাডেমী থেকেই। ইংরেজি ও উর্দুতে লেটার নম্বরসহ প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করেন।
একই সালে তিনি পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে আই. এ শ্রেণীতে ভর্তি হন।
কলেজে ঢুকেই তিনি ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িত হয়ে পড়েন। ভাষার প্রশ্নে, রাষ্ট্রভাষার উর্দুর পরিবর্তে বাংলা ভাষা দাবির আন্দোলনে নিজেকে নিয়োজিত করেন। ছাত্র আন্দোলনের পুরোধা, প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক ছাত্র গ্র“প যেটা পরবর্তীতে ছাত্র ইউনিয়ন রূপে আÍপ্রকাশ করে তিনি সেটার সক্রিয় ও সংগ্রামী সদস্য হয়ে পড়েন। তৎকালীন তুখোড় ছাত্র নেতৃবৃন্দ, রণেশ মৈত্র, আব্দুল মতিন, কামাল লোহানী, তৌফিক ইমাম প্রমুখের সহযোগীযোদ্ধা হিসাবে নিজেকে সামিল করেন।
সমাজতন্ত্র তার জীবনের মূলমন্ত্র হয়ে ওঠে। তৎকালে রাশিয়া ও চীন থেকে আসা সমাজতন্ত্রের ওপর লিখিত বই পুস্তক পাঠ (যে সব বই তৎকালীন পাকিস্তানে নিষিদ্ধ ছিল) তার ছাত্র জীবনের শিক্ষার প্রধান অবলম্বন হয়ে ওঠে।
তিনি ’৫২-র ভাষা আন্দোলন, ’৫৪-র স্বৈরাচার আইউব বিরোধী আন্দোলন, মুসলিম লীগ বিরোধী আন্দোলন, ’৫৪-র নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের সপক্ষে নির্বাচনী প্রচারণায় আÍনিয়োগ করেন।
তিনি ছিলেন একজন অংকন শিল্পী। সুন্দর হস্তাক্ষরে পোস্টার, ব্যানার, প্লাকার্ড লেখায় তার জুড়ি ছিল না।
পুলিশের তীক্ষœ নজর উপেক্ষা করে তিনি রাতের বেলায় সরকার বিরোধী শ্লোগান সম্বলিত পোস্টার লিখেছেন এবং রাতের বেলাতেই নিজ হস্তে শহরের দেয়ালে দেয়ালে এঁটে দিয়ে এসেছেন। তিনি ছিলেন অকুতোভয়। তার উপর ছিল পুলশের সর্তক দৃষ্টি। তিনি বাড়িতে থাকতে পারতেন না। তার বিরুদ্ধে হুলিয়া থাকা সত্ত্বেও তিনি আন্দোলনের কাজ করেছেন নিষ্ঠার সাথে।
তিনি পালিয়ে বেড়িয়েছেন বহু দিন। কলেজের পড়া তার হয়নি। ১৯৫২ এবং ১৯৫৪ সালে তিনি দু’বার গ্রেফতার হন। প্রথম বার ছ’মাস কারাভোগ করেন। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে তিনি পড়াশোনায় মনোযোগ দেন।
এডওয়ার্ড কলেজ থেকে তিনি ১৯৫৫ সালে প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়ে আই. এ পাশ করেন। পাশ করার পর সরকারী অন্য কোনও চাকুরী না পেয়ে তিনি পাকসীর সাহাপুর স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। এখানে শিক্ষকতাকালীন তিনি ঈশ্বরদীতে বিবাহ করেন।
১৯৮১ সালে ২৯ নভেম্বর ৫০ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু ঘটে। শাহজাহান মাহমুদ বেঁচে নেই।
কিন্তু তাঁর স্মৃতি অম্লান হয়ে আছে সমাজতন্ত্রী, প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাসী তার সমসাময়িককালের জীবিত ছাত্র বন্ধুদের হƒদয়ে। এখনো তারা তাঁকে স্মরণ করেন। এডওয়ার্ড কলেজের শতবর্ষপূর্তি উৎসবে আসা প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রীদের স্মৃতিচারণমূলক আলোচনা সভায় তার কথা উঠে এসেছে তাঁর বন্ধুদের নস্টালজিক বক্তৃতায়।
প্রয়াত মুহম্মদ আবদুস সাত্তার বাসু, সহকারী অধ্যাপক, সাংবাদিক, শাহজাহান মাহমুদের ভগিনেয়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।