আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হরিদাসের ইশ্বর দর্শন।

প্রবাসী অনেক অনেক দিন আগের কথা। গ্রামের লোকেরা তখন অসভ্য ছিল। তাহারা মদ, জুয়া এবং অন্যান্য অসামাজিক কাজে লিপ্ত থাকিত । সেই অধর্মের, অন্ধকারের যুগে দূর দেশের নাম না জানা গ্রামে জন্ম হরিদাসের। হরিদাসের জন্ম বৃত্তান্ত খুজিয়া পাওয়া যায় না , তাহা অনেক দিন আগের কথা।

হরিদাস ও কিছু লিখিয়া যায় নাই কারন হরিদাস ছিল মুর্খ, অশিক্ষিত। তবে তাহার মেধা ছিল প্রখর। অত্যন্ত চতুর প্রকৃতির হরিদাস ছিল প্রখর বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন। কিভাবে ধন সম্পদ করায়ত্ব করা যায়, কিভাবে ক্ষমতা লাভ করা যায় ইত্যাদি ছিল নখ দর্পনে। বাল্যকাল হইতেই হরিদাস ছিল ইশ্বর ভক্ত।

ইশ্বরও হরিদাসের ভক্ত ছিল। এই ইশ্বর এবং হরিদাস কিন্তু হেলফেলার কেহ নহে। ইশ্বর শুনিয়া অনেকে মনে করিতে পারেন ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর বা ঐ রকম কেহ, বাস্তবে তাহা নহে। প্রকৃতপক্ষে ইশ্বর ছিলো হরিদাসের আবিস্কার। ইতিপুর্বে অনেকেই ইশ্বরকে আবিস্কার করিয়াছে দাবী করিয়াছিল কিন্তু তাহাদের ইশ্বর প্রকৃত ইশ্বর ছিলো না।

হরিদাস ভাল করিয়া জানিত নিজে বিখ্যাত হইতে হইলে , নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমান করাইতে হইলে তাহাকে কেরামতি দেখাইতে হইবে। কেরামতি দেখানোর প্রথম কর্ম হিসেবে ইশ্বর নামক প্রানী আবিস্কার করিলো। পুর্বেই বলিয়াছি সেই গ্রামের লোকেদের শিক্ষা দীক্ষা ছিল না। তাহারা কেহ বিশ্বাস করিল ,কেহ বা হরিদাসের দাবীকে বিশ্বাস করিল না। গ্রামের শেষ প্রান্তে যে বুড়ো বটগাছ ছিলো তাহার তলে বসিয়া হরিদাস ধ্যানস্থ হইত।

প্রকৃতপক্ষে চোখ বুজিয়া নিজের বদ মতলব হাসিল করিবার ফন্দি আটিত। হরিদাস গৌতম বুদ্ধের বানী কিছু কিছু শুনিয়াছিল। সুতরাং প্রথমেই ইশ্বরের প্রেরিত গৌতম বুদ্ধকে পীর মানিল। নিজেও "ইশ্বর প্রেরিত" এই রুপ দাবী করিল। তাহাতে খুব বেশী ফায়দা হইল না।

একদিন গ্রামের লোকেরা সদলবলে হরিদাসের আস্তানা গুড়াইয়া দিলো। বাধ্য হইয়া হরিদাস শিষ্য শাবক লইয়া পাশের গ্রামে গিয়া আস্তানা গাড়িল। গ্রাম হইতে কিছু দূরে হাট বসিত। হাটে কেনাবেচা শেষে লোকজন ফিরিয়া যাওয়ার পথে তাহাদের সহিত টাকা পয়সা থাকিত। হরিদাসের চোখ পড়িল ব্যাবসায়ী এবং হাটুরেদের উপর।

নিজের ইশ্বরকে, নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করিতে হইলে ধন সম্পদের প্রয়োজন হরিদাস সম্যক উপলব্ধি করিয়াছিল। প্রারম্ভে গোপনে অতঃপর শক্তি প্রয়োগ পুর্বক ব্যাবসায়ীদের নিকট হইতে থেকে মাসোহারা সংগ্রহ শুরু করিল হরিদাস। কিছুদিনের মধ্যেই হরিদাস তাহার আশ্রম খুলিল। অশিক্ষিত গ্রাম বাসীদের নিকট তাহার আবিস্কৃত ইশ্বরের কথা, তাহার উপদেশ বানী বন্টন শুরু করিল। ক্রমশ তাহার ধন সম্পদ বাড়িতে থাকিলে নিজের দল গঠন করিল।

কঠোর নিয়ম নীতির মধ্যে হরিদাসের দল পরিচালিত হইত। অন্য ডাকাত দলের সর্দার যেমন নিজে প্রধান অংশ রাখিত, হরিদাস কিন্তু তাহা সমান ভাবে দলের লোকদের মধ্যে বিতরন করিত। সেই হরিদাস একদিন নিজ গ্রামে ফিরিয়া আসিল। তখন তাহার প্রভাব প্রতিপত্তি, খ্যাতি এবং দলের লোকজনের ভয়ে গ্রামের কেহ আর উচ্চবাচ্য করিবার সাহস পাইল না। তাহাকে যে বুড়ো বটগাছ হইতে উৎখাত করা হইয়াছিলো সেই খানেই গড়িয়া উঠিল তাহার সদর দফতর।

লোকজন সদলবলে আসিয়া তাহার লাঠীয়াল বাহিনীতে ভর্তি হইতে লাগিল। লুন্ঠনকৃত সম্পদের ভাগ পাইতো হরিদাসের শিষ্য সামন্তেরা। হরিদাসের দল ক্রমশ ভারী হইতে লাগিল। কেহ ভয়ে, কেহবা লোভে তাহার ইশ্বরের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করিল। কিছুদিনের মধ্যে হরিদাস, সর্বশ্রেষ্ঠ, সর্বশেষ, সর্ববৃহত, সর্বগুরু ইত্যাদি বিশেষনে ভুষিত হইল।

Reward and punishment শব্দ হরিদাস জানিত না, কারন তখন দেশে ইংরেজী শিক্ষার প্রচলন হয় নাই। তবে ইহার উদ্দেশ্য সম্পর্কে সে ভালমত ওয়াকিবহাল ছিল। যাহারা তাহার ইশ্বরকে স্বীকার করিবে তাহাদের জন্য কি পুরস্কার এবং যাহারা বিশ্বাস করিবে না তাহাদের জন্য শাস্তি কি হইবে তাহার একটি তালিকা বৃহদাকৃতি বর্নে লিপিবদ্ধ করিয়া সদর দফতরের প্রবেশদ্বারে প্রদর্শিত থাকিত। তাহার সে নীতিমালা লোক মুখে প্রচলিত ছিল। অতঃ পর তাহা কিতাবে লিপিবদ্ধ হয়।

তাহা এখন ও হরিদাসের কিতাবে পাওয়া যাইবে। হরিদাসের ভাষা আমি বুঝি না , অনুদিত হরিদাসের কিতাব হইতে যাহা উদ্ধার করিতে পারিয়াছি তাহা নিম্নরুপ: পুরস্কারঃ- বিশ্বাসীদের জন্য বিনামুল্যে আহার ও সুরাপান। হেরেমখানায় অবাধ সম্ভোগের অধিকার। বিশ্বাসী যোদ্ধাদের জন্য লুন্ঠন কৃত ধনসম্পদ , বন্দীকৃত পুরুষদের ক্রীতদাস এবং নারীদের দাসী হিসেবে রাখার বিধান , ইত্যাদি। তাহাদের নিমিত্তে পরকালে সুন্দরী রমনী, পানীয় ইত্যাদির অফুরন্ত ভান্ডার থাকিবে বলিয়া শিশ্যদের নিশ্চয়তা দান করিয়াছিল ।

শাস্তিঃ- অবিশ্বাসীদের জন্য ইহকালে এবং পরকালে বেত্রাঘাত, অগ্নিকুন্ড, শুলে চড়ানো, শিরচ্ছেদ ইত্যাদি। পরকালের ব্যাপারে হরিদাসের আস্থা ছিলো না । তবে সবাইকে পরকালের ভয় দেখাইয়া কিভাবে কাজ হাসিল করি্তে হয় তাহা ভাল করিয়া জানিত। ইশ্বর না বিশ্বাস করিলে কি ধরনের শাস্তি হইবে তাহার নমুনা প্রদর্শনের নিমিত্তে “শিক্ষা কেন্দ্র” স্থাপন করিয়াছিল। সেখানে মাঝে মধ্যে অবিশ্বাসীদের শাস্তির নমুনা প্রদর্শনীর ব্যবস্থা থাকিত।

তাহার ঈশ্বরে বিশ্বা্সী ভক্তগন উহা দেখিয়া উল্লাস প্রকাশ করিত। উপরোক্ত সমস্ত বিধানই ছিল হরিদাসের মস্তিস্কপ্রসুত, কিন্তু বরাবরের ন্যায় তালিকার শেষে লিখিয়া রাখিয়াছিলঃআদেশক্রমে “ইশ্বর” পুনরা্য যাহাতে কেহ ইশ্বর আবিস্কারের দাবী না করিতে পারে সেই নিমিত্তে কিতাবের প্রথমেই লিখিয়া রাখিয়াছিল "ইহাই সর্ব শেষ ইশ্বর আবিস্কার, ইহার পর অন্য কাহারও দাবী গ্রাহ্য হইবে না" হরিদাস তাহার আবিস্কারের পেটেন্ট নেয় নাই কারন হরিদাস বিশ্বাস করিত তাহার আবিস্কার প্রশ্নাতীত। "হরিদাসী" ছাড়া অন্য কাহারো প্রতি তাহার দুর্বলতা ছিল না। হরিদাসীর সংখ্যা ছিলো অগুনিত। হরিদাসীর ব্যাপারে ইশ্বর তাহাকে সাহায্য করিয়াছিল।

কেহ প্রশ্ন উথথাপন করিলে ,ইশ্বর বানী প্রেরন করিত। ইশ্বরের নির্দেশের দোহাই দিয়া খালাস পাইতো হরিদাস। আর প্রতিবারই কিতাবে লিপিবদ্ধ হইত "সমস্ত প্রসংসাই ইশ্বরের"। হরিদাস প্রতিদিন সকালে তাহার দরবারে বসিয়া ইশ্বরের গুনাগুন, নির্দেশাবলী বর্ননা করিত আর দরবারের সভাকবি তাহা লিপিবদ্ধ করিত। হরিদা্সের মৃত্যুর পর তাহা কাব্য হিসেবে আত্মপ্রকাশ করিয়াছে।

এক রাতে হরিদাসকে সভায় অনুপস্থিত দেখিয়া ভক্তবৃন্দ অনুসন্ধানে নিবৃত্ত হইল। দীর্ঘ অনুসন্ধান শেষে প্রত্যুষে শহরের ভাটিখানাতে হরিদাসীর কবল হইতে তাহাকে উদ্ধার করিলো । এইবার হরিদাস ইশ্বর দর্শনের বর্ননা দিলো। দাবী করিল ইশ্বরের নির্দেশে তাহার এই নৈশাভিযান । কিভাবে ইশ্বর দুত মারফত তাহাকে আমন্ত্রন জানাইল, কোথায় ইশ্বরের সাক্ষৎ মিলিল, কি প্রকারে পানশালায় পৌছাইল, কিভাবে ইশ্বরের সহিত পান করিল, কতজন হরিদাসী সেখানে ছিল্, কি পরিমান মধু পান করিয়াছিল ইত্যাদির বর্ননা দিয়াছিল হরিদাস পরদিনের সভায়।

সভাকবি তাহা লিপিবদ্ধ করিয়াছিল । আজ ও হরিদাসের কিতাবে সে বর্ননা পাওয়া যাইবে। দীর্ঘকাল হইল হরিদাস দেহ ত্যাগ করিয়াছে। কিন্তু তাহার কীর্তির সাক্ষ্য বহন করিয়া চলিয়াছে সেই গ্রাম যাহার নাম এখন হরিদাসপুর। তাহার ইশ্বর আজ ও বিশ্বাসীদের পুরস্কার এবং অবিশ্বাসীদের শাস্তি বিধানে সদা তৎপর।

ইদানিং ইশ্বর দুশ্চিন্তিত। অবিশ্বাসীদের খাতার পাতা দ্রুত নিশেঃষ হইয়া আসিতেছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে অবিশ্বাসীদের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাইতেছে। উহাদের শায়েস্তা করিবের জন্য হরিদাসকে স্বর্গালয় হইতে মর্তে প্রেরন করিতে চাহিয়াছিলেন, হরিদাস রাজী হয় নাই। বুড়ো বটগাছ এখন হরিদাসের সমাধিক্ষেত্র, পবিত্র ভুমি।

হরিদাসের মাজারে প্রতি বছর কার্তিক মাসের দ্বিতীয় রবি বারে সাড়ম্বরে " হরিদাস উৎসব" উদযাপিত হইয়া আসিতেছে। হরিদাস হিন্দু হইয়া জন্ম গ্রহন করিলেও সে কিন্তু হিন্দু বা মুসলমান ছিল না। তাহার প্রচলিত ইশ্বর ধর্ম আজ ও পালন করিয়া চলিয়াছে গ্রামের লোকেরা। হরিদাসের মাজারের খাদেমরা আজও মুরিদদের ইশ্বর প্রেরিত বানী বর্ননা করিয়া থাকে প্রতি শুক্রবার দুপুর দুই ঘটিকায়। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।