আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দুখীবুড়ি ও নেংটি ইঁদুর

বউটুবান নদীপাড়ের একটি গ্রাম। সেই গ্রামে বাস করে এক থুত্থুরে বুড়ি। তার ছেলে মেয়ে, নাতি পুতি, জমি-জিরাত সবই আছে। কিন্তু বিপদের সময় কিছুই তার কাজে লাগেনি। তার আছে উধুমদুমা চারটি ছেলে।

এরা যেমন নির্দয় তেমনি লোভী ও স্বার্থপর। ছেলেরা বুড়ির যত্ন-আত্তি করবে তো দূরের কথা, দেখাশোনা পর্যন্ত করে না। ছেলে ও ছেলের বউয়েরা উঠতে বসতে বুড়িকে অপয়া, অকর্মার ধাড়ি ইত্যাদি বলে গাল পাড়ে। তারা বুড়িকে উটকো ঝামেলা ও সংসারের অতিরিক্ত বোঝা মনে করে। এত অযত্ন-অবহেলা আর কষ্টের মধ্যেও বুড়ি কেমনে কেমনে জানি বেঁচে আছে।

আর তাতেই বাড়ির সবাই বুড়ির ওপর মহা বিরক্ত। বর্ষাকাল। প্রচন্ড বৃষ্টি ও বন্যার পানিতে রাস্তা-ঘাট ডুবে গেছে। চারদিকে থইথই করছে পানি। ঝড়ো হাওয়ায় কাঁপুনি উঠেছে বুড়ির।

ঘরের কোণায় তাঁর পুরনো কাঁথা পড়ে আছে। বুড়ি হাত বাড়িয়ে কাঁথাটা ধরে টান দিতেই কাঁথার ভেতর থেকে অসংখ্য নেংটিইঁদুর বেরিয়ে চিকচাক করে দিগি¦দিক ছোটাছুটি করতে লাগল। বুড়ি কাঁথাটা তুলে ঝাড়া দিতেই টপাটপ মাটিতে পড়ল কতগুলো ইঁদুরছানা। এরা চিঁচিঁ চোঁচোঁ করতে লাগল। বুড়ি অসহায় ইঁদুরছানার দিকে কিছুণ তাকিয়ে থেকে পরে কি মনে করে জানি কাঁথাটা যেখানে ছিল সেখানেই রেখে দিল।

ঠান্ডা বাতাসে ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল বুড়ি। ইঁদুরেরা ছোটাছুটি করে কোথাও পালাবার সুযোগ না পেয়ে বুড়ির কাছে ফিরে এসে বলে- বুড়িমা, এই বন্যায় আমাদের আর কোথাও নিরাপদ আশ্রয় নেই। তুমি যদি আমাদের তাড়িয়ে দাও তো বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে আমাদের মরতে হবে। সবাই আমাদের অপকারী প্রাণী মনে করে। কিন্তু সুযোগ পেলে আমরাও যদি কোনো উপকার করতে পারি! বুড়ি ইঁদুরকে বলে, আমি তোমাদের তাড়িয়ে দেবো না।

তোমরা আমার সাথেই থাকবে এবং আমি যা খাই তোমরাও তা খাবে। আমার কাঁথা তোমাদের জন্য রইল। এখানেই তোমরা তোমাদের সন্তানদের নিয়ে বসবাস করো। আর মনে রেখো, আমি যতদিন বেঁচে আছি ততদিন তোমাদের কোনো ক্ষতি হতে দেবো না। এ কথা শুনে ইঁদুরেরা আনন্দে বুড়ির কাছে এসে নাচানাচি করতে লাগল।

তারা বুড়িকে অনেক কৃতজ্ঞতা জানিয়ে মনের সুখে কাঁথায় আশ্রয় নিল। একদিন হলো কি, একটা বিড়াল এসে বুড়ির ঘরে ঢুকে খপ করে একটা ইঁদুর ধরে ফেলে। ইঁদুরের চিৎকার-চেঁচামেচিতে বুড়ি হাতের লাঠি দিয়ে দিল এক বাড়ি। লাঠির আঘাতে বিড়ালের একটি পা ভেঙ্গে গেল। বিড়ালটি মুখের ইঁদুর ফেলে মিঁ-ঞা-ও মিঁ-ঞা-ও করে ল্যাংড়াতে ল্যাংড়াতে গিয়ে ঘরে উঠল।

আদরের পোষা বিড়ালের এ দুরবস্থা দেখে বাড়ির সবাই রেগে মেগে আগুন হয়ে গেল এবং বুড়ির প্রতি প্রচন্ড ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। এ-জন্য ছেলেরা বুড়িকে বাড়িছাড়া করার সিদ্ধান্ত নিল। কেননা এ বাড়িতে বুড়ির মূল্য-মর্যাদা বিড়ালের একটা ঠ্যাং এর চেয়েও কম। ছেলেরা অগ্নিমূর্তি ধারন করে বুড়ির ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। বড় ছেলে আহত বিড়ালটাকে কোলে নিয়ে আদর করতে করতে বলে, এই যে বিড়ালটা দেখছ, সে আমাদের অনেক উপকার করে।

আর তুমি আমাদের এই প্রিয় বিড়ালটিকে মেরে ফেলতে চেয়েছিলে। আবার কখন যে তুমি আমাদের শিশু-সন্তানদের ওপর চড়াও হয়ে কোন অঘটন ঘটাও তা কে জানে! আমাদের ঘামঝরা অন্ন দিয়ে তোমাকে আর পোষতে পারবো না। নির্বাসনে দেবো তোমাকে। দুর্বল মা সবল ছেলেদের মুখে নির্মম কথা শুনে একটা লম্বা শ্বাস ফেলল। বলল না কিছুই।

যেই কথা সেই কাজ। বাড়ির সাথেই খরস্রোতা নদী; তারপর গহীন বন। ছেলেরা সেই বনে বুড়িকে নির্বাসনে দিয়ে এলো। বুড়ি যাওয়ার সময় তার ঘরে যা যা ছিল তা নিয়ে গেল। তার কাঁথার ভেতরে ছিল নেংটিইঁদুরগুলো।

বুড়ির সাথে এরাও নির্বাসিত হলো। নেংটিইঁদূরেরা বুড়ির খাবারের সন্ধানে চারিদিকে বেরিয়ে গেল। ক্ষুধার্ত বুড়ি গাছতলায় বসে ঝিমূতে লাগল। ইঁদুরেরা গহীন বনের ঝোপ-ঝাড়ের ভেতর দিয়ে অনেক কষ্টে বনে ঘুরতে লাগল এবং সামনে যাকে পেল তার কাছেই বুড়ির দু:খের কথা বলল। ‘আমাদের রক্ষা করতে গিয়ে এক অসহায় দুখীবুড়ি বনে নির্বাসিত হয়েছেন।

আমাদের বিপদের দিনে নিজে উপোস করে আমাদের খাইয়েছেন। আমরা তাঁর দয়ায় কঠিন বিপদ থেকে রক্ষা পেয়েছি। সেই বুড়ি আজ ক্ষুধার্ত। তোমরা এই দয়ালুবুড়ির জন্য কিছু খাবারের ব্যবস্থা করে দাও ভাই। ‘ ইঁদুরের মুখে বুড়ির কাহিনী শুনে বনের পশু-পাখিরা বলল, বুড়ি যদি সত্যি সত্যি দয়ালু হয়ে থাকে আর তোমাদের উপকার করে থাকে তবে তাঁর জন্য কোনো চিন্তা করো না তোমরা।

এ বনে তাকে না খেয়ে মরতে দেবো না। সন্ধ্যা হয় হয়। বুড়ি ক্ষুধার জ্বালায় ছটফট করছে। ইঁদুরছানাগুলোও চিঁচিঁ করছে। বুড়ি মনে মনে ভাবছে, তাকে বনের ভেতরে একা ফেলে রেখে এতক্ষণে নেংটিইঁদুরগুলো যারযার মত পালিয়ে গেছে।

হঠাৎ বুড়ির সামনে একটা বানর এসে ফুচকি দিল। তারপর চারদিক থেকে আসতে লাগল বাঘ, ভল্লুক, বনগরু, গাধা, শিয়াল। এসব ভয়ংকর প্রাণী দেখে ভয়ে বুড়ির শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। বুড়ির আর বুঝতে বাকি রইল না যে, এখনই তার জীবনলীলা সাঙ্গ হবে। এখনই তাকে টেনে হিঁচড়ে খেয়ে ফেলবে পশুরা।

পশুরা বুড়িকে বলে, হে দয়ালুবুড়ি, তুমি আমাদের দেখে ভয় পেয়ো না। আমরা তোমাকে খেতে আসিনি, খাওয়াতে এসেছি। তুমি যে কত মহৎ আর দয়ালু তা নেংটির কাছ থেকে শুনেছি। তোমার সেবা যত্ন করে আমরা ধন্য হতে চাই। পশুদের কথায় বুড়ি বিষ্ময়ে বলে, একি বলছ, তোমরা না হিংস্র প্রাণী! পশুরা জবাব দিল, হিংস্রতা আমাদের ধর্ম নয়।

বেঁচে থাকার জন্য আমাদের হিংস্র হতে হয়। আমাদের চেয়েও হিংস্রপ্রাণি মানুষ। এ বনে ক্ষুধা না পেলে কেউ কাউকে অনর্থক বধ করে না কিন্তু মানুষ এতোই হিংস্র যে তারা মনের আনন্দে বিনা কারণে আমাদের নির্মমভাবে হত্যা করে, আমাদের ধরে খাঁচায় বন্দী করে আনন্দ উপভোগ করে। তাদের সামান্য আনন্দের জন্য আমাদের কত জীবন যে বিসর্জন করতে হয়! কিন্তু তুমি তো শুধু মানুষই নও, অতিমানুষ। তুমি ক্ষুদ্রপ্রাণী নেংটিইঁদুরের প্রতি যে দয়া করেছো তার প্রতিদান অবশ্যই পাবে।

এই বলে যে যা এনেছে তা বুড়ির সামনে এনে রাখল। নানা জাতের ফল, শবজি, মাছ, মধু ও মাংসের স্তুপ পড়ে গেল বুড়ির সামনে। বুড়ির চক্ষু ছানাবড়া। খাবে আর কতো! পশুরা বলে, তুমি হতাশ হয়ো না। আমরা প্রতিদিন তোমাকে খাবার এনে দেবো।

তোমাকে কোনো কষ্ট করতে হবে না বুড়িমা। বুড়ির ও ইঁদুরের আর কোনো কষ্ট রইল না, মহানন্দে দিন কাটতে লাগল তাদের। বুড়ি বনের ফলমূল, মাছ-মাংস, মধু, ডিম ইত্যাদি খেয়ে সবল হয়ে উঠল। সে বন জুড়ে ঘুরে বেড়ায়। যেখানে যায় সেখানেই তার কদর।

২ এদিকে বুড়ির ছেলেমেয়েরা পড়েছে বিপাকে। নদীভাঙ্গনে তাদের বাড়ি-ঘর, জমি-জমা বিলীন হয়ে গেছে। তারা এখন নিঃস্ব। এদের খাবার নেই, মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই। এরা পথে পথে ঘুরে বেড়ায়।

কোথায় যাবে কোনো উপায় না পেয়ে ওরা ঘুরে ফিরে সেই বনে গিয়ে উঠল যেই বনে একদিন ওদের মাকে নির্বাসন দিয়েছিল। ছেলেরা বনের ভেতরে মাকে পেয়ে কেঁদে কেঁদে বলে, মা, তোমার প্রতি আমরা অনেক অন্যায় অবিচার করেছি, আমরা পাপী। তোমাকে নির্বাসনে দেয়ার পর থেকে আমরা একটি দিনও সুখে-শান্তিতে থাকতে পারিনি। একটা না একটা বিপদ লেগেই থাকতো। এই প্রমত্তা নদী আমাদের শেষ করে দিয়েছে।

সবকিছু হারিয়ে পথের কাঙ্গাল হয়ে গেলাম। আমরা এখানে সবার সাথে মিলে মিশে থাকতে চাই। তুমি আমাদের দয়া করে এ বনে একটু আশ্রয় দাও মা। সর্বংসহা মা অনুতপ্ত ছেলেদের দয়া করলেন। ছেলেরা বউ বাচচাদের নিয়ে বনে সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে লাগল।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.