ভালকে সমর্থন এবং খারাপকে বর্জন করতে শিখুন ।
টেলিফোন লাইনের ও প্রান্তে প্রেমিকাকে রেখে এ প্রান্তে মালয়েশিয়ায় গলায় ছুরি চালিয়ে আত্মহত্যা করেছে রাজীব বিশ্বাস। তখন একটু মুখের কথায়ও বাধা দেয়নি প্রেমিকা রিমি পারভীন। পরে প্রেমিকের আত্মহত্যা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে সহমরণে যেতে নিজেও আত্মহত্যা করে রিমি। মৃত্যুর আগে বড় বোনকে লিখে যায়, ‘আমি আমার জানু পাখিকে ছাড়া বাঁচতে পারলাম না
।
ওকে আমিই মেরে ফেলেছি। ’
সূত্র মতে, নড়াইল জেলার নরাগাতি থানার চরখালী গ্রামের রিমি পারভীন (২৪)। তিন বোন ১ ভাইয়ের মধ্যে সে ছিল সবার ছোট। বড় বোন দুলালী পারভীন ঢাকায় ৫৬/৭ উত্তর পীরেরবাগের ৫/এ নম্বর ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকেন। তার স্বামী মো. নুরুজ্জামান মহাখালীতে একটি প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করেন।
রিমি গ্রামের স্কুল ও কলেজে লেখাপড়া শেষে ঢাকায় চলে আসে। মিরপুর বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে ভর্তি হয় দুই বছর আগে। এখন সে সমাজকর্ম বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। বোনের সঙ্গে থেকেই চালিয়ে যাচ্ছিল লেখাপড়া। রিমির কলেজে পড়া অবস্থায় নড়াইল জেলার ভবানীপুরের অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক রঞ্জিত কুমার বিশ্বাসের একমাত্র ছেলে রাজীব বিশ্বাসের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
দু’জনের মধ্যে ঘন ঘন ফোনে কথা হতো। প্রায়ই দেখা করতো দু’জনে। বিষয়টি রিমির পরিবারের লোকজন জানতে পারে। রাজীব হিন্দু ধর্মাবলম্বী হওয়ায় তারা এ প্রেম কোনভাবেই মেনে নেননি। রাজীবের কাছ থেকে রিমিকে দূরে রাখতে তাকে ঢাকায় পাঠানো হয়।
এরপরও রিমির সঙ্গে দেখা করতে রাজীব ছুটে আসতো ঢাকায়। এ নিয়ে দু’পরিবারের মধ্যে অনেক দেন-দরবার হয়েছে। রিমির বোন রাজীবকে নিষেধ করে দিয়েছেন রিমির সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে। রিমিকেও চাপ দেয়া হয়েছে রাজীবকে ভুলে যেতে। অবস্থা বেগতিক দেখে বছর খানেক আগে রাজীবের পিতা তাকে স্টুডেন্ট ভিসায় মালয়েশিয়া পাঠিয়ে দেন।
এরপর মালয়েশিয়া থেকে রাজীব নিয়মিত রিমির সঙ্গে যোগাযোগ রাখতো। নিজের খরচের টাকা বাঁচিয়ে রিমিকে পাঠিয়ে দিতো। এদিকে রিমির পরিবারের লোকজন রাজীব দেশে আসার আগেই তাকে অন্যত্র বিয়ে দেয়ার প্রস্তুতি নেয়। পাত্রও দেখতে থাকে। রিমিকে সাফ জানিয়ে দেয়- রাজীবের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা যাবে না।
সূত্র আরও জানায়, কয়েকদিন আগে পরিবারের পক্ষ থেকে বিয়ের জন্য রিমিকে চাপ দেয়া হয়। রিমি ফোনে যোগাযোগ করে রাজীবের সঙ্গে। তাকে ভুলে যেতে বলে। রাজীব রিমিকে জানিয়ে দেয় সে তাকে ছাড়া বাঁচবে না। রিমিকে ভুলতে হলে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে হবে।
গত সোমবার সন্ধ্যায় রাজীবের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলে রিমি। রাজীব জানায়, তাকে না পেলে সে আত্মহত্যা করবে। কিন্তু রাজীবের কথায় কোন গুরুত্ব না দিয়ে রিমি সম্পর্কচ্ছেদের কথা বলে। এ নিয়ে রিমি ও রাজীবের মধ্যে টেলিফোনে ঝগড়া হয়। এক পর্যায়ে রিমিকে টেলিফোনের লাইনে রেখে রাজীব গলায় ছুরি চালায়।
পরদিন রিমি নিশ্চিত হয় রাজীব আত্মহত্যা করেছে। এরপর সে বাসায় এসে দু’টি চিরকুট লেখে। মঙ্গলবার রাত ১০টার দিকে রিমি তার রুমের দরজা বন্ধ করে দেয়। রাতের খাবারের জন্য বোন দুলালী পারভীন ডাকতে গেলে ভেতর থেকে কোন সাড়াশব্দ পায়নি। এরপর রুমের দরজা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে দেখেন রিমি সিলিং ফ্যানের সঙ্গে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে ঝুলে আছে।
তাৎক্ষণিক তাকে ঝুলন্ত অবস্থা থেকে নিচে নামানো হয়। খবর পেয়ে প্রতিবেশীরা ডাক্তার ডাকতে যান। কিন্তু আশপাশে কোন ডাক্তার না থাকায় তাকে রাতে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হয়। রাত ১১টার দিকে ঢামেকের কর্তব্যরত ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন। গত বুধবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে রিমির লাশের ময়নাতদন্ত হয়।
এরপর দাফনের জন্য লাশ নড়াইলের গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
এদিকে রিমির শোবার কক্ষে তল্লাশি চালিয়ে দু’টি চিরকুট উদ্ধার করেছে মিরপুর থানা পুলিশ। চিরকুটে লেখা আছে, ‘বুবু, আমি রাজীবকে সত্যিই মন থেকে ভালবাসতাম। কিন্তু ও আমার সঙ্গে গ্যাঞ্জাম করায় গত ১৩-৬-১১ তারিখ সময় ৫.১৮ মিনিট আমাকে টেলিফোনের লাইনে রেখে গলায় ছুরি চালিয়ে আত্মহত্যা করে। আমি নিশ্চিত হলাম আজকে।
তুই বল ও আমাকে ভালবেসে আমার জন্য মারা গেল। আমি কোন অধিকারে বাঁচি। তোদের সঙ্গে অনেক অন্যায় করেছি। আমাকে ক্ষমা করে দিস। আর আমার অ্যাকাউন্টে ২৫ হাজার টাকা ও বাসায় ৮ হাজার টাকা আছে।
সব টাকাই রাজীবের। ওর বাবা শেষ সঞ্চয়টুকু দিয়ে বাইরে পাঠিয়েছিল। ওর বাবার আর কিছু নেই। ওই টাকাগুলো ওর বাবাকে দিয়ে দিস। আজকে রাতে ওর লাশ পাঠিয়ে দেবে ঢাকায়।
যখন আমার এ চিঠি পড়বি, তখন ওদের পরিস্থিতি কিছুটা ভাল হবে। প্লিজ বুবু টাকাগুলো রাজীবের বাবাকে দিয়ে দিস। ওর বাবা বৃদ্ধ মানুষ। অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক। ওনার আর কিছুই নাই।
বাঁশগ্রামে যেয়ে ভবানীপুর বাসস্ট্যান্ডে যেয়ে রঞ্জিত কুমার বিশ্বাসের কথা বললে সবাই দেখিয়ে দেবে। ওনারা ওনাদের ছেলেটাকে হারালো। আর তোরা তোদের বোনকে। আমরা দু’জন দু’জনের জন্যই মারা গেলাম। তবে রাজীবকে মেরে ফেলেছি আমি।
আর রাজীব ছাড়া রিমির বাঁচার অধিকার নেই। আমি একজন খুনি। আমার রূপার ও সোনার হার পার্সিয়াকে দিস। ওই দু’টো আমার টাকায় কেনা। আর মোবাইলটা তুই নিস।
আমার ব্যাংকের পাসওয়ার্ড ...। টাকাগুলো রাজীবের বাবাকে দিস প্লিজ। ওনাদের বলিস আমার কাছে রেখে গিয়েছিল। এখন আমি নাই, টাকাগুলোয় বৃদ্ধ বাবা-মা কতদিন চলতে পারবে। আর একটা কথা, রাজীব তোদের কত কথা বলেছে।
এখন ও আর নেই বুবু। আর কোনদিন বলতেও আসবে না। ওর বাবা-মাকে কোন ধরনের কথা বলিস না। ওনারা তো ওনাদের সন্তানকে হারিয়েছেন। বুবু, শেষবারের মতো তোর কাছে আমার অনুরোধ আমার মৃত্যু নিয়ে রাজীবের বাবা-মাকে কিছু বলিস না।
ওনার একমাত্র ছেলেটা শুধুমাত্র আমার জন্য হারালো। রাজীব গলায় ছুরি দেয়ার সময় আমি ওকে বাধা দেইনি বুবু। আমি ওকে মেরে ফেলেছি। ও আমাকে সত্যিকার অর্থে ভালবাসতো। কিন্তু আমি ওর ভালবাসার সম্মান রাখতে পারিনি।
ওর মৃত্যুর জন্য আমিই দায়ী। আমাকে ক্ষমা করে দিস। আমি আমার জানু পাখিকে ছাড়া বাঁচতে পারলাম না। ওকে আমি মেরে ফেলেছি বুবু। ওর মরার সময় একবারও বাধা দেইনি আমি ওকে।
আমার জানু পাখিকে ক্ষমা করে দিস। রিমি। ’
গতকাল সকালে উত্তর পীরেরবাগে সরজমিন গিয়ে দেখা গেছে রিমিদের বাসা তালাবদ্ধ। পাশের ফ্ল্যাটের সাইফুলের মা জানান, মঙ্গলবার রাতে হঠাৎ কান্নাকাটি শুনতে পাই। এ সময় রিমির বড় বোন বলেন, রিমি সংজ্ঞাহীন হয়ে গেছে।
ওকে ডাক্তারের কাছে নিতে হবে। তার সঙ্গে আমার ছেলে সাইফুলও মেডিকেলে যায়। পরে জানতে পারি রিমি আত্মহত্যা করেছে। আরেক প্রতিবেশী জানান, রিমি ছিল খুবই হাসিখুশি। শ্যামবর্ণের হলেও তার চেহারা ছিল মায়াময়।
শুনেছি মালয়েশিয়ায় পড়াশোনা করে এক হিন্দু ছেলের সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্ক ছিল। পরিবারের লোকজন সম্পর্ক মেনে না নেয়ায় রিমি ও তার প্রেমিক আত্মহত্যা করেছে।
মিরপুর মডেল থানার অপারেশন অফিসার আবু বকর মিয়া জানান, রিমি ও রাজীব একে একে দু’জন আত্মহত্যা করে। এ ঘটনা খুবই কষ্টের।
মিরপুর মডেল থানার ওসি কাজী ওয়াজেদ মিয়া বলেন, এ ঘটনা বড়ই মর্মস্পর্শী।
রিমির পরিবারের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, রাজীব হিন্দু ধর্মাবলম্বী হওয়ায় তাকে ছেড়ে দিতে রিমিকে চাপ দেয়া হচ্ছিল। এদিকে গতকাল বৃহস্পতিবার মালয়েশিয়া থেকে রাজীবের লাশ ঢাকায় এসে পৌঁছেছে।
নড়াইলে পৌঁছেছে রাজিবের লাশ
হুমায়ুন কবীর রিণ্টু, নড়াইল থেকে জানান, নড়াইল সদর উপজেলার ভবানিপুর গ্রামের রাজিব (২২) মালয়েশিয়ায় আত্মহত্যা করেছে। তার বাড়িতে শোকের মাতম চলছে। গতকাল সন্ধ্যায় ভবানিপুর গ্রামে তার লাশ নিয়ে আসলে এক হৃদয় বিদারক অবস্থার সৃষ্টি হয়।
কান্নায় ভেঙে পড়েন সবাই। গতকাল ভদ্রবিলা শ্মশানে তার সৎকার করা হয়েছে। তার পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, ১৩ই জুন সন্ধ্যায় সে মালয়েশিয়ায় গলায় রশি দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। মাত্র ৯ মাস আগে স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে সে হোটেল ম্যানেজমেন্ট পড়তে মালয়েশিয়ায় যায়। হঠাৎ করে তার মৃত্যু সংবাদ শুনে তার পরিবারের লোকজন মুষড়ে পড়েছেন।
তার মা তৃপ্তি রানী অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে আছেন ঘরের মধ্যে। বাবা আশুতোষ নির্বাক হয়ে পড়ে আছেন। তার বাবা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক রনজিত বিশ্বাস কারো কথার উত্তর দিচ্ছেন না। শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকছেন। মৃত্যু সংবাদ শোনার পর তার বাবা ও মা দু’জনেই খাওয়া গোসল ছেড়ে দিয়েছেন।
রাজিবের বাবা কোন কথার জবাব না দিয়ে শুধু একটা কথাই বলেন আমার সব শেষ হয়ে গেছে। ছেলের কোথাও কোন প্রেম ছিল কি-না তা তিনি জানেন না বলে জানান। রাজিবের কাকা যুব উন্নয়নের প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা আশুতোষ বিশ্বাস চাকরি সুবাদে যশোর থাকেন। তিনি জানান, রাজিবকে ওর বাবা অনেক কষ্টে টাকা পয়সা খরচ করে মালয়েশিয়ায় পাঠিয়েছিল। মালয়েশিয়ায় যাওয়ার আগে সে ইংরেজি বিষয়ে অনার্স পড়তো।
স্টুডেন্ট ভিসা পেলে মালয়েশিয়ায় চলে যায়। যশোরে পড়াকালীন মাঝে মধ্যে সে তার কাকা আশুতোষের বাসায় যেত। তার কাকা আশুতোষ জানান, রাজিব খুবই চাপা স্বভাবের অত্যন্ত বিনয়ী। সব সময় মাথা নিচু করে থাকতো। প্রয়োজন ছাড়া কথা বলতো না।
প্রয়োজনীয় কথা বা কাজ থাকলে সেরে বাসা থেকে চলে যেত। শুনেছি রিমি নামে বুয়েটপড়ুয়া একটা মেয়ের সঙ্গে তার প্রেম ছিল। তবে আত্মহত্যার কারণ কি তা তিনি বলতে পারেননি। রাজিবের একমাত্র বোন লতা বিশ্বাস জানান, রিমি নামের ওই মেয়েটার কারণেই আমার ভাই মরতে পারে। তাছাড়া অন্য কোন কারণ নেই।
বাড়িতে এত অভাব সত্ত্বেও বাবার অবসরের টাকা-পয়সা খরচ করে তাকে পড়তে পাঠানো হয়েছে। তার সব দাবিই বাবা পূরণ করেছেন। কয়েক দিন আগেও বাড়ি ফোন করে জানিয়েছে সে ভাল আছে। তারপর কেন যে এমন কাজ করলো।
সুত্র: Click This Link ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।