এই যে ফাঁকিবাজ সাহিত্যিক,আপনার ফোন বাজে দয়া করে ধরেন নাহলে আমি মোবাইলটা ধরে আছার দিবো!''
;কি ভয়াবহ কথা!!তুই জানিস এই মোবাইলটা আমার জান,আমি মরতে রাজি আছি তবু মোবাইলের কিছু হওয়া যাবেনা...
;ওরে বাপস!!!এ দেখি মোবাইলের সাচ্চা প্রেমিকা!এবার দয়া করে মোবাইল নিয়া বিদায় হও...
মোবাইলটা হাতে নিয়ে স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠি!হায় হায়,আম্মুর ফোন,আজকে খবর আছে...বাসায় যাওয়ার সময় কানে তুলা দিয়ে ঢুকতে হবে,ভাবতে ভাবতে ফোন কানে ধরতেই বিনা বিরতিতে ঝাড়ি শুরু...
;এই মেয়ে,তুই কি শুরু করছিস?ফোন ধরিস না কেন?সকালে না খেয়ে বের হলি কোন আক্কেলে?তোর জ্বালায় আমি পাগল হয়ে যাব!ইত্যাদি ইত্যাদি।
একটু পর বললাম,
;আম্মু,এসব কথাতো আমি বাসায় আসলেও তুমি বলতে পারবা নাকি?শুধু শুধু টাকা খরচ করে এসব কথা বলার কোন মানে আছে?মুল কথা যেটা সেটা বল...
কিন্তু রেজাল্ট দেখি ঊল্টা,মনে হল আম্মুর রাগের মাত্রা বেড়ে গেল...
;টাকা গেলে আমার যাবে তোর কোন দরকার নাই ভাবার তোর যেমন বাসা নিয়া কোন চিন্তা নাই...সকালে না খেয়ে বের হওয়াটা মনে হয় খুব ভাল কাজ না?ইত্যাদি ইত্যাদি। আবার শুরু হইল...কি যে করি ফোন কানে নিয়ে আল্লাহকে ডাকতে লাগলাম,একটু পর আম্মু বলল,
;তোর নীলা মামী আজকে বিকেলে বাসায় চলে যাবে,তোর নিপু মামা ফোন করেছিল তোকে যেতে বলেছে ক্লাস শেষ করে দেখা করে আসবি।
আমি বললাম,
;আম্মু তোমরাতো আমাকে বড় থেকে বুড়ি বানায় দিবা মনে হয়!বাবুতো যেদিন হইল সেদিন দেখে আসছি আবার যাওয়ার কি আছে?
;তুই কথা কম বল,যেটা বলছি সেটা কর।
কি আর করা,আম্মু খুব ভাল করেই জানে আমি যাবনা তাই রাগী মুড নিয়ে ফোন করেছে যাতে যাই,কিন্তু আমার কোনভাবেই নিপু মামার সামনে যাওয়ার ইচ্ছা নাই।
অনেক চিন্তা ভাবনা করতে করতে ব্যাংক হাসপাতালে গেলাম,কি করব কি বলব বুঝতেছিনা...!হঠাৎ ফোন বেজে উঠল,তাকিয়ে দেখি দিপা খালার ফোন...আবার কি হল?
;শোন,তুই কি হাসপাতালে গিয়েছিস?
;হুম,লিফটের সামনে আছি।
;দেখ,কোন বেশি কথা বলবিনা,চুপ থাকবি,যা বলে শুধু শুনে আসবি।
;খালা তুমি ভাল করেই জান আমি শুনে আসার মেয়ে না,আর এত কিছুর পর শুধু শুনে আসব আমি তা হবে না..
;হুম,ঘটকালীটা করার সময়তো মনে ছিল না...
;খালা তুমি আবার পুরোনো কথা কেন উঠালা?আমার দোষ না?তোমারা যে্মন কোয়ালিটির মেয়ে চাইছ আমি তেমন মেয়েই খুজে এনে দিছি আর এখন আমার দোষ,আমি মনে হয় নীলার বাসায় যেয়ে থাকতাম যে আমি জানব তার মনের খবর,তোমরা এত বছরে তোমার ভাইকেই চিনলা না আর নীলাতো সেই দিনের মেয়ে...
;তুই কি এখন তাহলে হাসপাতালে ঝগড়া করবি?
;আমার এমন কিছু করার কোন ইচ্ছা নাই,আমি এখন ফোন রাখি গত তিন বছরে এই একই কথা বলতে বলতে আমার মুখ ব্যাথা হয়ে গেছে...
হাসপাতালের প্রতি অন্যরকম একটা অনুভুতি কাজ করে কোন ভয় বা খারাপ লাগা না,এক ধরনের ভালো লাগা...হাসপাতালে আসলে দেখা যায়,অনেক মানুষের অনেক রকমের মুখ,অনেক ধরনের অনুভুতি...কারো চোখে আনন্দ কারো চোখে দুঃখ...কেউ সুস্থতার সুখ নিয়ে বাড়ি ফেরে আবার কেউ প্রিয়জন হারানোর ব্যাথা নিয়ে বাড়ি ফেরে...বেবী ওয়ার্ডটা আমার খুব পছন্দের জায়গা,নতুন মানুষ আসার আনন্দে মুখোর আত্নীয় স্বজন,বাবা হবার অনাবিল আনন্দ,মা হবার সুখ আর ছোট্ট মানুষটার আগমনী কান্না...সে এক দেখার মত দৃশ্য...
এসব ভাবতে ভাবতে ২০৪নং কেবিনের সামনে চলে আসলাম,দরজায় নক করে ভেতরে ঢুকে দেখি মামী বেড এ বসে আছে আর পাশে মামা। আর বাবুটা মনে হল ঘুমাচ্ছে। নিপু মামা আম্মুর চাচাত ভাই,আমার নানারা সব ভাই কাছাকাছি থাকাতে আমাদের সম্পর্কটা অনেক ভাল,বিশেষ করে আমার আর মামার।
সালাম দিয়ে খবর জানতে চাইলাম,মামা বলল বিকেলে ডাক্তার দেখে যাবার পর বের হবে,মামীর দিকে তাকিয়ে হেসে বললাম,
;কি মামী?কেমন লাগছে?কার মত মনে হচ্ছে মেয়েকে তোমার মতো নাকি মামার?
মামী হেসে বলল,
;কিছুটা লাগছে,তুমি এসেছ খুব ভালো হয়েছে,মনটা খুব অস্থির হয়ে আছে কেমন যেন লাগছে...আর তার উপর তোমার মামা কাল কি একটা কান্ড করল শুনেছতো নিশ্চয়ই...
আমি মুখ গম্ভীর করে মাথা নিচু করে ফেললাম,এ বিষয় নিয়ে এখন কথা বলা ঠিক হবেনা মনে হয়,কিন্তু মামী যখন কথা উঠাল তখন কি করব বুঝতেছিনা...!কিন্তু ব্যাপারটা মোটেও চুপ থাকার মতো না,নানা-নানু খুবই কষ্ট পেয়েছে,নানুতো কান্নাকাটি করছে...এদিকে মামাও চুপ। আমিও চুপ করে রইলাম,একটু পর মামাই শুরু করল,
;আসলে কথা প্রথমে আম্মাই শুরু করেছিল,তার একই কথা বাচ্চা হওয়ার পর তোমার মামীকে মায়ের বাসায় পাঠানো যাবেনা,এ বাসায় আনতে হবে,আচ্ছা তুমিই বল,এ বাসায় কে দেখবে তোমার মামীকে?
আমি বাবুটাকে একটু আদর করে বললাম,
;তাই বলে আপনি নানুকে এভাবে বলবেন?শত হলেও আপনার মা,সামনে নানা ছিল বড় মামীরা ছিল সবার সামনে এভাবে বলাটা কি ঠিক হইছে,আপনার বাচ্চার খারাপ তারা চাইবে কেন?
মামা বললেন,
;হ্যা তা ঠিক,কিন্তু কঠিন কথা না বলে উপায় ছিল না,বিয়ের পর থেকে নিয়ে এ পর্যন্ত আব্বা আম্মারতো খালি না আর না,আমার কোন কাজই তাদের পছন্দ না,আলাদা হতে চাইলাম তাও দিবেনা আবার একসাথে থাকাও সম্ভব হচ্ছেনা...বলতে বলতে মামা থেমে গেলেন,আমিও চুপ করেই রইলাম। কি বলব?আমার এ বিষয়ে তেমন কিছুই বলার ইচ্ছা এখন নেই,তিন বছর আগে সবার পছন্দের সাথে মিলিয়ে মেয়ে খুঁজে এনে বিয়ে করানো হয়েছিল নিপু মামার। কিন্তু বিয়ের পর কেন জানি সব কিছু হঠাৎ করেই অনেক বেশি বদলে গেল,সবার প্রিয় আদরের ছোট অনুগত ভাই হঠাৎ করেই বদরাগী,গম্ভীর আর পর পর ভাব মানসিকতার মানুষ হয়ে গেল। দোষ কম বেশি সবারই ছিল কিন্তু বুঝদার মানুষের কাছে প্রত্যাশা বেশি থাকে এটা মামা একদম ভুলেই গেলেন।
ব্যাপার গুলো এমনভাবেই হতে লাগল যে সবার রাগ আর ক্ষোভ এসে পড়ল আমার উপর,এক পর্যায়ে আমি বাধ্য হয়ে নানুর বাসায় যাওয়াই কমিয়ে দিলাম,গেলেই শুধু নালিশ আর নালিশ। এ ব্যাপার নিয়ে নীলা মামীর সাথে অনেকবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কথা বলে দেখেছি, যতটুকু বুঝেছি,নতুন মানুষ হিসেবে মামী যতটা না ভুল আচরন করছে তার থেকে অনেক বেশি কষ্টকর আচরন করছে মামা। কারনটা আমি আম্মু কেউই ধরতে পারলাম না,তবে আমি ধরতে পারলাম ওদের প্রথম ম্যারেজ ডে তে।
মামার পাঁচ ফ্রেন্ডদের মধ্যে মামাই সবার শেষে বিয়ে করেছেন,বাকি চার ফ্রেন্ড অলরেডী বিয়ে করে বাচ্চার বাবা,এবং বিয়ের কয়েক বছরের মধ্যেই তারা আলাদা বাসা নিয়ে আলাদা সংসার করছে,একই অবস্থা নীলা মামীর বাসায়ও ও নিজে জয়েন্ট ফ্যামিলিতে বড় হলেও ওর কাজিন আর ফ্রেন্ডরা সব যার যার মতো সংসার করছে ব্যাতিক্রম শুধু ওরাই। জয়েন্ট ফ্যামিলিতে কোন কিছু করে শান্তি নাই,এখানে অনেক বেশি রেসট্রিকশন,সবার খবরদারী বেশি,মানুষ বেশি ইত্যাদি টাইপের মনোভাব ওদের ভেতর খুব ভালো ভাবেই বাস করছে,এতোদিনতো সবার সাথেই ছিলাম এখনতো বড় হয়েছি,নিজের পায়ে দাড়িয়েছি এখনতো নিজের মতো করে চলব,এখনো যদি সেই আগের মতো সবার মাঝে থাকবো এটা কেমন কথা......
হায়রে...এই জন্যই কি বাবা-মা এত কষ্ট করে সন্তান মানুষ করে?...কিন্তু ওরা চাইলেও আলাদা হতে পারেনি,নানার একই কথা,আমি যত দিন বেঁচে আছি যত কিছুই হোক আমার কোন ছেলে আলাদা হতে পারবেনা,আর তাই গত তিন বছর ধরেই এত কিছুর মাঝেও সবাই একসাথেই আছে।
আমাকে চুপ থাকতে দেখে মামা খুব অবাক হলেন,তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে,আমি সেদিকে না তাকিয়ে উঠে গিয়ে বাবুনিকে কোলে নিলাম,ওর দিকে তাকিয়ে বললাম,
;এই যে ছোট্ট আপ্পি,কেমন আছো?তুমি জান?তুমি আসাতে আমরা সবাই কত খুশি হয়েছি,
তোমার আসার খবর শুনে তোমার বড় চাচ্চুরা এতো এতো মিষ্টি সবাইকে খাইয়ে্ছে,আর তোমার দাদু মসজিদে যেয়ে মাইকে ঘোষনা দিয়েছে!শুধু তাই না তোমার দাদু কষ্ট করে হেঁটে যেয়ে তোমার জন্য স্বর্নের চেইনের অর্ডার দিয়ে এসেছে,সেটা পড়িয়ে তোমাকে ঘরে ঢুকানো হবে,তোমার দাদী চোখে মোটা পাওয়ারের চশমা পড়ে তোমার জন্য সুন্দর সুন্দর কাঁথা জামা বানিয়েছে,তোমার চাচী-ফুপ্পিরা তোমার জন্য এতো এতো গিফট কিনে রেখেছে,তোমার বড় ভাইয়া আপুরা তাদের সব খেলনা দিয়ে তোমার ঘর সাজিয়ে রেখেছে...বলতে বলতে কন্ঠটা ধরে এলো। অনেক কষ্টে স্বাভাবিক হয়ে বলতে লাগলাম,
;তুমি কত ভাগ্যবতি দেখেছ?তুমি এসেই সবার মন জয় করে নিয়েছ,সবার ভালোবাসা আদায় করে নিয়েছ আর নিবেইবা না কেন?তুমিতো তাদের সবার আদরের ছোটনের মেয়ে,তোমার বাবাকে তারা অনেক ভালোবাসে,তোমার দাদাতো এখনো তোমার বাবাকে ছোটনই ডাকে...শুনেছি তোমার বাবা নাকি তার মাকে ছাড়া একদিনও থাকতে পারতো না,এমনকি অফিস থেকে এসেও মা ভাত মাখিয়ে না রাখলে খেত না,আর এখন?তোমার সেই বাবা তার মাকে ছেড়ে আলাদা থাকার কথা ভাবে?যে মানুষগুলা তোমার জন্য এতো এতো আয়োজন করে বসে আছে সেই মানুষগুলার সাথে থাকতে তোমার আব্বু-আম্মুর ইচ্ছে করেনা। সব কিছু কিভাবে ভুলে গেল তোমার বাবা?এতোই সহজ ভালোবাসার দেনা শোধ করা?...
বলতে বলতে চোখ ভিজে এলো আমার,তাড়াতাড়ি চোখ মুছে আবার বললাম,
;এখন আর আমার কোন দুঃখ নেই,কারন এখন তুমি এসেছ,এখন তোমার বাবা-মা বুঝবে বাবা-মায়ের কাছে সন্তান কি জিনিস,কত কষ্ট একটা সন্তান মানুষ করা আর কত কষ্ট সন্তানের দেয়া আঘাত সহ্য করা,এখন তারা বুঝবে...''আবার ও চোখ ভিজে এলো আমার। চোখ মুছে মাথা তুলে দেখি,মামা-মামী দুজনেই মাথা নিচু করেই আছেন,বুঝতে পারছি দুজনের মনেই একটা ঝড় বয়ে যাচ্ছে,হে আল্লাহ, এই ঝড় যেন এবার সব কষ্ট উড়িয়ে নিয়ে যায়,ভুলিয়ে দেয় সব ব্যাথা...
একটু পর মামা মোবাইল বের করে ফোন করে বলতে লাগল,
;ভাবি,আমি নীলা আর বাবুনিকে নিয়ে বাসায় আসছি আপনি একটু আমাদের ঘরটা পরিস্কার করে রাখেন আর আব্বা-আম্মাকে এখন কিছু বইলে্ন না আমি এসে সারপ্রাইজ দিব।
একটু পর শুনি মামী ও ফোনে বলছে,
;আম্মু,আমি বাবুনিকে নিয়ে সোজা আমার বাসায় যাচ্ছি,তুমি সবাইকে নিয়ে ওখানেই এসো না না কোন সমস্যা হবেনা ও বাসায় টেক কেয়ার করার অনেক মানুষ আছে বড় ভাবি ছোট ভাবি,আম্মা অনেক মানুষ তুমি চিন্তা করো না...
ওয়াশ রুম থেকে এসে আমি দরজার বাইরে দাড়িয়া সব শুনে মনে মনে আল্লাহর দরবারে লাখ লাখ শুকরিয়ে আদায় করলাম,অবশেষে এই কষ্টের বৃত্তের একটা ইতি টানা হল,যদিও এই ইতিবৃত্তের মাঝখানে রয়ে গেছে অনেক অজানা গল্প...থাক,সে গুলো অজানাই থাক... ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।