ছেলেটির সফটওয়্যার ডেভেলপ করার নেশা সেই ছোট্টবেলা থেকেই। বয়স তখন ১০ কি ১২! লেখাপড়ার চেয়ে প্রোগ্রামিং করার পেছনেই বেশি আগ্রহ।
চিকিৎসক বাবাও ছেলের অদম্য ইচ্ছাটির কথা জানতে পারেন সময়মতো। লেখাপড়া না করে প্রোগ্রামিংয়ে সময় নষ্ট করছে জেনে তিনি এতটুকুও রাগান্বিত হননি। বরং তিনি ছেলের ইচ্ছার মশালে ক্ষণে ক্ষণে যেন ঘি ঢালতে শুরু করেন! নিজেই ছেলেকে শিখিয়েছেন ‘আটারি প্রোগ্রামিং ভাষা’।
ছেলে যখন কেবল প্রাইমারি শিক্ষার দুয়ার পেরিয়ে মাধ্যমিকে পা দিয়েছে, প্রোগ্রামিংয়ের নেশা তখন আরোও বেড়েছে। ছেলের এ আকাংখাকে পূর্ণ করতে তখন খ্যাতনামা সফটওয়্যার ডেভেলপার ডেভিড নিউম্যানকে টিউটর হিসেবেও নিয়োগ দিয়েছেন বাবা। তারপর থেকে প্রোগ্রামিংয়ে আরও দুর্দান্ত গতিতে এগুতে শুরু করে ছেলেটি।
সফটওয়্যার ডেভেলপ করার ক্ষেত্রে ছেলেটির লক্ষ্য একটি নির্দিষ্ট গোলকে বন্দি ছিল। তিনি কেবল একটি কম্পিউটারের সাথে অন্য কম্পিউটারের সাথে যোগাযোগ প্রক্রিয়া কিভাবে সহজ করা যায় সেসব নিয়েই ভাবতেন এবং সফটওয়্যার তৈরি করতেন।
মাধ্যমিক লেভেলের শিক্ষা শেষ হওয়ার আগেই একটি নতুন প্রযুক্তির মিডিয়া প্লেয়ার তৈরি করেছিলেন তিনি। ‘সিনাপসে মিডিয়া প্লেয়ার’ নামক এই মিউজিক প্লেয়ারটিতে বিশেষ ধরণের কৃত্রিম ইনটেলিজেন্সি ব্যবহার করা হয়েছিল। যেটি ব্যবহারকারীর গানশোনার ‘হ্যাবিট’ বুঝে সে অনুযায়ী নিজস্ব ‘প্লেলিস্ট’ তৈরি করে গান বাজাতে সক্ষম ছিল। মিউজিক প্লেয়ারে কৃত্রিম ইনটেলিজেন্স ব্যবহারের ধারণাটি টেক মহারথীদের বিস্মিত করলো ব্যাপক। ‘সিনাপসে মিডিয়া প্লেয়ার’ পিসি ম্যাগাজিনের জরিপে ৫ এর মধ্যে ৩ র্যাংক পেল।
মাইক্রোসফট এবং অ্যাপেল উভয়ই মিডিয়া প্লেয়ারটি কিনে নিতে চাইলো। এমনকি নিজ প্রতিষ্ঠানে নিযুক্তও করতে চাইলো ছেলেটিকে।
‘এখনই চাকরি-বাকরিতে নিজেকে জড়াতে চাই না, সংক্ষিপ্ত করতে চাইনা সৃজনশীলতার পথ। আমাকে আরোও এগিয়ে যেতে হবে। নতুন কিছু তৈরি করতে হবে।
’ ঠাই জবাব ছেলেটির।
প্রিয় পাঠক, প্রোগ্রামিং পাগল ছেলেটির নাম কি এখনও ধরতে পেরেছেন কেউ?
যার গল্প এতক্ষণ ধরে করলাম তিনি হচ্ছেন বিশ্বের সর্ববৃহৎ সামাজিক যোগাযোগ সাইট ফেসবুকের প্রধান নির্বাহী মার্ক জুকারবার্গ।
বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে, ঘুরে তিনি এতটুকুও সময় নষ্ট করেননি। কম্পিউটারই ছিল তার একমাত্র বন্ধু। আর এই বন্ধুর সঙ্গে নির্বিঘেœ তিনি খেলেছেন।
২০০২ সালের সেপ্টেম্বরের কথা। মাধ্যমিক শেষ করে কেবল হার্বার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন জুকারবার্গ। ততদিনে ‘প্রোগ্রামিং প্রডিজি’ হিসাবে তার সুনাম আশেপাশে বেশ ছড়িয়েছে। হার্বার্ডে পড়াশোনার পাশাপাশি তাঁর নতুন স্বপ্ন ইন্টারনেটে একটি পারষ্পরিক যোগাযোগের ওয়েবসাইট তৈরি। যেখানে মূলত সবার ছবি থাকবে আর বন্ধুরা এসব ছবিতে কিছু মন্তব্য যুক্ত করবে।
হার্বার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এই প্রকল্পটির নাম ছিল ‘ফেসম্যাশ’। সাইটটি তৈরির পর হার্বার্ডের শিক্ষার্থীদের ছবি আপলোডের পালা। সব শিক্ষার্থীর ছবি আর জীবনবৃত্তান্ত কোথায় পাবেন জুকারবার্গ? সাহসী একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন বটে! তিনি হ্যাক করলেন হার্বাডের শিক্ষার্থী ডাটাবেজ নেটওয়ার্ক। এরপর সেখান থেকে ছবি সংগ্রহ করে তা ওয়েবে আপলোড করলেন তথ্যসহ। পরদিন থেকেই এটি তুমুল জনপ্রিয়তা পেল পুরো হার্বার্ড জুড়ে।
শিক্ষার্থীরা এটি এতবার ভিজিট করলো যে পুরো হার্বার্ডের নেটওয়ার্ক সার্ভারই ডাউন হয়ে গেল। প্রথম সফলতা হিসাবে জুকারবার্গ এতে খুশি হলেও এতে বেশ ঝামেলাও পোহাতে হয়েছিল তাঁকে। কম্পিউটার নেটওয়ার্ক হ্যাকিংয়ের দায়ে কপালে জুটলো ভর্ৎসনা, অনুমতি ছাড়াই ছবি আপলোডের কারণে কেউ কেউ ব্যাপক ক্ষিপ্ত হলো জুকারবার্গের উপর। জুকারবার্গের ওয়েবসাইট বাতিলের জন্য আবেদন জমা পড়ল কয়েক ডজন।
এরপর একটু দমে গেলেন জুকারবার্গ।
কৃতকর্মের জন্য প্রকাশ্যে সবার কাছে ক্ষমা চাইলেন। তবু তার স্বপ্ন নিয়ে থেমে থাকলেন না। এগিয়ে যেতে থাকলো ফেসম্যাশের আদলে নতুন একটি ওয়েবসাইটের কোডিং, দ্যা ফেসবুক ডটকম।
২০০৪ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি চালু হলো জুকারবার্গের তৈরি করা ‘দ্যা ফেসবুক’। চালুর কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই হার্বার্ডের ডরমিটরি রুম থেকে দ্যা ফেসবুক প্রকল্প গেল পালো আলতোর নিজস্ব অফিসে।
প্রায় একই সময়ে হার্বার্ডের লেখাপড়াও ছাড়লেন জুকারবার্গ। নিজস্ব অফিসে যাওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের বেশকিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য চালু হলো ‘দ্যা ফেসবুক’। বড় আকারে কার্যক্রম শুরু করতে গিয়ে জুকারবার্গ পড়লেন নতুন বিপাকে! বিনিয়োগকারী দরকার। অনলাইন অর্থ লেনদেনকারী প্রতিষ্ঠান পেপাল সহ প্রতিষ্ঠাতা পিটার থিয়েল প্রথম বিনিয়োগ করেছিলেন ফেসবুক প্রকল্পে। তিনি ৫ লাখ ডলারের বিনিময়ে পেয়েছিলেন ফেসবুকের ৭ শতাংশ শেয়ার।
জুকারবার্গের প্রকল্পের ভবিষ্যত দিন দিন উজ্জল হতে থাকলো। এরপর একে একে বহু ভেনচার ক্যাপিটালিস্ট ফার্মের বিনিয়োগ হয়েছে ফেসবুকে। দুর্দান্ত গতিতে এগিয়ে যেতে থাকলো ফেসবুক। ২০০৭ সালের ২৪ মে চালু হলো ‘ফেসবুক প্লাটফর্ম’। প্রতিদিনই তৈরি হতে থাকলো লাখ লাখ নতুন ফেসবুক ভিত্তিক অ্যাপ্লিকেশন।
এরপরের ইতিহাস সবারই জানা। ৬০ কোটি ফেসবুক ব্যবহারকারী, বছরে প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার মুনাফা, ২ সহশ্রাধিক কর্মী আর যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় বিশাল অফিস।
বলতে গেলে শূণ্য থেকেই শুরু জুকারবার্গের। এরপর একটি স্বপ্নকে পুঁজি করে রাজকন্যা, প্রাসাদ, ১৪ বিলিয়ন ডলার আর টাইমের মতো ম্যাগাজিনের সম্মাননা!
আর কি চাই? নিজের অবস্থান নিয়ে জুকারবার্গও বেশ উচ্ছসিত। তার সোজা কথা, ‘স্বপ্ন দেখেছি বলেই আজকের এই অবস্থান।
যখন যেখানে যে অবস্থাতেই ছিলাম না কেন, নিজের স্বপ্নকে পুঁজি করেই যাত্রা ঠিক রেখেছি। ’
নতুন প্রজন্মের উদ্দেশ্যেও জুকারবার্গের সোজা পরামর্শ, ‘ইউনিক অ্যান্ড কুল আইডিয়া’ খুঁজে বের করো, দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা করো, আত্মবিশ্বাস নিয়ে এগিয়ে চলো আর কারো সমালোচনায় হতাশ হবে না। সাফল্য
আসবেই। ’
View this link ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।