আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

টংগা ঝিরি পাড়ার ত্রিপুরা আদিবাসীদের সাথে কাটানো দুর্লভ কিছু মুহূর্ত

'জীবন' হলো এক কাপ গরম চা আর একটা জ্বলন্ত বেনসনের মতো। গরম চা একসময় জুড়িয়ে যাবে, বেনসনের তামাকও পুড়ে শেষ হয়ে যাবে। টংগা ঝিরি পাড়া দীর্ঘদিন থেকেই ভাবছিলাম পাহাড়ী কোন পাড়ায় গিয়ে আদীবাসীদের সাথে ক’'টা দিন কাটিয়ে আসবো। কাজের ব্যস্ততায় সে সুযোগ আর হয়ে ওঠেনি। তবে সম্প্রতি বান্দরবান জেলার লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নের অন্তর্ভূক্ত 'টংগা ঝিরি পাড়া' ঘুরে দেখার সৌভাগ্য হলো।

বর্তমানে এখানে ৬৮ টি বাড়িতে ৫৬ টি পরিবার বাস করছে। টংগা ঝিরি পাড়ার পাহাড়ী বাড়ি পাহাড়ের উপরে ত্রিপুরাদের বসতি ১৬ জুন, ২০১১। সকাল থেকেই টিপ টিপ বৃষ্টি। তারপরেও যাবো যখন মনস্থির করেছি, রওনা হয়ে গেলাম। লামা’র গজালিয়া স্ট্যাণ্ড থেকে জনপ্রতি ৫০ টাকার টিকেট কেটে সকাল ৯.৩০ এর ’'শর্ট বডি'’-তে উঠে বসলাম।

আমার সাথে আরও ৫ জন কলিগ রয়েছেন। ঠিক হলো, আমরা কিয়াজু বাজারের আগেই নেমে পড়বো। লক্ষ্য, টংগা ঝিরি পাড়া। টংগা ঝিরি পাড়ায় পায়ে হাঁটা পথ প্রসঙ্গত: জানিয়ে রাখছি, লামা সহ অন্যান্য পাহাড়ী এলাকায় যানবাহন না পাওয়াটা একটা বড় সমস্যা। আর সন্ধ্যার পরেতো পাহাড়ী রাস্তায় কোন প্রকার যান চলাচলই করেনা।

চান্দের গাড়ি কিংবা শর্টবডি’র জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। মূলত: চান্দের গাড়ির পাশাপাশি এখানে '’শর্ট বডি’' চলে। ’'শর্ট বডি’' এক ধরনের জীপ যেখানে ড্রাইভার সহ ১৫ জন অনায়াসে বসতে পারে। তবে, ’শর্ট বডি’-এর ছাদে, দরজার পাশে - যেখানেই সামান্য জায়গা আছে, সেখানেই উঠে পড়ে মানুষ। চান্দের গাড়ির সাথে ’'শর্ট বডি'’-এর পার্থক্য হলো, ’শর্ট বডি’-জীপের সামনের অংশের ’গ্যালারি’ -তে ৪ জন বসতে পারে, আর এর পিছনের দরজাটা চলন্ত অবস্থায় আটকানো থাকে।

ফিরে আসি টংগা ঝিরি পাড়াতে ঘুরতে যাবার প্রসঙ্গে। এটি মূলত: একটি ত্রিপুরা পাড়া, যেটি দুর্গম এলাকার মধ্যে পড়েনি। অর্থাৎ, আমরা যারা পাহাড়ে থাকিনা, তাদের জন্য একটু কষ্ট হলেও যাওয়া সম্ভব। অসম্ভব সুন্দর, শান্ত এক পরিবেশ। পাহাড়ের উপর থেকে দেখা দৃশ্য টংগা ঝিরি পাড়া থেকে তোলা ছবি বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় সমতল অঞ্চলের ’'গ্রাম'’-এর মতো পাহাড়ী এলাকায় ’'পাড়া’' ব্যবস্থা রয়েছে।

এক একটি পাড়ায় অনেকগুলো আদিবাসী পরিবার বাস করে। এসব পাড়ার নিয়ন্ত্রণে থাকেন 'কারবারী' এবং 'হেডম্যান'। তাদের কথাই ওই পাড়ার মানুষজন মেনে চলে। ত্রিপুরাদের বাড়িঘর ত্রিপুরাদের বাড়ি পাহাড়ের উপরে ত্রিপুরাদের বাড়ি লামার আদিবাসীদের মধ্যে মার্মারা (যারা অপোকৃত সমতলে থাকে) একটু শিক্ষিতই বলা যায়। এরা ভালো বাংলা বলতে ও বুঝতে পারে।

এদের অনেক পরিবারেই মাধ্যমিক পাশকৃত ছাত্রছাত্রী রয়েছে। মার্মারা মূলত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। মুরং আদিবাসীরা পাহাড়ের উপরে এবং দুর্গম এলাকাগুলোতে থাকে। এরা বাংলা ভাষা বলতে গেলে বুঝেইনা। আর জামা কাপড় পড়ার ব্যাপারে কেন যে এরা উদাসীন, তা আমার বোধগম্য নয়।

লামাতে মারমা বা মুরংদের মতো সংখ্যায় বেশি না হলেও এখানে বেশ কিছু ত্রিপুরা পাড়া রয়েছে। ত্রিপুরারা মূলত খ্রীস্টান ধর্মাবলম্বী। এরাও কম-বেশি বাংলা বুঝে এবং বলতে পারে। অশীতিপর এক ত্রিপুরা বৃদ্ধা পাহাড়ী ছোট শিশুরা টংগা ঝিরি পাড়ার যে ত্রিপুরা পরিবারের বাড়িটিতে আমরা গেলাম, সেটি বাইকতি ত্রিপুরা নামের এক ভদ্রমহিলার বাড়ি। বাইকতির বয়স আনুমানিক ২২, কোলে ছোট্ট একটি বাবু।

তিনি বাংলা ভাষা খুব একটা বুঝেন না। তবে কাছাকাছি ইউনিসেফের স্কুলে কাস থ্রি-তে পড়ু–য়া জুয়েল ত্রিপুরা আমাদের কথাগুলো তাকে ট্রান্সলেট করে ত্রিপুরা ভাষায় বুঝিয়ে দিল। অধিকাংশ আদিবাসী মহিলা যারা মূলত পাহাড়েই থাকেন এবং খুব একটা পড়ালেখা করেননি, আমি দেখেছি যে, তারা অপরিচিত কোন মানুষের সাথে কথা বলেন না। বাইকতিও এর ব্যতিক্রম নন। এসব ক্ষেত্রে মহিলাদের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য পুরুষদের সাথেই প্রথমে কথা বলতে হয়।

টংগা ঝিরি পাড়ার ভেতর দিয়ে হেঁটে চলেছি আমরা পায়ে হাঁটা পথে আমরা এগিয়ে চলেছি ওই দূর পাহাড়ে যাবো আমরা টংগা ঝিরি পাড়ায় গিয়ে ত্রিপুরা আদিবাসীদের ব্যাপারে চমকপ্রদসব তথ্য জানতে পারলাম। মারমা কিংবা মুরংদের মতই ত্রিপুরা মহিলারা ঘর এবং ঘরের বাইরের সব কাজগুলো করে থাকেন। এখানে কোন পরিবারে মেয়ে শিশু জন্মালে সেটা তাদের জন্য আশির্বাদ হিসেবেই তারা দেখেন এবং খুশী হন সবাই। কারণ দিন-রাত পরিশ্রম করে এই মেয়েরাই সংসার চালায়। তারা ভোর পাঁচটায় উঠে রান্না করে ঘরের পুরুষের জন্যে খাবার রেখে বাকী মহিলাদের জন্য কলাপাতায় খাবার মুড়ে নিয়ে থুরুম (পিঠে বহনকারী বেতের তৈরি বড় ঝুড়ি)-এ ভরে পাহাড়ে কাজ করতে চলে যান।

খুব ছোট শিশু, যারা মায়ের দুধ খায়, তাদেরকে শরীরের সাথে কাপড় দিয়ে বেঁধে সাথে নিয়ে কাজে যায় আদিবাসী মেয়েরা। বিকালে ফিরে আসার পর আবার তারা ঘরের বাকী কাজগুলো সেরে ফেলে। এরই মধ্যে তারা নিজেরাই নিজেদের কাপড় বুনে, ছোট বাচ্চাদের দুধ খাওয়ায়, স্থানীয় বাজারে গিয়ে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে নিয়ে আসে, পাহাড়ের নিচের ঝিরি থেকে ছোট কলসিগুলোতে পানি নিয়ে থুরুম-এ ভরে পিঠে করে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসে। আর পুরুষরা বাড়িতে থাকে, অপোকৃত বড় বাচ্চাদের দেখাশুনা করেন, মদ্য পান করে, কিংবা খুব বেশি হলে ছোট টং দোকানে গিয়ে আড্ডা দেয়। বিয়ের সময় কিন্তু একজন পুরুষকে তার পছন্দের পাত্রীকে বিয়ে করতে হলে বেশ ভালো পরিমাণ উপঢৌকন দিতে হয়।

আদিবাসীরা নিজেদের বাড়ি নিজেই তৈরি করে, আবার কারবারীর নির্দেশে পাড়া পরিবর্তনের সময় এভাবেই বাড়িঘরের অংশ খুলে নিয়ে চলে যায় অন্যান্য আদিবাসীদের মতোই ত্রিপুরারাও শূকর এবং কুকুর পালে এগুলোর মাংস খাবার জন্যে। পাহাড়ী জুম চাষে প্রাপ্ত ধান, আলু, শসা, সব্জি-ই তাদের প্রধান খাদ্য তালিকার অন্তর্ভূক্ত। তবে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কথা বলতে গেলে এদের অবস্থা খুবই নাজুক। দুর্গম এলাকাগুলোর আদিবাসীরা খুব বড় ধরনের প্রয়োজন না হলে লামা পর্যন্ত আসেন না। স্থানীয় লতা পাতা দিয়েই তারা রোগের চিকিৎসা চালান।

আর আদিবাসী শিশুদের ই.পি.আই-এর টীকা নেবার ব্যাপারে তারা অনেকেই মনে করেন যে, টীকা খুব একটা ভালো কিছু না। টীকা নিলে বাচ্চাদের জ্বর আসে। তাই তারা যে কোন প্রকার টীকা নেবার ব্যাপারেই অনিচ্ছুক। পাহাড়ী শূকর টংগা ঝিরি থেকে ফেরার পথে কম্পনিয়া হয়ে বাইশখালি স্ট্যাণ্ডে দীর্ঘ প্রায় এক ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকার পর একটা শর্টবডি এলো। ঝুম বৃষ্টির মধ্যে আমরা ফিরে চললাম লামার উদ্দেশ্যে।

ফেরার পথে বাইশখালী স্ট্যাণ্ডের উদ্দেশ্যে যাত্রা এরপরে সুযোগ পেলে আশা করছি দুর্গম কোন পাহাড়ী পাড়ায় গিয়ে আদীবাসীদের সাথে বেশ কিছুদিন কাটিয়ে আসবো। খুব শীঘ্রই এরকম একটি উদ্যোগ নিতে যাচ্ছি। কেউ যদি উৎসাহী হন, নির্দ্বিধায় আমার সাথী হতে পারেন। সবাইকে শুভেচ্ছা। লামার বিখ্যাত 'হাতির দুধ' কলা কিভাবে লামা যাবেন: ঢাকা থেকে কক্সবাজারের এ.সি বাসে চড়ে চকোরিয়া বাস স্ট্যাণ্ড (লামা-আলীকদম বাস স্ট্যাণ্ড) নেমে পড়বেন।

সেখান থেকে শর্টবডি-তে ৩৫ টাকায় (গ্যালারীতে বসলে ৪০ টাকা) অথবা ৩০ টাকায় বাসে করে ১ ঘন্টায় পৌঁছে যাবেন লামা। লামাতে থাকার ব্যবস্থা: মিরিঞ্জা হোটেল: ফোন নম্বর: ০১৫৫৩ ২৪৪৮২৬, ০১৫৫৩ ৭৫৭৪৭৫, ০১৫৫৩ ৬৫৫০৯৪, ০১৫৫৬ ৬২৪৪৮৩ লামাতে খাবার হোটেল: ১. হোটেল জব্বারিয়া ২. হোটেল মেহমান ৩. হোটেল জামান না বলা কথা: ১. যদি বেশ কিছুদিনের জন্যে লামাতে কাজে যান, তাহলে দিনে দিনে কক্সবাজারে ফিরে গিয়ে ভালো হোটেলে থাকতে পারবেন। কারণ লামাতে লোডশেডিংটা খুব বেশি। আর হোটেল মিরিঞ্জা 'চলে' টাইপ থাকার হোটেল। ২. দুর্গম পাহাড়ে ঘুরতে গেলে সাথে স্থানীয় গাইড থাকাটা আবশ্যক।

মারমা বা মুরং গাইড হলে ভালো হয়। ৩. এ অঞ্চলে ম্যালেরিয়া এবং জোঁকের প্রোকোপ বেশি। তাই সাথে 'ওডোমোস' ক্রিম এবং লবণ নিতে ভুলবেন না। ৪. পাহাড়ী রাস্তায় চলাচলের জন্য বাজার থেকে রাবারের স্যান্ডেল কিনে নেবেন। ৫. অনুমতি ব্যতীত আদিবাসীদের (বিশেষত: মেয়েদের) ছবি না তোলাটাই শ্রেয়।

৬. রাত ৮.৩০ এর পর লামা থেকে চকোরিয়ার অথবা চকোরিয়া থেকে লামার রাস্তায় কোন যানবাহন চলবেনা। ৭. বর্ষার সময় গেলে সাথে ছাতা এবং রেইনকোট নিতে ভুলবেন না। লামা নিয়ে আরেকটি লেখা পড়ুন আমার ভ্রমণ-কাহিনী ও ছবি ব্লগ গুলোর কালেকশন  ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১১ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।