বোরহান উদ্দিন আহমেদ (মাসুম)
গ্রেপ্তারের পর রুমানা মনজুরের স্বামী হাসান সাইদকে গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সামনে হাজির করা হয়
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রুমানা মনজুরকে নির্যাতনের মামলায় তাঁর স্বামী হাসান সাইদকে কেন গ্রেপ্তার করা হয়নি জানতে চেয়ে হাইকোর্ট গতকাল বুধবার বেলা ১১টার দিকে রুল জারি করেন। এর তিন ঘণ্টা পর বেলা সোয়া দুইটার দিকে রাজধানীর উত্তর মুগদায় আত্মীয়ের বাসা থেকে পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে। ঘটনার ১০ দিন পর সাইদ গ্রেপ্তার হলেন।
পত্রিকায় প্রকাশিত খবরের সূত্রে বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি গোবিন্দ চন্দ্র ঠাকুরের বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রুল জারি করেন। আদালত আসামিকে কেন গ্রেপ্তার করা হয়নি বা এ বিষয়ে নেওয়া পদক্ষেপ জানাতে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা, ধানমন্ডি থানার ওসি ও ধানমন্ডি সার্কেলের সহকারী পুলিশ কমিশনারকে আজ বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টায় আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেন।
সাইদকে গ্রেপ্তারের পর ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার (দক্ষিণ) মনিরুল ইসলাম বলেন, হাসান সাইদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি তাঁর স্ত্রীকে হত্যার চেষ্টা করেছেন। আগেও তিনি রুমানাকে মারধর করতেন। তবে গ্রেপ্তারের পর বাঁচার জন্য সাইদ নানা কথা বলছেন বলে উপকমিশনার জানান।
গোয়েন্দা পুলিশের হেফাজতে থাকা হাসান সাইদ স্ত্রীকে নির্যাতনের ঘটনা অস্বীকার করেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি চোখে ভালো দেখতে পাই না।
ধস্তাধস্তির কারণে ও (রুমানা) আহত হয়ে থাকতে পারে। ’
৫ জুন রাজধানীর ধানমন্ডিতে রুমানা তাঁর বাবার বাসায় স্বামী হাসান সাইদের নির্মম নির্যাতনের শিকার হন। রুমানার দুই চোখে আঙুল ঢুকিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়। কামড়ে নাকের ডগা ছিঁড়ে ফেলা হয়। ল্যাবএইড হাসপাতালে কয়েক দিন চিকিৎসার পর মঙ্গলবার তাঁকে ভারতের চেন্নাইয়ের শংকর নেত্রালয়ে নেওয়া হয়।
সেখানে তাঁর চোখের পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হয়েছে বলে জানা গেছে।
রুমানাকে নির্যাতনের পরের দিন তাঁর বাবা অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা মনজুর হোসেন ধানমন্ডি থানায় হাসান সাইদকে আসামি করে হত্যাচেষ্টার অভিযোগ এনে মামলা করেন। মঙ্গলবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকেরা সাইদকে গ্রেপ্তারের জন্য ২৪ ঘণ্টা সময় বেঁধে দেন।
পুলিশের কর্মকর্তারা দাবি করেন, মামলা হওয়ার পর থেকে তাঁরা সাইদকে খুঁজছিলেন। একপর্যায়ে গোয়েন্দা পুলিশ জানতে পারে, তিনি তাঁর চট্টগ্রামের বাসায় আছেন।
পুলিশের একটি দল সেখানে অভিযান চালায়। পরে তারা জানতে পারে, সাইদ ঢাকায় অবস্থান করছেন। ওই খবরের ভিত্তিতে গতকাল দুপুরে গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল মুগদা এলাকায় সাইদের এক আত্মীয়ের বাসা থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারের পর দুপুরে তাঁকে গোয়েন্দা পুলিশের মিন্টো রোডের কার্যালয়ে হাজির করা হয়। সেখানে সাইদ সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন।
সাইদ সাংবাদিকদের বলেন, রুমানা আহত হওয়ার পর তিনি শ্বশুরের বাসা থেকে পালিয়ে যাননি। বাড়ির নিরাপত্তাকর্মীরা তাঁকে আটকে রাখেন। পরে রুমানার পরিবারের সঙ্গে কথা বলে তিনি সেখান থেকে ছাড়া পান। রুমানার পরিবার তাঁর পাসপোর্টও রেখে দেয়। ধানমন্ডি থেকে বের হয়ে তিনি চলে যান পরীবাগে নিজের বাসায়।
সেখান থেকে চট্টগ্রামের বাড়িতে যান। তিনি আদালতে আত্মসমর্পণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তাই এক আত্মীয়কে সঙ্গে নিয়ে গতকাল সকালে ঢাকায় আসেন।
স্ত্রীর ওপর নির্যাতনের কারণ জানতে চাইলে সাইদ বলেন, ফেসবুকের (সামাজিক যোগাযোগের নেটওয়ার্ক) তালিকা থেকে রুমানার এক বন্ধুকে মুছে ফেলা নিয়ে তাঁদের মধ্যে হাতাহাতি হয়। এরই একপর্যায়ে রুমানা তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন।
এ সময় তাঁর (সাইদ) চোখ থেকে চশমা পড়ে যায়। চশমা ছাড়া তিনি আবছা (পাঁচ শতাংশ) দেখেন বলে দাবি করেন। ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে রুমানা আহত হয়ে থাকতে পারেন বলে দাবি করেন তিনি।
কিন্তু রুমানার চোখ উপড়ে ফেলার চেষ্টা এবং নাকের অংশ ছিঁড়ে ফেলার বিষয়ে জানতে চাইলে সাইদ সদুত্তর দিতে পারেননি। তিনি বলেন, রুমানার সঙ্গে তাঁর সুখের সংসার ছিল।
সাত বছর প্রেম করার পর ২০০০ সালে তাঁদের বিয়ে হয়। এরপর ১১ বছর তাঁরা সুখের সংসার করেন। তবে অশান্তি তৈরি হয় রুমানা বিদেশে যাওয়ার পর।
সাইদ বলেন, তাঁর কিছু ব্যবসা ছিল। সেসব ভালোমতো চলছিল না।
একপর্যায়ে তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন, দুজনে কানাডায় স্থায়ী হবেন। এই লক্ষ্য নিয়ে গত বছরের আগস্টে নিজের খরচে রুমানা কানাডায় পড়তে যান। ফিরে আসেন ১২ মে। সাইদের দাবি, ফিরে আসার পর থেকে তাঁর আচরণ অস্বাভাবিক মনে হতে থাকে। ফেসবুকে এক ইরানি বন্ধুর সঙ্গে প্রায়ই আড্ডা দেন।
চোখে ভালো না দেখলে স্ত্রী ফেসবুকে কার সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছেন, তা কী করে দেখতে পেলেন জানতে চাইলে সাইদ বলেন, রুমানা তাঁর ল্যাপটপ খোলা রেখে বাথরুমে গেলে তিনি আতশ কাচ দিয়ে তা দেখেন।
সাইদ দাবি করেন, কিছুদিন আগে তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন, দুজনেই আত্মহত্যা করবেন। সে হিসেবে ১৯২টি ঘুমের বড়ি আনেন। কিন্তু তিনি নিজে বেশ কিছু বড়ি খেলেও রুমানা খাননি। ওই সময় সাইদ দুই দিন ল্যাবএইড হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন বলেও দাবি করেন।
তবে রুমানার বাবা এর আগে অভিযোগ করেছিলেন, আগেও রুমানার ওপর নির্যাতন হয়েছে। তবে এ নিয়ে রুমানা কোনো অভিযোগ করেননি। কানাডা থেকে আসার পর আর না যাওয়ার জন্য রুমানাকে চাপ দিচ্ছিলেন সাইদ। অক্টোবরে রুমানার থিসিস জমা দেওয়ার জন্য কানাডায় যাওয়ার কথা ছিল।
সাইদ নিজেকে বুয়েটের ছাত্র বলে দাবি করলেও পড়াশোনা শেষ করেছেন কবে জানতে চাইলে কোনো জবাব দেননি।
রুমানার পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়, সাইদ পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি।
গোয়েন্দা পুলিশের কর্মকর্তারা জানান, সাইদকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডে নেওয়া হবে। আজ তাঁকে আদালতে হাজির করা হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, রুমানাকে গতকাল শংকর নেত্রালয় হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। তাঁর চোখে গুরুতর জখম হয়েছে বলে চিকিৎসকেরা প্রাথমিকভাবে মত দিয়েছেন।
শুক্রবার থেকে তাঁর চিকিৎসা শুরু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী: মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেছেন, নির্যাতনকারী যেই হোকে, তাকে শাস্তি পেতে হবে। রুমানা মনজুরের ওপর নির্যাতনের ঘটনায় গতকাল নিজ মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে আন্তমন্ত্রণালয় প্রতিবাদ সভায় তিনি এ কথা বলেন। তিনি বলেন, রুমানা স্বামীর হাতে নির্যাতিত হয়ে আসছিলেন। তাই আরও আগে যদি আইনের আশ্রয় নিতেন, তাহলে হয়তো এই পাশবিক ঘটনা না-ও ঘটতে পারত।
নারী নির্যাতন প্রতিরোধে পর্যাপ্ত আইন আছে। প্রয়োজন আইনের সাহায্য চাওয়া।
সভায় বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব, উপসচিব, জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব ও সহকারী সচিব পদমর্যাদার নারী কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
মানবাধিকার কমিশনের উদ্বেগ: রুমানার ওপর স্বামীর নির্যাতনকে ভয়াবহ মাত্রার পারিবারিক নির্যাতন আখ্যা দিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। এ ধরনের ঘটনায় নির্যাতনকারীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছে কমিশন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলায় রুমানাকে নির্যাতনের প্রতিবাদে সংহতি সমাবেশ হয়। ছাত্র-শিক্ষক, বুদ্ধিজীবীসহ নিপীড়নবিরোধী সংগঠনগুলো এই সমাবেশের আয়োজন করে।
সমাবেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন রুমানার স্বামী সাইদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করে বলেন, দেশকে মানবিক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে তরুণ সমাজকেই এগিয়ে আসতে হবে।
উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষক মালেকা বেগম ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন সমাবেশে বক্তব্য দেন।
সমাবেশে ছাত্র ফেডারেশন, ছাত্র ইউনিয়ন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদসহ বিভিন্ন প্রগতিশীল ও সাংস্কৃতিক সংগঠন সংহতি প্রকাশ করে।
মানববন্ধন: গতকাল বেলা ১১টায় খুলনার পিকচার প্যালেস মোড়ে মানববন্ধন করে বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠন গৃহ সুখন। মানববন্ধন থেকে রুমানাকে নির্যাতনকারী স্বামীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানানো হয়।
বিকেল সাড়ে তিনটায় ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন করে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ। মানববন্ধন থেকে নির্যাতনকারীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি, পারিবারিক সহিংসতা বন্ধের জন্য পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ সুরক্ষা) আইন, ২০১০-এর বিধি প্রণয়ন এবং এর বাস্তবায়নসহ পাঁচ দফা দাবি জানানো হয়। বিকেলে প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন করে সমাজতান্ত্রিক মহিলা ফোরাম।
সুত্রঃ Click This Link ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।