জীবন কবিতার মত। আর কবিতাগুলো দুর্বোধ্য। ( জ্ঞান বিজ্ঞানে যাদের ব্যাপক আগ্রহ, সেই সকল মহিয়সী নারীদেরকে উৎসর্গ করলাম)
বিবাহ যোগ্য মকবুল ভাই একটা হীরার আংটি কিনেছেন। আংটি পকেটে নিয়ে টেকনাফ-তেঁতুলিয়া করছেন। দেশের বিভিন্ন আনাচে কানাচে মেয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছেন।
কোন মেয়েই পছন্দ হচ্ছে না। ইতিমধ্যে দুজন ঘটকের সাথেও তার কথা হয়েছে। ঘটক সাহেবেরা প্রায়ই নানারকম স্যাম্পল দেখাচ্ছে। সময়ে অসময়ে ফোন করছে। পত্রিকায় পাত্র চাই বিজ্ঞাপন দেখলেই মকবুল ভাই ফোন করেন, হ্যালো আসসালামুআলাইকুম.. .. আমি পাত্রের বড় ভাই বলছি.. .. পাত্রী সম্পর্কে জানতে চাই।
তিনি নিজেও পাত্রী চাই বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকতে পারেন। কিন্তু মকবুল ভাই কিছুতেই মনের মত পাত্রী খুঁজে পাচ্ছেন না।
‘মকবুল ভাই ঘটনা কি?’
‘আরে বলো না, ব্যাটে বলে হচ্ছে না। ’
‘আমার কিন্তু মনে হয়, আপনের চওড়া ব্যাট নিয়া নামতে হবে। ’
‘আরে না ব্যাট ঠিকই আছে।
বল ওয়াইড হচ্ছে। ’
সব বল ওয়াইড হবার কারন কি কে জানে। মকবুল ভাই নিজে এমন কিছু রসগোল্লা না। লম্বায় টেনেটুনে ফুট পাঁচেক হবেন। গায়ের রং অন্ধকার।
তার উপর শরীর বিশালকায় ফুড বেবী ধারন করছে। বুদ্ধিসুদ্ধির অবস্থাও খুব খারাপ। একদিন ভুড়ি ভাসিয়ে হাটতে হাটতে আসছেন।
আমি বললাম, মকবুল ভাই.... জব্বর ফিগার বানাইছেন ভাই.... এক্কেবারে সালমান খান।
মকবুল ভাই সিনা টাইট করে ফেললেন।
‘সত্যি বলছো?’
‘অবশ্যই সত্যি বলছি। আপনের লগে মিথ্যা কইয়া আমার লাভ কি? আপনার জমির সীমানায় কি আমার জমি আছে?
‘কয়েকদিন ব্যায়াম করছিতো তাই। ’
বেকুব মানুষ। কেউ মজা লইলেও বোঝেন না। মাঝে মাঝে দুঃখ পাই।
দুয়ে দুয়ে চার না হলে, হবে সোয়া চার কিংবা পৌনে চার। কিন্তু দুয়ে দুয়ে তের চৌদ্দ হচ্ছে কেন বুঝতে পারছি না। এত এত কোয়ালিফাইড মেয়েদের বায়োডাটা তার কাছে। সব পরীর মত মেয়েরা। এদের সবগুলোকে একে একে বাট্টু মকবুল ভাই নিজে রিফিউজ করছেন, বিশ্বাস হয়না।
অবশ্য মকবুল ভাইয়ের কাছ থেকে মেয়েগুলো রিফিউজড হলেও বাতিল হয়ে যাচ্ছে না। সব রিফিউজড বায়োডাটা চলে যাচ্ছে আরেক বুড়া ব্যাচেলর জহির ভাইয়ের কাছে। জহির ভাই মকবুল ভাইয়ের দেশী । ল্যাংটা কালের বন্ধু। মকবুল ভাইয়ের সাথে জহির ভাইয়ের এ বিষয়ে একটি গোপন দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে।
জহির ভাইকে একদিন বললাম, ভাই ঝেড়ে কাশেন।
জহির ভাই ঝেড়ে কাশি দিলেন।
‘মকবুল রিফিউজ করার কে? মকবুলরেই কোন মাইয়া পাত্তা দিতাছে না। হালায় নিজে একটার পর একটা হিট খাইয়া আসে আর চাপা পিটায়। ’
বুঝলাম, ভাই মকবুল তলে তলে ভাল বিটলা।
বিটলা ভাইয়ের মন খুব খারাপ। অফিসে দুই দিনের ছুটির অ্যাপ্লিকেশন দিয়েছেন। ডিজিএম ছুটি দেন নাই।
আমি বললাম, মন খারাপ করার কি আছে? বাড়ি দুই দিন পরে যান অসুবিধা কি? জরুরী কিছু?
‘আমি তো যাব পাত্রী দেখতে। ’
‘তাইলেতো জরুরী বিষয়।
ডিজিএমরে বুঝাইয়া বলেন। আগেতো ফরজ কাম। ’
‘বললামতো বুঝাইয়া, পাত্রী দেখতে যাব। তাও স্যার ছুটি দিলনা। ’
ডিজিএম মহোদয় আল্লাওয়ালা মানুষ।
ব্যাচেলর অফিসার তিনি দু চোখে দেখতে পারেন না। বিয়ের ফজিলত সম্পর্কে সকাল বিকাল দুবেলা বিশেষ বয়ান করেন। কেউ পাত্রী দেখতে গেলে তারই সবচেয়ে বেশী খুশি হওয়ার কথা। বিভিন্ন জায়গায় চাকরিবাকরির ইন্টারভিউ দিতে গেলে আমি সাধারনত পাত্রী দেখতে যাচ্ছি বলে ছুটি নেই। অথচ তিনিও মকবুল ভাইয়ের উপর ব্যাপক নাখোশ।
ইতিপূর্বে মকবুল ভাইকে দশ পনেরবার পাত্রীদেখা বাবদ ছুটি দিয়েছেন। শেষবার ছুটি দেয়ার সময় বলেছিলেন, এইটাই তোমার লাস্ট চান্স, এ ছুটিতে যদি পাত্রী ফাইনাল না হয় নেক্সটটাইম আর ছুটি হবেনা।
এবার আবিস্কার করলাম ডিজিএম মহোদয় এক কথার মানুষ। বেঁচে থাকতে তিনি পাত্রী দেখা বাবদ মকবুল ভাইকে ছুটি দিবেন না।
মকবুল ভাইয়ের অনুপুস্থিতিতে বললেন,অফিস দপ্তরির মত চেহারা, বিয়ে করতে চায় শ্রীদেবীকে।
হুজুর হইবার পূর্বে ডিজিএম মহোদয় প্রচুর হিন্দি ফিল্ম দেখতেন। শ্রীদেবী তার যৌবনের হিট নায়িকা। একদিন জানতে চাইলেন এসময়ে হিট নায়িকা কে?
আমি বললাম,ক্যাটরিনা কাইফ।
‘সিনেমা দেখবা না, সিনেমা দেখা পাপ। ’
ছুটি না পেয়ে মোবাইলে মকবুল ভাই পাত্রীর মার সাথে নিজে কথা বললেন।
‘হয়েছে কি আন্টি। আমাদের অফিসে কয়েকজন ফরেন ক্লায়েন্ট আসবেন। ফরেন ক্লায়েন্টের সাথে ইংরেজীতে কথা বলতে হয়তো। এখানে আবার কেউ ইংরেজীতে সাউন্ড না। ডিজিএম স্যার আমাকেই ওনাদের সাথে ডিল করার জন্য সিলেক্ট করেছেন।
ওনারা চলে গেলেই আমি আসব। ’
মকবুল ভাই যে বিটলা কয়েকদিন হল মাত্র জেনেছি। যতই দিন যাচ্ছে ততই তার বিটলামি দেখছি, ততই অবাক হচ্ছি। কিসের ফরেন ক্লায়েন্ট আসবে, উনি ইংরেজীর কি বুঝেন? শিশু শ্রেনীর বাচ্চাদের সাথেও হয়তো ইংরেজীতে পারবেন না। আর সবচেয়ে বড় কথা কয়েকদিন আগে মার্কেটিং সেকশানে প্যাঁচ লাগানোর দায়ে তিনি কারন দর্শানোর নোটিশ পেয়েছেন।
বর্তমানে সেকশান বিহীন অবস্থায় আছেন। অফিসে আসেন আর যান। সচেতনভাবে অফিসের গুরুত্বপূর্ন কাজ থেকে তাকে দুরে সরিয়ে রাখতেই সবাই স্বচ্ছন্দ বোধ করে।
মকবুল ভাইকে বুঝাইলাম, নতুন ইস্যু বানাতে হবে। পাত্রী দেখতে যাব বললে হবে না।
বিটলা মকবুল ভাইয়ের জন্য ইস্যু বাইর করা কোন ব্যাপারই না। দুইতিন দিনের ছুটি ম্যানেজ করলেন।
মকবুল ভাইকে বুঝাইলাম, মেয়েদের এভাবে কষ্ট দেয়া ঠিক হচ্ছে না। বয়স হচ্ছে, তাড়াতাড়ি বিয়ে করে ফেলেন।
‘আরে লম্বা মেয়েই তো পাচ্ছি না।
’
‘কি বলেন গতমাসেই যে একটা লম্বা মেয়ে দেখলেন। ’
’দেখতেতো সুন্দর না। ’
’সব কিছুতো একসাথে পাওয়া নম্ভব না। আপনাকে অপটিমাইজ করতে হবে। লা শাটেলিয়ার নীতিতে চলতে হবে।
’
‘ভাল কথা বলেছো। ’
‘বহু দিনের অভ্যাস ভালে কথা ছাড়া বলতে পারি না। ভাই আপনাকে একটা গল্প বলি মন দিয়ে শোনেন। এইটা আমার গল্প না। প্লেটোর গল্প।
’
‘প্লেটোর গল্প শোনার টাইম নাই। ’
‘না না এটা আপনার শোনা অতীব জরুরী। প্রেম ও বিবাহ বিষয়ক। ’
‘আচ্ছা বল। ’
প্লেটো একদিন তার গুরুর কাছে জানতে চেয়েছেন, গুরু প্রেম কী জিনিস?
গুরু তাকে বিরাট একটা গম ক্ষেতের সামনে নিয়ে বললেন, এই যে বিস্তীর্ন গম ক্ষেত।
এই গম ক্ষেত থেকে সবচেয়ে সুন্দর যে গমের শীষটা তুমি দেখতে পাবে সেটা তুলে নিয়ে আসবে। তবে কখনোই পিছনে ফেরা যাবেনা।
প্লেটো সেই বিশাল গম ক্ষেত ঘুরে খালি হাতে ফিরে এলেন।
গুরু জানতে চাইলেন, এত বিশাল গম ক্ষেত থেকে তুমি একটা সুন্দর গমের শীষ খুঁজে পেলে না?
প্লেটো বললেন, গুরুজী আমি গম ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে যখন যাচ্ছিলাম, খুব সুন্দর একটা গমের শীষ আমার চোখে পরেছিল। ভাবলাম সবেতো কতটুকু মাত্র এলাম সামনে নিশ্চয়ই এর চেয়ে খুব সুন্দর কিছু আমি খুঁজে পাব।
কিন্তু বাকি পথে আমি সেই শীষটার চেয়ে সুন্দর কোন শীষ আমি খুঁজে পাইনি। আর আপনি যেহেতু বলেছেন পিছনে ফেরা যাবে না। তাই খালি হাতে আমাকে ফিরতে হল।
গুরু বললেন, এটাই প্রেম।
তারপর কিছুদিন কেটে গেল।
প্লেটো একদিন গুরুর কাছে জানতে চাইলেন, গুরুজী বিবাহ জিনিসটা কি?
গুরু এবার তাকে নিয়ে গেলেন বিরাট একটা বনের সামনে। বললেন, এই নাও কুঠার। এই বিশাল বন থেকে সবচেয়ে লম্বা যে গাছটা তোমার চোখে পরবে সেটি তুমি কেটে আনবে। তবে মনে রেখ শর্ত একই, কখনো পেছনে ফেরা যাবে না।
প্লেটো কুঠার হাতে জঙ্গলে ঢুকে পরলেন এবং খুব অল্পসময়ের মধ্যে তিনি একটি গাছ কেটে নিয়ে এলেন।
গুরু জানতে চাইলেন, এই বিশাল বনে এর চেয়ে কত লম্বা লম্বা গাছ রয়েছে আর তুমি এটি কেটে আনলে?
প্লেটো বললেন, গুরুজী এইবার আর রিস্ক নেই নাই।
গুরু বললেন, এটাই বিবাহ।
মকবুল ভাইকে বললাম, আর রিস্ক নিয়েন না।
‘তোমার চুটকিটা সুন্দর। ’
‘চুটকি মানে? এইটা চুটকি নাকি?’
অপাত্রে জ্ঞান দান করে মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল।
মকবুল ভাই সপ্তাহ খানিক নিখোজ। তিন দিনের ছুটি নিয়ে গেছেন আর কোন খবর নাই। মোবাইল বন্ধ। ডিজিএম মহোদয় প্রতিদিন তার হাজিরা খাতায় একটা করে জিজ্ঞাসা চিহ্ন দিচ্ছেন আর বকাঝকা করছেন।
‘ মজনুগীরি বাইর কইরা দেব।
’
বেশ কয়েকদিন পরে মকবুল ভাই অফিসে এসেছেন। এসেই দপ্তরীর হাতে টাকা দিয়ে বললেন বাজার থেকে ভাল মিষ্টিটা আনতে। সবাই জানতে চায় ঘটনা কী?
‘বিয়ে করে ফেললাম। ’
সবার চোখে সন্দেহ।
‘কোথায় বিয়ে করলেন? ভাবি কি করেন?’
‘মেয়ে ডাক্তার।
ডাক্তারি পড়ছে একটা প্রাইভেট মেডিকেলে। বাড়ি যশোর। ’
মিষ্টি টিষ্টি খেলাম তবু বিশ্বাস হয়না। জহির ভাইও বিশ্বাস করছেন না।
মকবুল ভাই নিজেই আমাকে একা পেয়ে বললেন, বিয়েটা তো তোমার জন্যই হলো।
‘মানে?’
‘ তোমার ওই চুটকি। ’
‘কোন চুটকি?’
‘ আরে প্লেটোর গল্প। মেয়েটাকে বেশ কদিন বুঝাচ্ছিলাম লাভ হচ্ছিল না। শেষে একদিন রেস্টুরেন্টে দাওয়াত করলাম। শেষবারের মত দেখা করব।
এরপর তুমি তোমার মত থাকবে আমি আমার মত। খাওয়া দাওয়া শেষে বললাম প্লেটোর গল্পটা। মেয়েতো পুরা মুগ্ধ। হীরার আংটিটা নিয়ে গেছিলাম। আঙুলে পরিয়ে দিলাম।
ওই দিনই কাজী অফিসে বিয়ে হয়ে গেল। ’
‘আসলেই?’
পুরো ঘটনার বর্ননা ম্যাজিকের মত। বিশ্বাস হল না। তবে মকবুল ভাই আসলেই বিয়ে করেছেন। প্লেটোর গল্প শুনে হোক আর যে কারনেই হোক বিয়ে হয়েছে।
ভাবী দেখতেও অনেক সুন্দরী। মকবুল ভাই আমার সাথে ভাবি কে পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমার নামটা শুনেই চমকে উঠলেন, ও প্লেটোর গল্প। আপনিইতো বলেছিলেন তাই না? দারুন গল্প।
মকবুল ভাইটা আসলেই বেকুব।
নিজে ক্রেডিট নেয় না, যার ক্রেডিট তাকে দিয়ে দেয়। প্লেটোর গল্পটার এত ক্ষমতায় আমি পুলকিত হই। এ গল্পটা আমিও একজনাকে শুনাতে চাই। চান্স পাইতেছি না। যাকে শুনাতে চাই প্রেমপীরিতিতে তার আগ্রহ নাই, তার আগ্রহ জ্ঞান বিজ্ঞানে।
গতকাল ফোন করে বলল, ও লেভেলে কেমিস্ট্রিতে লা শাটেলিয়ার নীতি পড়ছিলাম ভুলে গেছি। আপনার মনে আছে?
‘হ্যাঁ, মনে আছে। ’
প্লেটোর গল্প বুকে চেপে আমি লা শাটেলিয়ার নীতি বুঝাতে শুরু করলাম।
শামীম ভাই এবং ব্যারন’সের জিআরই বই ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।