আমি শুধুই মানুষ, কোন বিশেষণ নাই। বেশ কিছু দিন আগের কথা। তখনও আমি কোন চাকুরীতে যোগ দেইনি। মাত্র ভার্সিটি থেকে পাশ করে বের হয়েছি। স্বাভাবিকভাবেই পকেটে একসাথে ক্ষুদ্রতম তিন সংখ্যার টাকাও জমা হয়না।
তার আগেই খরচ হয়ে যায়। এমন সময়ে একদিন সকালে ঘুম ভাঙলে দেখি আমার মোবাইলে ৩০০ টাকার লোড এসেছে। ব্যালেন্স চেক করে নিষ্চিত হলাম। বুঝতে পারছিলামনা খুশি হবো কীনা! কারণ আমি জানি একটু পরেই ফোন করে বলবে ভাই প্লিজ ব্যালেন্সটা ব্যাক করেন। অল্প বিস্তর অ্যামাউন্ট ইতোপূর্বে বহুবার আমাকে ব্যাক করতে হয়েছে।
এখন এই ৩০০ টাকার কী গতি করি। যাহোক, এসব ভাবতে ভাবতেই টাকা গুলো দিয়ে বন্ধু-বান্ধবদের দেদারসে কল করা শুরু করলাম। যা ভাবনা তাই হলো- একটু পরেই অপেক্ষার ফোন আসল। বিনম্র অনুরোধে টাকাটা ফেরত চাইলো। আমি জোর দিয়ে তাকে বলতে পারলামনা যে, এক্ষুণি ফেরত পাঠাচ্ছি।
কারণটা তো আপনাদেরকে ইতোমধ্যেই বলেছি। কয়েকদিনের মধ্যেই সেই ব্যালান্স শেষ হয়ে গেল। সেই লোক আর ফোন না করায় টাকা ফেরত দেওয়ার কথা ভুলে গেলাম। দিনও গড়িয়ে যেতে লাগল। এর মধ্যে বিভিন্ন চাকুরীর ইন্টারভিউ দিলাম, চাকুরী পেলাম, করলাম।
কিন্তু সেই লোকের টাকার কথা আমি ভুলে গেলাম আর ফেরতও দেওয়া হলোনা। অবশ্য আমি এর মধ্যে আমার সেই সিমটাও পাল্টিয়েছি। যার জন্য সুযোগ পেলে ফেরত দেওয়ার মানসে সেভ করা নম্বরটার কথাও ভুলে গেছি। আর সে কারণেই হয়তো লোকটা আমাকে আর খুজেঁ পায়নি। গত মার্চ মাসের এক শেষরাতে হঠাৎ করে আমার সেই লোকের কথা মনে হলো।
তখন আমি লক্ষ্মীপুরে একটা প্রথম শ্রেনীর চাকুরীতে যুক্ত। সবে মাত্র যোগদান করায় আর ৩০ তম বিসিএস এর লিখিত পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত থাকায় বাসা নিতে পারিনি বলে থাকি অফিসের গেস্ট রুমে। মনে পড়ার সাথে সাথে আমি এতটাই লজ্জিত হলাম যা আমি সচরাচর হইনা। গত এক বছরও তো আমি চাকুরী করেছি, সম্মানজনক টাকাও আয় করেছি, তাহলে আমি কেন টাকাটা ফেরত দিলাম না। ছিঃ নিজেকে খুব নোংরা মনে হচ্ছিলো।
আমি দ্রুত ঘুম থেকে উঠে সেই সিমটা মোবাইলে লাগিয়ে নম্বরটা নিলাম। তারপর দাড়োয়ানকে ডেকে তুলে গেট খুলে বাইরে গেলাম আর একটা দোকানদারের প্রথম কাস্টমার হয়ে টাকাটা ফেরত পাঠালাম। আহ! কি শান্তি! আমি লোকটাকে ফোন দিয়ে জানিয়ে দিলাম আর সাথে সাথে ফোনটা কেটে দিলাম। কারণ আমার খুব লজ্জা লাগছিল। সকাল এগারটার দিকে যখন আমি লক্ষ্মীপুর ডিসির রুমে নারী দিবস উদযাপনের আয়োজন নিয়ে একটা মিটিং এ সেই সময় লোকটি আমাকে ফোন দিল।
আমি রিসিভ করতে না পারায় মিটিং শেষে কল করলাম। তিনি জানালেন টাকাটা তিনি পেয়েছেন আর ওনি আমার সাথে একবার দেখা করতে চান। বুঝলাম লোকটা আমার টাকাটা পেয়ে খুব খুশি হয়েছেন আর আমাকে খুব ভালো মানুষ ভাবতে শুরু করেছেন। কিন্তু আমি তো জানি আমি কি লজ্জাজনক কাজ করেছি। তাই আমি আর কথা না বাড়িয়ে ফোনটা কেটে দিলাম।
সে লজ্জায় আর কখনো আমি লোকটার ফোন ধরিনি । পরে আমার বার বার শুধু একটা কথাই মনে হতো; এদেশের মানুষগুলো কত ভালো। তারা কারো কাছে কিছু চায়না বরং কারো কাছ থেকে তার ন্যায্য পাওনাটা পেলেই কাউকে তারা অত্যাধিক ভালো মানুষ মনে করে। কিন্তু আমরা যারা সরকারী চাকুরী করে বা তথাকথিত রাজনীতি করে গরীব মানুষের টাকায় বিলাসী জীবন যাপন করি তারা কী একবারও একথাটা ভাবি? এটা আমার দৃঢ় বিশ্বাস আমারা যদি সবাই মানুষ হিসাবে অতিরিক্ত কিছু না করে বরং আমাদের স্বাভাবিক দায়িত্বগুলো পালন করে যাই তাহলেই দেশটা অনেক সুন্দর হবে। ক্ষুধা, দারিদ্র্যতা আর দূর্নীতি মুক্ত একটা দেশ আমরা নিশ্চিতভাবেই গড়তে পারব।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।