শুচি সৈয়দ
শুচি সৈয়দ
রাজনৈতিক অস্থিরতার যুগ পেরিয়ে এখন বোধকরি আমার অর্থনৈতিক অস্থিরতার যুগে পদার্পণ করেছি। পৃথিবীব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার ঢেউ, সেই ঢেউয়ের দোলা থেকে আমাদের অর্থনীতি মুক্ত থাকবেÑ এ কথা ভাবাও মূঢ়তা, বিশেষতঃ এই বিশ্বায়নের শতকে। তবে পৃথিবীব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা আর আমাদের অর্থনৈতিক সংকটের চরিত্র ভিন্ন ভিন্ন।
দেশের অর্থনৈতিক অস্থিরতার বিষয়টি নিয়ে কিছু লিখবোÑ অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ মাসেÑ যখন জাতীয় সংসদে জনপ্রতিনিধিরা আগামী বছরের জন্য প্রণীত রাষ্ট্রের মুখ্য অর্থনৈতিক দলিলটি পাশ করবেন সেই সময়Ñ এ ভাবনাটি মাথায় গত এক সপ্তাহ ধরে পোষণ করছি। গত কয়েক মাস ধরে চলছে লাগাতার অর্থনৈতিক অস্থিরতা।
আজ যদি টঙ্গীর কারখানা শ্রমিকরা বেতন ভাতার দাবিতে রাস্তায় নেমে আসে তবে তার পরদিন কিংবা পরের সপ্তাহে আশুলিয়ায়, তার পরের সপ্তাহে হয়তো সাভার কিংবা তেজগাঁও-এর শ্রমিকরা অবরোধের কর্মসূচি দিচ্ছে। আজ রাতে যখন এই লেখাটি লিখছি তখনও চ্যানেলের সংবাদে দেখছি মিরপুরের শ্রমিকরা ন্যায্য ওভারটাইম এবং মজুরির দাবিতে রাস্তা অবরোধ কর্মসূচিতে নেমেছে তার দৃশ্য। বিষয়টি দিনে দিনে বিস্তৃত থেকে বিস্তৃততর হয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক অস্থিরতার গর্ভে ১/১১-এর জš§ ঘটেছিল। জানিনা এই দেশের অর্থনৈতিক অস্থিরতা কোন নিয়তির দিকে আমাদেরকে ঠেলে দিচ্ছে।
অর্থনীতির যে দলিলে ভোক্তা বা ক্রেতা পর্যায়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর ওপর মান্যবর অর্থমন্ত্রী ভ্যাট, ট্যাক্স আরোপ করছেন সেই দলিলেই উপেক্ষার অনলে দগ্ধীভূত শ্রমিকের ন্যায্য মজুরির বিষয়টি। একদিকে বাজেটের ভেতরে দ্রব্যের দাম বাড়ছে অন্যদিকে কমছে মানুষের মূল্য; বাজেটের বাইরেই সেটি থেকে যাচ্ছে। অবস্থাটা যেন ঠিক সেই গানের মতÑ ‘মন মাঝি তোর বৈঠা নেরে/আমি আর বাইতে পারলাম না। ’ দেশের গরীব মানুষ নিরাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিচ্ছে জীবনের। সাহসী এবং উচ্চাভিলাষী বাজেট জীবন ধারণের ন্যূনতম নিশ্চয়তা নিশ্চিত করছে না।
নিরুপায় গার্মেন্ট শ্রমিক নেমে আসছে পথেÑ বকেয়া বেতন আর ওভারটাইমের দাবিতে। ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের দাবিতে। ওভারটাইম চলাকালীন মানসম্মত নাস্তার দাবিতে। দেশের অর্থনীতিতে প্রবাসী বাংলাদেশীদের পাঠানো রেমিটেন্স-এর পরেই আছে গার্মেন্টস খাত। এই খাত থেকে অর্জিত হয় দেশের বৈদেশিক মুদ্রার দ্বিতীয় বৃহত্তম জোগান।
সোনালী আঁশের সোনালী গৌরব যেমন অস্তমিত হয়েছে তেমনই যে হাঁস স্বর্ণডিম্ব প্রসবিনী তাকে আমরা খুঁদকুড়োও দিতে কুণ্ঠিত। ভবিষ্যতে যখন এ খাত দুটির গৌরবের সোনালী সময় অস্তমিত হবে তখন হয়তো আমরা এসবের জিনোম সিকোয়েন্স-এর সন্ধানে গবেষণায় অবতীর্ণ হবো কিন্তু তাতে করে দুর্ভাগ্যের বর্তমান নিয়তিকে আমরা এড়াতে পারব কিনা সেটাই প্রশ্ন বটে।
বছর দুয়েক আগে আমার খুব প্রিয় সহকর্মী এসএম গোর্কির তোলা একটি ছবি ছাপা হয়েছিল আমাদের পত্রিকায়। সংবাদপত্রে কাজ করি দীর্ঘদিন। দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় আমার নিজের কাছেই সংবাদপত্রকে দুঃসংবাদপত্র বলে মনে হয়।
প্রতিদিন সংবাদপত্র পাঠের মাধ্যমে যে প্রভাত শুরু হয়, তা আমার কাছে মোটেও সুপ্রভাত বলে প্রতিভাত হয় না। কিন্তু সেদিন সকালটিকে আমি সুপ্রভাত বলে উপলব্ধি করিÑ দুঃসংবাদের দাউ দাউ আগুনের সেই দৃশ্য পাঁচ কিংবা ছ কলামব্যাপী এসএম গোর্কির ছবির সঙ্গে আমার প্রিয় সম্পাদক গোলাম সারওয়ার-এর ক্যাপশন পড়ে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে যাই। মনে হয় সত্যিই আজ আমাকে সংবাদপত্র সুপ্রভাত জানালো। সম্ভবত ঈদের আগে, রোজার মাসে তেজগাঁও শিল্প এলাকার শ্রমিকরা সেদিন তাদের পুঞ্জিভূত দাবি-দাওয়া নিয়ে রাস্তায় নেমে এসেছিল। কারখানায় আগুন দেবার সেই দৃশ্য।
কি ছিল এসএম গোর্কির তোলা সেই ছবিটিতে? গোর্কির সেই ছবিটিতে ছিল দাউ দাউ করে জ্বলা একটি কারখানার অগ্নিকাণ্ডের দৃশ্য। আর সেই আগুন নির্বাপিত করার জন্য এক তরুণ শ্রমজীবীর অসাধারণ আকুতি। নাম না জানা এক তরুণ শ্রমিক তার সামান্য মুঠোয় মুঠোবন্দি বালি নিক্ষেপ করছে আগুন নেভানোর প্রাণান্ত প্রয়াসে। গোর্কির ছবিটিকে যুগান্তরের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক গোলাম সারওয়ার আরও অসাধারণ করে তুলেছিলেন তাঁর কাব্যিক ক্যাপশনে। আমি বিশ্বাস করি গোর্কির ঐ ছবিটিই একমাত্র সত্য সাক্ষী আমাদের শ্রমজীবী ভাইদের মনোভঙ্গীর।
নজরুলের একটি কাব্য পংক্তি এমনÑ ‘জাহান্নামের আগুনে বসিয়া হাসি পুষ্পের হাসি’Ñ গার্মেন্টসহ বিভিন্ন কল-কারখানার যে শ্রমিকরা অর্থনৈতিক অস্থিরতায় শিকার হয়ে পথে নেমে আসছেÑ তারা নিরুপায় ও বাধ্য হয়ে হচ্ছেÑ তাদের সমস্যাগুলোকে সনাক্ত করতে হবে।
‘নামমাত্র বেতন’ (শব্দবন্ধে উল্লেখিত শব্দ দুটি উপলব্ধি করতে পারবেন না পাঠক) কাকে বলে? আমি আমার অভিজ্ঞতার উপলব্ধি থেকে জানিÑ আমি আড়াইশ’ থেকে তিনশ’ টাকা বেতনে গার্মেন্টসের হেলপারদের কাজ করতে দেখেছি ১৯৮৬-৮৭ সালে। বিস্ময়ও হার মানত, আমি কিছুতেই বুঝতে পারতাম না কিভাবে এই মেয়েগুলো দিনের পর দিন মাসের পর মাস এই বেতনে চাকরি করে? সেই মেয়ে শ্রমিকগুলো কি অদক্ষ? ফাঁকিবাজ? ছদ্ম-শ্রমিক? উত্তর খুঁজতে চেষ্টা করতাম। না, তারা ফাঁকিবাজও নয়, অদক্ষও নয়, নয় তারা ছদ্ম শ্রমিকও। তারা অমানুষিক শ্রমজীবী।
তিন শ’ টাকা বেতন তার সঙ্গে ওভারটাইম আরও দেড়শ’ দু শ’ টাকা মোট পাঁচ শ’ কিংবা সাড়ে পাঁচ শ’ টাকা সাকুল্যে মাসিক আয়Ñ ঘর-ভাড়া দিয়ে এই ঢাকা শহরে তারা কিভাবে বেঁচে আছে এই ধাঁধায় আমার মাথা চক্কর দিতো। খুঁজতে খুঁজতে শেষে যে উত্তরটি খুঁড়ে বের করার মত করে পেয়েছিলাম সেটি এখনো আমাকে বিষণœ করে। কারণ সেই ‘নামমাত্র বেতনে’র রূঢ় বাস্তব রূঢ়রূপেই বিদ্যমান। পাঠক বলবেন সেই উত্তরটি কি? উত্তরটি হচ্ছেÑ যে মেয়েটি সারা মাস চার পাঁচ শ’ টাকায় গার্মেন্টসে শ্রম দিচ্ছে সে একা নয়, তার একার শ্রমে সে এ শহরে টিকতো নাÑ তার সঙ্গে একই কাতারে শ্রম দাসত্বের নিগড়ে বাধা তার মা-খালা-ছোট বোন-ফুপুÑ এরকম করে প্রায় গোটা পরিবারটি। অর্থাৎ গ্রাম থেকে প্রায় একটি গোটা পরিবার শহরে এসে নামমাত্র মজুরিতে গার্মেন্টসে দিনরাত প্রাণান্ত শ্রম দিয়ে শাক-ভাতে জীবনধারণ করছে মাত্র।
১৯৮৬-৮৭ সনের পাঁচ শ’ সাড়ে পাঁচ শ’ টাকা এখন বোধহয় হাজার বারো শ’ হয়েছে অর্থাৎ দ্বিগুণ হয়েছে মাত্র। আর তার সঙ্গে মুদ্রাস্ফীতির কারণে সেই টাকার মান কি পাঁচ শ’র নিচে চলে যায়নি? তাহলে বাস্তবতাটা কি কঠিন সেটা কি উপলব্ধি করতে পারছেন? এই শ্রমিকেরা যদি তাদের জীবনধারণের ন্যূনতম ন্যায্য মজুরির দাবিতে রাস্তায় নেমে না আসে তাহলেই তো বরং সেটাকে বলতে হবে অস্বাভাবিকতা! গার্মেন্টস মালিকরা ট্যাক্স ফ্রি কাপড় এবং অন্যান্য এক্সেসরিজ আনবেন বন্ডেড ওয়ার হাউজের সুবিধায়। পোশাক রপ্তানি করে পাবেন এক্সপোর্ট প্রমোশন বেনিফিট কিন্তু শ্রমিকরা বঞ্চিত হবেন জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় ন্যূনতম ন্যায্য মজুরি থেকেÑ এটা সংবিধান সম্মত নয়। জাহান্নামের আগুনে বসিয়ে শ্রমিকদের হাসো পুষ্পের হাসি বলার মত ব্যবস্থা এটি।
পাঠক, এই অর্থনৈতিক অস্থিরতাকে কি শ্রমিক অসন্তোষ বলা যাবে? যদিও আমরা সেটাই বলে থাকি।
যেন আমরা সব সন্তোষজনক ব্যবস্থাদি নিশ্চিত করে রেখেছি তাদের জন্য এবং তা তারা মেনে নিচ্ছে না; বিষয়টি সে রকম নয় মোটেই।
আজই প্রধানমন্ত্রীর কিছু সুপারিশসহ আগামী অর্থবছরের বাজেট পাশ হল জাতীয় সংসদে। প্রধানমন্ত্রী তার সমাপনী বক্তব্যে বললেন, এই বাজেটকে অনেকে উচ্চাভিলাষী হিসেবে সমালোচনা করেছেন, কিন্তু একটা জাতির সামনে এগুবার জন্য রূপকল্প না থাকলে, এগুবার জন্য প্রেরণা বা প্রণোদনা না থাকলে এগুবার পথ পাওয়া যাবে কিভাবে। খুবই সত্যি কথা। কোনও সন্দেহ নেই লক্ষ্য না থাকলে, লক্ষ্য অর্জনের চেষ্টা না থাকলে দেশ সামনের দিকে এগুবে কিভাবে?
বাজেটগুলো প্রণীত হয় আয়-ব্যয়, উন্নয়ন, সংযোজন-বিয়োযোজন এসব নিয়ে জাতীয় সংসদের সদস্যদের শুল্কমুক্ত সুবিধায় মহামূল্যবান গাড়ি আমদানি, কালো টাকা সাদা করার শ্রেণী স্বার্থে।
শ্রমিকদের স্বার্থ সেই দলিলের ‘পবিত্রতা’ হানিকর বলেই বিবেচিত বোধ করি। বাজেটেও কিছু ধাঁধা থাকে, সে ধাঁধা ভেদ করা দুঃসাধ্য। দুঃস্থ ভাতা, বিধবা ভাতা, বয়স্ক ভাতা, কৃষি ভর্তুকি, সারে ভর্তুকি ইত্যাদি শব্দের করুণায় ভেসে যাবার ব্যবস্থা আছেÑ নেই এদেশের অমানুষিক শ্রমদানকারী শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিন্ত করার অঙ্গীকার।
পাঠক, বাজেটের ধাঁধা সমূহ এবং বাজেটের বাইরের ধাঁধা সমূহ ভেদ করার কষ্ট এ লেখার শেষ প্রান্তে আপনার ঘাড়েই চাপিয়ে দিচ্ছি।
আমার সহকর্মী গোর্কির ছবিতে একমুঠো বালি নিয়ে যে তরুণ শ্রমিক সর্বগ্রাসী অগ্নি নির্বাপণের আকুতি নিয়ে তা দাউ দাউ আগুনে নিক্ষেপ করে, আমিও তার মতই ছোট্ট তার দাবিটির কথা স্মরণ করিয়ে, তার পক্ষ হয়ে দেশের রূপকল্প রচনায় তাদেরকে অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়োজনের প্রতি সনির্বন্ধ দৃষ্টি আকর্ষণ করছি রূপকল্প রচয়িতাদের প্রতি।
উচ্চাভিলাষী যাত্রা কেবলমাত্র কতিপয় মানুষের জন্য নয়Ñ সেই যাত্রায় যারা বাংলাদেশ নাম এই জনপদে সভ্যতার পিলসুজে নিজেদের রক্ত জল করে শ্রমদান করে যাচ্ছে তাদেরকেও নিতে হবে। কেননা এরাই বাংলাদেশের প্রকৃত প্রাণস্পন্দন। কেবলমাত্র তাহলেই অর্থবহ হবে ভবিষ্যতের অগ্রযাত্রা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।