শুচি সৈয়দ
শুচি সৈয়দ
পড়তে পড়তে মনের মধ্যে জেগে গিয়েছিল লেখার ইচ্ছা। সেই শৈশবে সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুটি আড়ি দিয়েছিল আমার সঙ্গে। নিঃসঙ্গী আমার সঙ্গী হয়ে গেল বই, পেয়ে গেলাম জীবনের সবচেয়ে বিশ্বস্ত এবং প্রিয় বন্ধুকে। পাঠের একটি শক্তি আছে। চোখ খুলে দেয়, মন খুলে দেয়, ঐশ্বর্যে ভরে দেয় হƒদয়।
ভুবন ভরিয়ে দেয় আলোয়। পাঠের সেই শক্তি জাগিয়ে তোলে মানুষের অন্তরাÍাকে। গড়ে দেয় ন্যায়-অন্যায় বোধ। অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে শেখায়। আমার ক্ষেত্রে এমনটিই ঘটেছে।
ছড়া শিখেই লেখালেখির শুরু। লেখার যে একটি অসাধারণ শক্তি আছে তা আমি উপলব্ধি করেছি সেই শুরুতেই। লেখার কারণে লেখকের জীবনে যেমন অনেক প্রাপ্তি যোগ থাকে তেমন অপ্রাপ্তির বঞ্চনাও থাকে। জীবনে যেমন অনেক পুরস্কারে পুরস্কৃত হয়েছি লিখে, তেমন বঞ্চনাও জুটেছে বটে কপালে। ছড়া লিখে আমার জীবনে ঘটেছে পাসপোর্ট বিড়ম্বনা।
আমার কোনও পাসপোর্ট নেই। পাসপোর্টের জন্য আবেদন করে একটি চিরকুট পেয়েছিলাম কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ‘আপনার পাসপোর্টের আবেদন বিবেচনার জন্য আরও কিছু সময়ের প্রয়োজন। ’ এই আরও কিছু সময়ের দৈর্ঘ্য কত সেটা আমার জানা নেই। মাস ছয়েক পর চিঠি লিখে খোঁজ করলে আরেকটি চিরকুট পাওয়া গেল ওই একই বাক্যে নতুন স্মারক এবং তারিখ সম্বলিত। ‘আপনার আবেদন বিবেচনার জন্য আরও কিছু সময় প্রয়োজন।
’ বছরখানেক পর পাসপোর্ট অফিসের বিভাগীয় কার্যালয়ে সরাসরি খবর নিতে গেলাম চিরকুটগুলোসহ। কর্মকর্তা ভদ্রলোক আমার কথা শুনে আমাকে বসালেন। তলব করে ফাইল আনালেন আমার আবেদনের। ফাইল পড়তে পড়তে ভদ্রলোক আমার দিকে তাকিয়ে রসিয়ে রসিয়ে হাসতে থাকেন। জ্যোতিষীর ভঙ্গিতে তিনি বলতে থাকলেন, ‘আপনি কবিতা লেখেন?’ সময় নেন।
বলেন, ‘জ্বালাময়ী কবিতা?’ ‘আপনার পাসপোর্ট দিতে তো সময় লাগবেই। ’ ভদ্রলোক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নথি থেকে পাঠানো আমার সম্পর্কিত তথ্যাবলী পড়ে শোনান। তারপর আমি আর পাসপোর্টের হদিস করিনি। যে নথির কারণে আমার এই পাসপোর্ট বিড়ম্বনা সেই নথিটির জš§ আমার ছড়ার কারণে। দেশের প্রথম সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে সে সময় লেখা আমার ছড়া বিভিন্ন পত্রিকায় ছাপা হলে আমাকে একদিন ন্যাশনাল সিকিউরিটি ইন্টিলিজেন্সের (এনএসআই) জেলা অফিসে ডেকে নিয়ে গিয়ে এক সুদীর্ঘ সাক্ষাৎকার নেন প্রবীণ কর্মকর্তা।
যিনি বিশ্বাসই করতে পারেননি আমার মতো এক পুঁচকে (তখন স্কুলে পড়ি) রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছি। দীর্ঘক্ষণ আমার সঙ্গে কথা বলেও তার মনে এই আস্থা জš§ায়নি যে আমিই সেই লেখক যার সম্পর্কে তথ্য চেয়েছেন তার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ। ফলে আমি তার অফিস থেকে চলে আসার পর তিনি তলব করেন আমার এক অগ্রজ প্রতিম কবি শই শিবলীকে। তার সাক্ষ্যে নিশ্চিত হল আমিই সেই। শিবলী ভাই তার অফিস থেকে বেরিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে ছুটে গিয়েছিলেন আমার বাড়িতে।
গিয়ে আমার বইয়ের র্যাকে টেবিলে যেখানে যত রাজনৈতিক বইপত্র ছিল সব একত্রে থলে বন্দি করে লুকিয়ে রেখে আসেন খাটের নিচে। আমি বাড়ি ফিরে তাজ্জব! সেদিন মনে মনে বিরক্ত হয়েছিলাম, এত ভয় পাওয়ার কি আছে। আজ বুঝি ভয়ের চেয়েও অধিক যে কারণে শিবলী ভাই সেদিন উদ্বিগ্ন হয়েছিলেন আমার জন্য তার নাম ভালোবাসা। শিবলী ভাই ওই একবারই আমাদের বাড়িতে গিয়েছিলেন। তার আগেও নয়, পরেও নয়।
একজন লেখকের জন্য কি দুর্লভ আর মহামূল্যবান নয় এই ভালোবাসা? লেখা তো মানুষকে ভালোবেসে মানুষেরই জন্য। সেই লেখা হয়তো কখনও কখনও কায়েমি স্বার্থবাদী শাসক শোষককে আঘাত করে। তারা সে আঘাত থেকে রক্ষা পেতে চান, অথবা চায় ফিরিয়ে দিতে। আমার ক্ষেত্রে সেই ফিরিয়ে দেয়ার অংকটি হচ্ছে আমার একটি জš§গত মৌলিক অধিকার থেকে আমাকে বঞ্চিত রাখার জন্য প্রতিবন্ধকতা রচনা করা।
লিখতে লিখতেই এক সময় আমার কাছে মনে হয়েছে এখন লেখার চেয়েও জরুরি গণতান্ত্রিক অধিকারের পক্ষে মিছিল করা।
জড়িয়ে পড়েছি গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের আন্দোলনেও। আবার স্বৈরাচারবিরোধী সুদীর্ঘ আন্দোলনে থাকতে থাকতে এক সময় এমন উপলব্ধি হয়েছে মিছিলের চেয়েও কম জরুরি নয় লেখা। চেতনার পরিচর্যা না থাকলে, লাগাম না থাকলে অনেক বিরাট প্রাপ্তি আর অর্জনও চোরাবালিতে তলিয়ে যায়। তাই শুধু রাজপথে অধিকার আদায়ের লড়াই-ই নয় সমানভাবে চালিয়ে যাওয়া প্রয়োজন লেখালেখি। পথে-র প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আর মতে-র পরিণত উপলব্ধি ছাড়া কোন জীবনই সঠিক গন্তব্যে পৌঁছতে পারে না।
কোন আন্দোলন, কোন সংগ্রামই সঠিক লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে না। এই ঘাটতির কারণেই নব্বইয়ের নাগরিক গণঅভ্যুত্থানে আমরা যে গণতন্ত্র কায়েম করেছি তা রূপ পেয়েছে গণতান্ত্রিক স্বৈরাচারে। সংখ্যাগরিষ্ঠ আর নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ স্বৈরাচারে। যাকে চিন্তাশীল ভাবুকরা বলছেন, ‘অটোক্রেসি থেকে মবক্রেসিতে’ রূপান্তর। রূপান্তর না বলে বলা প্রয়োজন লেবেল পরিবর্তন হয়েছে মাত্র।
সত্যি কথা বলতে কি বাংলাদেশের শোষক শাসকদের মধ্যে আমি কোন পার্থক্য দেখি নাÑ মনে হয় এরা সবাই ‘আমগাছ জামগাছ বাঁশঝাড় যেন/মিলেমিশে আছে ওরা আÍীয় হেন। ’ জিয়াউর রহমান, এরশাদ, খালেদা জিয়া, শেখ হাসিনা টু মেনন-ইনু, গোলাম আজম-নিযামী- আমি কোন পার্থক্য খুঁজে পাইনা এদের ভেতর। সব প্রো-পাওয়ার, প্রো-পিপল নেই কেউ। জীবনের এই সব ধাঁধাপূর্ণ পথ পরিক্রমা সত্ত্বেও আমার বিশ্বাস লেখার যে শক্তি সেই শক্তির উৎস এদেশের সরলপ্রাণ মানুষ। আর লেখার এই শক্তিকে সাহস রূপে সেই মানুষের কাছেই ফিরিয়ে দেয়া একজন লেখকের কাজ।
এই পনের কোটি হতভাগ্য মানুষের জীবনকে অর্থবহ পরিবর্তনের আন্দোলন কিংবা সংগ্রামে মানুষের সঙ্গে থাকাই একজন লেখকের কর্তব্য।
নিচে উদ্ধৃত ছড়াটি লিখে তৎকালীন সামরিক শাসকের বিরাগভাজন হয়েছিলাম বোধকরি। আর আজও উপলব্ধি করি এই ছড়াটি প্রাসঙ্গিক আমাদের সমাজের জন্য। আগে সামরিক শাসকরা গণতন্ত্র, কথা বলার অধিকার হরণ করত আর এখন দলতন্ত্রের কর্মীরা আমাদের সাংবিধানিক অধিকারকে ভূলুণ্ঠিত করে। আমরা প্রতিনিয়ত হই দলতন্ত্রের অসহায় বলী।
বত্রিশ বছর কাটল, কেউ কথা রাখেনি, ......!
আর কতকাল
আর কতকাল হুজুর
ভয় দেখিয়ে জুজুর
ফায়দাটা তার লুটে
একলা চেটেপুটে
দৈত্যসেনা নিয়ে
দেশটাকে কাঁপিয়ে
চালাবেন এই শাসন?
এখন দেশে জোয়ার
নয় তা মাথা নোয়ার
দৈত্যসেনা ‘ফেল’
অচলও রাইফেল
জ্বলছে দেশে আগুন
বাঁচতে চাইলে ভাগুন
পালান ছেড়ে আসন !
পাবনা, ১৯৭৮
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।