যখন বিকাল হতে থাকে, হতে হতে সূর্যটা ঢলে পড়ে, পড়তে থাকে
বাবার পকেট হাতড়ে টাকা নেয়াটাতে খারাপ কিছু মনে হতো না। দুটাকা বড়জোর পাঁচটাকা এই হচ্ছে সর্বোচ্চ অংক। একদিন খাবার টেবিলে মা বললেন বাবাকে, তোমার পকেট থেকে কৌশিককে টাকা নিতে দেখলাম! বাবা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, কত নিয়েছিস? আমি বিক্রমের সাথে বললাম, দুই টাকা! বাবা বললেন, সিগারেটের দাম কি এখন দুই টাকা? আমি হৈ হৈ করে বলি, কে সিগারেট খায়? আমার বাবা আমার ভাল বন্ধু। তিনি আমায় যখন তখন বুকে জরিয়ে ধরতেন। আলতো করে মাথায় হাত বুলিয়ে বলতেন, সিগারেট খেয়ে নিজের ক্ষতি আর করিস না! আর কেন তুই দুইটাকা নিস, নিলে দশটাকা নিবি, খুচরা টাকা পান খাবার জন্য আমার লাগে।
বাবা পান খান। ছোটবেলায় তার জন্য পান আনতে যেতাম বাসার পাশের দোকানে। খরছাড়া হাকিমপুরি জর্দা আর শুকনো সুপারী এটা গিয়ে বলতো হতো দোকানীকে। এখন মাঝে মাঝে কোন বাড়ীতে ভূরিভোজের নিমন্ত্রণ থাকলে খেয়ে দেয়ে পানের দোকানে গিয়ে আমি নিজের জন্য তেমন একটা পান দিতেই বলি। পানের বোটায় চুন নিয়ে ডান হাতের আঙুলে একটু লাগিয়ে সেটা মুখের ভেতরে পানের শরীরে লাগিয়ে দিতে দেখতাম বাবাকে।
আমিও ঠিক একই রকম করি। আমার মনে হয় শেষ জীবনে আমিও পান খাবো, আর আমার সন্তান আমার বাবার মতই পান খাবার বিষয়টা রপ্ত করবে।
বাবার শরীর থেকে অদ্ভুত এক সুগন্ধ আসে। মিস্টি। তার বুকে কাঁচাপাকা পশম।
অফিস থেকে ফিরে সারাদিন পড়ার টেবিলে থাকতেন এবং এখন অবসর জীবনে সারাদিন তাকে টেবিলেই পাওয়া যায়। প্রচুর পড়াশুনা করেন, তসলিমা নাসরিন থেকে শুরু করে হুমায়ুন আহমেদ কেউই বাদ যায় না। আমাদের অপর বাস্তব পড়ে তার অভিমত হচ্ছে, এটা তো সাধারণ পাঠকের জন্য হয়নি! আমি চেয়ারের পেছনে দাড়িয়ে হাত গলিয়ে দেই তার বুকে। গরমের সময় তিনি খালি গায়ে থাকতে পছন্দ করেন। বুকের অন্দিলে মাথা ঘসে যে সুঘ্রানের মৌতাতে আমি বুদ হয়ে থাকি, তার তুলনা পৃথিবীর অন্য কিছুর সাথে হতেই পারে না।
আমার বাবা আমাকে তুই বলে ডাকতেন। কবে সেটা তুমি হয়ে এখন বেশ সম্মানের সাথে উচ্চারিত হতে শুরু করেছে নিজেই খেয়াল করিনি। আগে তিনি আদেশ দিতেন। এখন পরামর্শ চান। আগে তিনি টাকা দিতেন।
এখন আমি দেই মাঝেসাঝে। বাবার কাছে টাকা চাইতে খুব অস্বস্তি বোধ করতাম। সৎ একজন ক্লাস ওয়ান অফিসারের অর্থসংকট চোখে পড়তো নিদারুণ। মায়ের বাজারের থলি ভরতেই তিনি হিমশিম খেতেন, তার উপরে আমার বায়না যে তাকে অসহায় করে দেবে এটা বুঝে চুপ থাকতাম। পরিকল্পনাগুলোকে কাটছাট করতাম।
অন্যভাবে করতাম। আজকে বাবা কোন প্রয়োজনে যখন টাকা চান, তখন আমার মনটা নেচে ওঠে। বাবাকে কিছু দিতে পেরে মনে হয় আমার উপার্জন স্বার্থক হলো। খুব অসহায়ও লাগে। সারাজীবন যে লোকটা আয় করেছেন, আজকে তিনি নির্ভর করেন ভাড়া কয়েকটা বসতবাটির আয়ের উপর।
আমার বাবার খুব ভাল গানের গলা। বিদ্যুত চলে গেলে, মায়াবন বিহারীনি, এই যে নদী, কাজলও নদীর জলে এমন সব গান মাতিয়ে রাখতো আমাদের কৈশর, যৌবনের অনেকটা সময়। আমার ছোটবোনও খুব ভাল গান গায়। তাদের দ্বৈত সংগীত শুরু হলে পড়শীরা কান লাগিয়ে শুনতেন। আজকে আমার বাবা হার্টের সমস্যায় ভূগছেন।
এখনও তেমন মেজর কিছু হয়নি। তবে গান গাইতে তিনি আগের মত স্বর তুলতে পারেন না। চওড়া সুরের জায়গায় হাফিঁয়ে ওঠেন। কিন্তু কেমন এক মাদকতা আছে তার গলায়। তার গাওয়া সব গান আমার প্রিয়।
রাস্তায় যেতে যেতে, টিভি, রেডিওতে যখনই সে গানগুলো শুনি আমি কেবল বাবাকেই দেখি। আমার বাবাকে গাইতে দেখি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।