আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পরিপত্রের ‘কাগজের পুতুল’ আসীন সিংহাসনে (!)

শুচি সৈয়দ শুচি সৈয়দ বাস্তবতা অনেক সময়ই কল্পনাকে ছাড়িয়ে যায়। আমাদের স্বল্পায়ু জীবনে তেমন অনেক ঘটনারই মুখোমুখি হই আমরা। সেরকম অভিজ্ঞতায় বিস্ময়ের অনুভূতি জাগে, বিব্রতবোধ করি, কখনও কখনও অস্বস্তির কারণ হয় তা। দেশের স্থানীয় সরকার নির্বাচন আসন্ন। কিছুদিন আগ থেকেই সেটার সাড়া-শব্দ, আওয়াজ-নেওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে।

বিশেষ করে গত দুই ঈদে মহল্লার দেয়ালে দেয়ালে ৪ রঙা রঙিন পোস্টারে এলাকাবাসীর উদ্দেশ্যে লিখিত শুভেচ্ছার স্লোগান থেকে। নির্বাচন আসে নির্বাচন যায়। আমাদের ভোটে নতুন নতুন জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হন, পৌরসভা মেয়র, কাউন্সিলর পদে নতুন মুখ আসেন কিন্তু পুরনো ব্যবস্থার কোন পরিবর্তন দেখতে পাই না। পুরনো ব্যবস্থার মধ্যে নতুন অনেক কিছু সংযোজন করেও নতুনকে তুলে আনা যায় না। যেমন তৃণমূলের নির্বাচনে প্রত্যেক ওয়ার্ডে নারী কাউন্সিলরদের নির্বাচনের ব্যবস্থা রয়েছে কিন্তু নির্বাচিত নারী কাউন্সিলরদের ক্ষমতা পুরুষ কাউন্সিলরদের মুখাপেক্ষী, তাদের দ্বারা আচ্ছাদিত যেন।

ফলে তাদের অবস্থা জাতীয় সংসদে মনোনীত মহিলা সংসদ সদস্যদের মতোই অনেকটা। পদ আছে কাজ নেই। অর্থাৎ উজিরে খামাখা! উজিরের অবশ্য একটা ঠাঁট আছে। এদের কোন ঠাঁটও নেই। ঠাঁট যে নেই সেটা উপজেলায় নির্বাচিত মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানদের ভাষ্যেই পরিষ্কার।

তাদের কয়েকজনের সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছে একটি জাতীয় দৈনিকে। সেই সাক্ষাৎকারের কিছু বিস্ময়কর সত্য পাঠকদের জন্য উদ্ধৃত করিÑ বরিশাল বানারীপাড়ার নির্বাচিত মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান আমিরুননেছা বেগম বলেছেন, ‘কাগজে-কলমে আছি, কিন্তু কাজে-কর্মে নেই। আমার কাছে শুধু সরকারের একটা পরিপত্র আছে। আর ক্ষমতা সংসদ সদস্যের চেলার চেয়েও কম। ’ (দৈনিক কালের কণ্ঠ, জয়িতা, ২৬ নভেম্বর ২০১০) কক্সবাজার সদরের নাসিমা আক্তার জানান, ‘ক্ষমতা থাকে ইউএনও-চেয়ারম্যানের কাছে।

আমরা কাগজের পুতুল মাত্র। ... সরকার আমাদের একটা পরিপত্র দিয়ে হাত-পা বেঁধে রেখেছে। কাজ করার কোন ক্ষমতা দেয়নি। ’ (দৈনিক কালের কণ্ঠ, জয়িতা, ২৬ নভেম্বর ২০১০) যেন এক নির্বাচিত প্রহসন! অবরোধবাসিনী নারীদের ঘর থেকে বাইরে এনে ‘সিংহাসনে’ (!) বসিয়ে হাত-পা বেঁধে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা। এদের অবস্থা অনেকটা গত শতকে একটি আলোচিত পোস্টারের মতো।

১৯৯১ সালে একদল প্রাণবান তরুণ সংবাদকর্মীর প্রাণস্পন্দিত দৈনিক হিসেবে প্রকাশিত হয় ‘আজকের কাগজ’Ñ সাদা কালো এক রঙা একটি পোস্টার ছাপা হয়েছিল তার। তাতে হাত বাঁধা, চোখে এবং মুখে পট্টিবাঁধা একটি লোকের ছবির ওপর এই বাক্যটি উৎকীর্ণ ছিল ‘আমাদের হাত বাঁধা নেই, আমাদের চোখ খোলা, আমরা বলতে পারি। ’ বিপুল আলোচিত ছিল এ পোস্টার। আজকের নির্বাচিত নারীরা ওই পোস্টারের সাক্ষাৎ প্রতিমূর্তি। তাদের নিয়ে যদি পোস্টারটি করতেই হয় তবে স্লোগানটি লিখতে হবে বিপরীত।

লিখতে হবেÑ ‘আমাদের হাত বাঁধা, পাও বাঁধা, চোখ এবং মুখ বন্ধ। ’ উপজেলা চেয়ারম্যানদের জন্য যখন ৪০ কিংবা ৬০ লাখ টাকার গাড়ি ক্রয় করা হচ্ছে তখন এদের অনেকের বসার জন্য চেয়ার-টেবিলের ব্যবস্থাও করা হচ্ছে না। রবীন্দ্রনাথের আÍজীবনী বাল্যস্মৃতিতে সে যুগে ঠাকুর পরিবারের নারীদেরও গঙ্গাøানে পাল্কিসহ ডুবিয়ে আনার ঘটনার উল্লেখ পাই। নির্বাচিত নারী জনপ্রতিনিধিদের অবস্থা যেন এ যুগে অনেকটা সেরকমেরই। পরিপত্রই যদি তাদের নিয়তি হয়, তা হলে নির্বাচনের গঙ্গাøানের পুণ্যটা কার খাতায় যোগ হবে! আর সেই ‘গঙ্গাøানের পাপে’ তারা কেন অচ্ছুত বিবেচিত হবেন, তাদের যারা সমর্থন জানিয়ে সম্মানিত করেছিলেন সেই ভোটারদের কাছেই কেন তারা করুণার পাত্রে পরিণত হবেন? এ এক প্রহেলিকা, এ এক প্রহসন বটে।

পুরুষতান্ত্রিক প্রহসন। ভাগ্যিস আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও মাননীয় বিরোধীদলীয় নেতা পুরুষতন্ত্রের প্রহসনে পরিপত্রের পুতুলে পরিণত হননি। ২. পত্রিকায় দেখলাম এবার ভোটাররা ভোটপ্রার্থীদের কাছে এলাকার উন্নয়নে তাদের লিখিত পরিকল্পনা দাবি করেছেন। অর্থাৎ ‘সোনা দিয়ে মুড়ে দেব রাস্তা’Ñ এ প্রতিশ্র“তি দেবার দিন ফুরিয়ে আসছে। ‘না’ ভোটের একটা সীমিত চর্চা নিকট অতীতে হয়েছেÑ ভবিষ্যতে সেটি আরও ব্যাপক হয়ে উঠতে পারে যদি ভোটারদের সচেতনতা বৃদ্ধি পায়।

দেশের একজন আÍত্যাগী সংগ্রামী প্রয়াত রাজনীতিক কমরেড অমল সেন তাঁর লেখা একটি পুস্তিকা ‘জনগণের বিকল্প শক্তি’-তে গত শতকের আশির দশকে লিখেছিলেনÑ ভোটাররা ভোট দিয়ে যে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করেন সেই জনপ্রতিনিধি যদি তার নির্বাচন এলাকার ভোটারদের স্বার্থবিরোধী কাজ করে তবে তাকে ফিরিয়ে আনার জন্য পুনর্নির্বাচনের ব্যবস্থার বিধান রাখার কথাÑ নির্বাচনী পদ্ধতির মধ্যেই। বোধকরি মধ্যবর্তী নির্বাচনে জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের মাধ্যমে খণ্ডিতভাবে যে-কাজটি সম্পন্ন হয়। কমরেড অমল সেনের প্রস্তাবনাটি ছিল আরও স্পষ্ট। তা হচ্ছে, এলাকার লোকজনই তাদের অনাস্থা জ্ঞাপক ভোট দিয়ে প্রতিনিধি প্রত্যাহার করবে। অর্থাৎ জনস্বার্থের বিরুদ্ধে কোনওভাবেই অবস্থান নিতে পারবেন না নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি।

বর্তমান নির্বাচনী ব্যবস্থায় যেটি ঘটে না। একবার নির্বাচিত ঘোষিত হলেই জনপ্রতিনিধি আর জনপ্রতিনিধি থাকেন নাÑ সর্বাঙ্গে হয়ে ওঠেন নিজেরই প্রতিনিধি। ফলে জনতার হিসেবের সঙ্গে তার হিসাব আর মেলে নাÑ মেলে না বলেই এক টার্মেই গুছিয়ে নিতে চান আখের। জীবনের সব প্রাপ্তির পাত্র করে তোলেন ক্ষমতাকে। কেমন করে? তার একটি বাস্তব উদাহরণের কথা বলি, এক নির্বাচনে এলাকার সবচেয়ে দরিদ্র ঘরের ছেলেটিকে সবাই মিলে মেম্বর পদে দাঁড় করিয়ে জিতিয়ে আনল তরুণরা।

‘আবুল’ ভোটে জিতে মেম্বর হল। কথা ছিল, এলাকার রাস্তাঘাটের উন্নয়নের কাজ করবে। গরিব মানুষের জন্য সরকারের বরাদ্দকৃত সুযোগ-সুবিধা সত্যিকার গরিব মানুষরা যাতে পায় সে ব্যবস্থা করবে। যাতে করে ভাগ্য বদলাবে এলাকাবাসীর। কিন্তু আবুল সে কাজ করল না।

ভাগ্য বদলাতে থাকল কেবল আবুলেরই। তার ভাঙা ঘরের ছাউনির পাশেই পাকা বাড়ি হল, গরিব মানুষের প্রাপ্য বরাদ্দের নয়-ছয় করে জোতজমি হলÑ এলাকার রাস্তা-ঘাট যা ছিল তা আরও করুণদশায় নিপতিত হল। গ্রামের যে ছেলেরা আবুলকে দাঁড় করিয়ে জিতিয়ে এনেছিল তারা আবুলকে ধরল, কেন দরিদ্র আবুল ধনী হওয়ার জন্য গরিবের হক আদায় না করে আÍসাৎ করছে? আগামীতে তো আর আবুলকে তারা জিতিয়ে আনতে পারবে না। জনগণের কাছে আবুলের হয়ে যেতে পারবে না। তা হলে আবুল কেন এমন গর্হিত কাজ করছে? আবুলের জবাব খুব সহজ-সরলÑ জীবনে সে এই একটিই সুযোগ পেয়েছে, ক্ষমতার এই এক টার্মেই তাকে বড়লোক হতে হবে।

আগামী বার সে নির্বাচনে আর দাঁড়াবে না। তার আর দরকারও হবে না তার। এটি বাংলাদেশের একটি গ্রামের নির্বাচিত মেম্বও জনৈক আবুলের জীবনের সত্যি ঘটনা! এটা অনেক আবুলের জন্যই সত্য বটে! আমাদের নির্বাচন ব্যবস্থায় এসব আবুলেরাই নানাপন্থায়, বারবার ফিরে আসেÑ গোটা নির্বাচন ব্যবস্থাটাই নির্বাচন না থেকে তাদের কাছে ব্যবসায় হয়ে উঠেছে একথাও ভুল নয়। অভিজ্ঞতা অন্যরকমেরও আছে। সেটাও এক গরিবের অভিজ্ঞতাই।

গ্রামের গরিব কাঠুরে সাদেক আলী। জীবিকা নির্বাহ করে কাঠ কেটে। চেয়ারম্যান-মেম্বারদের দুর্নীতি আর দৌরাÍ্যে অতিষ্ঠ গ্রামের তরুণরা কাঠুরে সাদেক আলীকে নির্বাচনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বিপুল ভোটে জিতিয়ে মেম্বর নির্বাচিত করল। সাদেক আলী ভোট পেল চেয়ারম্যান প্রার্থীর চেয়েও অনেক বেশি। নির্বাচিত মেম্বর, আলোচিত সেই মেম্বর সাদেক আলীকে দেখি শহরের প্রবেশ মুখে বসে কাঁঠাল বিক্রি করছেন।

কৌতূহলী হয়ে তার সঙ্গে আলাপ জমিয়ে যা জানা গেল তার সারাংশ হচ্ছেÑ সাদেক আলী বিব্রত, বিরক্ত, বিড়ম্বিতÑ কারণ ইউনিয়ন পরিষদের মিটিংগুলো হচ্ছে, গম ভাগ-বাঁটোয়ারা করার মিটিং, ব্রিজ-কালভার্টের নামেÑ কে কোথায় কত মন গম বরাদ্দ করিয়েÑ কাজ না করে বিক্রি করে টাকা-পয়সা আÍসাতের মিটিং। সাদেক আলী এ ‘হারাম রুজিতে’ রাজি নয়Ñ মিটিঙের ভাগ-বাঁটোয়ারার হিসাব সে তার ভক্ত পৃষ্ঠপোষক তরুণদের জানিয়ে দেয়ায় অন্য মেম্বাররা তাকে আর ভাগ-বাঁটোয়ারার মিটিঙেই ডাকে নাÑ সেও নিস্তার পেয়ে বেঁচেছেÑ এ তার ভাষ্য। জনপ্রতিনিধিদের(!) এই সংস্কৃতির পরিবর্তন ঘটাতে হবে। ক্ষমতার কাঠামোয় গরিব মানুষের অভিজ্ঞতা যেমন আবুলের উদাহরণ; তেমনই সাদেক আলীরাও ব্যবস্থা পাল্টাতে না পারা রণেভঙ্গ দেয়ার উদাহরণ বটে। এই উদাহরণের ভেতরে পরিপত্রের ‘কাগজের পুতুল’দেরও রাখতে হবে।

ব্যবস্থাকে পাল্টাবার, পরিবর্তনের নিরন্তর চেষ্টায়, প্রক্রিয়ায় অব্যাহত রাখতে হবে অংশগ্রহণ। অংশগ্রহণ করতে হবে ব্যবস্থাকে কার্যকর এবং শুদ্ধ করার প্রয়াসেই। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.