ঘুম-তার্কিক গ্রাম বাংলার ব্যবহৃত বহু শব্দ অভিধানে নেই। অঞ্চলভেদে এসব শব্দের উচ্চারণ ও অর্থের পার্থক্য রয়েছে। শব্দগুলো আঞ্চলিক শব্দ হিসাবে পরিচিত। সাধু ও চলিত বাংলার জগতে এসব শব্দের প্রবেশাধিকার খুবই সীমিত। গ্রামের মানুষের সংলাপ লেখার সময় লেখকরা সাধারণত এই শব্দগুলো ব্যবহার করেন।
লেখ্য ভাষায় এসব শব্দ খুব বেশি ব্যবহৃত না হলেও যুগ যুগ ধরে গ্রাম্বাংলায় এগুলো চালু রয়েছে এবং থাকবে।
গ্রাম্য শব্দের (গ্রামে প্রচলিত আর্থে) বাঙালি লেখা প্রথম শব্দকোষ একজন মুনশির। তিনি ছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ফারসি অনুবাদক ন্যাথানিয়াল ব্রাসি হ্যালহেডের ভাষা শিক্ষক। হ্যালহেডের অনুরোধে তিনি গ্রামবাংলায় প্রচলিত প্রায় দু হাজার শব্দের একটি তালিকা ফারসি অর্থসহ করে দেন। কাজটি তিনি সম্পন্ন করেন ১৭৭৪-৭৫ সালের দিকে।
হ্যালহেড পরে এটি A Bengali Persian vocabulary হিসেবে প্রকাশ করেন। এর পান্ডুলিপি ব্রিটিশ মিউজিয়াম লাইব্রেরিতে রক্ষিত আছে। অজ্ঞাতনামা এই মুনশির সংগৃহীত শব্দের বানান দেখে মনে হয় তিনি নোয়াখালী অঞ্চলের লোক। যেমন তিনি লিখেছেন কেদা (কাদা), গোদারা (গুদারা), ছফরি আম (পেয়ারা)। এগুলো নেয়াখালী অঞ্চলের উচ্চারণ।
অর্থাৎ তিনি নিজে শব্দগুলো যেভাবে উচ্চারণ করতেন সেভাবেই বানান লিখেছেন।
গ্রামাঞ্চলে প্রচলিত এই শব্দসম্পদের গুরুত্ব বিবেচনা করে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরও গ্রামের শব্দ সংগ্রহে নেমেছিলেন। তিনি প্রায় তিনশ শব্দ সংগ্রহ করেন। সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকায় এই সংকলন প্রকাশিত হয় ১৩০৮ বঙ্গাব্দে। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী সহ অনেকেই পরে গ্রামে প্রচলিত শব্দ সংগ্রহ করেছেন।
এর বহু পরে ড.মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্ আঞ্চলিক ভাষার অভিধান সম্পাদনা করে প্রকাশ করেন। বলা যেতে পারে এটি প্রথম বাংলা গ্রাম্য শব্দকোষ।
তৎসম শব্দের যেমন একাধিক অর্থ থাকে গ্রামাঞ্চলে প্রচলিত শব্দও একাধিক অর্থে ব্যবহৃত হয়। এক এলাকায় একটি শব্দের যে অর্থ, অন্য এলাকায় তার ভিন্ন অর্থ। হ্যালহেডের মুনশি টুমটাম শব্দের অর্থ দিয়েছেন আসবাব।
অথচ ঢাকা অঞ্চলে (শীতলক্ষ্যার পূর্বপার এলাকা) টুমটাম বলতে বোঝায় ছোট ছোট গৃহস্থালি জিনিসপত্র। বিদ্যাসাগর তার শব্দ সংগ্রহে আদামাদা শব্দটি নিয়েছেন। জ্যোতিভূষণ চাকী তার অর্থ করেছেন অর্ধেক। লাক্ষণিক অর্থে মাঝারি গোছের। উদাহরণ দিয়েছেন- এইটা আদামাদা মানুষের কাম না।
মাঝারি গোছের অর্থ প্রকাশ করার জন্য তিনি সিলেটি একটি প্রবাদ তুলে দিয়েছিলেন, আদামারা চ’দরি যারা, আলবায়ে মাস্ মারে তারা। অর্থাৎ যারা আধা চৌধুরী তারা আলের কোলে মাছ ধরে। মোট কথা, তাদের বনেদিয়ানা নেই, জীবনযাত্রা দীনহীন। শীতলক্ষ্যা পারে (এখন নরসিংদী জেলার অন্তর্গত) আদামাদা শব্দের অর্থ অনিচ্ছা সত্ত্বে বা অবহেলার সঙ্গে কোনও কাজ করা অথবা অর্ধসমাপ্ত অবস্থায় রাখা। যেমনঃ হালায় কামডা আদাখেঁচ্রা কইর্যাা ফালাইয়া রাখছে।
এই অঞ্চলে (পলাশ, কাঞ্চনডাঙ্গা, চরসিন্দুর প্রভৃতি এলাকা) আরও যেসব শব্দ হরহামেশা ব্যবহৃত হয় তার কিছু উদাহরণ দিচ্ছি।
১। খাম্বিরা। । গিয়া দেহি হেয় (সে) গদিত খাম্বিরা অইয়া বইয়া রইছে।
(গ্যাট হয়ে বসে আছে অর্থে)। কামডা খাম্বিরা মত কর। (ধীরেসুস্থে করা অর্থে)। হেয় ত খাম্বিরা টাইপের মানুষ। (ধীরস্থির অর্থে)।
খাম্বিরা তামুক আনিছ। (অম্বুরি তামাক আনা অর্থে)।
২। হাডোর, হাডোর ভাঙ্গা। ।
ঘরের ছোটখাটো জিনিসপত্র বা আসবাব হচ্ছে হাডোর। সেগুলো গুছিয়ে রাখা হচ্ছে হাডোর ভাঙ্গা। হাডোর-এর ছোটগুলো হচ্ছে টুমটাম। এগুলো গুছানো হচ্ছে- এক ফাইল করা। যেমন টুমটামগুলা এক ফাইল কইর্যা্ রাখ।
৩। উষ্টা। । তোরে একটা উষ্টা দিমু। (লাথি দেওয়া অর্থে)।
উষ্টা খাইয়া পইড়্যা গেছি। (হোঁচট খেয়ে পড়ে যাওয়া অর্থে)
৪। হালতারা। । ঝাঁটা, পিছা।
গালি অর্থে পিছমারা।
৫। হডা, হড়ইয়া। । কামচোর, যে কাজে ফাঁকি দেয়।
৬। বোন্দা, বোন্দাগাজি। । বোকা, সহজ-সরল।
৭।
ওডা। । ঘরের দরজার সম্মুখ ভাগ।
৮। ওসারা।
। ঘরের সামনের বারান্দা।
৯। আঙ্গা,আঙ্গানো। ।
জ্বালানো। বাতিডা আঙ্গা। অহনও বাতিডা আঙ্গানো অইল না?
১০। চডান,বিচরা। ।
বাড়ির কাছাকাছি ঘাস যুক্ত মাঠ। গরুগুলান বিচরার মধ্যে লাইড়া দে। চডানের মদ্যে নিয়া কাপড়গুলা লাড়। (মাঠে নিয়ে কাপড়গুলো নেড়ে বা বিছিয়ে দে)।
১১।
ডুম। । গাছের টুকরো। ডুমডা ফাইড়া লাকড়ি বানা। (গাছের গুঁড়িটা চিরে লাকড়ি বানানো অর্থে)
১২।
বিচন, বিচুন। । হাতপাখা। গরমের জ্বালায় বাঁচি না, বিচনডা দে বাওয়াই (বাতাস দেই)
(কিছুটা সংক্ষেপ করা হয়েছে)
(কেউ-কেউ দিলীপ দেবনাথের “শব্দচিন্তা চমৎকারা” পড়ে দেখতে পারেন। প্রকাশ করেছেঃ দিব্যপ্রকাশ)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।