আলোকিত জীবনের একজন সহযাত্রী
তার দু’বাহু ছিল না জড়িয়ে ধরার, না ছিল দু’হাত স্পর্শ নেবার কিংবা আরেক হাত ধরতে, এমনকি পা ছাড়াই যার জন্ম হয়েছিল অলৌকিকতায় । সে না পারতো হাটতে বা দৌড়াতে কিংবা নাচতে, না পারতো দু’পায়ের উপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে। একজন মানব সন্তান যার না আছে পা, না আছে বাহু। একবার ভাবুন তো আমরা কি করতাম? এমন হলে আমাদের দৈনন্দিন জীবনটা ক্যামন হতো?
১৯৮২ সালে অষ্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে চিকিৎসা বিজ্ঞানের আগাম পূর্বাভাস কিংবা কোন ব্যাখ্যা ছাড়াই পৃথিবীতে এলো এক মানব সন্তান যার না আছে পা, না আছে বাহু । তার নাম নিকোলাস ভয়্যাচিচ Nicholas Vujicic (pronounced Voy-a-chich) সংক্ষেপে Nick Vujicic নিক ভয়্যাচিচ ।
জ্ঞান হওয়ার পর নিক ভয়্যাচিচ যখন বুঝতে পারলেন যে তিনি অন্য বাচ্চাদের চেয়ে আলাদা দুঃখের শুরুটা সেখান থেকেই। আশৈশব অঙ্গহানীর এই যন্ত্রনা স্কুলে এবং চারপাশে আত্মসন্মানবোধের প্রশ্নে তাকে ক্রমাগত এক নিঃসীম হতাশায় একাকীত্ত্বের দিকে ঠেলে দিচ্ছিল। কেন তিনি চারপাশের অন্য বাচ্চাদের মতো নন, কেন তার হাত-পা ছাড়াই জন্ম হয়েছে? তিনি কি করবেন এই বিকলাঙ্গতা নিয়ে? পৃথিবীতে তার কি প্রয়োজন আছে? চরম হতাশা এবং মানসিক বিপর্যস্থতায় কাতর নিক বুঝতে পারেন স্কুল এবং চারপাশে তিনি একা। সাত বছর বয়সে তার জন্য বিশেষ ভাবে ডিজাইন করা ইলেক্ট্রনিক হাত এবং বাহুর ব্যবস্থা করা হয়। ধারনা ছিল এবার অন্ততঃ অন্য বাচ্চাদের পছন্দনীয় হবে আগের চেয়ে কিন্তু ট্রায়াল পিরিয়ডেই উপলব্ধি করলেন যে স্কুল এবং চারপাশে আগের মতোই অন্য বাচ্চাদের কাছে তিনি অপছন্দনীয়।
নিক তখন ইলেক্ট্রনিক ঐ যন্ত্রটা ফেলে দিয়ে তার নিজের যা আছে তাই নিয়ে চলার দৃঢ সংকল্প করলেন।
হাত নেই, পা নেই, দুঃখও নেই।
একনিষ্ট পরিশ্রমী ও অধ্যাবসায়ী নিক বড় হওয়ার সাথে সাথে তার শারীরিক সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করতে থাকেন। দিন যত যায় পরিস্থিতির সাথে একাত্ম হয়ে নিক অর্জন করতে থাকে আরও বড় সাফল্য। গ্রেড সেভেনে পড়ার সময় তিনি ক্লাস ক্যাপ্টেন নির্বাচিত হন এবং বিকলাঙ্গতা অভিযানসহ বিভিন্ন ধরনের কল্যানমুখী কাজে ফান্ড গঠনে স্টুডেন্ট কাউন্সিলের সাথে কাজ করেন।
স্কুলের গন্ডী পেড়িয়ে পরবর্তীতে একাউন্টিং এবং ফাইনান্সিয়াল প্লানিং এর উপর তিনি ডাবল স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন। তার স্বপ্নের পূর্ণতা দিতে মাত্র ১৯ বছর বয়স থেকে শিক্ষার্থীসহ অন্যান্যদের বলতে থাকেন নিজের জীবনের গল্প। মনের শক্তিতে নিজের যা আছে তাই নিয়ে শুরু করে কিভাবে তাবৎ পৃথিবীর সকল প্রতিকুলতাকে অতিক্রম করা যায় সেই কাহিনী। যা যোগায় প্রেরণা, অনুপ্রাণিত করে কিভাবে আমাদের মনোভাব সকল বৈরীতাকে পরাভূত করে নিয়ে যায় অসীম উচ্চতায়।
প্রতিষ্ঠা করলেন মোটিভেশনাল বক্তৃতা প্রতিষ্ঠান Attitude Is Altitude।
তার উদ্বুদ্ধকরন বক্তৃতা অষ্ট্রেলিয়ার তরুন প্রজন্মসহ সকলের কাজে প্রেরনার উৎস হয়ে দাঁড়ায়। ২০০৫.সালে অষ্ট্রেলিয়ায় দেশ ও জাতির সেবায় অনন্য যুব সমাজের জন্য প্রবর্তিত সবচেয়ে সন্মানজনক পুরস্কার "Young Australian of the Year" পদকের জন্য মনোনীত হোন।
শুধু তরুনরা নয় ২৯ বছর বয়সী এই বিকলাঙ্গ তরুনের বক্তৃতায় অনুপ্রাণিত হচ্ছেন তার চেয়ে দ্বিগুন বয়সীরাও। ইতোমধ্যে অষ্ট্রেলিয়ার ব্রিসবেন থেকে নিক আমেরিকার ক্যালিফোর্ণিয়ায় স্থানান্তরিত হয়েছেন। সেখানে তিনি অলাভজনক একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের প্রেসিডেন্ট।
১৯ বছর বয়সে শুরু করে সারা পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে নিয়ে যাচ্ছেন নিক তার জীবনের গল্প। শেয়ার করছেন বিভিন্ন শ্রেনী ও পেশার মানুষের সাথে। । পৃথিবীর অন্ততঃ 20টির বেশী দেশে বক্তৃতা করেছেন, সাক্ষাৎকার দিয়েছেন বিভিন্ন দেশের টিভি চ্যানেলে।
মানুষ জানতে চায় “তুমি কি ভাবে পারো হাসতে?” পরক্ষনেই তারা উপলব্ধি করে জীবনে দৃষ্টিসীমার বাইরে আরো অনেক কিছু আছে ফলে পরিপূর্ণ জীবন যাপন করছে একজন হাত-পা বিহীন বিকলাঙ্গ মানুষ।
নিক তার শ্রোতাদের সাথে উচ্চাভিলাসী স্বপ্ন এবং মানসচিত্রের গুরুত্ব শেয়ার করেন। বিশ্বব্যাপী উদাহরন হিসেবে তার নিজের অভিজ্ঞতা প্রয়োগ করে অন্যদের তাদের মনোভাব যাচাই এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থার বাইরের দৃষ্টি দিতে চ্যালেঞ্জ করেন। সকলের মাঝে নাগাল উচ্চতায় বিকশিত হতে সমস্যাকে প্রতিবন্ধকতার পরিবর্তে সম্ভবনা হিসেবে দেখতে তিনি উদ্বুদ্ধ করেন। তিনি জোড়ালো ভাবে উপস্থাপন করেন, কেন আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত শক্তিশালী হাতিয়ার যা আমাদের । জীবনের সুষ্ঠু বিন্যাসে এবং আমাদের করনীয় বিষয়কে সুস্পষ্ট করতে অন্তর্নিহিত প্রভাব ফেলে।
নিক তার নিজের জীবনকে তুলে ধরে বলেন যে স্থির সংকল্পই আমাদের বৃহৎ স্বপ্ন পূরনের প্রধান চাবিকাঠি আর ব্যর্থতা হচ্ছে অভিজ্ঞতা, অন্যথায় ব্যর্থতার গ্লানি আমাদের পক্ষাঘাতগ্রস্থ করবে।
এখন বিকলাঙ্গতা নিয়ে নিকের অনুভুতি কেমন? সে এটাকে মেনে নেয়, করে আলিঙ্গন আর বার বার মজা করে তার এই অবস্থায় বিভিন্ন কৌশল দেখিয়ে।
সে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে স্বতন্ত্র রসিকতায়, অধ্যাবসায় এবং বিশ্বাস দ্বারা।
চারপাশে সকলকে দৃষ্টিভঙ্গী.যাচাইয়ে উৎসাহিত করে যা নির্দিষ্ট সীমায় উন্নীত তাদের মানসচিত্রের প্রতিরুপ। তার চ্যালেঞ্জের এর নতুন সজ্ঞায় যারা নিজেদের জীবনে পরিবর্তন চান তিনি তাদের সাথে হোন সংঘবদ্ধ।
আর তারা পায়ে পায়ে শুরু করে উচ্চাভিলাসী স্বপ্ন যাত্রা। তার রয়েছে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে জনসাধারনের সাথে সংযুক্ত থাকার অকল্পনীয় ক্ষমতা এবং শিশু-কিশোর, তরুন এবং পরিণত বয়সের সকলকে আকৃষ্ট করতে পারেন অবিশ্বাস্য বুদ্ধিদীপ্ত রসিকতায়। এভাবেই অঙ্গহীন নিকোলাস ভয়্যাচিচ হয়ে উঠেছেন সত্যিকারের একজন প্রেরণাদায়ক আন্তর্জাতিক মোটিভেটর।
সারা পৃথিবীর কাছে যার প্রাপ্তি ছিল করুনা অথচ সেই বিকলাঙ্গ মানুষটি আজ আমাদের স্বাভাবিক মানুষদের প্রেরনার উৎস। কি সেই শক্তি, কি সেই সাহস যা তাকে করেছে অনন্য? তা জানব আমরা আগামী লেখায়।
.
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।