আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমার উল্টোমুখে চলা---কলেজে ভর্তি হলাম

I am what I am and that's how I would be. No I am not stubborn. I just want to be myself.

আমার উল্টামুখে চলা---স্কুল অধ্যায় আমার উল্টামুখে চলা---বিরতির পর কলেজে ভর্তি হওয়ার জন্য আমাদের সময়ে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়া লাগতো। এসেস-সির রেজাল্ট যাই-ই হোক না কেন, ভর্তি পরীক্ষার উপর ভিত্তি করেই ভাল কলেজে চান্স পাওয়ার নিয়ম ছিল। লেখাপড়া নিয়ে বাসায় ততদিনে আমাকে মোটামুটি একঘরে করে রাখা হয়েছে। চট্টগ্রাম কলেজে পড়া মানে রীতিমত বংশীয় মর্যাদা রক্ষার মত ব্যাপার। তারউপরে কলেজ ভর্তি টিচারদের মধ্যে আব্বু-আম্মুর বন্ধু-বান্ধব আত্মীয়পরিজনে গিজগিজ করছে, আমি চান্স না-পেলে তাঁদের কাছে মান যাবে।

আমি জানতাম এত মেধাবীদের ভীড়ে আমি সেই ঐতিহাসিক কলেজে চান্স পাবোনা। কাজেই হাতের পাঁচ হিসেবে পরীক্ষা দিলাম গার্লস কলেজে ও মহসিন কলেজে। রেজাল্ট বের হলো। গার্লস কলেজে চান্স পেলাম না!! আমার আত্মা শুকিয়ে গেল। এখন বাকী শুধু মহসিন কলেজ।

রেজাল্টের আগের রাতে আমি উপরওয়ালার কাছে বিনিদ্র দোয়াপ্রার্থী। আমার সকল দোয়া সার্থক করে পেয়ে গেলাম মহসিন কলেজে চান্স। চট্টগ্রাম কলেজের রেজাল্ট দেখার-ই কোনও মানে নেই। আমার বান্ধবী লোপা আর আমার পরীক্ষার সিরিয়াল নাম্বার পরপর হওয়াতে ও আমার রেজাল্ট-টা দেখে নিল। ওর কাছেই শুনলাম, আমি চট্টগ্রাম-কলেজেই চান্স পেয়েছি! কিন্তু আমার তো উল্টামুখে চলার বাতিক।

গোঁ ধরে বসলাম আমি পড়বোনা চট্টগ্রাম কলেজে। কে পাত্তা দেয় আমার কথা? বাসার সকলের প্রেস্টিজ আমার মান-অভিমানের চেয়ে অনেক দামী। সুতরাং সবুজ ফিতার এপ্রন পড়ে ক্লাস করতে যাওয়া শুরু করলাম। ক্লাসের সামনের দুইসারিতে বসতো মেয়েরা। পেছনের বাকি সারিগুলোতে বসবে ছেলেরা।

এটার একটা নেগেটিভ সাইড হলো, ক্লাস পালানো যায়না কিংবা ক্লাসে দেরি করে ঢুকলে টিচারদের চোখ এড়ানো যায়না। ক্লাসগুলো যথেষ্ট বোরিং ছিল। টানা ৫০ মিনিট ধৈর্য ধরে শিক্ষকের বোরিং লেকচার শোনার মত মানসিকতা সেসময় আমার ছিলনা। এটা বুঝতাম এইসব ক্লাস করে নষ্ট করার মত সময় আমার হাতে ছিলনা। তখন আমার মুভি দেখতে ইচ্ছে করতো, খেলাধুলা কিংবা আড্ডা মারা আমার কাছে অনেক বেশি ইন্টারেস্টিং ছিল।

পেছনের সারিতে বসা শুরু করলাম। গ্যালারির পেছনে বসে লুকিয়ে গল্পের বই পড়া যায়, কিংবা গল্পকরা যায়। মোদ্দা কথা ‘নিজের মত’ থাকা যায়। কিছু ছেলেপেলের মিজাজ খারাপ হলো তাদের জায়গা দখল করেছি বলে। কিছু মেয়ে আমার এই উদ্যোগের সাথী হলো।

কিছু টিচার আপত্তি জানালেন। কিন্তু আমি পেছনে বসার মজা পেয়ে গেলাম। দেখতাম পেছনে বসে ছেলেরা অনেক ‘আকাম-কুকাম’ করছে। তাছাড়া দেরি করে ক্লাসে ঢোকা, আগে বেরিয়ে যাওয়া, প্রক্সি দেওয়া---এইসব সুবিধা তো আছেই। মেইন বিল্ডিংএর কোনও এক গ্যালারির পাশে বড় ঘন্টা ঝোলানো থাকতো।

একবার সেই ক্লাস থেকে আগেভাগে বেরিয়ে ঘন্টা বাজিয়ে দিলাম। কলেজে কো-এডুকেশনে পড়তাম, কিন্তু আমার স্কুল ছিল মেয়েদের। কেন জানি ছেলেদের সাথে কখনই আমার বন্ধুত্ব হোলোনা। ছেলেরা প্রথমদিন থেকেই আমার শত্রু-শ্রেণীতে পড়ে গেল। আমি নিজের মত লাফালাফি করতাম, কারো সাতে পাঁচে ছিলাম না।

এখন ভাবলে অবাক লাগে, টানা দু-বছর কলেজে আমার নতুন কোনও বন্ধু সেভাবে দেখতে গেলে হোলই-ই না। বাসার কাছে কলেজ হওয়াতে কিছু কিছু ছেলে নিয়মিত আমাদের গলি পর্যন্ত পিছে পিছে আসতো। একদিন ছেলেগুলোর সাথে কথা বললাম। তাদের নাম-ধাম জিজ্ঞাসা করলাম। এরপর থেকে তারা আর পেছনে পেছনে আসতোনা।

আমাদের গলির সামনে কেউ কেউ দাঁড়িয়ে থাকতো মাঝে সাঝে, তবে কলেজে আমাকে, আমার বান্ধবী লোপাকে এবং খুব সম্ভবতো আমার আরো কিছু বান্ধবীকে ওরা অন্য-নামে ডাকা শুরু করলো। একদিন এক ছেলেকে ডেকে আমাদের নাম জানিয়ে দিলাম। কিন্তু এরপরেও তারা এমন-ই করতো। সামনাসামনি কথা বলতোনা, কিন্তু পেছন থেকে আজগুবি আচরণ করতো। একসময় মনে হলো এটাই বুঝি কলেজের কালচার।

সেই কালচারে গা-ভাসাতে গিয়ে মাঝে মাঝে আমিও হাঁকডাক করেছি। কিন্তু কেন যেন ব্যাপারটা বেশি ইন্টারেস্টিং মনে হয়নি আমার কাছে। মনে হত সময়ের অপচয়। নিজের মত থাকতাম। ক্লাস করতে ভাল্লাগতোনা।

কারণ এত ভাল কলেজের এত ভাল টিচাররা এমনভাবে পড়াতেন যে আমার ঘুম আসতো। স্কুল মিস্ করতাম খুব। কারণ আমাদের স্কুলের টিচারগুলো খুব ইন্টারেস্টিং ভাবে পড়াতেন। একদিন শুনলাম, বিএন্সিসি করলে ২৫% ক্লাসের এটেন্ডেন্স পাওয়া যায় মুফতে। বিনিময়ে আমাকে ওদের ড্রিল, ক্যাম্পিং, ইত্যাদি কর্মশালায় যোগ দিতে হবে।

সাথে সাথে নাম দিলাম। খুব ভালো লাগতো। আমার কলেজ লাইফে এই একটা জিনিস আমি সত্যি-ই উপভোগ করেছি। শারিরিক ব্যায়াম বা খেলাধুলা আমার বরাবরই ভালো লাগতো। যখন বিএন-সিসি র ইউনিফর্ম পরে প্যারেড করতাম, যথারিতি ছেলেপেলে পেছন থেকে আমাদের ঠোলা বলে হাঁক মারতো।

অবাক লাগতো এই ভেবে, এই বয়সে ওদেরও তো উচিত আমাদের এইসব উদ্যোগে যোগ দেওয়া। বিএন-সিসি র ক্যাম্পিং ছিল আমার কলেজ জীবনের সেরা সময়। সেই ক্যাম্পিং এর সূত্র ধরে তিনটা প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বাংলাদেশের আটজন ছেলেমেয়ের একটা দল গিয়েছিল ভারতের ন্যাশনাল ডে প্যারেডে যোগ দিতে। আমিও ছিলাম তাদের মধ্যে একজন। আমার বয়সী, আমার চেয়ে ছোট-বড় আরও অনেক দেশের অনেক ছেলেমেয়ের সাথে ক্যাম্পিং করলাম ১৮ দিন।

প্যারেড, শুটিং, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে খুব ভাল একটা সময় পার করেছিলাম। আমি যখনই শুনি কাউকে বিএন-সিসি করতে, তাকে অন্য নজরে দেখি। ঐ বয়সে, ছাত্রজীবনে পড়াশুনার বাইরে খেলাধুলার সুযোগ যদি নাও থাকে, এমন একটা কর্মকান্ডের মাধ্যমে যদি ফিটনেস ধরে রাখা বা সামাজিক সেবার সুযোগ পাওয়া যায় তবে সেটা না-নেওয়াটা বোকামি। আমি কলেজ-জীবনে সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় নাম দিয়েছি, পুরস্কার পেয়েছি ঠিকই। এইচ-এস-সি তে টেনেটুনে একটা ফার্স্ট ডিভিশনও পেয়েছি।

তবু আমার এই বিএন-সিসির অভিজ্ঞতা আমার কাছে একটা জানালার মত কাজ করেছে। টিপিক্যাল বাউন্ডারির বাইরে গিয়ে কিছু করা, এবং দেখে আসার একটা সুযোগ ছিল যেন।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.