কুল বাংলাদেশে চাষযোগ্য একটি দীর্ঘমেয়াদি ফল। বর্তমানে বিভিন্ন ফল বাগানে মিশ্র বাগান করতে কুলের জুড়ি নেই। নতুন আম বাগান, লিচু বাগান, পেঁপে বাগানে ব্যাপকভাবে কুলের চাষ হচ্ছে। আবার কিছু কিছু জায়গায় কুল বাগানের মধ্যে অনায়াসে বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি চাষ করা সম্ভব। কুল যেখানেই চাষ করা হোক না কেন এর ভাল ফলন পেতে হলে সঠিক বাগান ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত জরুরি।
অঙ্গ ছাঁটাই কুলের ফলনকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। প্রতি বছর কুল সংগ্রহ করার পর অঙ্গ ছাঁটাই করতে হয়। ছাঁটায়ের সময় শক্ত শাখাগুলো গোড়া থেকে না কেটে একহাত পরিমাণ রেখে সামনের ভাগ ছাঁটাই করতে হবে। অঙ্গ ছাঁটায়ের উপযুক্ত সময় হল মার্চ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত। অঙ্গ ছাঁটায়ের পর নতুন শাখা বের হলে সুস্থ সবল ও আলো বাতাস পায় এমন ৩/৪ টি প্রাথমিক শাখা রেখে বাকিগুলো ভেঙে ফেলতে হবে।
সুষম সার ব্যবস্থাপনা ছাড়া আশানুরূপ ফলন আশা করা যায় না। তাই গাছের বৃদ্ধির সাথে সাথে সারের পরিমাণ বাড়াতে হবে। সমস্ত সার দু’কিস্তিতে প্রয়োগ করতে হবে। প্রথমবার অঙ্গ ছাঁটায়ের পর এবং দ্বিতীয়বার জুন-জুলাই মাসে। নিম্নে সারের নাম ও পরিমাণ এবং গাছের বয়স উল্লেখ করা হল- গোবর সার প্রথম বছর ১০ কেজি, ২য় বছর ২০ কেজি, ৩য় বছর ২৫ কেজি, ৪র্থ বছর ৪০ কেজি, ৫ম বছর ৫০ কেজি, ৬ষ্ঠ বছর বা তদুর্ধ ৬০ কেজি।
ইউরিয়া প্রথম বছর ২০০ গ্রাম, ২য় বছর ৪০০ গ্রাম, ৩য় বছর ৫০০ গ্রাম, ৪র্থ বছর ৬০০ গ্রাম, ৫ম বছর ৭০০ গ্রাম, ৬ষ্ঠ বছর বা তদুর্ধ ৮০০ গ্রাম। টিএসপি প্রথম বছর ২৫০ গ্রাম, ২য় বছর ৪৫০ গ্রাম, ৩য় বছর ৫৫০ গ্রাম, ৪র্থ বছর ৬৫০ গ্রাম, ৫ম বছর ৭৫০ গ্রাম, ৬ষ্ঠ বছর বা তদুর্ধ ৮৫০ গ্রাম। এমপি প্রথম বছর ১৫০ গ্রাম, ২য় বছর ২৫০ গ্রাম, ৩য় বছর ৩৫০ গ্রাম, ৪র্থ বছর ৪৫০ গ্রাম, ৫ম বছর ৫৫০ গ্রাম, ৬ষ্ঠ বছর বা তদুর্ধ ৬৫০ গ্রাম। জিপসাম প্রথম বছর ৫০ গ্রাম, ২য় বছর ১০০ গ্রাম, ৩য় বছর ১৫০ গ্রাম, ৪র্থ বছর ২০০ গ্রাম, ৫ম বছর ২৫০ গ্রাম, ৬ষ্ঠ বছর বা তদুর্ধ ৩০০ গ্রাম। জিংক সালফেট প্রথম বছর ৫০ গ্রাম, ২য় বছর ৫০ গ্রাম, ৩য় বছর ৫০ গ্রাম, ৪র্থ বছর ৬০ গ্রাম, ৫ম বছর ১০০ গ্রাম, ৬ষ্ঠ বছর বা তদুর্ধ ১০০ গ্রাম।
বোরিক এসিড প্রথম বছর ৫০ গ্রাম, ২য় বছর ৫০ গ্রাম, ৩য় বছর ১০০ গ্রাম, ৪র্থ বছর ১০০ গ্রাম, ৫ম বছর ১০০ গ্রাম, ৬ষ্ঠ বছর বা তদুর্ধ ১০০ গ্রাম।
সেচ প্রয়োগ:গুণগত মানসম্পন্ন কুল উত্পাদনের জন্য সেচের প্রয়োজন। সমগ্র উত্পাদনকালীন সময়ে ৩/৪ বার সেচ দেওয়া উত্তম। প্রথমবার অঙ্গ ছাঁটাই করে সার প্রয়োগের পর, দ্বিতীয় বার মে মাসে ও ৩য় বার গুটি বাধার পর এবং শেষ বার কুল যখন মার্বেল আকারের হয়। তবে মাটিতে পর্যাপ্ত রস থাকলে সেচের পানি কম লাগবে।
আগাছা দমন:কুল বাগান পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। এপ্রিল/মে মাসে কুল বাগানের সমস্ত আগাছা চাষ দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে। কারণ তানাহলে বর্ষাকালে বাগান আগাছায় ভরে যাবে এবং পরবর্তীতে আগাছা দমন কষ্টসাধ্য ও ব্যয়বহুল হবে ফলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ফলন বিপর্যয় হতে পারে।
রোগবালাই ও পোকামাকড় দমন ব্যবস্থাপনা:পাউডারি মিলডিউ রোগ:কুলের পাউডারি মিলডিউ একটি মারাত্মক রোগ। গাছের পাতা, ফুল ও কচি ফল পাউডারি মিলডিউ রোগে আক্রান্ত হয়।
আক্রান্ত ফুল ও ফল গাছ হতে ঝরে পড়ে। গাছের পরিত্যক্ত অংশ এবং অনান্য পোষক উদ্ভিদে এই রোগের জীবাণু বেঁচে থাকে এবং বাতাসের মাধ্যমে বিস্তারলাভ করে। কুলগাছে ফুল আসা শুরু হলে সালফার জাতীয় ছত্রাকনাশক প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে ৭/১০ দিন পর পর দু’বার সেপ্র করতে হবে।
মিলিবাগ/ছাতরা পোকা:এই পোকার আক্রমণ কুলের কচি পাতায় ও কচি ডগায় দেখা করা যায়। এরা দলবদ্ধভাবে আক্রমণ করে কচি পাতা ও কচি ডগার রস শোষণ করে নেয় ফলে গাছের বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যায়।
এই পোকা দমনের জন্য যেকোনো স্পর্শক কীটনাশক নির্দেশিত মাত্রায় সেপ্র করতে হবে।
কুলের মাকড়:কচি পাতায় এর আক্রমণ দেখা যায়। মাকড় দ্বারা আক্রান্ত হলে পাতা কোকড়ানো আকার ধারণ করে এবং শুকিয়ে যায়। এই মাকড় দমনের জন্য যেকোনো সালফার জাতীয় ছত্রাকনাশক প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে ৭/১০ দিন পর পর দু’বার সেপ্র করতে হবে।
সেমিলুপার:ফুল ফোটা শুরু হলেই এই পোকার উপস্থিতি দেখা যায়।
প্রথমে কচি পাতা ও পরবর্তীতে কচি কুলের অংশবিশেষ খেয়ে ক্ষতি করে। এই পোকা দমনের জন্য যেকোনো স্পর্শক কীটনাশক নির্দেশিত মাত্রায় সেপ্র করতে হবে।
স্টোন উইভিল:কুল মটরদানা থেকে শুরু করে পরিপক্ব হওয়া পর্যন্ত এই পোকা দ্বারা আক্রান্ত হয়। পুর্ণাঙ্গ পোকা কচি কুলের ভেতরের পৃষ্ঠে ডিম পাড়ে। এরপর কুলের আটিতে আক্রমণ করে ফলে কুল বিকৃতি আকার ধারণ করে।
কুল মটরদানার মত হলেই যেকোনো কীটনাশক নির্দেশিত মাত্রায় ৭ দিন পর পর সেপ্র করতে হবে।
পরিশেষে বলা যায়, কুল বাগান হতে ভাল ফলন পাওয়ার জন্য সঠিক সময়ে ডাল ছাঁটাইকরণ, সার প্রয়োগ, সেচ প্রয়োগ, রোগবালাই ও পোকামাকড় দমন এবং ফুল ফুটন্ত অবস্থায় যেকোনো কীটনাশকের ব্যবহার থেকে বিরত থাকলে আশানুরূপ ফলন পাওয়া সম্ভব।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।