আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

চরিত্র-৩



পর্ব ১ও ২ রেণুর একটা বিশেষ গুন ছিল, সব কথা গোছাইয়া বলিতে পারিত এবং যত দুঃখের কথায় হউক না কেন তাহাতে নির্মল হাসির একটা আভা বিরাজ করিত। আমি তাহার সব কথা মনযোগ দিয়া শুনিতাম আর ভাবিতাম ‘ইস আমিও যদি ইহার জীবনের একটা অংশ হইতে পারিতাম !’ আমার নীরব আকুতি যথাস্থানে পৌঁছাইতে বেশিদিন দেরী হইল না,রেণু আমার সহিত দেখা করিতে রাজী হইল। প্রায় অচেনা অজানা এক মেয়ের সহিত দেখা করিতে যাইব,এক বিচিত্র অনুভূতি আমার মনের মধ্যে ক্রিয়া করিতে লাগিল। কি করিব,কি বলিব তাহা ভাবিয়া স্থীর করিতে পারিলাম না। রিকশা করিয়া রওনা হইয়াছি,গন্তব্যের দুরত্ব কমিবার সাথে সাথে আমার হৃৎস্পন্দন বাড়িতে লাগিল।

কিন্ত মাঝপথে গিয়া জানিতে পারিলাম ব্যাস্ততাহেতু আজ আমাদের সাক্ষাৎ হইবে না। আমার বাড়তি হৃৎস্পন্দন শীঘ্রয় কমিতে লাগিল এবং কমিতে কমিতে একসময় স্বাভাবিকের চেয়েও বেশ খানিকটা কমতি পড়িল। প্রথমেই হোঁচট, আমি কিঞ্চিত মনঃক্ষুণ্ণ হইলাম। নিজের কথার মূল্য দেয় না যাহারা, তাহাদেরকে আমার বড়ই অপছন্দ। অভিযোগ করিবার পূর্বেই রেণু দোষ স্বীকার করিয়া বলিল ,কাল আসেন দেখা হবে।

আমি ফের রাজী হইলাম। কিন্তু কাল আসিতে আসিতেই রাগ করিয়া সিদ্ধান্ত পাল্টাইয়া পূর্বদিনের শোধ লইলাম। আমার এহেন আচরণে রেণুও রাগ করিল; আর কখন যে এই দ্বিপক্ষীয় রাগ-অভিমানের ফাঁক গলাইয়া অনুরাগের বীজ বপিত হইল তাহা ঠিক উপস্থাপন করিতে পারিব না। এই বীজ অঙ্কুরীত হইয়া তৃতীয় পল্লব বাহির হইলে আমরা তৃতীয়বারের মত আবার দেখা করিতে স্থির করিলাম। প্রথম দুইদিন দেখা হয় নাই, আজও যে অনুরূপ ঘটিবেনা তাহার নিশ্চয়তা নাই, সুতরাং আমি আগ বাড়াইয়া যাইতে বিশেষ উদযোগী হইলাম না এবং আমাদের ক্যাম্পাসে আসিতে রেণুকে পীড়াপীড়ি করিতে লাগিলাম।

ওয়াদাভঙ্গের প্রায়েশ্চিত্য করিতে রেণু আমাদের ক্যম্পাসের মূল ফটকের সামনে দাঁড়াইয়া থাকিল। আমি ইচ্ছা করিয়াই দশ মিনিট পরে উপস্থিত হইলাম। কিন্তু রেণুকে ঠিক রেণুর মত লাগিল না। প্রথমবার ট্রেনে আসিবার সময় যেমন দেখিয়াছিলাম ঠিক তাহার বিপরীত, কালো বোরখা আর স্কার্ফের মধ্যে ছোট্ট একটা মুখাবয়ব প্রথমে চিনিতেই পারিলাম না। কিন্তু আমাকে চিনিতে রেণুর দেরি হইল না, হাত নাড়িয়া ইশারায় আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করিল।

আমি রিকশা হইতে নামিয়া হন্তদন্ত হইয়া তাহার নিকটবর্তী হইলাম কিন্তু এমন ভাব দেখাইলাম যে, নিত্যান্তই দায়ে পড়িয়া আসিয়াছি, দায় সারা হইলেই চলিয়া যাইব। আমাকে দেখিয়া রেণু ঈষৎ হাস্য করিল, কিছু অভিমান আর কিছু অপেক্ষা ভঙ্গের প্রশান্তিমাখা হাসিটুকু আমি আজও ভুলিতে পারি নাই। আমিও একটুও হাসিয়া বলিলাম, চলুন আমাদের ক্যাম্পাস ঘুরিয়া দেখবেন। মাথা দোলাইয়া সন্মত হইয়া রেণু আমার সঙ্গে সঙ্গে চলিল। অপরিচিতার সহিত দেখা করতে আসিবার প্রাক্কালে যে বিচিত্র অনুভুতি আর শংকা মনের মধ্যে কাজ করিতেছিল তাহা এইবার একমুখি হইল এবং নিজেদের গৌরব বাড়াইবার কাজে ব্যবহৃত হইতে লাগিল।

ভিতরে ঢুকিয়া আমি আমদের বিভিন্ন ভবনসমূহ এবং আগাছাতুল্য ফুলগাছগুলির সৌন্দর্য বর্ণনা করতে লাগিলাম। আগন্তুককে বিশেষ একটা আগ্রহী মনে হইল না। সে বারবার একই কথা বলিতে লাগিল যে, তাহাদের ভবনগুলির চেয়ে আমাদেররগুলি পুরাতন এবং কম সুন্দর। আমি বিব্রত হইয়া বলিলাম মুচির জুতা সবসময়ই ছেঁড়া থাকে এবং দর্জীর পরিধেয় জীর্ণই হয়; আমরা গড়ি বিধায় স্থাপনা এরূপ হওয়াটাই সঙ্গত। যথার্থ উত্তরেও শ্রোতাকে মুগ্ধ মনে হইল না এবং পুরা বিষয়টাই বাদ পড়িল।

আমাদের ক্যাম্পাস দেখা হইলে ক্ষাণিকবাদে গোধূলীলগ্নে রেণূদের ক্যাম্পাসে গিয়া আমরা বসিলাম। এতদিন আমাদের মধ্যে যে সমস্ত কথা কিংবা বার্তা আদান-প্রদান হইয়াছে আজ তাহার একটা সুরাহা হওয়া দরকার। আমি হঠাৎ করিয়া একসময় রেণুকে বলিয়াই বসিলাম, এতদিন যা কিছু বলেছ কিংবা লিখেছ তা কি বুঝেশুনে করেছ? কিছুক্ষন চুপচাপ থাকিয়া রেণু জবাব দিল জানিনা। না জানিবার কারণ জানিতে আমার প্রবৃত্তি হইল না। এই জানিনার উত্তর সেদিন না পাইলেও একদিন ঠিকই পাইয়াছিলাম।

আগুনে দগ্ধ হইতে আগ্রহী যে পতঙ্গ তাহাকে রোধিবার কেহ নাই, প্রেমের জলে ডুবিতে যে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, জলাধারে সে আপনিই পৌঁছিয়া যায়। সুতরাং আমাদের আর যথাস্থানে স্থীর থাকা সম্ভব হইল না। একদিন হইল কি, রেণুর সহিত কথা বলিবার সময় অজানা এক নাম্বার হইতে আমার ফোনে বার্তা আসিল, ‘ভালবাসি তোমাকে’। আমি শিহরিত হইয়া উঠিলাম। বন্ধুদের নিকট বহুবার আক্ষেপ করিয়া বলিয়াছি যে, জীবনে তেইশ বসন্ত পার হয়ে গেল, মহব্বতের কথা কাউকে শোনাইতে পারিলাম না, কেউ শুনাইলও না।

ইহাতে কেবল শ্রোতাদের দন্তবিকশিত হাসিটুকুই হজম করিতে হইয়াছে; আজ তাহার মেয়াদোত্তীর্ণ হইল। ভালবাসি কথাটা প্রথম শুনাইল যে তাহাকে চিনিতে বাঁকি থাকিল না আর আমি যে চিনিতে পারিয়াছি সেটা তাহাকে বুঝিতে দিলাম না। এই বুঝিতে না দেয়াটাই সকল বুঝিবার সাক্ষ্য বহন করিয়া আমাকে ও রেণুকে আচ্ছন্ন করিয়াছে আবার মোহ ভঙ্গ করিয়া আমদিগকে পূর্বের যথাস্থানে স্থাপন করিয়াছে যাহার প্রভাবে আমার অনুভূতির দুয়ার খুলিয়াছে পূর্ণবেগে। দিন পার হইতে হইতে একদিন রেণুর সহিত আমার সম্পর্কটা আর আগের মত থাকিল না। খাওয়া দাওয়া হইতে ঘুমানো পর্যন্ত অনেরবার তাহার সহিত আমার কথা হইত এবং এই সময়ের মধ্যে যাহাকিছু ঘটিত তাহার প্রায় সবকিছুই ভাগাভাগি করিতাম।

যে দুর্বিপাকে পড়িয়া দুটি মানুষ এক গেরোয় বাঁধা পড়ে আমরাও সেইখানে উপনীত হইলাম এবং সমস্ত ভনিতার অবসান ঠিক এক মাসের মাথায় রেণু তাহার ভালবাসার কথা আমাকে সরাসরি জানাইল। আমি তো এতটাকাল ইহার অপেক্ষাতেই ছিলাম, কোন মধ্যম সরলা সুন্দরীর সহিত হঠাৎ করিয়া পরিচয় ঘটিবে, অতঃপর জানাশোনা ঘটিয়া তাহারপর পক্ষ হইতে প্রস্তাব আসিবে আর আমি আমার সমস্ত প্রেম দিয়া তাহাকে বুকে আঁকড়াইয়া ধরিব। আজ তাহাই ঘটিল, মনের মধ্যে প্রেমের যে গোপন সুড়ঙ্গ তৈয়ার করিয়া রাখিয়াছিলাম, সে পথ ধরিয়া একেবারে মনের গহিনা আসিয়া রেণু আমার প্রেম মন্দিরে উলুধ্বনি করিয়া উঠিল, আর অমনি মন্দিরের ঘুমন্ত প্রেমদেবতা জাগিয়া উঠিয়া বলিল, ভেনাস ! এসো, মোর পাশে অধিষ্ঠিতা হও। ভেনাস অগ্রসর হইল। কিন্তু দ্বাররক্ষীরা তাহাকে থামাইয়া দিয়া বলিল, তিনখানা ধাপ অতক্রম না করা পর্যন্ত তুমি তোমার কাঙ্খিত স্থানে স্থীর হইতে পারিবে না।

ভেনাসরূপী রেণু অস্ফুট স্বরে বলিল, কি সেই ধাপ? আমি তখন বলিলাম, সামনা সামনি বলি? রেণু রাজী হইল এবং সাক্ষাতের দিন ধার্য হইল। যে কামিণীর টানে যুগে যুগে বহু মহাযোগীর ধ্যান ভঙ্গ হইয়াছে, বিস্তর যুদ্ধ হাঙ্গামার সূচনা হইয়াছে, আজ তাহার ডাকে আমার ভেতরেও এক ভয়ানক অস্থিরতার সূচনা হইল। আমি অগ্নিকুন্ডের পাশেই ঘুরিতে লাগিলাম কিন্তু সহসাই তাহাতে ঝাঁপ দিলাম না। কত অব্যাক্ত কথা তাহার চোখেমুখে ভাসিত। আমি কতক অনুমান করিতে পারিতাম আবার কতক বুঝিয়াও বুঝিতে পারিতাম না।

তবে আমি ইহা স্পষ্ট বুঝিতে পারিতাম যে, বহু অভিজ্ঞতামন্ডিত এই রমনী এখনও ইহার স্বপ্নপুরুষকে খুঁজিয়া পায় নাই; যাহাদিগকে মনের সিংহাসনে বসাইবার জন্য মনে মনে কল্পনা করিয়াছে তাহাদের মধ্যে আমার স্থানই সর্বাগ্রে। কিন্তু ছলনাময়ী হঠাৎ বলিল, আজকেই শেষ, আর আপনার আমার দেখা হবে না। আমি আকাশ হইতে পড়িলাম। কি বলার কথা ছিল আর কি শুনিতেছি। আমি খানিকটা অবাক হইয়া বলিলাম, কেন ? রেণু বলিল, এভাবে চলতে থাকলে আমি যে আপনার প্রতি দূর্বল হয়ে পড়ব, আমি তা চাই না; আর এতদিন যা কিছু বলেছি,লিখেছি তা একটাও মনের কথা নয়, সবই মজা করেছি।

আমার এতদিনের আশা, কল্পনা সবকিছু একটা দীর্ঘশ্বাস হইয়া বাহির হইয়া গেল আর সেইক্ষনে মনে হইল ইহাকে জোরে একখানা চপেটাঘাত করি। এতখানি অসন্তোষের মাঝেও আমি শান্ত সুরে রেণুকে বলিলাম, যে মজা অন্যের অনিষ্ট করে,মন ভাঙ্গে তা অপরাধের সামিল; মজা করিয়া অন্যকে ল্যাং মারিয়া ফেলিবার মধ্যে অনেক আনন্দ আছে বটে, কিন্তু যেদিন তুমি একই ক্রীড়ার সামগ্রী হয়ে ভূমিস্যাৎ হবে সেদিন বুঝবে মন ভাঙ্গার বেদনা। গৃহে ফিরিয়া প্রতিজ্ঞা করিলাম মরিচীকার পেছনে আর ছুটব না এবং একসময় রাগের চোটে রেণুর ফোন নম্বর মুছিয়া ফেলিলাম। আমি আর যোগাযোগ করিলাম না বটে কিন্তু রেণু একদিনই পার হইতে দিলনা; পরের দিন ফোন করিয়া বলিল, ফুলতলা এসো, কথা আছে। আমার মন আর ঠিক থাকিল না, অভিমান ভুলিতেও সময় লাগিল না।

পদ্মাতীরের এই ফুলতলার কথা কোনদিনও শুনিনাই। কিন্তু কি এক দুর্নিবার আকর্ষণে ইহার প্রতি নিজের প্রেমিক সত্বাকে ধাবিত হইতে দেখিলাম। এতকাল বিভিন্ন জায়গায় অনেক যুগলকে দেখিয়া কখনো কখনো বা মনে মনে ঈর্ষান্বিত হইয়াছি, নানা আপ্তবাক্য মনে মনে আওড়াইয়াছি ; আজ তাহার অবসান হইবে, আমি নূতন রাজ্যে প্রবেশ করিব, আমার ভেতরে শিহরণ না বহিয়া গিয়া পারিল না। আমি অনেক্ষণ ধরিয়া একটি গাছের তলায় বসিয়া অপেক্ষা করিতেছি আর সূর্যের আলোয় চিকচিক করা ঊর্মি আর নদীতে নৌকার চলাচল দেখিয়া সময় পার করিতেছি। সে যখন আসিল তখন বেলা পড়িয়া আসিয়াছে, রিকশা হইতে নামিয়া রেণু সোজা আমার পাশে বসিয়া বলিল, কি ভাবছেন ? আমি নদীর স্রোতের দিকে ইশারা করিলাম।

রেণু ঝুঁকিয়া আমার কাছাকাছি হইয়া ইশারার মানে বুঝিবার চেষ্টা করিতে লাগিল কিন্তু ঠিক বুঝিয়া উঠিতে পারিল না। আমি তাহার মুখের দিকে তাকাইলাম, অস্তগামী সূর্যের আভায় সে মুখচ্ছবির পূর্ণ বর্ণনা করিবার যোগ্যতা আমার নাই, কাঁধের একপাশ দিয়া সদ্য শ্যাম্পু করা লম্বা কালো চুল ছড়িয়া আছে আর রেণু আমার দিকে তাহার ডাগর চোখে তাকাইয়া আছে, আমি বেশিক্ষণ সে নেত্রযুগলে তাকাইয়া থাকিতে পারিলাম না। এমন মনোহর মুখায়ব আর সুন্দর চুলের কাছাকাছি এর আগে আমি কখনও আসি নাই। কথা ছিল ফুলতলাতে অনেক কথা হইবে,কিন্ত তাহা হইল না। যেটুকু কথা হইল তাহা অত্যন্ত নগন্য এবং সময় যে কখন হঠাৎ ফুরাইয়া গেল তাহা টেরই পাইলাম না।

শেষে মনের কথা মনে রাখিয়াই উঠিতে হইল। আমি পায়ে হেঁটে রেণুকে তাহার মেসে পৌঁছাইয়া দিলাম। পথিমধ্যে একবার তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “যে সিদ্ধান্ত নিয়েছ তা কি আবেগের ফল, নাকি সত্যি ?” রেণু বলিল, ‘আপনাকে আমার ভাল লেগেছে, যাচাই বাছাইয়ের পর যদি আপনি যদি আমাকে পছন্দ করেন তবে আমরা একটি ভাল সিদ্ধান্তের দিকে যেতে পারি” আমি বলিলাম তা বটে, কিন্তু আমার কিছু কথা আছে। রেণু বলিল, “ কাল শহীদ মিনারে আসুন আমি শুনব। ” চলবে...............


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।