যাত্রা হল শুরু : বিমান বন্দরে চিরন্তন বাঙালীয় প্যাচাল....
পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর বাড়ি ঘুরে আসার পর রমযান শুরু হয়ে গেল। দেখতে দেখতে যাওয়ার দিন চলে আসল। রাত দশটায় শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গালফ এয়ার লাইন্সে বাহরাইন হয়ে ফ্রাঙ্কফুর্ট সেখান থেকে ট্রেনে করে এরফুর্ট। জ্যামের কথা মাথায় করে সন্ধ্যা ছয়টার দিকেই রওয়ানা দিলাম। ইফতারির সময় হওয়ায় রাস্তা-ঘাট মুটামুটি ফাঁকাই ছিল তাই সময় মত পৌছাতে কোন সমস্যা হয়নি।
ইফতারি রাস্তায়ই সারা হল দুধ আর কলা দিয়ে। রাস্তার জ্যামের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া গেলেও আসল বিপদ অপেক্ষা করছিল সামনে। বিমানবন্দরে ঢুকার সাথে সাথেই চেক ইন শুরু হল। পাঁচ সাত মিনিট লাইনে দাড়ানোর পর পাসপোর্ট হাতে নিয়ে গালফ এয়ারের কর্মকর্তা বললেন আপনাদের পাসপোর্ট চেক করাননি কেন, চেক করিয়ে নিয়ে আসেন। কোনার কাউন্টারে আরেকজন কর্মকর্তা দেখলাম সবার পাসপোর্ট চেক করেছেন।
আগে এই নিয়ম ছিলনা এখন আবার কবে থেকে পাসপোর্ট চেক করার নিয়ম করা হল জিজ্ঞেস করলেও উনার কাছ থেকে কোন উত্তর পাওয়া না। মনে মনে ভাবলাম হয়তো কয়েকদিন আগে বিশাল সংখ্যক পাসপোর্ট বাতিল করার কারনে হয়ত এই বাড়তি চেকের ব্যবস্থা। কিন্তু কাউন্টারে গিয়ে চক্ষু চড়কগাছ। লাইনে অনেক লোক, সবার হাতে পাসপোর্ট আর পাঁচশত টাকা। দু-একজনকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম সরকার নতুন নিয়ম করেছে, পদ্মা সেতুর জন্য বিদেশগামী সকল যাত্রীকে পাঁচশত টাকা করে সারচার্জ দিতে হবে।
কবে থেকে এই নিয়ম কর্তব্যরত কর্মকতাকে জিজ্ঞেস করলেও তাঁর মুখ দেখে বুঝতে পারলাম উনাকে জিজ্ঞেস করেই মহাপাপ করে ফেলেছি। পকেটে যত টাকা ছিল তা ইউরো করে ফেলায় পাঁচশত টাকা আছে কিনা তাই নিয়ে শঙ্কিত ছিলাম, ভাগ্যিস ফিরে আসার সময় কাজে লাগবে বলে কিছু টাকা মানিব্যাগে রেখেছিলাম তাই গুনে দেখি কোনমতে এ যাত্রা পার পাওয়ার মত টাকা পকেটে আছে। রোকন ভাইযের ও একই অবস্থা। কিন্তু বিপদ দেখলাম অন্যদের, অনেক যাত্রী যারা দীর্ঘ দিনের জন্য বাইরে যাচ্ছে তাদের কাছে কোন টাকা নেই, কাজে লাগবেনা বলে হয়ত সব টাকাই বাড়িতে দিয়ে এসেছে, তারা পড়ল মহা ফ্যাসাদে, অনেকে ফোন করে বাইরে দাড়ানো আত্নীয়-স্বজনের কাছথেকে টাকা নিয়ে এসে দিয়ে মুক্তি পাচ্ছিল। দশমিনিট লাইনে দাড়িয়ে অপেক্ষা করার পর আমাদের পাসপোর্ট/টিকেট চেক করে বললেন আমাদের টাকা টিকেটের সাথে নেয়া হয়েগেছে।
যাই হোক অনেক ঝামেলার পর চেক ইন শেষ হওয়ার পর ভাবলাম যাক এবার মনে হয় মুক্তি পাওয়া যাবে। কিন্তু হায়! আরও বড় বিপদ অপেক্ষা করছিল সামনে। বাংলাদেশের ইমিগ্রেশন পুলিশের সুখ্যাতির!! কথা সবারই জানা থাকার কথা। একসাথে বেশ কয়েকটি ফ্লাইট থাকার কারনে ইমিগ্রেশনের সামনে দীর্ঘ লাইন,এমিরেটসের দুবাইগামী ফ্লাইট ছাড়ার সময় চলে আসছিল বলে অফিসার গোছের একজন পুলিশ কর্মকর্তা এসে এমিরেটসের যাত্রীদের এগিয়ে দিচ্ছিলেন। আমরা তখন একঘন্টা ধরে লাইনে দাড়িয়ে আছি।
অবস্থা তখন খারাপ শুধুমাত্র এক প্যাকট দুধ আর একপিস রুটি দিয়ে ইফতার করার পর ঠিকমত পানিও খেতে পরিনি। তেষ্টায় প্রাণ ওষ্ঠাগত্। আমার চেয়ে বাহরাইনগামী আরেকজনের অবস্থা আরও খারাপ, অনেক্ষন ধরে প্রসাব চাপিয়ে রাখলেও আর সম্ভব হচ্ছিল না। তার অবস্থা বলে একজন অফিসারের দৃষ্টিআকর্ষণ করলে উনি বললেন কোন উপায় নাই, ইমিগ্রেশন নামের পুলসিরাত পার না হয়ে কিছুই করার নাই। আমি তাকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করলাম ভাই পুলসিরাত পার হওয়ার আগে বেহেশতে প্রবেশ করার সুযোগ নাই্, সুতরাং অপেক্ষাই করেন আর দোয়াকালাম যা মনে আছে পড়তে থাকেন।
একজন যাত্রীর চেক ইনে কমেপক্ষে দশ মিনিটের বেশী সময় যাচ্ছিল্। বাংলাদেশ ইমিগ্রেশন পুলিশের কম্পিউটার অপারেটিং দক্ষতা দেখার মত। একেকজন পাসপোর্ট দেখছিলেন আর হাজারো অকাজের প্রশ্ন করছিলেন। আপনার নাম কি? বাড়ি কোথায়? বাপের নাম কি? গ্রামের নাম কি? যত সব উদ্ভট প্রশ্ন। দুনিয়ার আর কোথাও ইমিগ্রেশনে এমন অদ্ভুতূড়ে প্রশ্ন করা হয় বলে আমার জানা নাই।
ওহ! কম্পিউটার দক্ষতার কথা বলছিলাম, একেক জন পশ্ন করছিলেন আর কিবোর্ডর দিকে চার চক্ষু দিয়ে দেখে দেখে টাইপ করছিলেন। তাদের এ অবস্থা দেখে শত দুঃখের মাঝেও হাসি পাচ্ছিল। রোকন ভাইকে বললাম ভাই চলেন এয়ারপোর্ট পুলিশের পরিচালকের কাছে এদের টাইপিং দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য একটা প্রস্তাব দেই, এখানে পোস্টিং দেয়ার আগে সবাইকে নীলক্ষেতের কম্পিউটার দোকানগুলোতে একমাসের একটা ইন্টার্নশিপ বাধ্যতামূলক করে দেয়া উচিত। উনি হাসলেও বললেন ভাই খারাপ বলেননি, চলেন কথা বলি। পরে ভাবলাম উনারা যদি আবার মাইন্ড করেন তাইলে আর এ যাত্রা ইউরোপ যাওয়া লাগবে না।
এর ফাঁকে এমিরেটস আর গালফ এয়ারের দু কর্মকর্তার মাঝে একপ্রস্থ ঝগড়াও হয়ে গেছে। কার যাত্রী আগে যাবে এ নিয়ে্। এমিরেটসের কর্মকর্তার গলার শক্তি বেশী হওয়ায় গালফ এয়ারের কর্মকর্তা ঝগড়া শুরু করার আগেই ক্ষ্যান্ত দিলেন। যাক অনেক ঝামেলার পর আমার ডাক আসল। সম্ভবত পাসপোর্টে সিল-সাপ্পরের বহর দেখে কিছু না বলেই শুধু উল্টে-পাল্টে দেখেই ছেড়ে দিলেন।
যাক অনেক ঝামেলা পর মুক্তি পাওয়া গেল!! যেন ঘামদিয়ে জ্বর ছাড়লো। এদিকে প্লেন অলরেডি চল্লিশ মিনিট লেট। দৌড়ে গিয়ে প্লেনে উঠলাম, মনে করছিলাম আমিই শেষ যাত্রী যার জন্য অপেক্ষা করছে। ভিতরে গিয়ে শুনলাম এখনও অনেক যাত্রীর ইমিগ্রেশন শেষ হয়নি, তাই ফ্লাইট ছাড়তে আরও দেরী হবে। রোকন ভাইকে খুঁজলাম আশে-পাশে-আমার পাশের সিটে বসার কথা থাকলেও এখনও এসে পৌছাননি।
ফোন দিলে রিসিভ করছিলেন না তাই ভাবলাম এখনও ইমিগ্রেশন নামের পুলসিরাত পাস হতে পারেননি। আরও দশমিনিট পর সবাই যখন এসে পৌছাল তখন প্লেন টেক অফের প্রস্তুতি নিচ্ছে। পরে শুনলাম জার্মানিতে নাকি অনেক ভূয়া ছাত্র যাচ্ছে তাই ছাত্রদের বেলায় ইমিগ্রেশন অনেক কঠোর!! যদিও বাস্তবে অবস্থা তার ঠিক উল্টো। রোকন ভাই বলল সাত জনের একটা গ্রুপ উচ্চশিক্ষার জন্য জার্মানীতে যাচ্ছে। তাকেও একই গ্রুপের সাথে চেক করছিল।
যদিও সে বার বার বলছিল সে স্টুডেন্ট ভিসায় নয়, সাংস্কৃতিক বিনিময় ভিসায় মাত্র পনের দিনের জন্য একটা শর্ট কোর্সে অংশ নিতে যাচ্ছে। কিন্তু কে শোনে কার কথা!! অবশেষে সিটে বসতেই প্লেন টেক অফের জন্য দৌড় শুরু করে দিল। কিন্তু তখন অলরেডি পঞ্চাশ মিনিট দেরী। আমরা দু’জনই মনে মনে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠছিলাম, বাহরাইন থেকে কানেকটিং ফ্লাইট ধরতে পারব কিনা। সৌভাগ্যক্রমে ফ্লাইট ছাড়ার ঠিক আগমূহুর্তে ফ্লাইট ধরতে পেরেছিলাম।
একঘন্টা ট্রানজিট থাকলেও একমিনিটও পাইনি।
ইয়োরোপের পথে প্রান্তরে-১ ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।