বাঙলা কবিতা
নববসন্তের রূপকথা : এ কি নওজোয়ান গাড়ি রে !
রহমান হেনরী
তিনি যখন জন্ম নেন, তখন বিশ শতকের বার্ষিক গতি অন্তত একুশ বার ঋতুচক্রের বদল ঘটিয়েছে। ১৯২০ এর দশকে, বিশ্ব সাহিত্যেও ঘটেছে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ডি, এইচ, লরেন্সের উইমেন ইন লাভ (১৯২০) এবং লেডি চাটার্লিস লাভ (১৯২৮) ; জেমস জয়েসের ইউলিসিস (১৯২২) ; টি, এস, এলিয়টের ওয়াস্ট ল্যান্ড (১৯২২); হার্মান হেসের সিদ্ধার্থ (১৯২২); কাহলিল জিবরানের দ্য প্রফেট (১৯২৩) ; ই, এম, ফর্স্টারের আ প্যাসেজ টু ইন্ডিয়া (১৯২৪) ; ফ্রাঞ্জ কাফকার দ্য ট্রায়াল (১৯২৫) ; মার্সেল প্রাউস্তের ইন সার্স অব লস্ট টাইম (১৯২৭) ; ভার্জিনিয়া উলফের টু দ্য লাইট হাউস (১৯২৭) ; এরিখ মারিয়া রেমার্কের অল কোয়াইট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট (১৯২৯) ; উইলিয়াম ফকনারের দ্য সাউন্ড এন্ড দ্য ফুরি (১৯২৯) ; আর্নেস্ট হেমিংওয়ের দ্য সান অলসো রাইজেস (১৯২৬) এবং
আ ফেয়ারওয়েল টু আর্মস (১৯২৯) সহ অনেকের অনেক অনেক উল্লেখযোগ্য গ্রন্থাদি প্রকাশিত হয়েছে ১৯২০-১৯২৯ সময়কালের মধ্যে। ইতোমধ্যে, জন্ম নিয়েছেন আমাদের কবি আবুল হোসেন, যিনি, অতঃপর, ১৯৪০ এর দশকে জড়তামুক্ত স্মার্ট কালজ্ঞানসম্পন্ন এক টানটান গদ্যভাষাকে কাব্যিকতায় উত্তীর্ণ করবেন এবং সেই কাব্য-ঋতুর নাম দেবেন -- নববসন্ত। যেন তা নির্ধারিত হয়ে গেছে তার জন্ম-মুহূর্তের বৈশ্বিক সাহিত্যপ্রবাহ দ্বারাই।
কেননা, আমার বিশ্বাস, কবির জন্ম পৃথিবীর সামনে এক গুরূত্বপূর্ণ ঘটনা। বাংলা কবিতার দিকপালগণ-- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জসীমউদিদন, জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু, সুকান্ত ভট্টাচার্য ... বেঁচে আছেন, সক্রিয় ও সচল আছেন তাঁরাও। এমন মাহেন্দ্রক্ষণ, তাঁর, কবি আবুল হোসেনের, শৈশব ও বেড়ে ওঠার দিনগুলো।
বাংলা কবিতায় আধুকিতা বেশ পাকাপোক্তভাবে জেঁকে বসেছে সেই চার দশকেই ; পূর্ব বাংলার সৃজনশীল চিন্তার সামনে তখন দুটি পথ, দুটি হাতছানি, দুইটি দ্বিধা। ১৯৪৭ এর দেশভাগ পূর্ব বাংলার বাঙালিকে আবহমান বাঙালি জাতীয়তাবাদের দিকেও টানছে, টানছে নব্য-পাকিস্তানী জাতীয়তাবাদও।
চল্লিশী কবিতার দুই গুরুত্বপূর্ণ মেধা সৈয়দ আলী আহসান ও ফররুখ আহমদ সেই নব্য-পাকিস্তানী জাতীয়তাবাদের কাণ্ডারী। ওই কাণ্ডারীদ্বয়ের নৌকো এড়িয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদে উদ্দীপ্ত দীপশিখা হাতে যারা এগিয়ে গেছেন, পরবর্তীতে যে চেতনা আমাদের মহান ভাষাযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পূর্ব বাংলার বাঙালিদের হাতে এনে দিয়েছে স্বাধীন সার্বভৌম এক রাষ্ট্র, আহসান হাবীব ও আবুল হোসেন বাংলাদেশের কবিতায় সেই চেতনাবাহী নাবিকদের মধ্যে অগ্রগণ্য।
শুরু থেকেই, ছন্দ ভাঙচুরের খেলা, প্রধানত গদ্য ও বাকছন্দ নিয়ে অত্যন্ত রাজসিক আত্মবিশ্বাসে, কবিতায় উপস্থিত হয়েছেন এই কবি। চার দশকের সাহিত্যে, বিশেষত কবিতায় যতগুলো প্রবণতা লক্ষণীয়, তার মধ্যে কবির সমাজচেতনা ও সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রসঙ্গই প্রধান। আমাদের কবি, অবুল হোসেন, সমাজচেতনায় নিবিষ্ট থেকেও উচ্চকিত করেছেন তার ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্য, নিজস্ব কাব্যস্বর।
কবিতা শরীরের আঁঠালো পিচ্ছিল-ভাবকে বর্জন করে কবিতাকে করতে চেয়েছেন শিঁড়দাঁড়াময় দৃঢ়, ঝকঝকে আধুনিক, কবিতার ভাষাকে জনভাষার আত্মীয়। বলাই বাহুল্য, প্রথম কাব্য নব বসন্ত থেকেই তার এই মনষ্কামনা সফলভাবে পূর্ণ। ছলোছলো ভাবাবেগ তার কবিতায় অনুপস্থিত। বাঙলা কবিতাকে নুয়ে-পড়া আনুনাসিক-কান্নাময় মেয়েলি গীত হয়ে ওঠার থেকে মুক্ত করেছেন তিনি। এই-ই তার আধুনিকতা, স্মার্টনেস ও স্বাতন্ত্র্য, তার কবিতারও।
গদ্যের ভেতরে কাব্য সঞ্চার করার আজীবন কারিগর এই কবি, বিরলপ্রজ, কিন্তু অসফল নন। তাই যখন, বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ কাব্য-অলোচক, প্রথাবিনাশী বহুমাত্রিক লেখক ও কবি, হুমায়ূন আজাদ, তাঁর “শামসুর রাহমান : নিঃসঙ্গ শেরপা” গন্থের ভূমিকায় প্রসঙ্গত বলেছেন, উজ্জ্বলতা নিয়ে চলতে শুরু করে অল্পতেই ফুরিয়ে গেছেন এই কবি ; আমি একমত হতে পারিনি। আবুল হোসেনের কবিতা থেকেই পঙ্ক্তি তুলে এনে, পেন্সিল দিয়ে জবাব লিখে রেখেছি , ব্যক্তিগত সংগ্রহে থাকা আমার কপিটির সংশিষ্ট পাতায় :
দ্যাখো, না-ই দ্যাখো, থাকো চোখ বুঁজে
রেহাই পাবে না কোনো গম্বুজে
আসছে ঢেউ।
(আর কতকাল / দুঃস্বপ্ন থেকে দুঃস্বপ্নে )
বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত “কবিতা” পত্রিকায় দেখি : এ কি নওজোয়ান গাড়ি রে ! দুঃখিত, ভুল লিখলাম। ১৯৪২ সালের সেই পাঠে ছিল ‘ একি উড়ো গাড়ি রে !’ পরবর্তীতে, “বিরস সংলাপ” (১৯৬৯) এর পাঠ : এ কি নওজোয়ান গাড়ি রে ! হ্যাঁ, ‘ডি. এইচ. রেলওয়ে’ কবিতার কথাই মনে এলো।
মানে, দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়ে। তারও আগে, এই কবির কবিতায় উঠে এসেছে ট্রেন :
ধড়মড় করে জেগে ওঠে আলুথালু স্টেশন। আর তখন
প্রথমে আস্তে তারপর ধুপধাপ করে জোরে জোরে
নিঃশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে ভিড় ছাড়িয়ে ঝাঁ ঝাঁ শব্দে গান ধরে শহরতলির ঘরবাড়ি
কাঁপিয়ে সেই কামানের গোলা
ঝলসিযে দিযে যায় মাঠের পর মাঠ, বনের পর বন।
কিংবা,
আফ্রিকার মাঠে তাড়া-খাওযা হাতি হরিণ জেব্রা গণ্ডার হুড়মুড় করে ছোটে
দিকবিদিকে ( কোনো দিকে তাকাবার সময় নেই এক মুহূর্ত ) আসছে ধাওয়া করে
মৃত্যু দ্রুতপায় আসছে সে, তাই বাজছে দ্রিমিদ্রিমি, ছুটছে পৃথিবী, ছুটছে মানুষ
বাসে ট্রামে রেস্তোরাঁয় পার্কে মাঠে, থিয়েটারে
সিনেমার পর্দায়, হুঁশ
নেই আর কারো, ছুটছে অবিরাম ট্রেনের চাকায়,
( ট্রেন / নববসন্ত )
আবুল হোসেনের কবিতা আস্বাদনের আনন্দ অভূতপূর্ব। গত শতাব্দির চারের দশকে আবির্ভূত এই কবির কাব্যভাষা প্রাগ্রসর,আধুনিক, দৃঢ়, তেজি যুবকের টানটান সিনার মত।
কাব্যভাষার এই ঋজুতা ও দ্রাঢ্য একুশ শতকের বাংলা কবিতাতেও প্রায় দু®প্রাপ্য। তাঁর কবিতার উপমা উৎপপ্রেক্ষা ও ধ্রুব-ধ্বনির ব্যঞ্জনা স্নায়ূ-ভেদী। আমাদের চংক্রমিত করে, পাঠে মনোযোগী করে এবং পাঠ শেষে বিস্ময়-স্তম্বিত করে দেয়, বার বার মনে হয় : এ কি নওজোয়ান ‘কবি’ রে !
শনশন এক প্রকাণ্ড জোড়ো চিল
উড়ছে নীলে অকান্ত পাখায় ঘুরে ঘুরে,
সহসা বিদ্যুৎ - শীর্ণা বাঁধাকপি চা ভূটানী তন্বী পাইন মেঘে
বাঁকানো শিং বুনো বাইসন এই ট্রেন
শিলিগুড়ি থেকে উঠছে দার্জিলিং।
( ডি. এইচ. রেলওয়ে / বিরস সংলাপ )
চার দশকের বুদ্ধিদীপ্ত, স্মার্ট, উজ্জ্বল, গতিময় এই কবির কথা যতবার ভাবি, ব্যক্তিগত অনুভবে, মগজের কোষে কোষে গুঞ্জরিত হয় :
যে যার বাজারে গেছে। পাংশু আঁশটে ঘরে বাতি জ্বেলে
বসে আছে যরে মূর্তির মতো একা একজন
নিঃশব্দ বিনিদ্র পাহারায়।
অথবা বুদ্ধের মূর্তি
সে, নির্বাণ প্রার্থনায়, ক্ষুধা-তৃষ্ণাহীন। শব্দ নেই
ঘরময় কালের যাত্রার স্মৃতি গমগম করে।
(সঙ্গ : নিঃসঙ্গতা / দুঃস্বপ্ন থেকে দুঃস্বপ্নে )
কবির এই নিঃসঙ্গতাই কবিকে আরও খাঁটি করে তোলে, আবার যন্ত্রণাও দেয়। এমন সাহসী যে তার কাব্যভঙ্গি, এমন দৃঢ় যে তার মনোবল, সে কি কেবলই ব্যক্তিগত চরিত্রবল ! নাকি তাঁর পয়মন্ত কবিতাগুলোই তাকে সঙ্গ দেয়, ভরসা দেয়, সাহসী করে তোলে ! আমি এই কবির সম্পর্কে শেষোক্ত
মন্তব্যই প্রণিধানযোগ্য মানি। তিনিই আমাদের ভূ-খণ্ডে জীবিত বর্ষীয়ান এক কবি; দীর্ঘায়ূ কামনা করি তাঁর।
তাঁর এবং তাঁর কবিতার তারুণ্য দেখে,
বলি : এ কি নওজোয়ান ‘কবি’ রে !
কবিকে নমস্কার ।
______
জুনান নাশিত সম্পাদিত গ্রন্থ :
" আবুল হোসেন : কবির পোর্ট্রেট"
প্রকাশ # অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১১
দাম : ৫৫০ টাকা
প্রকাশক : মিজান পাবলিশার্স
(পৃ. ২৪০-২৪২ দ্রষ্টব্য)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।