আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পণ্যকরণে নারী, সরলীকরণ থেকে বিশ্বায়ন

সমাজ পচনস্তরের বিপ্রতীপ মেরুর এই বাসিন্দার পেট চলে শব্দ শ্রমিকের কাজ করে একটু পেছন থেকে শুরু করা যাক। যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টা সিটির হোটেলগুলোতে কর্তৃপক্ষ ভ্রমণকারীদের আরও অধিক সময় ধরে রাখার উপায় হিসেবে ১৯২১ সালে মেয়েদের সুইমিংস্যুটনির্ভর একটি প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। এটিই সুন্দরী প্রতিযোগিতার উৎস। মূলত এরপর থেকেই নারীর সৌন্দর্য ও শরীরনির্ভর প্রতিযোগিতার প্রসার ঘটে। হতে থাকে স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে নানারকম আয়োজন।

কালক্রমে এর আন্তর্জাতিক রূপ দাড়ায় বিশ্বসুন্দরী প্রতিযোগিতা। মিস ওয়ার্ল্ড ১৯৫১ সালে, মিস ইউনিভার্স ১৯৫২ সালে মিস ইন্টারন্যাশনাল ১৯৬০ সালে। এসব আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার জন্য জাতীয় পর্যায়ে নানারকম আয়োজন চলতে থাকে। এক্ষেত্রে জৌলুস আর রূপ খোলতাইয়ের আকর্ষণ হিসেবে বিশ্ব দরবারে জনপ্রিয় দেশ ভারতে শুরু হয় ফেমিনা মিস ইন্ডিয়া, সানন্দা তিলোত্তমা প্রতিযোগিতা। বাংলাদেশে যেমনটা রয়েছে লাক্স-চ্যানেল-আই সুপারস্টার, প্যান্টিন ইউ গট দ্য লুক বা রূপসী তোমার গুনের খোঁজে প্রতিযোগিতা।

তবে শুধু মিস ওয়ার্ল্ড বা সিন ইউনিভার্সের জাতীয় প্রতিনিধি নির্বাচনই তো মূল কথা নয় পণ্যের প্রচার-প্রসারের জন্য কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিনিয়ত দরকার হয় আকর্ষণীয় দেহ ও মুখ। তাই গাটের পয়সা খরচ করে চলে সুন্দরী খোঁজার পায়তারা। পাশাপাশি তারা এধরনের কাজকে সামাজিক দায়িত্ব বলে সাধারণ মানুষের সিমপ্যাথীও কুড়িয়ে নেয়। শুধু তাই নয় খুঁজে পাওয়া নারী যাতে সবার চোখে ও মনে থাকে তার জন্য সে ছোট ও বড় পর্দায় নিজের কতৃত্ব বলবৎ রাখে। এ টিকে থাকার প্রতিযোগিতা কোন কোন ক্ষেত্রে নারীর স্বতীত্ব রক্ষার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ।

এই সব সুন্দরী প্রতিযোগিতার আয়োজকরা সুশীল সমাজ বা নারীবাদী আপত্তির বিপরীতে দু’টি যুক্তি প্রদর্শণ করে থাকে, প্রথমত এটি নারীর ক্ষমতায়ন ঘটায়, দ্বিতীয়ত এখানে দৈহিক সৌন্দর্য মূল কথা নয় এর জন্য তার বুদ্ধিমত্তা বা ট্যালেন্টই বিচারের মাপকাঠি। এ আয়োজনে প্রতক্ষভাবে যুক্ত থাকে একটি মিডিয়া। যেমনটা আমাদের দেশে চ্যানেল আই, ভারতের টাইমস অব ইন্ডিয়ার অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ফেমিনা। নারীর ইচ্ছায় চলে নারীর বস্তুকরণ। এটা ভোগ সংস্কৃতির নমুনা।

রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণ: বিশ্বে সার্বজনীন ও সর্বজনগ্রাহ্য সুন্দরী রদবদলের ইতিহাসে কোন ভারতীয় প্রথম প্রাইম খেতাব জিতে নেয় ১৯৬৬ সালে রিটা ফারিয়া। ১৯৬৬ থেকে ১৯৯৪ সময়কালে, ২৮ বছরে কোন ভারতীয় সুন্দরী পয়দা হয়নি। এরপর থেকে পাল্টে যেতে শুরু করে দৃশ্যপট। ভারতে আসে সুন্দরীদের জোয়ার। প্রথমে মিস ইউনিভার্স খেতাব জিতেন সুস্মিতা সেন, সাথে সেবছর মিস ওয়ার্ল্ড নির্বাচিত হন ঐশ্বরিয়া রায়।

তিন বছর পর ১৯৯৭ সালে মিস ওয়ার্ল্ড হন ডায়না হেইডেন। ১৯৯৯ সালে মিস ওয়ার্ল্ড হন যুক্তামুখী। ২০০০ সালে আবারও মিস ইউনিভার্স ও ওয়ার্ল্ড ভারতের দখলে আসে। এবছর মিস ইউনিভার্স ও ওয়ার্ল্ড হন যথাক্রমে লারা দত্ত ও প্রিয়াংকা চোপড়া। দেখা যাচ্ছে ১৯৯৪ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত ছয় বছর সময়ে ভারত পেল ছয়জন বিশ্বসুন্দরী।

আবার ২০০০ সালের পর থেকে দশ বছরে ভারত ভুগছে সুন্দরী খরায়। তবে কি ভারতে সুন্দরী জন্মানো বন্ধ হয়ে গেল? নব্বইয়ের দশকে ভারতে বিশ্বসুন্দরীদের এই সমাগমের পেছনে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণ রয়েছে। সেসময় নরসীমা রাও সরকার ভারতকে অর্থনৈতিক উদারীকরণের সিদ্ধান্ত নেয়। সোভিয়েত পতনের পর ভারতের বিশাল বাজারকে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ায় ব্যবহারের অংশ হিসেবে এ সিদ্ধান্ত আসে। বিশ্ববাজারের পণ্য বিকোবার জন্য চকচকে মোড়কের সাথে প্রয়োজন দেখা দিল একগুচ্ছ বহিরাঙ্গন পন্য।

বলা বাহুল্য এসকল ক্ষেত্রে পুঁজিবাদের সূত্র থিঙ্ক গ্লোবালি, অ্যাক্ট লোকালি। তাদের লক্ষ্য ছিল ভারতের মাধ্যমে পুরো দক্ষিন এশিয়ায় বাজার সম্প্রসারণ। বলতে হবে এক্ষেত্রে কর্পোরেট থিওরী বেশ ভালোই কাজে দিয়েছে এবং তাদের লক্ষ্যও অর্জিত হয়েছে ইতোমধ্যে। আগেই বলেছি এসকল সুন্দরীদের গ্রহণযোগ্য করে তোলার কাজ করে মিডিয়া। এ ধরনের প্রতিযোগিতা থেকে বরবারই দূরে ছিল বেশিরভাগ মুসলিম দেশ।

তবে ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারে হামলার পর থেকে বিশ্বজুড়ে বদলে যেতে থাকে মুসলীম সহনশীলতা। এ সংকট কাটিয়ে উঠতে ব্যবহার করা হয় পরের বছরই একজন মুসলমানকে দেয়া হয় এ খেতাব। ২০০২ সালে মিস ওয়ার্ল্ড হন তুরস্ক থেকে ও মিস ইন্টারন্যাশনাল হন লেবানন থেকে। ঘটনাটিকে অনেকে কাকতালীয় বললেও এটা নিতান্তই বকতালীয় বৈকি। পুঁজির প্রধান লক্ষ্য সংস্কার ভেঙ্গে ভোগ সৃষ্টি করা।

তাই বিশ্বব্যাপী উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মুসলমানদের ঘরে ঢুকতে হলে একজন মুসলমান মুখপাত্র চাই। শুধু তাই নয় বর্ণবাদী অভিযোগ মুছতে তাদের তৈরী করতে হয় কৃষ্ণাঙ্গ সুন্দরী। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০১ সালে কৃষ্ণাঙ্গ একজন নারীকে দেয়া হয় মিস ওয়ার্ল্ড খেতাব। নৃবিজ্ঞানী সুসান র‌্যাঙ্কল মিস ইন্ডিয়া প্রতিযোগিতার আগে নির্বাচিত ২৬ জন প্রতিযোগির জন্য প্রশিক্ষণ প্রক্রিয়া নিয়ে গবেষণা করেছেন। গবেষণাপত্রে তিনি বলেছেন, নির্বাচিত ২৬ জনকে যেভাবে ঘষেমেজে সম্ভাব্য মিস ইন্ডিয়া রূপে তৈরি করা হয় তাতে তার নিজস্ব স্বত্ত্বা বলে আর কিছুই বাকি থাকে না।

কেননা যে নির্বাচিত হবে সে তো শুধুমাত্র জাতীয় পর্যায়ে নয় ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মিস ওয়ার্ল্ড, ইউনিভার্সসহ ব্রান্ডিংয়ের কাজ করবে। তার ভাষায় এক্সপার্টদের বুজরুকিতে সুন্দরীদের ঘষামাজা করে এমন একজন আদর্শ তৈরি করা হয় যেমনটা পুঁজি দাবী করে। সুসান র‌্যঙ্কল এই প্রকিয়ায় শরীরকে তুলনা করেছেন একটি যন্ত্রের সাথে। যাকে যেমনটা শিখিয়ে দেয়া হবে ঠিক ততটাই সে করবে। এর মধ্যে আছে ডায়েট কন্ট্রোল, ভাষাভঙ্গি, ত্বক, ফ্যাশন ইত্যাদি।

তবে কি সুন্দরীর সৌন্দর্য ও বুদ্ধিমত্তা তৈরি হচ্ছে কৃত্তিম পন্থায়? অন্যের দ্বারা? তাই কি তারা বলছে, স্মার্ট হতে চাও, অমুক বিস্কুট খাও। হাতে খোদাই করে লেখাটি বাসর রাতে স্বামীর কাছে ধরা পড়ে যাওয়ায় স্ত্রী নিচ্ছে মিথ্যার আশ্রয়, বলছে চুইংগাম খেলে চাপাড় জোড় বাড়ে, বাড়ে বিশ্বাসযোগ্যতা। আর এজন্য পরের ধাপে দেয়া হয় সবকিছুর বৈধতা, শক্তিশালী এ মাধ্যমের নাম মিডিয়া। ... পরের লেখাটি মিডিয়া নিয়ে লেখার ইচ্ছে রইলো। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১১ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.