আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মোটরসাইকেল এবং ২০০ সিসি ভালোবাসার গল্প



ছোটবেলায় মোটরসাইকেলের নাম জানতাম, হোন্ডা হিসেবে। ব্রান্ডটা এতই জনপ্রিয় হয়ে ওঠেছিল, এটা এক রকম মোটরসাইকেলের নামই হয়ে গিয়েছিল। যার কারণে এমন প্রশ্নও চলে আসত, এটা কোন কোম্পানির হোন্ডা? তবে যে দিন থেকে মোটরসাইকেল চিনি সে দিন থেকে অবশ্য সেটা এক ধরনের নিষিদ্ধ বাহন হিসেবে সামনে আসত। সে সময় বহু জায়গায় শোনা যেত, এটা মাস্তানদের বাহন। ওই সময় হোন্ডার সঙ্গে মিলিয়ে 'গুণ্ডা' নামটি খুব বেশি উচ্চারিত হতো।

হোন্ডা চালায় গুণ্ডারা। আমরাও আতকে উঠতাম, ওরে বাবা! তবে একটি মহলের এত অপপ্রচারের পরও মোটরসাইকেল প্রীতি কমেনি। বরং বছরে বছরে ৫০ সিসি করে বেড়েছে। ছোটবেলায় মোটরসাইকেল যখন খুব বেশি মানুষের হস্তগত হয়নি তখন বাড়ির পাশ দিয়ে মোটরসাইকেল গেলে অনেকের মতো দৌড়ে দেখতে যেতাম কে চালাচ্ছে? দূর থেকে শব্দ হলেই চলত, মোটরসাইকেলের অধিক গতি নিয়ে রাস্তার পাশে হাজির হতাম। দেখতাম, নায়কের মতো কেউ না কেউ স্বপ্নের বাহন নিয়ে ভো ভো শব্দে সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছে।

এলাকার অনেক বিরক্তিকর খলনায়কটাইপ অপছন্দের লোকও মোটরসাইকেলের কল্যাণে নিজের কিছুটা বিরক্তিকর ইমেজ কমাতে পেরেছিলেন। কেউ তার মোটরসাইকেল ধরতে দিলে তো সেই সময়ে সাত খুন মাফ করে দিতাম। যদিও তখন জানতাম না খুনের শাস্তি কী লেভেলের হয়! সে সময় অবশ্য মোটরসাইকেল সামনে পেলে চালানোর মতো দুঃসাহস হতো না। মোটরসাইকেলের কাছে ঘেঁষাটাই এক ধরনের রোমাঞ্চকর বিষয় ছিল। তখন মোটরসাইকেল চালানোর চেয়ে আনন্দের কাজ ছিল তার হর্ণ বাজানো।

হলুদ, লাল বা কালো বাটনই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে হর্ণের বাটনগুলো ছিল। খুঁজে খুঁজে সেগুলো চেপে ধরে রাখার মধ্যে আনন্দ ছিল অপার। বড় হয়ে একদিন মোটর সাইকেল চালাব, সেই চিন্তা করে অল্প সময়েই মোটর ছাড়া সাইকেল শিখে ফেলেছিলাম। কিন্তু কে জানত মোটরসাইকেল চালানো আর আমাকে দিয়ে হবে না। তাও আমার চেষ্টা অব্যাহত ছিল।

কিন্তু আমাকে শিখতে দিয়ে মোটরসাইকেলের ক্ষতি মেনে নিতে পারে এমন সহৃদয়বান ব্যক্তি হাতে গোনা যায় এমন একজনও ছিল না বলে। তা আর শেখা হয়নি। কেউ আমাকে যদি জিজ্ঞাসা করত, মোটরসাইকেল চালাতে পার? কথা ঘুরিয়ে জবাব দিতাম, বাসায় পছন্দ করে না। যদিও কথাটা সত্যিই ছিল। কিন্তু সেই প্রশ্নের উত্তর হিসেবে এটা যায় না।

তাও দিতাম। একদিন আমাদের মোটরসাইকেল শেখানোর জন্য কিনা কে জানে আমাদের বন্ধু পিন্টু `উছিলায়' আমাদের সামনে নাযিল হল এক মোটরসাইকেল। পিন্টু কিনেছিল। পিন্টু প্রতিদিন ভো করে একটা বাচ্চা টাইপের মোটরসাইকেল নিয়ে আড্ডায় হাজির হতো। আমরা তো মহাখুশি এবার হয়তো শেখা যাবে।

যদিও ততদিনে শেখার আগ্রহী সেই মোটরসাইকেল প্রেমিকের মানসিক মৃত্যু ঘটে গিয়েছিল। তারপরও সেটা জাগাতে চেষ্টা করলাম। আমরা যত খুশি, পিন্টু তত খুশি না। সে ব্যাপক ভাব নিয়ে থাকে। মোটরসাইকেল আনার পর তার পা মাটিতে পড়ে না।

মানে, সে মোটরসাইকেলেই বসে থাকে। নামে না। পা রাখে ব্রেক, গিয়ার অথবা অন্য কিছুর ওপর। তারপরও পিন্টুর যে দিন মন ভালো থাকত, আমরা নানা অজুহাতে তার কাছে চাবি চাইতাম। কদাচিৎ সে দিয়ে দিত।

এই কদাচিৎটা একটা সময় নিয়মে নিয়ে এলাম। আমরা গেলাম পাল্টে। আগে আড্ডায় পিন্টু এল কিনা সে বিষয়ে আমাদের মাথা ব্যাথা কমই ছিল। কিন্তু তখন পিন্টুই ছিল আড্ডার প্রাণ। আমাদের মোটরসাইকেল শিক্ষক।

আমরা সব কিছু বাদ দিয়ে বসে থাকতাম পিন্টুর অপেক্ষায়। সে একটা `বাছুর' টাইপের সাইকেল নিয়ে আসবে। আমরা তাতে চড়ে সেটা চালানো শিখব। অনেক দূর থেকেই আমরা পিন্টুর আগমন ধ্বনি পেতাম। প্রচণ্ড শব্দে আসছে।

কিন্তু যত গর্জে তত বর্ষে না। অপেক্ষার পালা শেষ হতো না। প্রতি কিমি. ১৫ বা ২০ মিনিটে চলা সে মোটরসাইকেল বেশ ধীর লয়ে আমাদের মাঝে প্রবেশ করত। আমরা প্রতিদিন পিন্টুর সেই 'বাছুর' টাইপের মোটরসাইকেল চালানোর জন্য ব্যাপক কসরত করতাম। পিন্টু এ সুযোগে আমাদের গালাগালি করত।

অ্যাই ব্যাটা, ব্রেক ধর। ক্লাষ ধর। গিয়ার ফেল। আমরাও তার কথা মতো এসব করতাম। করে করে যখন ফাইনাল স্টেজে পৌঁছতাম তখন প্রচণ্ড শব্দে 'হাফ ইঞ্চি'খানেক এগিয়ে সেটা থেমে যেত।

সিরিয়ালে অনেক শিক্ষানুরাগী থাকার কারণে একবার ডিসকোয়ালিফাইড মানে আবার পনেরোজনের পর। একের পর এক ট্রাই। সঠিকভাবে ব্রেক, ক্লাষ চাপা, গিয়ার ফেলাফেলি করে কেউ সেখানে থেমে যেত। কেউ একটু এগোত। কেউ পিন্টুর গালি শুনত।

এত এত শিক্ষার্থীকে পেছনে রেখে একটা সময় আমরা কয়েকজন মোটরসাইকেল চালানোর 'অ' 'আ' শিখেছিলাম। তবে আমরা পাস করলেও অন্য বন্ধুদের ফেল-এ কষ্ট পেতাম। যেমন, মানিক বড়জোড় মোটরসাইকেলে ওঠা পর্যন্তই শিখেছিল। লোটাস শিখেছিল, একদিকে বাঁকা হয়ে ইঞ্চিখানেক যাওয়া। তবে সবচেয়ে ব্যর্থ ছিল শাওন।

সে চালানোয় ব্যর্থ হয়ে বিকল্প আনন্দের সন্ধান করে দুঃখ ভোলার চেষ্টা চালিয়েছিল। তার আর মোটরসাইকেলে ওঠেনি। কেউ উঠলে সে স্টার্ট দিয়ে দিত। আমরা যে কেউ ওঠেই শাওনকে ডাক দিতাম, শাওন স্টার্ট...। শাওন ব্যাপক উদ্যমে স্টার্ট দিয়ে দিত।

আমরা এ সুবিধা নিয়ে অন্য দিকে মনোনিবেশ করে কিছুটা চালানোয় পারদর্শী হয়ে ওঠেছিলাম। আমি ব্যক্তিগতভাবে এরপর বহুদূর এগিয়েছিলাম। সেই মোটরসাইকেল চালানোর নানা সূত্র কাজে লাগিয়ে নির্দ্বিধায় স্বল্প দূরত্বে মোটরসাইকেল চালানোয় পারদর্শী হয়েছিলাম। তবে যেটা হতো, স্টার্ট দেয়ার পর অনেক কিছুই ভুলে যেতাম। গিয়ার বাড়ানো কমানো নিয়ে জটিলতা।

ব্রেক নিয়ে সমস্যা আরও কত কী। দু'বার তো মরতে মরতে বেঁচে গিয়েছিলাম। একবার অল্পতেই। আরেকবার এক অনুষ্ঠানে। বড় মাঠে আরেকজনের মোটরসাইকেল নিয়ে যাত্রা শুরু করেছি।

কিন্তু আর থামাতে পারছি না। হাতের ব্রেকও কাজ করছে না। পায়েরটাও না। ব্রেক চাপতে না পেরে খালি ঘুরছি। আর আল্লাহকে ডাকছি এবং কিছুক্ষণ পর পর আমার মোটরসাইকেলের স্পিড বাড়ছে, যা দেখে সবাই আমাকে বাহবা দিচ্ছে।

এত জোরে আমি মোটরসাইকেল চালাচ্ছি। এদিকে তো আমার অবস্থা শেষ। মোটরসাইকেল আর থামে না। সে ঘুরছেই। আমি মনে মনে আল্লাহকে ডাকছি, মানির মান রাখ।

কিন্তু এটাও আমার সন্দেহ হচ্ছিল আমি আসলে মানি কিনা? যদি না হই তাহলে তো আজ এখানেই শেষ। পুরো না মরলেও, যতটুকু বাঁচা, সেটা লজ্জায়ই মরে যেতে হবে এখানে আজ যদি মোটরসাইকেল নিয়ে পড়ি। এই পৃথিবী থেকে নিজের চলা যখন থামানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম তখন পৃথিবীর ক্ষেত্রে আঙ্গুর ফল টক থিওরি অ্যাপ্লাই করে সুখ পাচ্ছিলাম। যাক, এখন মরে গেলে অনেক ঋণ থেকে বাঁচা যাবে। ঢাকার জ্যামে আর কষ্ট করতে হবে না।

কষ্ট করতে হবে না দেশের নানা সমস্যায়। ঠিক তখনই ঘটল অঘটন। হঠাৎ কি মনে করে একটি মাইক্রোবাস থেকে মাইক্রোমিলিমিটারখানেক দূরত্বে গিয়ে মোটরসাইকেলটি থেমে গেল। ঠিক সেই মুহূর্তে একটু আনন্দ হতে গিয়েও মেজাজ ও মন খারাপ হয়ে গেল, এখন যে বেঁচে গেলাম এখন জ্যামের যন্ত্রণা থেকে বাঁচাবে কে? তাও না হয় বাঁচলাম, কিন্তু এত ঋণ কে শোধ করবে?

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।