Miles to go before I sleep.....
ছোটকালে জ্বর হলে স্কুল কামাই করা যেত, আবার শুধু জ্বর তেমন কঠিন রোগও না, তাই জ্বর খুবই কাম্য অসুখ ছিল। আমার প্রায়ই জ্বর হত। প্রতি বছরই কয়েকবার অন্তত। আমি এম্নিতেই তালপাতার সেপাই ছিলাম, জ্বর হলে আরো কাবু হয়ে যেতাম। তবে জ্বর থাকা অবস্থায় জ্বর বাড়াকমার সাথে সাথে মুডও পরিবর্তন হত।
খুব বেশী জ্বর হলে লেপমুড়ি দিয়ে টকটক করে কাঁপাকাঁপি করাতেও একটু মনে হয় রোমান্ঞ আছে, নাকি?
জ্বর হলে আমার বাবা রাতে আমি আধো-ঘুম হলে হাত কপালে ছুয়ে জ্বর দেখত। বাবার গায়ের গন্ধ পেতাম, ভাল লাগত খুব। আমার বাবার গায়ের গন্ধটা দারুন, শুধু জ্বর হলেই বাবা গা ছুঁয়ে দেখত, এম্নিতে বাবা কখনও ছেলেমেয়েদেরকে আদর করা জানতনা। নিজে সাত বছর বয়সে মা হারিয়েছিলেন এবং মোটামোটি আদরযত্ন ছাড়াই, অবহেলায় বড় হয়েছেন, সেজন্যই হয়ত বা। তাই জ্বর হলে এদিক দিয়ে ভালই হত।
তবে রাতে বাবা কয়েকবার ঘুম থেকে উঠে মশারি ঠিকঠাক আছে কিনা, বালিশ একপাশে হেলে গিয়েছে কিনা, আমি আর ভাইয়া খাটের একদম একপাশে চলে এসেছি কিনা এসব দেখতেন। দিনের বেলা পড়ালেখা করার জন্য রাগারাগি করতেন, রাতের বেলা ঘুম থেকে উঠে বালিশ ঠিক করে দিতেন। বাবার ভয়ে আমরা মার্বেল, ডাংগুলি এসব খেলতে পারতাম না গ্রামের অন্যসব ছেলেদের সাথে, গাছে উঠতে পারতাম না, বেশিক্ষণ পুকুরে সাতরাতে পারতাম না। গ্রামের অন্য কোন ছেলেকে তাদের বাবা-মা'রা এসব করতে বাঁধা দিতনা, শুধু আমার বাবা কেন বাঁধা দিত জানিনা। মার্বেল খেলা নাকি জুয়া শেখায়, ডাংগুলি চোখে লাগতে পারে, পুকুরে বেশিক্ষণ থাকলে অসুখ করবে, গাছে উঠলে পড়ে যাওয়ার চান্স আছে।
অবশ্য বাবার অজান্তে সবকিছুই করেছি, শুধু ধরা না খাওয়াটাই ছিল গুরুত্বপূর্ণ।
জ্বর হলে মা তো সারাক্ষণ বসেই থাকত পাশে, সুরা ইয়াসীন আরো কত কি সূরা পড়ে ফু দিত কিছুক্ষণ পরপর। অর্থনৈতিকভাবে টানাটানির সংসারেও কিভাবে কিভাবে জানি বাবা-মা আমি যা খেতে চাই তাই জোগাড় করে ফেলত জ্বর হলে। জ্বর হলে আমার মায়ের নফল নামাজ পড়ার হার অনেক বেড়ে যেত, রাতজেগে এম্নিতেই মা তাহাজ্জুদ পড়তেন, তখন আরো অনেক বেশি পড়া শুরু করতেন। জ্বর হলে মা যখন মাথায় পানি ঢালত তখন ভাল লাগত, ঠান্ডা পানি চুলের ভিতর দিয়ে পড়ছে, মা হাত দিয়ে মাথায় পানি সমভাবে পড়ে যেন সেভাবে বিলি কাটছে।
আমাদের খাটটা পুরানো হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু জ্বর হলে মা বেডশীট প্রতিকয়েকদিনেই বদলে দিত, যাতে ফ্রেস লাগে। প্রতি কয়েক মিনিট পরপর মা কপালে হাত দিয়ে জ্বর দেখত। জ্বরে কয়েকদিন ভুগার পর যখন একটু ভালর দিকে, তখন যে মায়ের মুখে সারাক্ষণ কি খুশি লেগে থাকত। একটা মানুষ এত অল্পতে কেন খুশি হবে?
এমেরিকায় মানুষ থার্মোমিটার দিয়ে জ্বর দেখে, কপালে হাত দিয়ে জ্বর দেখেনা। এমেরিকান মায়েরা কি ছেলের জ্বর হলে মাথায় পানি ঢালে? জ্বলপট্টি দেয়? মায়েরা হয়ত আমার মায়ের মতই তাদের ছেলেকে ভালবাসে এখানে।
তবুও আমি আমেরিকার মায়েদেরকে অনুরোধ করব তারা যেন তাদের সন্তানের জ্বর হলে তাদের পাশে বসে বাইবেল থেকে কিছু পড়ে ফু দেয়, তাদের মাথায় যেন পানি ঢালে, ঠান্ডা পানি, পারলে যেন জলপট্টিও দেয়। আর যেন কিছুক্ষণ পর পর কপালে হাত দিয়ে জ্বর দেখে। আমার মা হাতের তালু দিয়ে একবার জ্বর দেখতেন আবার হাতের উল্টা তালু দিয়েও একবার দেখতেন। এমেরিকার মায়েদের কাছেও অনুরোধ ঠিক যেন সেভাবেই জ্বর দেখে। থার্মোমিটার ব্যবহার করতে চাইলে করুক, আমার আপত্তি নেই, তবে যেন একবার হলেও হাত দিয়ে জ্বর দেখে।
এমেরিকান বাবাদের কাছে অনুরোধ, তারা যেন রাতের বেলা মাঝে মাঝে ঘুম থেকে উঠে তাদের সন্তানেরা খাট থেকে পড়ে যাচ্ছে কিনা সেটা দেখে। ছেলের জ্বর হলে আমার বাবা রাতের বেলা হলে কপালে হাত দিয়ে জ্বর দেখতেন, দিনের বেলা অত ভালবাসা দেখাতেন না, শুধু আমার হাত একটু করে দেখতেন। এমেরিকান বাবাদেরও উচিৎ হবে সেরকম করা। বাবা জ্বর বেশি দেখলে মুখে দুঃখের একটা শব্দ করতেন, এমেরিকান বাবারাও সেরকম করতে পারে, সেটাই বরং ভাল হবে।
তবে এমেরিকান মায়েদের অবশ্যই উচিৎ আমার মায়ের মত করে হাত দিয়ে জ্বর দেখা।
এর অন্যথা করা ঠিক হবে না। সত্যি এমেরিকান মায়েরা যেন এরকমই করে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।