আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিয়ের আড্ডায় মিসির আলী, হিমুও(৭)



তিন মাস কেটে গেছে। এই তিন মাসে হিমুকেঅনেক খুঁজেছে রূপা। হদিস পায়নি। সে যখন ধরেই নিয়েছে হিমুর সাথে আবার কখনো দেখা হবার কোনো সম্ভাবনাই আর নেই, তখনই একদিন, রমনা পার্কের সামনে ফুটপাতের বেঞ্চিতে বসে থাকতে দেখলো হিমুকে। প্রায় ছুটে গেলো রূপা।

কাছে গিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করবার আগেই হিমু অতি স্বাভাবিকভাবে বললো, তারপর রূপা! কী অবস্থা? রূপা বললো, আমি কি আপনাকে কিছু কথা জিজ্ঞেস করতে পারি? পারো। তবে তোমার জিজ্ঞেস করতে পারা না পারায় কিছু যায় আসে না। যাকে নিয়ে প্রকৃতির যা পরিকল্পনা, তাকে তাই করতে হবে। তুমি চাইলেও , না চাইলেও। কিছু বলতে যাচ্ছিলো রূপা।

হাতের ইশারায় থামিয়ে দিলো হিমু। বললো, আমার কথা এখনো শেষ হয়নি। সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে রূপা বললো, আমি তো আপনার বক্তৃতা শুনতে আসিনি। আমি এসেছি কিছু সমস্যার সমাধান করতে। অবশ্য সমাধান আমি নিজেই করবো।

আপনার কাছ থেকে কিছু ব্যাখ্যা জানা দরকার। এর বেশি কিছু না। শোনো রূপা। আমাদের এই পৃথিবীটা বড়ই অদ্ভূত জায়গা! তুমি যখন যা চাইবে, দেখা যাবে পাচ্ছোনা। যখন আর চাইবেনা, দেখবে পেয়ে গেছো।

এই যেমন ধরো, তিন মাস তুমি আমাকে হন্যে হয়ে খুঁজেছো, পাওনি! আজ যখন খোঁজাখুঁজি ছেড়ে দিয়েছো, পেয়ে গেলে। অদ্ভুত না? আসলে রূপা, পৃথিবীটা হচ্ছে ছায়ার মতো। তুমি ছায়াকে ধরতে যেয়ে ছায়ার পিছু নেবে। দেখবে ধরতে পারছো না। যতই তুমি সামনে আগাচ্ছ, ছায়াও ততো দূরে সরে যাচ্ছে।

কিন্তু তুমি যখন ফিরে আসবে, দেখবে ছায়াও তোমার পিছু পিছু আসছে। তারপর বলো, তোমার মায়ের শরীর কেমন? আমার মায়ের শরীর কেমন, সেটা জানা আপনার জন্য জরুরী না। তাছাড়া তিন মাস আমি আপনাকে হন্যে হয়ে খুঁজেছি, এই ধারণাই বা আপনার হলো কেনো? অনুমান। অনুমান করে বললাম। আমার আবার অনুমান শক্তি ভালো।

আমি আপনাকে কিছু প্রশ্ন করবো। আপনি কি দয়া করে অনুমান না করে সঠিক জবাব দেবেন? দিতেও পারি। আগাম বলা যাচ্ছেনা। আপনি কি ভনিতা ছাড়া কথাই বলতে পারেন না? একটু হাসলো হিমু। সেই চিরচেনা হাসি।

যে হাসিতে খুব সহজেই কাউকে বিভ্রান্ত করে ফেলা যায়। তবে রূপাকে বিভ্রান্ত বা বিব্রত মনে হলো না। তবে কিছুটা বিরক্ত বোঝা গেলো। যথাসম্ভব বিরক্তি চেপে রেখে বললো, আমি আপনার বেশি সময় নেবো না। মাত্র ৪/৫ কয়েক মিনিট।

দেয়া যাবে? যাবে। তবে সে জন্য তোমাকে দুই ঘন্টা অপেক্ষা করতে হবে। দুই ঘন্টা! দুই ঘন্টা অপেক্ষা করতে হবে কেনো? ফ্রি-ই তো আছেন। নাকি নিজেকে আমার কাছে একটু বেশি গুরুত্বপূর্ণ করে তুলতে চাইছেন? তার আর দরকার হবেনা। আপাতত এমনিতেই আপনি এখন আমার কাছে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।

হিমু বললো, দেখো রূপা। এই মুহুর্তে আমি মোটেও ফ্রি না। আমার পাশে যে চায়ের ফ্লাস্কটা দেখতে পাচ্ছো, ওটাও মালিকের নাম বদি, মোঃ বদিউল আলম। সে গেছে চা পাতা আনতে। ফ্লাস্কে চা আছে ৪/৫ কাপ।

আমার কাছে রেখে গেছে বিক্রির জন্য। ভ্রাম্যমান টি স্টলটির ফুল ইনচার্জ এখন আমি। সে আসুক। দায়িত্ব হ্যান্ড অভার করি। তারপর।

দেখুন। আমার দশ মিনিট সময় হলেই চলবে। আর আপনি তো আপনার টি স্টল চালু রেখেই আমার সাথে কথা বলতে পারেন। একটু আগে কিন্তু বলেছিলে ৪/৫ মিনিট। যাই হোক, সেটা সমস্যা না।

তোমাকে বসতে হবে। এক সাথে দুই কাজ হাতে নিলে কোনটাই ঠিকমত করা হয় না। চাইলে চা খেতে পারো এক কাপ। অবশ্য পয়সা দিতে হবে। প্রতি কাপ চার টাকা।

রূপা বুঝে গেলে এই লোক কঠিন চিজ। তর্কে গিয়ে লাভ হবেনা। সে বললো। আপনি কি আপনার ফ্লাস্কের সব চা বিক্রি না হওয়া পর্যন্ত আমাকে সময় দেবেন না? সহজ কথাটি একটু দেরিতে বোঝার জন্য রূপা তোমাকে ধন্যবাদ। রূপা ফ্লাস্কটি হাতে নিয়ে কাপে চা ঢালতে লাগলো।

এক কাপ এক কাপ করে মেপে মেপে সাড়ে চার কাপ চা সে ফেলে দিলো পাশের ডাস্টবিনে। তারপর পার্স থেকে নতুন একটি বিশ টাকার নোট বের করে বাড়িয়ে দিলো হিমুর দিকে। বললো, আপনার সাড়ে চার কাপ চায়ের দাম হয় আঠার টাকা। বিশ টাকা দিলাম। দু'টাকা ফেরত দিতে হবেনা।

ওটা বকশিস। যতটুকু বুঝতে পারছি, ফুটপাতে বসে চা বিক্রি করতে পারছেন, সো বকশিস নিতে সমস্যা থাকার কথা না। তবুও আপনি না নিতে চাইলে মোঃ বদিউল আলমের জন্য রেখে দিন। আপনার সব চা বিক্রি হয়ে গেছে। এখন তো আর আমাকে সময় দিতে আপনার কোনো আপত্তি নেই? তা নেই, তবে... এখানে আবার তবে আসছে কেনো? আপনার দরকার ছিল চা বিক্রি হওয়া।

হয়েছে। আমি কিনে নিয়েছি। আমি আমার খরিদ করা চা খেলাম কি ফেলে দিলাম, তা নিয়ে তো আপনার মাথা ঘামানোর দরকার নেই। দেখো রূপা। আমি বুঝতে পারছি তোমার বাবার অনেক টাকা আছে।

আমি জানি টাকা থাকলে অনেক কিছুই করা যায়। তবে তুমি কি জানো টাকা জীবনের অনেক কিছু হলেও সব কিছু নয়! সব কাজ টাকা দিয়ে হয় না। তুমি আমাকে বিশ টাকা দিয়ে চা'গুলো ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছো। এখন আমি যদি তোমাকে চল্লিশ টাকা দিয়ে বলি চা'গুলো আবার তুলে আনো, পারবে? এই যে তূমি অকারণে বিশটি টাকা ডাস্টবিনে ভাসিয়ে দিলে,তুমি কি জানো, একদিন, ১৯৭৪ সালের এমনি এক দিনে এদেশের শত শত মানুষ এই ডাস্টবিনের ময়লার ভেতরেই খাবার খুঁজে বেড়িয়েছে। এখনো এদেশের অনেক মানুষ ১০ টাকা দিয়ে দু'টি রুটি কিনে খেতে পায় না।

দু'গ্লাস পানি খেয়েই রাতে ঘুমিয়ে পড়তে হয়। তোমাদের টাকা আছে বলে খাবার ডাস্টবিনে ফেলে দেবে। আবার টাকা নাই বলে কেউ কেউ এই ডাস্টবিনেই খাবার খুজে পাবেনা। এটা কেমন কথা? শোনো রূপা। তুমি চা ফেলে দিয়ে অন্যায় করেছো।

তোমার শাস্থি হওয়া দরকার। আপাতত তোমার শাস্থি হচ্ছে বদি আসার আগ পর্যন্ত অপেক্ষা করা। অবশ্য তুমি চাইলে চলেও যেতে পারো। তবে আমার মনে হয় না তুমি সেটা পারবে। তুমি জড়িয়ে গেছো প্রকৃতির অদৃশ্য এক জালে।

তোমার ক্ষমতা নেই এই জাল ছিন্ন করে বের হবার। এতো ক্ষমতা তোমাকে দেয়া হয়নি। চুপ করে শুনে যাচ্ছিলো রূপা। এ জাতীয় কথাবার্তার জবাব দেয়ার কোনো মানে হয় না। তার উচিত এই ফাজিলটাকে কড়া একটি ধমক দিয়ে ফিরে আসা।

কিন্তু বিচিত্র কোনো কারণে সে লক্ষ্য করলো তার ভেতরে ফিরে আসার কোনো তাড়া নেই! তাহলে কি সত্যি সত্যিই এই ছেলের বিশেষ কোনো ক্ষমতা আছে!! রূপাকে দুই ঘন্টা অপেক্ষা করতে হলো না। পঁয়তাল্লিশ মিনিটের মাথায় টি স্টলটির প্রোপ্রাইটর বদিউল আলম সাহেব ফিরে এলেন। ম্যানেজমেন্টের দায়িত্ব মালিকের হাতে ফিরিয়ে দিয়ে হিমু তাকালো রূপার দিকে। বললো, বলো রূপা, কী চাও তুমি আমার কাছে? কী চাও মানে? আপনার কাছে কিছু চাইতে যাবো কেনো? আচ্ছা ঠিক আছে। আমার কাছে কিছু চাও না বুঝতে পারছি।

কী জানতে চাও, সেটাই বলো। দেখুন, ব্যাপারটি তেমন জরুরি কিছু না। আবার আমার নির্দোষ কৌ্তূহল মেটাতে জরুরিও। আমি আমাকে চিনিনা, আপনি আমাকে চেনেন না, অথচ সেদিন আপনি আচমকা আমার নাম ধরে কী সব বলে বসলেন! আমাকে দেখতে আসা, মায়ের পা ভেংগে ফেলা, এগুলোও আপনার জানার কথা না! জানলেন কী করে? আপনার কি কোনো সুপার ন্যাচারাল ক্ষমতা আছে? স্টেইট বলবেন। আপনার কথা বলার ধরণ থেকেই আমি বুঝে গেছি আপনি ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে কথা বলতে পছন্দ করেন।

প্যাঁচাপ্যাঁচির দরকার নাই। সরাসরি বলবেন। ক্রিকেটের ভাষায় যাকে বলে স্টেইট ড্রাইভ বা বোলার ব্যাক ড্রাইভ। হিমু বললো, দেখো রূপা। প্রাইমারি স্কুলের অংক আপার নামতা জিজ্ঞেস করার মত কথা বলছ তুমি! মনে হচ্ছে তোমার প্রশ্নের জবাব দিতে আমি যেনো বাধ্য।

এভাবে বললে তো আমি তোমার কোনো কথারই জবাব দেবো না। আমার কাছ থেকেও কিছু উদ্ধার করতে চাইলে মোলায়েম সুরে রিকোয়েস্ট করতে হবে। এক্সকিউজমী টাইপ। অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত রেখে রূপা বললো, আচ্ছা বাবা, ঠিক আছে। আমি কঠিন সুরে কথা বলে মহা বেয়াদবি করে ফেলেছি।

সরি। জনাব কি মেহেরবাণী করে আমার প্রশ্নগুলোর জবাব দেবেন? তার আগে বলো জানতে চাচ্ছো কেনো? বলেছি তো! কৌ্তূহল। শুধুই কৌ্তূহল? তিন মাস তুমি একজন মানুষকে সকাল-সন্ধ্যা পাগলের মতো খুঁজে ফিরেছো শুধুই কৌ্তূহল মেটানোর জন্য? বিশ্বাস করা কঠিন। সত্যি করে বলো আসল ঘটনা কী? রূপার মেজাজ এবার সত্যি সত্যিই বিগড়ে গেলো। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলো না।

দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে ব্যাঙ্গাত্বক হাসি দিয়ে বললো, আসল ঘটনা হলো , আমি আপনার প্রেমে পড়েগেছি। পড়ে কেবল হাবুডুবু খাচ্ছি না। একেবারে ডুবু ডুবু মেরে বসে আছি। আপনার প্রেমে আমি এতটাই উতলা হয়ে গেছি যে, একটি মুহুর্ত আমি আপনার নূরানী চেহারা না দেখে থাকতে পারছিনা। শুনুন রহিম বাদশা।

আপনি কি দয়া করে আমাকে রূপবান কন্যা হিসেবে গ্রহন করবেন? গ্রহন করবো কি করবো না, সেটা নির্ভর করছে আমার মেজাজ-মর্জির উপর। করতেও পারি আবার না ও করতে পারি। এর পরে আর বসে থাকা যায় না। রূপা চলে এলো। এই ছেলে যে মানসিক ভাবে অনেকাংশেই অসুস্থ, কোনো সন্দেহ নেই।

বিয়ের আড্ডায়-১ বিয়ের আড্ডায়-২-৩ বিয়ের আড্ডায়-৪ বিয়ের আড্ডায়-৫ বিয়ের ভাড্ডায়-৬ সামনে আসবে শেষ পর্ব

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।