আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দান্তে : আধ্যাত্মিক প্রেমের কবি

বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্‌উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ
দান্তে। ইউরোপের মধ্যযুগের অনতম্য ইতালিয় কবি ও দার্শনিক। বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্মিলিত ভাবে যে অবদান রেখেছেন- ইতালিয় ভাষার ক্ষেত্রে দান্তে একাই অনুরূপ অবদান রেখেছিলেন।

কেননা, দান্তের সময়কালে ইতালিতে ভাষাগত ঐক্য ছিল না। দেশটির নানা অঞ্চলের লোকে নানা ভাষায় কথা বলত। যাকে বলে vernacular ভাষা। অবশ্য এসব ভার্নাকুলার ভাষা লাতিন থেকেই উদ্ভূত হয়েছিল। দান্তে ফ্লোরেন্স অঞ্চলের ভার্নাকুলার ভাষায় সাহিত্য রচনা করায় ফ্লোরেন্স অঞ্চলের ভার্নাকুলার ভাষা হয়ে উঠেছিল আধুনিক ইতালিয় ভাষার ভিত্তি।

যা হোক। সাহিত্য রচনা ছাড়াও সক্রিয় রাজনীতিতেও জড়িয়েছিলেন দান্তে । পরিণামে নির্বাসিত হতে হয়েছিল জন্ম নগর ফ্লোরেন্স থেকে । নির্বাচিত জীবনে রচনা করেছিলেন ধ্রুপদি কাব্য ‘ডিভাইন কমেডি’- যে কাব্যগ্রন্থে মৃত্যু পরবর্তী জীবন সম্বন্ধে কাল্পনিক ও রূপকধর্মী মধ্যযুগীয় দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশিত হয়েছে। ... তবে প্রেয়সী বিয়াত্রিচের প্রতি দান্তের গভীর আত্মিক প্রেম যুগে যুগে মানুষকে অভিভূত মুগ্ধ করে রেখেছে।

দান্তে কাব্য রচনা করেছেন মধুরতম কাব্যিক ভাষায় । শুধু তাই নয় দান্তের জীবনবোধ মধ্যযুগকে অতিক্রম করে পরবর্তী কালেও বিস্তৃত হয়েছে। যে কারণে আধুনিক যুগের কবি এজরা পাউন্ড, টি এস এলিয়ট থেকে রুশ কবি আনা আখমাটোভা- এরা প্রত্যেকেই দান্তের কাছে তাদের কাব্যভাবনার অপরিসীম ঋন স্বীকার করেছেন । ইতালির মানচিত্রে ফ্লোরেন্স নগরের অবস্থান। দ্বাদশ শতকে নগরটি ছিল শিক্ষাসংস্কৃতির কেন্দ্র ।

এই নগরেই ১২৬৫ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে দান্তের জন্ম। এ নগরেই জীবনের ৩৮ বছর কাটিয়েছিলেন কবি, এ নগরেই লাভ করেছিলেন আধ্যাত্মিক প্রেমের অভিঘাত; রাজনৈতিক আর্বতে পড়ে নির্বাসিত হয়েছিলেন এ নগর থেকেই। দান্তের পুরো নাম দান্তে আলিঘিয়েরি। পরিবারটি ছিল মোটামুটি অভিজাত। বাবা সুদখোর মহাজন, বিষয় সম্পত্তি ভাড়া খাটাতেন।

যা হোক। পরিবারের অর্থ সম্পদ থাকায় দান্তের শিক্ষাদীক্ষা ভালোই হয়েছিল বলা যায়। শৈশবে ইউরোপীয় ধ্রুপদি সাহিত্য পাঠ করেছিলেন এবং পরবর্তীকালে খ্রিস্টীয় ধর্মসাহিত্যে আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। ৭ বছর বয়েসে নেমে এসেছিল বিপর্যয়। দান্তের মা মারা যান।

দান্তের বাবা আবার বিবাহ করার সিদ্ধান্ত নেন। তবে ভদ্রলোক বেশি দিন বাঁচেননি; মারা যান ১২৮০ খ্রিস্টাব্দে । দান্তের বয়স তখন ১৫ বছর। কিশোর বয়েসে ভাবনামগ্ন কবি ব্রুনেটো লাতিনি নামে একজন রাজনীতিবিদ এবং পন্ডিত কে অভিভাবক হিসেবে পেলেন দান্তে । লাতিনি অবশ্য সমকামী ছিল।

এতে দান্তের খ্রিস্টীয় আঁতে ঘা লেগেছিল। দান্তে সম্ভবত লাতিনি কে ঘৃনা করতেন। কেননা, দান্তের ‘ডিভাইন কমেডিতে’ লাতিনি-র স্থান হয়েছিল নরকে! মনে রাখতে হবে সময়টা মধ্যযুগ। দান্তের পক্ষে খ্রিস্টবিরোধী কিংবা সমকামের সমর্থক হওয়া সম্ভব ছিল না। ফ্লোরেন্স।

বর্তমান কালের ছবি। দান্তের কারণে এই নগরটির প্রতি বিশ্ববাসীর গভীর আগ্রহ। ১২৭৬ খ্রিস্টাব্দে একটি ঘটনা ঘটল। ১৬ বছর বয়েসি কিশোর দান্তে । ফ্লোরেন্স নগরের পথে একটি সুশ্রী বালিকাকে দেখে আমূল চমকে উঠল।

খোঁজ নিয়ে জানা গেল বালিকার নাম বিয়াত্রিচে পর্টিনারি । বিশিষ্ট ব্যাংকার ফলকো পর্টিনারির কন্যা। (পরবর্তীকালে লা ভিটা নিউভা এবং ডিভাইন কমেডি নামে দুটি কাব্যের বিষয়বস্তু এই বালিকা। ) অভিজাত বালিকার বয়স ৯। ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ চিত্রকর হেনরি হলিডের আঁকা এই ছবিটির নাম- Dante Alighieri Italian Writer Meeting His Beloved Beatrice Portinari on the Lung'Arno Florence বালিকা বিয়াত্রিচেকে দেখে কবি কিশোর প্রবল প্রেমানুভূতি বোধ করে।

বাবা এক বছর ধরে মৃত, ব্রুনেটো লাতিনির নষ্টামি দান্তেকে শোকার্ত এবং ক্ষুব্দ করে রেখেছিল। বালিকা বিয়াত্রিচের নিষ্পাপ মুখে স্বর্গে আভা। আহা, দেখে প্রাণ জুড়াল। পবিত্রা বালিকার সত্ত্বার গভীরে ডুবে যেতে থাকে কবি কিশোর। এবং এই প্রেম কেবলই যে দেহজ প্রেম নয়, আমুল ঐশ্বরিক, তা উপলব্দি করা যায়।

স্বয়ং ঈশ্বর বিয়াত্রিচে রূপে বালিকারূপে দর্শন দিয়েছেন ভক্ত দান্তের কাছে । এ প্রসঙ্গে ইউরোপীয় লেখকদের ভাষ্য হল: ... The woman Dante loved, Beatrice, whom he regards as both a manifestation and an instrument of the divine will, is his guide through paradise. এ তত্ত্ব আর কেউ না বুঝুক- বাঙালি বোঝে । কেননা, আমাদের দেশের রাজধানীর মগবাজার মোড়ে সন্ধ্যাবেলায় লাউড স্পিকারে বাজে চন্দনা মজুমদারের গান- আমার বন্ধু দয়াময় তোমারে দেখিবার মনে লয় ... বালিকা বিয়াত্রিচে কে দেখে কবি কিশোরের শূন্য পৃথিবী ভরে উঠল । মনের ভিতরে সারাবেলা বালিকার ভাবনা। দান্তে যেন রবীন্দ্রনাথের মতো করে বলছেন- ঘরেতে ভ্রমর এল গুন্গুনিয়ে ।

আমারে কার কথা সে যায় শুনিয়ে । । আলোতে কোন্ গগনে মাধবী জাগল বনে, এল সেই ফুল-জাগানোর খবর নিয়ে । সারা দিন সেই কথা সে যায় শুনিয়ে । ।

কেমনে রহি ঘরে, মন যে কেমন করে, কেমনে কাটে যে দিন দিন গুনিয়ে । কী মায়া দেয় বুলায়ে, দিল সব কাজ ভুলায়ে, বেলা যায় গানের সুরে জাল বুনিয়ে । আমারে কার কথা সে যায় শুনিয়ে । । কিন্তু, হায়।

এ জীবন এমন ছলনাময়। বিয়াত্রিচেকে দেখার আগেই যে সেই ১২ বছর বয়েসে জেমমা দোনাতি নামে একটি মেয়েকে বিবাহ করবেন বলে কথা দিয়েছিলেন দান্তে । কবি তো ওয়াদার খেলাফ করতে জানেন না। বিয়াত্রিচেকে দেখার ৯ বছর পর ১২৮৫ খ্রিস্টাব্দে জেমমা দোনাতি কে বিবাহ করেন দান্তে । কিন্তু কখনও কোনও কবিতায় স্ত্রী জেমমা দোনাতি-র কথা কখনও উল্লেখ করেননি দান্তে।

দান্তের কাব্যজুড়ে কেবলি বিয়াত্রিচে আর বিয়াত্রিচে। ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে ক্যানভাসের ওপর তেলরঙে আঁকা ইংরেজ চিত্রকর দান্তে গ্যাব্রিয়েল রসেটির Beata Beatrix ... । ছবিতে বিয়াত্রিচের মৃত্যুর আগেকার দৃশ্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। গ্যাব্রিয়েল রসেটি ইতালিয় বংশোদ্ভূত শিল্পী। কবিকে সম্মান জানানোর জন্য নামের পূর্বে দান্তে শব্দটি লিখতে।

Beata শব্দটি লাতিন ; এর অর্থ আর্শীবাদপুষ্ট । ( যেমন আমরা বলি: শ্রীরাধা) ১২৯০ খ্রিস্টাব্দের জুন মাস। দান্তে সংবাদ পেলেন বিয়াত্রিচে আর বেঁচে নেই ! দান্তের তখন ২৫ বছর বয়স। তরুণ কবিটি গভীর শোকে আচ্ছন্ন হলেন। জীবনজগৎ সম্বন্ধে নানা প্রশ্ন আর সংশয়ে আকূল হলেন।

গ্রিক চিন্তাবিদ অ্যারিস্টটল, প্রাচীন রোমান কবি ভার্জিল, বোথিয়াস- এর ‘কনসোলশন অভ ফিলসফি’ এবং দার্শনিক টমাস অ্যাকুইনাস লেখাগুলি গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়তে লাগলেন । কবিতা লেখাও অব্যাহত ছিল। তাঁর ১২৯৫ খ্রিস্টাব্দে রচিত ‘লা ভিটা নিউভা’ (নতুন জীবন) কাব্যগ্রন্থে দান্তে বিয়াত্রিচে কে অমর করে রাখলেন। কাব্যগ্রন্থ হলেও গ্রন্থটি গদ্য আর পদ্যের মিশেল। বিয়াত্রিচে কে দর্শন করে কবির মনে যে অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছিল সে সম্বন্ধে কবি ‘লা ভিটা নিউভা’ কাব্যগ্রন্থে যা লিখেছেন আমি তার ভাবানুবাদ করছি মাত্র।

...‘সেই প্রথম দর্শনের পর থেকে আমার স্বাভাবিক উদ্যম বাধাগ্রস্থ হতে থাকে। কারণ, আমার আত্মা সম্পূর্নভাবে সেই স্বর্গীয় মুখোশ্রীর ভাবনায় নিমজ্জ্বিত। সুতরাং আমি জড়োসরো শঙ্কচিত বোধ করি। বন্ধুরা উদ্বিগ্ন হল। যা আমি গোপন রাখতে চাই তা জানতে তারা জানতে নানা পন্থা অবলম্বন করল ।

আর আমি ওদের অভদ্র অজুহাত এড়িয়ে যাই প্রেমের উদ্দীপনার কথা ভেবে ... প্রেমের উদ্দীপনায় বিবেচনা বোধও ছিল। আমার মুখে প্রনয়ের চিহ্ন ছিল। যা লুকোন যায়নি। সুতরাং আমি প্রনয়ের বিষয়ে বলেছি। যখন তারা বলল, কার জন্য এত দহন? ওদের দিকে চেয়ে হেসে চুপ করে রইলাম।

’ ( The effects of Love on him) ...এ যেন শ্রীরাধারই সুপ্ত অভিব্যাক্তি ... শ্রীরাধা ভালোবাসলেন একজনকে আর ঘর করলেন আরেক জনের সঙ্গে। দান্তের ক্ষেত্রে রাধাকৃষ্ণের তুলনাটি যথার্থ। কেননা, বিয়াত্রিচের অন্যত্র বিয়ে হয়েছিল। স্বামী বিশিষ্ট ব্যাংকার সাইমোন দেই বারদি। বিয়াত্রিচেকে জীবনে দুবারের বেশি দেখেননি দান্তে।

প্রথম দেখার পরে আবার মাত্র একবার দেখা হয়েছিল-তাও ৯ বছর পর। তবুও অনুরাগের গভীরতার যেন কোনও শেষ নেই। কি এর ব্যাখ্যা? বহু বছর পর সে ব্যাখ্যা দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ তাঁর একটি গানে । একটুকু ছোঁওয়া লাগে, একটুকু কথা শুনি, তাই দিয়ে মনে মনে রচি মম ফাল্গুনী। ।

কিছু পলাশের নেশা, কিছু বা চাঁপায় মেশা, তাই দিয়ে সুরে সুরে রঙে রসে জাল বুনি। । যেটুকু কাছেতে আসে ক্ষণিকের ফাঁকে ফাঁকে চকিত মনের কোণে স্বপনের ছবি আঁকে। যেটুকু যায় রে দূরে ভাবনা কাঁপায় সুরে, তাই নিয়ে যায় বেলা নূপুরের তাল গুনি। ।

বিয়াত্রিচে বেঁচে নেই। হৃদয়ে গভীর বিরহ। তরুণ কবি পঙতির পর পঙতি রচনা করে মূর্ত করে তুলছেন স্বর্গীয় প্রেয়সীকে। যা হোক। বিয়াত্রিচের মৃত্যুর পর আমরা কবিকে রাজনীতি তে জড়াতে দেখি।

সম্ভবত বিয়াত্রিচের শোক ভুলে যেতে কবি ভিড়ে মিশে যেতে চেয়েছিলেন। (এটি আমার নিজস্ব ব্যাখ্যা) নির্জনতা অসহ্য ঠেকছিল। । প্রখ্যাত বাঙালি সাধক শ্রীচৈতন্যদেবের জীবনেও অনুরূপ পট পরিবর্তন লক্ষ করেছি। প্রিয়তমা স্ত্রী লক্ষ্মীদেবীর মৃত্যুর পর গানের দলে ভিড়ে মিশে গিয়েছিলেন শ্রীচৈতন্যদেবে ।

সংগীতের মাধ্যমে জাতপাত দূর করতে ব্রতী হয়েছিলেন মহামানব। গভীর শোকে দান্তে তেমনি রাজনৈতিক ডামাডোলে স্বেচ্ছায় নিক্ষিপ্ত করেছিলেন। যার পরিনতি মঙ্গলজনক হয়নি। কেননা, Enoch Powell একবার বলেছিলেন, All political careers end in failure ... এবার সেই প্রসঙ্গ। ইতালির মানচিত্র।

একাদশ শতকের শেষার্ধে ইতালিতে পোপ এবং সম্রাটের মধ্যকার দ্বন্দটি প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে উঠছিল। এই অভ্যন্তরীণ দ্বন্ধের ফলে ইতালিতে রাজনৈতিক ঐক্য ছিল না। স্থানীয় প্রশাসন চলত টাউন কাউন্সিলের সদস্যদের নির্দেশে। তৎকালীন ইতালিতে দু’টি রাজনৈতিক দল ছিল। গুয়েলফি দল এবং ঘিবেললিনি দল ।

গুয়েলফি- রা ছিল পোপ- এর সমর্থক এবং ঘিবেললিনি-রা ছিল সম্রাটের অনুগত। দান্তের সমকালীন সময়ে ফ্লোরেন্স নগরের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছিল অত্যন্ত জটিল। ফ্লোরেন্সে ছিল গুয়েলফি দলের প্রভাব । তবে দলটি দু’ভাগে ভাগ হয়ে পড়েছিল। (ক) শ্বেত গুয়েলফি ( এরা ছিল সম্রাট-এর সমর্থক) এবং (খ) কৃষ্ণ গুয়েলফি ( এরা ছিল পোপ-এর সমর্থক) ।

আমাদের কবিটি শ্বেত গুয়েলফি দলের সমর্থক ছিলেন। অবশ্য কবির এই রাজনৈতিক কর্মকান্ড শাপে বর হয়েছিল। রাজনৈতিক জটিল আবর্তে পড়ে কবি নির্বাসিত হয়েছিলেন, নির্বাসিত জীবনে ‘বিশ্ব ডিভাইন কমেডি’ লিখেছিলেন। | Dante Alighieri portrayed by Domenico Michelino holding The Divine Comedy against a backdrop of hell, purgatory and paradise ইতালিতে তৎকালীন পোপ ছিলেন অস্টম বোনিফেস। পোপে র সঙ্গে আলোচনার টেবিলে বসতে দান্তে কূটনৈতিক মিশনের সঙ্গে রোম গিয়েছিলেন ।

আলোচনার ফাঁকে পোপ সমর্থক কৃষ্ণ গুয়েলফি সৈন্যরা ফ্লোরেন্স নগরে প্রবেশ করে এবং নগরটি তছনছ করে। প্রাণহানির আশঙ্কায় দান্তে ফ্লোরেন্স নগরে ফেরার সুযোগ পেলেন না। ১৩০২ খ্রিষ্টাব্দে পোপ অস্টম বোনিফেস সমর্থিত কৃষ্ণ গুয়েলফি দল ফ্লোরেন্সে নতুন সরকার প্রতিষ্ঠিত করে। এরপর ধূর্ত পোপ দান্তের বিরুদ্ধে ঘুষ গ্রহনের অভিযোগ এনে মামলা দায়ের করে। কর্তৃপক্ষ দান্তেকে আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেয়।

কবি এড়িয়ে গেল। মামলার রায়ে বলা হল দান্তেকে গেরেফতার করে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হবে । এই মুহূর্তটিই ‘ডিভাইন কমেডি’-র সৃষ্টি মুহূর্ত। হতবিহবল দান্তে মানুষের ক্ষনিক এবং শাশ্বত নিয়তি সম্বন্ধে ভেবে বিমূঢ় বোধ করেছিলেন। বিনা অপরাধে এবং মিথ্যে মামলায় জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যার করার দন্ডাদেশটি দান্তের মনে গভীর আলোরন তুলেছিল ।

ক্ষণিক জীবনের অসারতা উপলব্দি করেছিলেন। তখন তিনি বিভিন্ন ইতালিয় নগরে নির্বাসিত জীবন কাটাচ্ছেন। কয়েকটি ঘটনায় ফেরারী জীবনে দান্তের মানসিক অবস্থা আমূল বদলে গিয়েছিল। (ক) বিয়াত্রিচে। (খ) বিয়াত্রিচের মৃত্যু।

(গ) পোপ সমর্থক কৃষ্ণ গুয়েলফি সৈন্যরা ফ্লোরেন্স তছনছ করা। (ঘ) বিনা অপরাধে মৃত্যুদন্ড ঘোষনা। এবং (ঙ) নির্বাসিত জীবনের অনিশ্চয়তা । এসব পর্যায়ক্রমিক দূর্ঘটনা দান্তের দৃষ্টিভঙ্গিতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছিল। জীবন-মৃত্যু, ঈশ্বর, পরকাল প্রভৃতি বিষয়ে গভীরভাবে ভাবিত হয়ে পড়েছিলেন ।

‘ডিভাইন কমেডি’ তে যেসব ভাবনা ফুটে উঠেছে। দান্তের এই চমৎকার আত্মমগ্ন ছবিটি এঁকেছেন প্রখ্যাত ইতালিয় শিল্পী জিত্তো (১২৬৬/১৩৩৭) দান্তে ‘ডিভাইন কমেডি’ কাব্যটি ১৩০৮ থেকে ১৩২১ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে নির্বাসিত ফেরার জীবনে রচনা করেছেন । দান্তে কাব্যের নাম রেখেছিলেন La commedia (The Comedy) কারণ স্বর্গে ঈশ্বর দর্শনের মাধ্যমে তাঁর যাত্রা শান্তিপূর্ণভাবে সমাপ্ত হয়েছিল। ১৫৫ খ্রিস্টাব্দের সংস্করণে divina (divine) শব্দটি যুক্ত করা হয়েছিল। কাব্যটি তিনটি ভাগে বিভক্ত।

ইনফার্নো (নরক), পার্গেটেরিও (শুদ্ধিস্থান ) এবং পারাডিসো (স্বর্গ)। দান্তে ইনফার্নো, পার্গেটেরিও এবং পারাডিসো ভ্রমন করছেন । উপকথা, ঐতিহাসিক এবং সমকালীন ব্যাক্তিত্বের সঙ্গে দান্তের দেখা হচ্ছে। প্রতিটি চরিত্রই রাজনৈতিক কিংবা ধর্মীয়ভাবে ক্রটিপূর্ণ কিংবা পূণ্যের প্রতীক। মনে থাকার কথা ... ব্রুনেটো লাতিনি নামে একজন রাজনীতিবিদ এবং পন্ডিত কে অভিভাবক হিসেবে পেলেন দান্তে ।

লাতিনি অবশ্য সমকামী ছিল। এতে দান্তের খ্রিস্টীয় আঁতে ঘা লেগেছিল। দান্তে সম্ভবত লাতিনি কে ঘৃনা করতেন। কেননা, দান্তের ‘ডিভাইন কমেডিতে’ লাতিনি-র স্থান হয়েছিল নরকে! ... ডিভাইন কমেডিতে কারও শাস্তি কিংবা পুরস্কার এদের কৃতকর্মের পিছনে বিশ্বজনীন ইঙ্গিত হিসেবে দেখানো হয়েছে । নরক এবং শুদ্ধিস্থানে দান্তেকে পথ দেখাচ্ছেন রোমান কবি ভার্জিল।

দান্তের চোখে ভার্জিল ছিলেন যুক্তিবোধের প্রতীক। আর বিয়াত্রিচে? বিয়াত্রিচে স্বর্গের প্রতীক। বিয়াত্রিচে স্বর্গে পথ দেখায়। তবে দান্তের এই পরলোক ভ্রমন গভীর অর্থে ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে আত্মার যাত্রা। এ নিবন্ধের প্রারম্ভে বলেছি যে ‘ডিভাইন কমেডি’ তে মৃত্যু পরবর্তী জীবন সম্বন্ধে কাল্পনিক ও রূপকধর্মী মধ্যযুগীয় দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশিত হয়েছে।

ভার্জিল। ( ৭০-১৯ খ্রিস্টপূর্ব) রোমান লাতিন কবি । ভার্জিল ‘এনেইদ’ মহাকাব্যের রচয়িতা। ট্রয়যুদ্ধের পর ট্রয় থেকে এনেইস পালিয়ে এসেছিল ইতালিতে, রোমান সভ্যতার ভিত গড়েছিল। ৬ষ্ট পর্বে রেেয়ছে এনেইস- এর নরক ভ্রমন।

সেখানে এনেইস- এর বাবার সঙ্গে দেখা। এভাবে ভার্জিল দান্তের ডিভাইন কমেডির উৎস হয়ে উঠেছিলেন। দান্তের অধ্যাত্মভাবনায় আরেকজন খ্রিস্টান দার্শনিকের গভীর প্রভাব পড়েছিল । ইনি টমাস অ্যাকুইনাস। টমাস অ্যাকুইনাস।

(১২২৫/১২৭৪ খ্রিস্টাব্দ ) মধ্যযুগের বিশিষ্ট দার্শনিক এবং ধর্মতাত্ত্বিক। ইনি খ্রিস্টীয় ধর্মীয় বিশ্বাসের সঙ্গে গ্রিক দার্শনিক আরিস্টটলের পদ্ধতির সমন্বয় সাধন করতে চেয়েছিলেন। দান্তের ওপর টমাস অ্যাকুইনাস-এর দার্শনিক ভাবনার প্রভাব পড়েছিল । ইতালির বিভিন্ন নগরে নির্বাসিত অবস্থায় কবির জীবনের শেষ দিনগুলি কেটেছিল । ১৩১৬ সালে ফ্লোরেন্স নগরের কর্তৃপক্ষ শর্তাধীনে কবিকে ফ্লোরেন্স নগরে প্রত্যাবর্তনের অনুরোধ করেন ।

কবি শর্ত মেনে নেন নি। ১৩২১ খ্রিস্টাব্দ। ইতালির রাভেন্না শহরে মৃত্যুবরণ করেন। রাভেন্না নগরে কবির কবর। ছবি।

ইন্টারনেট। তথ্যসূত্র: http://www.greatdante.net/ http://www.kirjasto.sci.fi/dante.htm Click This Link Click This Link http://dante.ilt.columbia.edu/comedy/ উৎসর্গ: দন্ডিত পুরুষ। এই লেখাটির জন্য ফেইসবুকে অনুরোধ করেছিলেন।
 

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।