আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

একটিমাত্র ডক্টরেট ডিগ্রির অধিকারী মশিউর রহমান মানব সভ্যতার নতুন সবক দিয়ে দেশবাসীকে চমত্কৃত করেছেন।

good

মশিউর রহমান তার ডক্টরেট ডিগ্রি যে মাত্র একটি, এটি বলার উদ্দেশ্য তাকে কোনোভাবেই খাটো করা নয়। তিনি যার উপদেষ্টা তার ডক্টরেটের সংখ্যা যে ডজনেরও ঊর্ধ্বে, সেই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি জনগণকে স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্যই অর্থ উপদেষ্টার অর্জিত ডক্টরেটের সংখ্যা উল্লেখ করেছি। বাংলাদেশের বুক চিরে ভারতকে করিডোর দেয়ার পক্ষে-বিপক্ষে এ পর্যন্ত কম লেখালেখি হয়নি। এ বিষয়ে আমার অবস্থানও পাঠক মোটামুটি জানেন। স্মরণে আছে, জরুরি আইনের দমবন্ধ করা পরিবেশে থেকেও সেই সময় ট্রানজিটের নামে করিডোর দেয়ার অপচেষ্টার বিরুদ্ধে চট্টগ্রামে গণসেমিনারের আয়োজন করেছিলাম।

সেখানে যে মূল প্রবন্ধটি পঠিত হয়েছিল, সেটা আমারই লেখা। জেলে বন্দি থাকা অবস্থায় প্রকাশিত আমার ‘এক এগারো থেকে ডিজিটাল’ বইয়ে লেখাটি সংকলিত হয়েছে। ওই সেমিনারের মূল বক্তা কবি, কলামিস্ট ফরহাদ মজহার সেদিন আগুনঝরা এক অসাধারণ বক্তৃতা দিয়েছিলেন, সেটাও মনে আছে। চট্টগ্রাম মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে অনুষ্ঠিত সেমিনারে হাজার হাজার শ্রোতার সামনে ফরহাদ ভাই বলেছিলেন, দেশের জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়ে মাঠে না নামলে পার্শ্ববর্তী পরাশক্তির আগ্রাসন রোখা যাবে না। শুধু সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে অংশ নিয়ে কোনো ফায়দা নেই।

। ফরহাদ মজহারের ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেছে। বাংলাদেশের জনগণ মাঠে নামেনি এবং ভারতের ফ্রি ট্রানজিট রোখাও যায়নি। অথচ ওইদিন জনতার স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়ায় উজ্জীবিত বোধ করেছিলাম। জরুরি আইনের বিধি-নিষেধ উপেক্ষা করে চট্টগ্রামের এত মানুষ সেদিন আমাদের বক্তব্য শুনতে এসেছিলেন যে, মুসলিম ইনস্টিটিউটের বাইরেও অসংখ্য শ্রোতার সমাগম হয়েছিল।

গণমানুষের অধিকার রক্ষার এক মহান সংগ্রামের স্বপ্ন দেখেছিলাম। আমার এই ট্রানজিটবিরোধী অবস্থানের ব্যাখ্যা রিমান্ডে টিএফআই সেলের অদেখা সব প্রশ্নকর্তার কাছেও দিতে হয়েছে। সেই দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাখ্যা আজ থাক। আজকের মন্তব্য-প্রতিবেদন ভিন্ন উদ্দেশ্যে লিখতে বসেছি। প্রায় দশ মাস কারাগারে বন্দি জীবন কাটিয়ে মুক্তিলাভের পর ঘটনাচক্রে আজই প্রথম মন্তব্য-প্রতিবেদনটি লিখছি।

ভারতকে ট্রানজিট দেয়া নিয়ে আঞ্চলিক পরাশক্তির দালালগোষ্ঠী আমাদের যেসব স্বপ্ন দেখিয়েছিল, তার উল্লেখ করাই এই লেখার জন্য অধিকতর প্রাসঙ্গিক। এদেশে ট্রানজিটের পক্ষে দীর্ঘদিন ধরে সর্বাধিক প্রচারণা চালিয়েছে সুশীল (?) সংগঠন সিপিডি। তারা জনগণের মস্তিষ্ক ধোলাইয়ের লক্ষ্যে ডোনারদের পয়সায় ঢাকার বিভিন্ন পাঁচতারকা হোটেলে দিনের পর দিন সেমিনার, গোলটেবিলের আয়োজন করেছে। সেসব সেমিনারে যেসব বায়বীয় অঙ্ক দেশবাসীকে বোঝানো হয়েছিল, তার বিশদ বর্ণনা দিয়ে পাঠকদের বিরক্তি উত্পাদন করে লাভ নেই। কেবল সার কথাগুলো উদ্ধৃত করলেই ধাপ্পাবাজির মাত্রা বোঝা যাবে।

তাদের প্রচারণা ছিল নিম্নরূপ। ১. ট্রানজিট দিলে অচিরেই বাংলাদেশ সিঙ্গাপুরের মতো অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি লাভ করবে। ২. বাংলাদেশের জিডিপি ৮০ ভাগ বৃদ্ধি পাবে। ৩. এই খাতে বছরে এক বিলিয়নেরও অধিক বৈদেশিক মুদ্রা আয় হবে। ৪. ভারতের সঙ্গে বিপুল বাণিজ্য ঘাটতি ট্রানজিটের আয় দিয়ে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস করা যাবে।

৫. এটি শুধু ভারতের ট্রানজিট নয়, আমরাও ভারতের মধ্য দিয়ে সার্কের অন্যান্য দেশে যাতায়াত করতে পারব। ৬. আমাদের অবকাঠামোর অভূতপূর্ব উন্নয়ন ঘটবে। ট্রানজিটের পক্ষে প্রচারণা প্রাথমিকভাবে সিপিডি শুরু করলেও পরবর্তী সময়ে তাবত্ ভারতপন্থী এবং সুশীল (?) মিডিয়া, বহুপাক্ষিক অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন—এডিবি, বিশ্বব্যাংক এবং পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলো সদলবলে সেই প্রচারণায় অংশগ্রহণ করে। স্মরণে রাখা দরকার, বহুপাক্ষিক আন্তর্জাতিক অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান এবং পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোতে ভারতীয় লবির অবস্থান শক্তির বিচারে ইহুদি লবির পরেই। আন্তর্জাতিক রাজনীতি সম্পর্কে যারা খোঁজখবর রাখেন তারাই অবগত আছেন যে, পশ্চিমা বিশ্বে নীতিনির্ধারণে এসব লবি যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে থাকে।

ভারতের পদতলে বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থ বিসর্জন দেয়ার নীতি গ্রহণের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। এডিবি প্রধান বাংলাদেশ সফরে এসে ট্রানজিটের পক্ষে ওকালতি করে গেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট থেকে বার বার বলা হয়েছে, ভারতীয় স্বার্থ রক্ষা হলেই কৌশলগত বিবেচনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থও রক্ষিত হবে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী দিল্লি গিয়ে ট্রানজিট চুক্তি সই এবং সেই চুক্তির ভিত্তিতে ট্রানজিট কার্যক্রম বাস্তবায়ন শুরু করার পর আজ তার অর্থ উপদেষ্টা বলছেন, কোনো ফি বা মাশুল পাওয়া তো দূরের কথা, চাওয়াই যাবে না। চাইলে আমরা অসভ্য জাতিতে পরিণত হব। আমার জানতে ইচ্ছে করে, বাংলাদেশের সামরিক এবং বেসামরিক আমলা শ্রেণীর মধ্যে কত শতাংশ ড. মশিউর রহমানের মতো ভারতের কাছে মাথা বিকিয়ে দিয়েছেন।

‘সভ্যতার সংঘাত’ তত্ত্ব-পরবর্তী বিশ্বে দেশের স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রামের কৌশল নির্ধারণে এই তথ্যটি জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ক্ষমতাসীন দলের প্রতিটি ব্যক্তি আমাদের অনবরত ভারতপ্রেমের সবক দিয়ে চলেছেন। তারা বলছেন, গণতন্ত্রের তীর্থস্থান ভারত আমাদের মহান বন্ধুরাষ্ট্র, মুক্তিযুদ্ধকালীন তাদের সহায়তার ঋণ আমরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরেও শোধ করতে পারব না, ইত্যাদি ইত্যাদি। দেশটির শাসকশ্রেণী তাদের জনগণের সঙ্গে কী আচরণ করে থাকে, সেটা জানার জন্য অরুন্ধতি রায় এবং মহাশ্বেতা দেবীর বইপত্র পাঠ করাই যথেষ্ট। তবে সেটি একান্তই তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়।

বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের বন্ধুত্বের নমুনা আমরা অবশ্য প্রায় প্রতিদিন সীমান্তে দেখতে পাচ্ছি। কিশোরী ফেলানীকে যখন খুন করা হয়, আমি তখন গাজীপুর জেলে বন্দি। কারাগারে সরবরাহ করা পত্র-পত্রিকায় ফেলানী হত্যার প্রসঙ্গ থাকলেও তার মৃতদেহের ছবি দেখেছি মুক্তির পর। এর থেকে হৃদয়বিদারক এবং করুণ আর কোনো দৃশ্য হতে পারে, আমি ভাবতেও পারি না। একবার চোখ বুজে কল্পনা করে দেখুন তো, আমার-আপনার শিশুকন্যার গুলিবিদ্ধ লাশ উল্টো হয়ে বাতাসে ঝুলছে সীমান্তে বন্ধুরাষ্ট্র কর্তৃক নির্মিত কাঁটাতারের বেড়ায়।

এমন বর্বরতার পরও বাংলাদেশের বুকের ওপর দিয়ে ফ্রি ট্রানজিটের একশ’ তিরিশ চাকার ভারতীয় ট্রেলারের সারি প্রতিবাদবিহীন চলে গেছে মনে হলে আমি ভেতরে ভেতরে কুঁকড়ে যাই। জাতি হিসেবে এতই ভীরু আমরা? রাষ্ট্রক্ষমতায় যেতে উন্মুখ বিরোধী দলগুলোর কথা না হয় ছেড়েই দিলাম। এদেশে নানারকম নামধারী রক্ষা কমিটিরও তো অভাব নেই। তাদের মধ্য থেকে একজনও কি একটা কালো পতাকা দেখাতে পারলেন না? নাকি রক্ষা কমিটি নামের অন্তরালে অন্য কারও স্বার্থ রক্ষা করা হচ্ছে? ফেলানীর পর সাতক্ষীরা সীমান্তে গত পরশু নিহত হয়েছে পনেরো বছরের বালক রেকাতুল ইসলাম। এই গত মাসেই বর্ডার গার্ডের ডিজি দিল্লি ঘুরে এসেছেন।

সেখানে যৌথ বিবৃতি দেয়া হলো, এখন থেকে আর কোনো বাংলাদেশী নাগরিককে বিএসএফ হত্যা করবে না। আমাদের নাগরিকদের গুলি করার জন্য লাইভ বুলেটের পরিবর্তে তারা রাবার বুলেট ব্যবহার করবে। দিল্লির সেই যৌথ ঘোষণা নিয়ে সুশীল (?) মিডিয়ার সে কী উচ্ছ্বাস! ভারতকে ধন্যবাদ জানিয়ে লিড নিউজ হলো, সম্পাদকীয় লেখা হলো। এই না হলে মুক্তিযুদ্ধের সহায়তাকারী, মহান গণতান্ত্রিক বন্ধুরাষ্ট্র! সেই সুশীলদের (?) জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি, এপ্রিলের আজ কুড়ি তারিখ। এর মধ্যেই বন্ধুরাষ্ট্রের সীমান্ত প্রহরীদের হাতে অন্তত পাঁচজন বাংলাদেশী খুন হয়েছে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন গত সংসদ অধিবেশনে হিসাব দিয়েছেন, তাদের ২৭ মাসের শাসনামলে ১৩৬ জন বাংলাদেশীকে সীমান্তে ভারতীয় বিএসএফ হত্যা করেছে। তাতে মাসে গড় হত্যা দাঁড়ায় পাঁচজন করে। এদেশের বর্ডার গার্ড এবং বন্ধুরাষ্ট্রের বিএসএফের ডিজি পর্যায়ের বৈঠকের পরবর্তী মাসের প্রথম কুড়ি দিনের মধ্যেই বিগত ২৭ মাসের গড় মাসিক হত্যাকাণ্ড স্পর্শ করা হয়েছে। বাকি দশদিনে সীমান্তে ভারতীয় গুলিতে আরও কতজন প্রাণ হারাবে, সেটা আমাদের জানা নেই। তবে যেদিন রেকাতুল খুন হয়েছে, সেই একই দিনে আরও দুই বাংলাদেশীকে বিএসএফ হত্যা করেছে।

অর্থাত্ একদিনে তিন খুন। আঞ্চলিক পরাশক্তির অনুগ্রহভাজন হয়ে ক্ষমতায় আসীন সরকারের কাছ থেকে এই নৃশংসতার কোনো প্রতিবাদ আশা করাটাই মূর্খতা। ফেলানী হত্যাকাণ্ডের এক সপ্তাহ পরে আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জনমতের চাপে পড়ে এক দায়সারা গোছের বিবৃতি প্রদান করতে বাধ্য হয়েছিল। সেই বিবৃতিও ঢাকাস্থ ভারতীয় হাইকমিশনারকে স্বহস্তে দেয়ার মতো সাহস অর্জন করতে পারেননি আমাদের চৌকস পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিজ দীপু মনি। ২০০৮ সালে ফরহাদ মজহার চট্টগ্রামে যে কথাটি বলেছিলেন সেটাই মোদ্দা কথা।

গণপ্রতিরোধ ছাড়া সম্প্রসারণবাদকে আমরা পরাভূত করতে পারব না। আমি এখনও বিশ্বাস করি, এদেশের দেশপ্রেমিক জনগণ যোগ্য নেতৃত্বের কাছ থেকে গণপ্রতিরোধের সেই আহ্বানের প্রতীক্ষাতেই আছেন। ২০১০ সালের ১৬ মে ফারাক্কা দিবসে রাজশাহীর পদ্মার চরে আয়োজিত এক প্রতিবাদ বিক্ষোভে প্রধান অতিথির বক্তব্যে পানি আগ্রাসনের জন্য ভারতের কাছে ক্ষতিপূরণ দাবি করার দুই সপ্তাহের মধ্যে আমি গ্রেফতার হয়েছিলাম। দীর্ঘ দশ মাস জেল খেটে জনগণের প্রতিবাদের মুখে আবার মুক্ত জীবনে ফিরে এসেছি। আজকের লেখায় ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর বর্বর হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানাচ্ছি।

এর সম্ভাব্য বিপদও যে আমি বুঝতে পারি না তা নয়। সেই বিপদ উপেক্ষা করে ড. মশিউর রহমানের কাছে একটি প্রশ্ন রেখে ভারাক্রান্ত মনে শেষ করছি আজকের মন্তব্য-প্রতিবেদন। ট্রানজিটের মাশুল চাওয়া যদি অসভ্যের পরিচায়ক হয়, তাহলে সীমান্তে আমাদের শিশু হত্যাকারীদের পরিচয় কী?

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।