ওয়াহিদ নবী ( কালের কণ্ঠ - ১৯/০৪/২০১১ )---
সিফ্ফিনের যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল ৬৫৭ সালে। এই যুদ্ধে এক পক্ষে ছিলেন খুলাফায়ে রাশেদিনের শেষ খলিফা হজরত আলী (রা.), আর অন্য পক্ষে ছিলেন হজরত মুয়াবিয়া (রা.)। হজরত মুয়াবিয়া (রা.) ছিলেন মুসলিম বিশ্বের সেই সময়কার সবচেয়ে বর্ধিষ্ণু প্রদেশ সিরিয়ার গভর্নর। আমিনী সাহেব একটি ক্ষুদ্র দলের নেতা, যিনি এই প্রথম একটি জাতীয় কর্মকাণ্ড সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সিফ্ফিনের যুদ্ধে যে রণকৌশল হজরত মুয়াবিয়া (রা.) অনুসরণ করেছিলেন, আমিনী সাহেব সেই একই কৌশল অনুসরণ করেন গত ৪ এপ্রিলের হরতালের দিন।
বিষয়টি সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করার আগে আসুন আমরা নিজেদের স্মরণ করিয়ে দিই প্রায় সাড়ে ১৩০০ বছরের ব্যবধানে ঘটা দুটি ঘটনার পটভূমি। আরব দেশে তখন গোত্র ব্যবস্থা (ঞৎরনব) প্রচলিত ছিল। কুরাইশ গোত্রটি ছিল সবচেয়ে বড়। গোত্রগুলোর মধ্যে থাকে বিভিন্ন বংশ (ঈষধহ)। একই গোত্রভুক্ত হলেও একই বংশের লোকদের মধ্যে নৈকট্য থাকত বেশি।
হজরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন বনি হাশেম বংশের। হজরত আলী (রা.) ছিলেন একই বংশের, যিনি রাসূল (সা.)-এর চাচাতো ভাই। হজরত মুয়াবিয়া (রা.) ছিলেন উমাইয়া বংশের। তাঁর চাচা তৃতীয় খলিফা উতমানও (কেউ কেউ ভুল উচ্চারণে তাঁকে উসমান বলে থাকেন) ছিলেন একই বংশের। খলিফা উতমানের বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ করেন অনেকে।
কেউ কেউ মনে করেন, ঘনিষ্ঠ আত্মীয় হওয়ায় উতমান মুয়াবিয়াকে সবচেয়ে বর্ধিষ্ণু প্রদেশ সিরিয়ার গভর্নরের পদটি দান করেন। স্বজনপ্রীতির কারণে খলিফা উতমান আততায়ীর হাতে নিহত হন। উতমানের স্ত্রী খলিফা হজরত আলী (রা.)-এর কাছে তাঁর স্বামী হত্যার বিচার দাবি করেন। হজরত আলী (রা.) বিচার করতে রাজি হন। কিন্তু তাঁর হাতে আরো অনেক সমস্যা থাকায় কিছুটা সময় চান।
এ সময় চাওয়াটাকে গড়িমসি হিসেবে বিবেচনা করে উতমানের স্ত্রী উতমানের রক্তমাখা কাপড় মুয়াবিয়াকে দিয়ে উতমান হত্যার বিচার দাবি করেন। মুয়াবিয়া (রা.) বিচার দাবি করলে হজরত আলী (রা.) তাঁকে একই কথা বলেন, যা তিনি উতমানের স্ত্রীকে বলেছিলেন। মুয়াবিয়া (রা.) উতমানের স্ত্রীর মতো একই উপসংহারে পেঁৗছেন। কিন্তু সমস্যা আরো ছিল।
উতমানের স্বজনপ্রীতির কথা আমরা আগেই উল্লেখ করেছি।
এই অভিযোগের ব্যাপকতার কারণে হজরত আলী (রা.) উতমানের নিয়োগকৃত সবাইকে বরখাস্ত করার সিদ্ধান্ত নেন। এর মধ্যে মুয়াবিয়া অন্যতম। মুয়াবিয়া (রা.) খলিফার আদেশ অমান্য করেন। শেষ পর্যন্ত খলিফা আলী (রা.) মুয়াবিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেন। ফোরাত নদীর তীরে সিফ্ফিন নামক স্থানে দুই দলের সৈন্যদের মধ্যে প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়।
উভয় পক্ষের বিপুলসংখ্যক সৈন্য হতাহত হলে দুই পক্ষের নেতারা চিন্তিত হয়ে পড়েন। বাইজান্টাইন সম্রাট মুসলমানদের গৃহযুদ্ধের সুযোগ নিতে পারেন। এসব নেতা আলোচনার মাধ্যমে একটা আপসরফার কথা ভাবেন। কিন্তু আলোচনায় কোনো অগ্রগতি হয়নি। এরপর তাঁরা মুয়াবিয়া (রা.) ও হজরত আলী (রা.)-এর মধ্যে একক যুদ্ধের কথা বলেন।
মুয়াবিয়ার বয়স তখন ৫৫ বছর। হজরত আলী (রা.)-এর বয়স আরো বেশি হলেও তিনি যোদ্ধা হিসেবে দক্ষ ছিলেন। সব দিক বিবেচনা করে মুয়াবিয়া (রা.) একক যুদ্ধে অংশগ্রহণে অস্বীকৃতি জানান। এমতাবস্থায় তিনি যে কৌশল গ্রহণ করেন, তাকে এক কথায় ঘৃণ্য বলা যেতে পারে। তিনি তাঁর সৈন্যদের বর্শা ও তলোয়ারের সঙ্গে পবিত্র কোরআনের পৃষ্ঠা গেঁথে যুদ্ধে পাঠিয়ে দেন।
এই অন্যায় কৌশলের পরিণতি হয় অত্যন্ত বিয়োগান্ত। হজরত আলী (রা.)-এর সৈন্যদের অনেকে যুদ্ধ করতে অস্বীকার করে বসেন। মুয়াবিয়ার ঘৃণ্য কৌশলের কথা ব্যাখ্যা করেও কোনো লাভ হয় না। বাধ্য হয়ে হজরত আলী (রা.) মুয়াবিয়ার সঙ্গে আপস করেন। আপসের কোনো সুনির্দিষ্ট শর্ত না থাকায় প্রকৃতপক্ষে মুসলিম বিশ্ব দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়।
শিয়া-সুনি্ন লড়াই এখনো চলছে। হজরত আলী (রা.)-এর জন্য সিফ্ফিন যুদ্ধের পরিণতি হয় আরো দুঃখজনক। একদল উগ্রপন্থী সমর্থক, যাদের খারেজিপন্থী বলা হয়, তারা মুয়াবিয়ার সঙ্গে আপস করাটা মোটেই উচিত হয়নি বলে মনে করে এবং এই আপসের জন্য হজরত আলীকে হত্যা করে। উগ্র সমর্থকরা যে শত্রুর চেয়েও খারাপ, খারেজিপন্থীরা তা প্রমাণ করল। এরপর মুয়াবিয়া তাঁর ক্ষমতা কুক্ষিগত করলেন।
রাসুল (সা.)-এর জ্যেষ্ঠ দৌহিত্র ইমাম হাসান (রা.)-কে প্রথমে নীরব করে পরে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হলো। নিজ সন্তান ইয়াজিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করলেন মুয়াবিয়া। প্রতিবাদ করে নিহত হলেন রাসুল (সা.)-এর কনিষ্ঠ দৌহিত্র ইমাম হোসেন (রা.)। এমনিভাবে ইসলামের আদর্শের পরিপন্থী বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্র সৃষ্টি করলেন মুয়াবিয়া, যার নাম উমাইয়া রাজবংশ।
গণতন্ত্রে হরতালের অধিকার অবশ্যই আছে।
তবে তা চরম পরিস্থিতিতে। হরতালে জান-মালের চরম ক্ষতি হয়। বলা হয়ে থাকে, বাংলাদেশের এক দিনের হরতালে তিন হাজার কোটি থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত ক্ষতি হয়। এই বিশাল ক্ষতি আমাদের মতো একটি দরিদ্র দেশের পক্ষে অপূরণীয়। কাজেই হরতাল আহ্বান করার আগে এগুলো ভেবে দেখতে হবে হরতাল আহ্বানকারীদের।
বিএনপির আহ্বানে হরতালগুলো খুব একটা সফল হয়নি। জনগণ সাড়া দেয়নি। শুধু ভাংচুর আর নিষ্ঠুরতা হয়েছে। বুদ্ধি করে তাই বিএনপি-জামায়াত আমিনী সাহেবকে হরতাল করার দায়িত্ব দিয়েছে। জাতীয় নেতা হিসেবে পরিচিত হওয়ার এই মহাসুযোগ আমিনী সাহেব লুফে নিয়েছেন।
তিনটি ইস্যুর ওপর তিনি হরতাল ডেকেছিলেন_১. নারী উন্নয়নের সরকারি পরিকল্পনার বিরোধিতা, ২. মাদ্রাসা শিক্ষার আধুনিকীকরণের বিরোধিতা, ৩. হাইকোর্টের ফতোয়াবিরোধী রায়ের বিরোধিতা। এসব বিষয়ে পত্রপত্রিকায় অনেক আলোচনা হয়েছে। বাংলাদেশে নারীরা সামাজিক দিক দিয়ে বঞ্চিত। কিছুদিন ধরে নির্যাতিত। রাস্তাঘাটে তাঁরা নির্যাতিত হচ্ছেন দিনদুপুরে।
ফলে অনেকে আত্মহননের পথ বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছেন। যৌতুকের বলি হচ্ছেন অনেক মহিলা। এসিড নিক্ষেপের শিকার হচ্ছেন অসহায় নারীরা। কিন্তু আমিনী সাহেব এবং তাঁর বন্ধুরা নীরব।
মাদ্রাসা শিক্ষা কি আধুনিকতার মুখ দেখবে না? মাদ্রাসার প্রাক্তন ছাত্ররা কি অন্যদের সঙ্গে চাকরি এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা করবে না? তারা কি শুধু অতীতমুখী শিক্ষা নিয়ে চিরদিন আমিনী সাহেবদের হুকুম পালনকারী হয়েই থাকবে? আসলে ফতোয়া ও দোররা বলতে কী বোঝায়, আমিনী সাহেবরা তা জনগণকে বুঝিয়েছেন কি? আমি আমিনী সাহেবদের অনুরোধ করব, গত ৬ ফেব্রুয়ারি কালের কণ্ঠে প্রকাশিত 'নূরজাহান থেকে হেনা' প্রবন্ধটি পড়তে।
ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে যাঁরা বিশেষজ্ঞ, শুধু তাঁরাই ফতোয়া দিতে পারেন। যাদের ফতোয়ার কারণে নূরজাহান বা হেনার মতো অসহায় নারীকে অকাল মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে হয়েছে, তারা কি ইসলাম ধর্মের বিশেষজ্ঞ? আমরা কি মধ্যযুগ পেরিয়ে একবিংশ শতাব্দীতে পা দিইনি? সরকারের নিয়োগকৃত আইন জানা বিচারক ছাড়া অন্য কেউ বিচারের দায়িত্ব নিলে জাতি যে ভয়াবহ পরিণতির সম্মুখীন হবে, এ কথা কি আমিনী সাহেব কিংবা তাঁর বন্ধুরা ভেবে দেখেছেন?
হরতালের দিন পুলিশের কাছ থেকে রাইফেল কেড়ে নেওয়া হয়েছে। ৮ এপ্রিলের কালের কণ্ঠে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে (আমিনীর হরতাল কী ইঙ্গিত বহন করছে) উল্লেখ করা হয়েছে, দলের লোকদের এগুলো শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। এগুলো গণতন্ত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। কোরআনের পৃষ্ঠা নিজ স্বার্থে ব্যবহার করে মুয়াবিয়া ইসলামের অপূরণীয় ক্ষতি করে গেছেন।
হরতাল জনগণ পছন্দ করে না। যে তিনটি কারণে আমিনী সাহেবরা হরতাল ডেকেছিলেন, সেগুলোর প্রতি যে জনসমর্থন নেই, এ কথা আমিনী সাহেবরা জানতেন। বিএনপি-জামায়াতিরাও জানতেন এসব কথা। তাই তাঁরা আড়ালে থাকার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু জনগণ অতটা বোকা নয়।
কোরআনের অবমাননা করে যাঁরা রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে চান, তাঁদের শুধু অপছন্দ করলেই চলবে না, প্রতিহতও করতে হবে।
লেখক : লন্ডন প্রবাসী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।