আমরা ছিলাম দশজন-তড়িৎ,যন্ত্র ও পুরকৌশলের কয়েকজন ডাকসাইটে(!!!) ছাত্র। ঢাকা শহরে বাঁন্দরামি করে আর পোষাচ্ছিলনা দেখে ঠিক করলাম বান্দরবানে গিয়ে (বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় জেলায়) উপদ্রব চালাবো। রাতকে ভোর করে, ভোরের নরম আলোকে মধ্যাহ্নের ঝাঁঝালো রোদে পুড়িয়ে যখন বগালেক পৌঁছাই, তখন সবেমাত্র শুরু হয়েছে সবুজ পানির জমিনে কনে দেখা আলোর নাচন। দীর্ঘ ষোল ঘন্টার ভ্রমণে উঁচু-নিচু রাস্তার ঝাঁকাঝাঁকনিতে ছাতু হয়ে যাওয়া আমাদের কোমরেও দোলা দিয়েছিল সেই আলোর খেলা। বগালেক- সেই পাহাড়ঘেরা হ্রদের কথাই বলছি, পলিভরা প্রায় সমতল এই ব-দ্বীপে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১২০০ ফুট উঁচুতে অবস্থিত সুবিশাল যে জলাধার বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পে যোগ করেছে নতুন মাত্রা।
পর্যটকদের অভ্যর্থনা জানানোর জন্য সেখানে হয়তো নেই আলিশান পাঁচতারার কোমল কার্পেট অথবা লাস্যময়ী ‘রিসিপসনিস্ট’, কিন্তু আছে একেবারে মাটির কাছাকাছি বাস করা কিছু জনগোষ্ঠি, আদিবাসী নামটাই যাদের পরিচয় সঠিকভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারে (অবশ্যই উপজাতি নয়,কারণ আমারা সবাই বাংলাদেশী)। দেখা হলে মুখে একগাল হাসি নিয়ে যারা আপনাকে জিজ্ঞেস করবে – “বাইয়ারা কোত্তেকে আসচেন?” বাঙালির অনন্য বৈশিষ্ট্য - আদি ও অকৃত্রিম আথিতেয়তা এখানে আপনি পাবেন অফুরন্ত। বিনিময়ে যে টাকার অঙ্কটা গুনতে হয় সেটা প্রকৃতপক্ষে হিসেবেই আসা উচিত নয়, যখন পশ্চিমা স্যুটেড-বুটেড ওয়েটারদের নকল হাসির সাথে পরিবেশিত উচ্চমুল্যের চিকেনফ্রাইয়ের বদলে এরা আপনার পাতে জোর করে উঠিয়ে দেবে ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত, যত চান তত !!!
লারাম রেস্ট হাউসের একটি বাংলোয় আমাদের জায়গা মিললো। পাহাড়ের ঢালে মাচার সমতলে সেই বাংলোর একটি মজার বৈশিষ্ট্য ছিলো এর কাঠের মেঝের ফাঁক- জরুরি প্রয়োজনে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে যেটা বেশ কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছিল। আর তখন ছিলো ঋতুবদলের দিন, প্রকৃতি ব্যস্ত ছিলো বসন্তের জন্য ঘর গোছাতে, থেকে থেকে শীত দিচ্ছিল মরণকামড়।
পিঠ গোঁজার ঠাই হিসেবে বাঁশ-কাঠের বাঙলো চললেও হাঁড় কাপানো শীতের মামলায় সেগুলো ছিলো নিতান্তই ৩০২ ধারার আসামি। বিশেষ করে শেষ রাতে যখন সারাদিনের বোঝাসম গরম কাপড়ের স্তুপটি আমাদের নব-পরিণীতা বধূর মত জড়িয়ে ধরতে হয়েছিল একফোঁটা ‘ওম’ এর আশায়।
ঝটপট ব্যাগ রেখেই নেমে পড়লাম বগালেক দেখতে। অসাধারণ ‘ভিউ’ পেয়ে আমাদের কখনো ঘুমকাতর, কখনো হই-হুল্লোড়ে সুর মুখর দলটির কেউ কেউ মেতে উঠলো ফটোসেশনে। আর আমরা রোমাঞ্চপ্রিয় কয়েকজন দিগন্তবিস্তৃত আয়নায় সবুজ পাহাড়ের ছায়া আর তার কোলে ঢলে পড়া ঘর্মাক্ত সূর্যদেবের স্নান দেখে শীত অগ্রাহ্য করে ঝাঁপিয়ে পড়লাম স্ফটিক স্বচ্ছ পানিতে, আড়চোখে ছিলো স্বল্পবসনা পাহাড়ী তরুণীদের জলকেলি।
চিৎকার করে বললাম “আমি আর কোথাও যাবনা। ” যথারীতি হৃদয়ের গহীনে আবেগের এই অকস্মাৎ বিস্ফোরণ আমার কন্ঠ পর্যন্ত পৌঁছায়নি।
সন্ধ্যা নামতেই আলো-আধাঁরির খেলায় শুরু হয়ে গেল নানান ঢংয়ে, বিচিত্র ভংগিমায় ‘টর্চলাইট ফটোগ্রাফি’। কেউ সাজলো জ্বিনের বাদশাহ, কেউ হলো রক্তচোষা আর সুযোগের অভাবে কেউ বনে গেল উদাস দেবদাস। রেস্ট হাউসের রসুইঘর থেকে যখন ডাক এলো বনমোরগের সালুন আর ‘ধাইন্যা’ মরিচ দিয়ে ভাত খাওয়ার, তখন আমাদের কাঁধে ছিলো ‘লোকাল স্পেশাল আইটেম’ গুলো চেখে দেখার সুকঠিন দায়িত্ব।
বলাই বাহুল্য, উপরমহলের অনুমতি ব্যতিত এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানানো এই ‘চুনোপুঁটি’ লেখকের পক্ষে সম্ভব নয়। অবশেষে মধ্যরাতে ধরা দিলাম নরম তোষকের ফাঁদে, আর ঘুমে ব্যাঘাত ঘটানোর দায়ে বাইরে হেঁড়ে গলায় সঙ্গীতচর্চারত আরেক অভিযাত্রী দলের দিকে ছুঁড়ে দিলাম বহুল প্রচলিত কিছু উপাধি, কানে আঙ্গুল না দিলে যেগুলো ঠিকমতো শোনা যায়না! তখনো আসলে ঠিক জানতাম না কিভাবে ঘুমাতে যাওয়ার সময়ে (ভোর পাঁচটা!) ঘুম থেকে উঠে পিঠে দশমণি বোঝা চাপিয়ে ঠান্ডার চাদরে নাক-চোখ মুড়ে রওনা দেব কেওকারাডংয়ের উদ্দেশ্যে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।