(২০০২ সালে ভারতের গুজরাটে সবরমতি ট্রেনে আগুন ধরিয়ে দেয়ার কথা করো বিস্মৃত হবার কথা নয়। আমারতো নয়ই। কেননা সে সময় আমি কলকাতায় অবস্থান করছিলাম। ফাঁকে একদিন আড্ডা দেবার জন্য আনন্দবাজার পত্রিকায় যাই বিখ্যাত ঔপন্যাসিক আবুল বাশার-এর কাছে। সেদিন তিনি আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন রবীন্দ্র সদনে।
সেখানে সন্তোষ সভা নামে একটি হলে স¤প্রীতির পক্ষে সভা। তিনি ওই অনুষ্ঠানের প্রধান বক্তা। আমি দর্শক হিসেবে বসলাম সবার সাথে। অনুষ্ঠান শুরু হবার কিছু সময় পর তিনি নিজেই মঞ্চে উঠে বললেন, গুজরাটের এ ঘটনা বাংলাদেশে কেমন প্রভাব ফেলেছে তা আমরা জানতে পারি বাংলাদেশ থেকে আগত একজন তরুণ লেখেকের কাছে। ’ বলেই তিনি ডাক দিলেন আমার নাম ধরে।
আমি তো যারপর নাই বিব্রতকর অবস্থায় মঞ্চে উঠে বললাম কয়েক মিনিট। অনুষ্ঠান শেষে আবুল বাশার কে বলালাম, ’আমি আপনার একটি সাক্ষাৎকার করতে চাই। এক কথাই তিনি রাজি হন এবং বলেন বসাটা যদি ওনার বাসায় হয় তাহলে বেশ ভালো হয়। আড্ডা দিতে দিতে কথা বলা যাবে। তাই হলো।
আমি পরদিন তাঁর নির্দেশনা মত শিয়ালদা থেকে ট্রেনে চেপে চলে যাই চল্লিশ মিনিটের রাস্তা নিশ্চিন্তপুরে। বাড়ি খুঁজে পেতে তেমন কষ্ট হয়নি। যাবার পর তিনি বললেন, দেখো যে পরিস্থিতিতে এখন আমরা রয়েছি, তাতে করে সাহিত্য বিষয়ে কথা না বলে বরং আমি রাজনীতি বিষয়ে কথা বলি। তোমাকে পরবর্তী সাক্ষাৎকারটি আমি সাহিত্য বিষয়ে দেবো। তা-ই হলো।
শুরু করলাম কথা। সে কথা থেকেই তৈরী করা নীচের সাক্ষাৎকারটি। যেটি বাংলাদেশে আনার পর শীর্ষ একটি দৈনিক যেটি এখন সবচেয়ে বেশি পাঠক তার বলে দাবি করে, সে পত্রিকা ভীত হয়ে সাক্ষাৎকারটি ছাপেন নি। পরবর্তীতে একই প্রকাশনা সংস্থার একটি সাপ্তাহিক-এ দেয়া হয় একজনের আগ্রহ থেকে। কিন্তু সম্পাদক একইভাবে সাক্ষাৎকারটি ছাপেননি।
পরবর্তীতে এটি ছাপা হয় ’সাপ্তাহিক খবরের কাগজ’ এর ৬ মে ২০০২ সংখ্যায়। ছাপা হবার পর তুমুল আলোচনা তৈরী করে সাক্ষাৎকারটি। পরবর্তীতে ’পথিক’ নামে একটি ছোট কাগজেও এটি ছাপা হয়। এবার বাংলাদেশে গিয়ে আমার সীতাকুণ্ডের গ্রামের বাড়িতে এটি খুঁজে পেলাম। আবার পাঠের পর মনে হলো এর আবেদন চিরন্তন।
তাই পাঠকদের জন্য আবার পত্রস্ত করলাম)
সাপ্তাহিক খবরের কাগজ ৬ মে ২০০২: বাংলা সাহিত্যের শক্তিমান কথাশিল্পী আবুল বাশার। জন্ম ভারতে। শিক্ষকতা দিয়ে কর্মজীবন শুরু করলেও একসময় চাকুরী ছেড়ে বামপন্থী রাজনীতিতে সক্রিয় হন। লিখেছেন একাধিক গ্রন্থ। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে মরুভাস্কর, ফুলবউ, সুরের সাম্পান, স্পর্শের বাইরে সিমার ও অগ্নি বলাকা।
ফুলবউ উপন্যাসের জন্য পেয়েছেন আনন্দ পুরুষ্কার। বর্তমানে কলকাতার দেশ পত্রিকায় কর্মরত। তিনি ভারতের সা¤প্রতিক রাজনীতির আদ্যপান্ত নিয়ে বলেছেন খোলামেলা কথা। তাঁর সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন মিলটন রহমান।
পূর্ব প্রকাশের পর-
মিলটন রাহমান: প্রত্যেকটি ধর্মতো শান্তির কথা বলে, মানবতার কথা বলে।
তাহলে সে ধর্ম কেন দাঙ্গার কথা বলে?
আবুল বাশার: যখন মানুষ আমাকে ধর্মের কথা বলে, তখন আমি বলি, ধর্মশাস্ত্রগুলো যেরকম আদর্শ মানুষের কথা বলেছিল, তেমন মানুষ খুব বিরল। অর্থাৎ প্রকৃত ধার্মীকের সংখ্যা অত্যন্ত কম। ইসলাম ধর্মে একটি অদ্ভুদ নির্দেশ আছে যে, পাশের বাড়ির মানুষ যদি উপবাস থাকে, তাহলে তোমার কোনও উপাসনা কাজে লাগবে না। চোখের সামনে উপবাস থাকতে দেখেও যে মানুষ বিচলিত হয় না সে প্রকৃত ধার্মীক নয়। ধর্মের তো ভালো দিকগুলো ছিলো, সেগুলোতো মানুষ নেয়নি! বরং ধর্মকে ভাঙিয়ে ভাঙিয়ে বারবার এ রক্তপাত হয়েছে।
হয়েছে ধর্মের সাথে জুলুম, অত্যাচার। ধর্ম মানুষকে অনেকখানিই ছিন্নমূল করেছে। যেমন বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের ধর্মের নামে ছিন্নমূল করা সহজ হয়ে উঠেছে এক শ্রেণীর মানুষের কাছে। এক শ্রেণীর তথাকথিত ধার্মীকদের কাছে। ধার্মিক কি গুন্ডা? মানুষ কী সে কথাও বোঝে না যে, ধার্মিক কখনো গুন্ডা হতে পারে না? সে কখনো অন্যের বুকে ছুরি বসাতে পারে না! অন্যের উপাসনালয় কিংবা বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করতে কিংবা ভেঙে দিতে পারে না! ধার্মিক কখনো ধর্ষক হয় না।
ধার্মিক আর ধর্ষক কী এক লোক? তাহলে এ পরিস্থিতি দেখার পরও এত কিসের উন্মাদনা! সে উন্মাদনা হচ্ছে আসলে সা¤প্রদায়িক বিদ্বেষ। ধার্মিক কখনো বিদ্বিষ্ট হয় না। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে এ সমস্ত ঘটনাই হচ্ছে রাজনৈতিক কূট ষড়যন্ত্র। মানবতার বিরুদ্ধে, মনুষত্বের বিরুদ্ধে। এগুলো এ উপমহাদেশে যেমন-ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশে একইভাবে চলছে।
এর হাত থেকে মুক্তি পাবার একমাত্র উপায়, ধর্মনিরপেক্ষতার যে কথা আমি বললাম এতক্ষণ ধরে তার একটি সামাজিক অনুশীলন দরকার। ব্যক্তিগত স্তরে অত্যন্ত নিভৃত আত্মিক সংকট থেকে মুক্তি পাবার জন্য মানুষ যদি ধর্ম প্রচার করে তো করুক। আপত্তির কিছুই নেই। কিন্তু কোনোভাবেই সামাজিক কাজকর্ম এবং রাষ্ট্রীয় কাজকর্ম কখনোই ধার্মিক নেতৃত্বে চলবে না। এমনকি নাস্তিক যে, যে ঈশ্বরে বিশ্বাস করে না; সে নাস্তিককে ধার্মিকের উচিত হবে শ্রদ্ধা জানানো।
যেমন নাস্তিক একজন প্রকৃত ধার্মিককে শ্রদ্ধা করবে; একজন ধার্মিক একইভাবে প্রকৃত নাস্তিককেও সম্মান শ্রদ্ধা করবে। কারণ নাস্তিকের পরলোকে কী হবে তার জন্য খোদা চিন্তা করছে। একজন ধার্মিকের সে কথা চিন্তা করার নয়। কে বেহেস্তে যাবে, কে দোজখে যাবে তা খোদা ছাড়া কেউ জানে না। যাকে তুমি দু’মুঠো অন্ন দিতে পারো না-তাকে বেহেস্তে পাঠানোর জন্য এত দুঃশ্চিন্তা কেন তোমার? গা থেকে জামা দিতে পারো না-আর একটা লোককে বেহেস্তে পাঠাতে চাও তুমি? পাছে সে দোজখে চলে যায় তার জন্য এত উদ্বেগ? এই যে ভন্ডামি-নিজের সঙ্গে নিজের অদ্ভুদ প্রতারণা-ভাবের ঘরেই যে চুরি- এ-ই শয়তান।
এ ব্যাপারগুলো বুঝতে হবে লোকদের। সাধারণ মানুষকে বুঝতে হবে, যে লোক সামান্য দান করে না-তার কাছ থেকে আমি ধর্মশিক্ষা নেব কেন? যে সমাজের সামান্য উপকার করে না, তার কাছ থেকে আমি ধর্ম শিক্ষা নেব কেনো?
যে লোকটা নিজেই প্রায় ভিখেরি-যে অন্যের বাড়িতে খেয়ে বেড়ায় এবং ধর্ম চর্চা করে সে লোকটা কতদূর ধর্মশিক্ষা দিতে পারে, সন্দেহ আছে। অধিকাংশ মক্তবী শিক্ষার ফলে যে সমস্ত মৌলানা, হাফেজ,ক্বারী তৈরী হয় তারা বেশির ভাগ পেট চালায় অন্যের দয়ায়। এই যে মানুষ-যে নিজের পেটের খোরাক জোগাড় করেছে ধর্মের নামে-আল্লার নামে যিকির করে যে অন্নের যোগাড় যোগাড় করে, সে তো হতভাগ্য, সে তো পরিশ্রম থেকে অন্ন যোগাড় করে না। তার কাছ থেকে কেন আমি ধর্মশিক্ষা আমি নেব? যে নিজেই স্ববলম্বি নয়।
ভিখেরী মানুষের কাছে আল্লার নামে ভিক্ষা চায়-আর সেই একই কথা আল্লার নামে কোরানের কয়েকটি আয়াত আওড়ে সেও কিন্তু পেটের খাবার যোগাড় করছে। এই মানুষকে ভিখেরী বলার নিয়ম নেই কেন? সেওতো এক ধরণের ভিখেরী। এসব মানুষের কাছ থেকে ধর্মশিক্ষা হয় বলেই-একটি ধর্মান্ধ সমাজের সৃষ্টি হয়। এই হচ্ছে ধর্ম, সা¤প্রদায়িকতা ইত্যাদি সম্পর্কে আমার বক্তব্য। এগুলো আমি এখন চিন্তা করছি।
আমি ষ্পষ্ট বলতে চাই-প্রকৃত ধার্মিক খুব বিরল। প্রকৃত নাস্তিকও খুব বিরল। কিছুটা ধার্মিক কিছুটা নাস্তিক এ ধরনের লোক প্রচুর। ধর্মকে ব্যবহার করে মানুষ আখের গোছায় এবং মসনদে বসে। এরা হচ্ছে প্রকৃত শয়তান।
এই শয়তানদের হাতে আজ পাকিস্তান, ভারত এবং বাংলাদেশ বিপন্ন। একদিন ধর্মের নামেই দেশ ভাগ করেছিল। আবার ধর্মের নামে আজ মানুষের ওপর অত্যাচার করছে। বাংলাদেশে সংখ্যা লঘুর ওপর অত্যাচার-ভারতেও সংখ্যা লঘুর ওপর অত্যাচার। যেহেতু সংখ্যায় তারা কম-যেহেতু তারা দূর্বল ও অনগ্রসর-তাই তাদের ওপর অত্যাচার করছে।
অত্যাচার করে এক ধরণের উল্লাসবোধ করছে। একজন দুর্বলকে অত্যাচার করার পর যে উল্লাসবোধ করে-তাকে আমাকে ধার্মিক বলতে হবে? তার ধর্মকে বিশ্বাস করতে হবে? সেতো আমি পারবো না।
এমন একটি বিপন্ন সময়ে তুমি এসেছ-তোমার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে-এ নিয়ে অনেক কথা বলা যায়। আমি সামান্যই বললাম।
মিলটন রহমান: সাহিত্যে আপনি এ বিষয়গুলো কিভাবে তুলে ধরেছেন?
আবুল বাশার: আমি সাহিত্যে এই ধর্ম ব্যপারটা কেমন করে উপস্থিত করেছি, ধর্মীয় সমস্যা সমূহকে, সা¤প্রদায়িকতার সমস্যাকে সেগুলোর আলোচনা আজকে করা গেলো না।
আমার পাঠক যারা আছে, তারা পড়ে নেবে। যেমন ’সুরের সম্পান’ উপন্যাসটি পড়লে বুঝতে পারবে, আমি কিভাবে স¤প্রতিকে-যাকে ’ক্ল্য্যসিকাল মিউজিক’ বলে, তার ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে আমি সেটাকে তুলে ধরেছিলাম। এছাড়া ব্রাত্যজীবন নিয়ে আমার ’স্পর্শের বাইরে’, ’জলমাটি আগুনের উপাখ্যান’ এবং ’পবিত্র অসুখ’ এগুলোতে প্রান্তিক জীবনের কাহিনী, তাদের মানসিক, সামাজিক সংকটের কথা আছে। আমি জানি আমার বাংলাদেশের পাঠকেরা পড়েন এগুলো এবং তারা আমাকে ভালোবাসে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।