আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আকাশলীনা-১০ [ভিন্ন আয়োজনে অন্য সাময়িকী]

আকাশলীনা] মুক্ত প্রাণ, স্বপ্নের সোপান

আকাশলীনা বৈশাখ ১৪১৮] এপ্রিল ২০১১] সংখ্যা ১০] বর্ষ ০১] ---------------------------------------------------------------------------- পাঠ-পূর্বক বিজ্ঞপ্তি] আকাশলীনা- মূলত এটি একটি ছোট পত্রিকা; প্রতি বাংলা মাসের প্রথম সপ্তাহে মুদ্রণ কাগজে প্রকাশিত হয়। বলা যেতে পারে, সাদা-কালোয় প্রকাশিত এটি আমাদের রঙিন এক স্বপ্নের গল্প! এখানে মূল পত্রিকার বর্তমান সংখ্যাটি অনলাইন পাঠকদের জন্য সরবারাহ করা হয়েছে। ভালোলাগা-মন্দলাগা বিষয়ে যে কেউই মন্তব্য করতে পারেন... পত্রিকাটির মুদ্রিত কপি নিয়মিত পেতে চাইলে; ফোন নম্বরসহ আপনিও ঠিকানা লিখে জানান। আমাদের সম্পাদনা পরিচিতি এবং সরাসরি যোগাযোগ করার ঠিকানা এই লেখার নিচে উল্লেখ আছে। সকলকে ধন্যবাদ।

-সম্পাদক, আকাশলীনা ---------------------------------------------------------------------------- মূল পত্রিকা এখান থেকে শুরু- ---------------------------------------------------------------------------- সম্পাদকীয়] দেখতে দেখতে আরো একটা বছর পার করে, নতুন সময়ে দাঁড়িয়ে আজ আমরা। একটা বছরে কি হয়? এই মামুলি প্রশ্নের একটা অসাধারণ জবাব হতে পারে- এক বছরে কী হয় না? ...আবার মজার উত্তরও আছে- এক বছরের মধ্যে কখনো দুই বছর পার হয় না! হ্যাঁ, বিষয়টাকে এতোক্ষণ কৌতুক মনে হতে পারে। এক বছরের মধ্যে যেমন দুই বছর পার হতে পারে না; তেমনি, এই এক বছরে আমাদের জীবনে অনেক প্রাপ্তির পাশাপাশি, অপ্রাপ্তিও আছে নিশ্চয়? অপ্রাপ্তিগুলো ভুলে যান; প্রাপ্তির আনন্দ নিয়ে তৃপ্তির একটা ঢেকুর তুলুন- দেখবেন, এই এক বছরের অনেক হতাশা মুছে গেছে! এবার আগামীর সীমানায় চোখ রেখে, আবার নতুন করে পথ চলুন... স্বপ্ন-সাফল্য ধরা দিবেই। জীবনের জয় হোক; বেঁচে থাকুক বন্ধুতা! সবার জন্য আবারো শুভেচ্ছা- শুভ নববর্ষ! ---------------------------------------------------------------------------- নববর্ষ] এলো রে এলো, বৈশাখ এলো চৌধুরী আফতাবুল ইসলাম সময়, প্রকৃতি, ঐতিহ্য- কী করে যেনো ছুঁয়ে থাকে জীবনকে, এক অতি আশ্চর্য্য। তা না হলে চারপাশে বিশ্বায়নের দাপটে পৃথিবী যখন এক পরিবার- সেই তুমুল হুল্লোড়ের মধ্যেও নিজস্ব উৎসবের এমন নিপাট আয়োজন? যে উৎসবের উচ্ছ্বাসে, স্বতঃস্ফূর্ততায়, রঙে-সুরে সমৃদ্ধ সকাল-দুপুর-বিকেল, সারাবেলা।

তারমানে, যতোই ব্যস্ততা ঘিরে রাখুক আমাদের দশদিগন্ত, যতোই প্রলুব্ধ করুক বিশ্বায়নের আহ্বান, মনের গহিনে নিরন্তর বহমান রহস্যমাখা ধানসিঁড়ির সেই চোরা স্রোত। যেনো- এই গাঙুরের ঢেউয়ের আঘ্রাণ লেগে থাকে চোখে-মুখে-/ রূপসী বাংলা যেনো বুকের ওপর জেগে থাকে... সে জন্যই তো নির্ভেজাল প্রাণের টানে একান্ত নিজস্বতায় প্রতি ঘরে ঘরে উৎসবের এই পরিপাটি আয়োজন। নববর্ষ মানে নিরন্তর বয়ে চলা সময়ের গতিপথে পলকের যতিচিহ্ন। আবার শুরু যাত্রা। নবযাত্রা।

আর নতুন যাত্রা শুরুর এই দিনটিই বাঙালির জাতি দর্শনের একমাত্র সর্বজনীন ঠিকানা। এই যে প্রাণের টান, বাঙালিয়ানার পরিপূর্ণ নিজস্বতাকে এমন আলিঙ্গন; এই কৃষ্টি, এই সংস্কৃতি, জাতি হিসেবে আমাদের অবশ্যই গর্বিত করে। আপন ঐতিহ্যের প্রতি এমন নিমগ্নতা, নিঃশর্ত ভালোবাসায় নিঃসৃত আবেগ আর প্রগাঢ় মন্থনেই শুধু সৃষ্টি হতে পারে এমন কীর্তি। আর সেই কীর্তির অনুপম রূপকার বাঙালি জাতি। নববর্ষ মানে নিজস্বতার সন্ধান।

জীবনকে সাজানো আপন ঐতিহ্যে। তোমরা যেখানে সাধ চলে যাও- আমি এই বাংলার পাড়ে রয়ে যাবো; দেখিবো কাঁঠাল পাতা ঝরিতেছে ভোরের বাতাসে... নববর্ষ মানে দিনমান পথে-প্রান্তরে লাল-সাদা-কমলার বন্যা। সুতি শাড়ি, পাঞ্জাবি। লাল-সবুজ টিপ। ব্যবসালয়ে, প্রিয় ঠিকানায় গাঁদার কারুকাজ।

নববর্ষ মানে নতুন পাঁজি, লাল প্রচ্ছদের হালখাতার উৎসব। পুরনো বন্ধুর সঙ্গে প্রাণময় আড্ডা। প্রিয় মানুষটির পাশাপাশি উদ্দেশ্যহীন হেঁটে চলা। নববর্ষ মানে লোকজ প্রান্তিক সংস্কৃতির ধুমধাম আয়োজন। লাল টুকটুকে মাটির পুতুল, বাঁশি, একতারা, ডুগডুগি, মুড়ি-খই-নাগরদোলার প্রতি বিশেষ পক্ষপাতিত্ব।

সবকিছুর মূলেই ওই আপন সংস্কৃতির প্রতি সুপ্ত নিবিষ্টতা। সে জন্যই হয়তো আজ পাঁচতারা হোটেলে গিয়েও পান্তাভাত, শর্ষে-ইলিশের আবদারও অপরাধ নয়। বাংলিশ ক্ষুদেবার্তায় লোকজ কথামালাও জায়েজ। নববর্ষের দিনে নতুন হুল্লোড়ে-আশ্বাসে উন্মেলিত হয় রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ, অতুল প্রসাদ, লালনের মানস দর্শন। প্রশ্ন জাগে- বৈশাখ আবাহনে এতো উচ্ছ্বাস আর পরিপাটি আয়োজন কেনো? বৈশাখ মানে ঝলমলে রোদ, চিড়বিড়ে গরম, হররোজ দুপুরে হঠাৎ দমকা বাতাস, বিকেলে আকাশ কালো করে তেড়েফুঁড়ে আসা বিকট কালবৈশাখি, মেঘের কলসি উপুড় করা ঝুম বৃষ্টি... আসলে, সময় বৈশাখকে দিয়েছে ঝোড়ো যৌবন, রুদ্র চরিত্র, আগ্রাসনের স্বাধীনতা।

সব মিলে এই সময়টার একটা যৌবন আছে। আর কে না জানে, মানুষ বরাবরই যৌবনের পূজারি। সে জন্যই হয়তো বাংলার ১,২৯৩টি মেলার মধ্যে বৈশাখ নিয়েই ২৪৫টি মেলার প্রচলন! যেখানে নববর্ষের মেলার সংখ্যাই ১৭৫টি! আজ যখন বিরামহীন পণ্যশাসিত অদ্বিতীয় সত্তার আহ্বানে জীবনবোধ ক্লান্ত, নিজস্ব সমাজবোধ পর্যবসিত বিশ্বায়নের আগ্রাসনে, তখন পরিপূর্ণ বাঙালিয়ানার আয়নায় আসুন একবার দেখি, বারবার দেখি, দেখি বাংলার মুখ- কোথায় সে নিয়ে গেছে সঙ্গে করে সেই নদী, তেপান্তর, মাঠ, ঘাস, সেই দিন সেই রাত্রি, সেসব মান চুল, ভিজে শাদা হাত সেসব নোনাগাছ, করমচা, শামুক, গুগলি, কচি তালশাঁস সেসব ভিজে ধুলো, বেলকুড়ি ছাওয়া পথ, ধোঁয়া ওঠা ভাত- কোথায় গিয়েছে সব? [] ---------------------------------------------------------------------------- নববর্ষ] বৈসাবি : পাহাড়ে প্রাণের উৎসব ফজলে এলাহী আবার হাসছে পাহাড়। সেজেছে উৎসবের রঙে। রাঙামাটি-খাগড়াছড়ি আর বান্দরবনে শুরু হয়ে গেছে বর্ষবিদায় এবং বর্ষবরণের উৎসব, পাহাড়িদের প্রাণের উৎসব- বৈসাবি।

পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে প্রধান তিন সম্প্রদায় ত্রিপুরা, মারমা আর চাকমাদের বৈসুক, সাংগ্রাই ও বিজু উৎসবের নামের আদ্যাক্ষর নিয়ে এই বৈসাবি উৎসব! তবে, সব আদিবাসী সম্প্রদায়ই নিজেদের নামে ডাকে তাদের উৎসবকে। তিন দিন ধরে চলে প্রতিটি উৎসব। বৈসুক : চৈত্র মাসের শেষের দুদিন ও নববর্ষের প্রথমদিন, মোট তিন দিন ধরে চলে বুইসুক বা বৈসুক উৎসব। চৈত্র মাসের শেষ দুদিনের প্রথমটি হলো হারি বুইসুক এবং শেষটি বুইসুকমা। আর নববর্ষের প্রথমদিন পরিচিত বিসিকাতাল নামে।

উৎসবের প্রথমদিন গাছ থেকে ফুল তোলে ত্রিপুরা ছেলে-মেয়েরা। সে ফুল দিয়ে ঘর সাজায়। ঝুড়িতে ধান নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে ঘুরে মোরগ-মুরগিকে ছিটিয়ে দেয়। বৈসুক শুরুর দিন থেকে গরাইয়া নৃত্য দল গ্রামে গ্রামে গিয়ে প্রত্যেক ঘরের উঠোনে নাচে। এই বৈচিত্র্যময়, চিত্তাকর্ষক নৃত্যকে ত্রিপুরারা বলে গরাইয়া নৃত্য বা খেরেবাই নৃত্য।

এতে ২২টি অসাধারণ মুদ্রা সৃষ্টি করা হয়। নৃত্য দলের শিল্পীদের একজনের কাঁধে একটি শূল থাকে। শূলে আবার বাঁধা থাকে একটি খাদি। যদি কোনো ঘরের উঠোনে এই শূলটি বসানো হয়, তবে ঘরের মালিককে গরাইয়া দেবতার পূজা দিতে হয়। এভাবে প্রত্যেক ঘরের উঠোনে নাচ শেষে শিল্পীদের মদ, মুরগির বাচ্চা, চালসহ অনেক কিছু দেওয়া হয়।

বিনিময়ে শিল্পীরা সেই গৃহস্থকে আশীর্বাদ করে যায়। নাচের পর উপঢৌকন হিসেবে পাওয়া জিনিসগুলো দিয়ে আবার গরাইয়া দেবতার পূজা করে শিল্পীরা। কেউ একবার এই গড়াইয়া নৃত্যে অংশ নেওয়ার অর্থ পরপর তিন বছর তাকে এই নাচে অংশ নিতে হবে। নইলে তার অমঙ্গল, এমন কি মৃত্যু হতে পারে- এমন কিংবদন্তি প্রচলিত আছে ত্রিপুরাদের মধ্যে। এই লোকো-নৃত্যটিতে অংশ নিতে পারে ১৬ থেকে ৫০০ জন মানুষ।

সাংগ্রাই : বৈসাবি উৎসবের বৈ-এর পর, সা এসেছে পাহাড়ের অন্যতম নৃগোষ্ঠী মারমাদের সাংগ্রাই উৎসব থেকে। মারমারা সাধারণত চন্দ্রমাস অনুসারে তাঁদের এই অন্যতম প্রধান সামাজিক উৎসবটি পালন করে থাকে। বছরের শেষ দুদিন এবং নববর্ষের প্রথম দিন- মোট তিন দিন ধরে চলে উৎসব। সাংগ্রাই উৎসব উদযাপনের সময় মারমা যুবক-যুবতীরা পিঠা বানানোর জন্য চালের গুঁড়া তৈরি করে। ঘিলার বিচি দিয়ে ঘিলা খেলা এই উৎসবে মারমাদের প্রিয় একটি খেলা।

এ সময় বৌদ্ধমন্দিরে গিয়ে ধর্মীয় বাণী শোনে তারা। চৈত্রসংক্রান্তি উপলক্ষে সাংগ্রাই উৎসব পালন করা হয় বলে ধারণা করা হয়। সাংগ্রাই শব্দটি এসেছেও সংক্রান্তি থেকেই। সাংগ্রাইয়ের তো বটেই, বৈসাবি উৎসবেরও অন্যতম আকর্ষণ মারমা তরুণ-তরুণীদের পানি খেলা। এই খেলার সময় যুবক-যুবতীরা একে অপরের দিকে পানি ছুড়ে মারে।

স্নিগ্ধতা-ভালোবাসায়-শ্রদ্ধায় ভিজিয়ে দেয় পরস্পরকে। মারমা সংস্কৃতি সংসদ প্রতি বছর মারমা অধ্যুষিত বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এই পানি উৎসব উদযাপন করে থাকে। বিজু : পার্বত্য চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় নৃগোষ্ঠী চাকমারা। বিজু তাই উদযাপিত হয় খুব জাঁকালোভাবে। এর সঙ্গে যেনো দুলে ওঠে পুরো পার্বত্য চট্টগ্রাম।

উৎসবের প্রথম দিনকে চাকমা ভাষায় ফুল বিজু, দ্বিতীয় দিনকে মূল বিজু এবং তৃতীয় দিনকে নুয়াবঝর বা গোজ্যা পেজ্যা দিন বলা হয়। ফুলবিজুর দিন বিজুর ফুল তোলা হয় এবং ফুল দিয়ে ঘর সাজানো হয়। দিন শেষে সে ফুল ভাসিয়ে দেওয়া হয় নদীতে। ঘরে ঘরে রান্না করা হয় পাজোন নামের এক বিখ্যাত খাবার। হরেক রকম সবজি আর তরকারি দিয়ে তৈরি করা হয় এ খাবারটি।

কে কার পাজোনে কতো বেশি পদের তরকারি দিতে পারে, তা নিয়ে এক ধরনের প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায় সবার মধ্যে। গ্রাম্য ছেলে-মেয়েরা ঘিলা আর গুদু, মানে হাডুডু খেলায় মেতে ওঠে। তারা আকাশ-প্রদীপ জ্বালায় এবং বাজি ফোটায় মহানন্দে। বয়স্করা মদ জগরা বা কাজ্ঞি পান করে। বিজু উৎসবের সময় কোনো প্রাণী হত্যা করা হয় না।

তবে নববর্ষের দিন মাছ-মাংসসহ মজার মজার খাবারের আয়োজন থাকে। কেনোনা, এই দিন ভালো কিছু খেলে সারা বছর ধরে ভালো খাবার খাওয়ার সম্ভাবনা থাকে বলে বিশ্বাস করে তারা। [] ---------------------------------------------------------------------------- রম্য] গোপাল ভাঁড়ের রসগোল্লা [বাঙালিয়ানা আর গোপাল ভাঁড়- এ দুটি ব্যাপার সমার্থক, নাকি বিপরীত; এ নিয়ে আলাপ চলতে পারে। কিন্তু গোপাল ভাঁড়ের কৌতুক শোনেননি, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার। একদিকে যেমন হাস্যরস, অন্যদিকে বুদ্ধির ঝিলিক- সবমিলিয়ে অনন্য তিনি।

আমাদের এই আয়োজনে ছাপানো কৌতুকগুলোর কোনো কোনোটি হয়তো আগেই জেনেছেন আপনি। তবুও বাঙালির গোপাল ভাঁড়ের চিরকালের আনন্দভান্ডারের সঙ্গে আরো একবার পরিচিত হতে দোষ কোথায়! -সম্পাদক] একবার, নিশ্চিন্দিপুরের জমিদার ঘোড়ায় চড়ে যেতে যেতে নয়াপাড়ার মোড়ে গোপালকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘গোপাল, তোমার জ্বর সেরেছে তো?’ গোপাল কোনো জবাব দেওয়ার আগেই জমিদারের ঘোড়া জোর কদমে ছুটে গিয়েছিলো। ওই ঘটনার সাত বছর পরে, আবার নয়াপাড়ার মোড়েই গোপালের সঙ্গে জমিদারের হঠাৎ দেখা। এবার অবশ্য জমিদার পালকিতে চড়ে যাচ্ছিলেন। পালকির দরজাটা খোলাই ছিলো।

জমিদার নতুন করে প্রশ্ন করার আগেই, সেই সাত বছর আগেকার প্রশ্নের জবাব দিলো গোপাল, ‘অসুখ সেরে গেছে, হুজুর। ’ জমিদার গোপলকে জিঞ্জেস করতে যাবেন- কিসের অসুখ? কিন্তু তার আগেই তিনি দেখলেন, এবার গোপাল নিজেই দৌড়ে পালাচ্ছে! শীতের সকাল। ঠাণ্ডায় গোপালের গরম গরম ক্ষুদের পায়েস খেতে ইচ্ছা হলো। পাচককে ডেকে তখনই হুকুম দিলেন, ‘গরম গরম পায়েস তৈরি করো। তৈরি হলেই আমায় ডাকবে।

গরম না খেলে ওর কোনো স্বাদ পাওয়া যায় না। ’ পায়েস রেঁধে থালায় ঢেলেই বাবুকে ডাকতে এলো পাচক। কিন্তু কী মুশকিল! বাবুর কাছে যে কয়েকজন ভদ্রলোক বসে আছেন? এঁদের সুমুখে কী করে পায়েসের কথা বলা যায়, বেশি রান্নাও হয় নাই, সবার জন্য হবে না। অথচ দেরি করলে পায়েস জুড়িয়ে অখাদ্য হয়ে যাবে। অনেক ভেবেচিন্তে এক কৌশল বের করলো পাচক।

সে এসে বললো, ‘বাবু। ভেতরে ক্ষুদিরাম বাবু আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন। হাঁড়িডাঙা থেকে থালাঘাটা আসতে দেরি হয়নি। এবার জুড়নপুর যাওয়ার ফিকিরে আছেন। এখন আপনার সঙ্গে দেখা করার ওয়াস্তা, জলদি যেতে চান।

’ গোপাল ব্যস্ত হয়ে বললেন, ‘না না। জুড়নপুর যাওয়ার আগেই তাকে আমি উদর-গড়ে পাঠাবার জন্য ঝটিতি থালাঘাটায় গিয়ে হাজির হলেন বাবু। সমাগত ভদ্রলোকেরা বৈঠকখানায় বসে তখন ভাবছেন, ক্ষুদিরাম বাবু কী কোনো স্টেটের নায়েব, না ম্যানেজার, না দেওয়ান? ভেবে কোনো কূল-কিনারা পেলেন না তাঁরা! গোপালকে ঠকাবার জন্য একদিন মহারাজ জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার স্ত্রী নাকি পরমা সুন্দরী?’ সঙ্গে সঙ্গে গোপালের উত্তর, ‘আগে আমিও তাই মনে করতাম, মহারাজ। কিন্তু মহারাজের স্ত্রীকে যেদিন দেখেছি, সেদিনই আমার ভুল ভেঙেছে। ’ এমন উত্তর পেয়ে মহারাজ নিরুত্তর! গোপালের ভাইপো গোপালের মতোই সেয়ানা।

তবে গোপালের মতো বুদ্ধি করে এতো পয়শা রোজগার করতে পারতো না। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের আর্থিক আনুকূল্যে গোপাল পাকা বাড়ি তুলেছিলো, কিন্তু তার ভাইপোর পক্ষে তখনো পাকা বাড়ি তোলা সম্ভব হয়নি। কুঁড়েঘরেই বাস করতে হতো তাকে। একদিন পাকা বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে গড়গড়া টানতে টানতে ভাইপোকে ডাক দিলেন গোপাল, ‘ওরে হাবু, এই অসময়ে বাড়ির ভেতর বসে কী করছিস রে? এদিকে আয়। ’ গোপালের ডাকে সাড়া দেয়নি হাবু।

সে বুঝতে পেরেছিলো, তার কাকা তাকে কোনো কাজে ডাকেনি; নতুন পাকা বাড়ির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যই এই ডাকাডাকি। দুই বছর পরে গোপালের ভাইপোরও পাকা বাড়ি হলো। সেও একদিন, নতুন পাকা বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে গোপালকে বললো, ‘ও গোপাল কাকা, দুই বছর আগে ছাদে দাঁড়িয়ে আমায় যেনো কী বলেছিলে?’ মহারাজের বাবার শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে রাজবাড়িতে গোপালের নিমন্ত্রণ। রাজা আর গোপাল একসঙ্গে বসেই আহার করলেন। আহারান্তে প্রতিদিন একমুঠি অন্ন কুকুরকে দিতেন রাজা।

আজও কুকুরের জন্য একমুঠি অন্ন হাতে করে উঠলেন। দেখা-দেখি গোপালও একমুষ্টি অন্ন হাতে নিলো। বাইরে এসে দুজনেই অন্নমুষ্টি কুকুরের জন্য মাটিতে ফেলে দিলেন। পোষা কুকুর নিকটেই বসেছিলো, সে রোজই রাজার হাত থেকে ভাত পেয়ে থাকে; কাজেই রাজার দেওয়া ভাতের দিকেই সে ছুটে এলো। তাই দেখে ঠাট্টা করে রাজা বললেন, ‘দেখলে তো গোপাল, তোমার ভাত কুকুরেও ছোঁয় না।

ঠিক কিনা দেখো। ’ গোপাল ভ্রু কুচকে বললো, ‘তাই দেখছি! ও দেখছি সগোত্র ভিন্ন অন্য গোত্রের হাতে খায় না! আমি ভিন্ন গোত্র, সে জন্যই আমার দেওয়া ভাত খেলো না। ’ মুখের ওপর জবাব পেয়ে রাজা রাগ করলেন না, উল্টো হেসে ফেললেন। [] > লেখাটি আমাদের বিশেষ সংগ্রহ থেকে প্রকাশিত ---------------------------------------------------------------------------- গল্প] অতিথি রুবেল কান্তি নাথ আমার কোনো অনুমতিরই প্রয়োজন মনে করেননি তিনি! আমার অনুমতিবিহীন, আমাকে কিছু না জানিয়েই আমার অন্দরমহলে, মানে আমার বেডরুমে প্রবেশ! কিছুতেই মানতে পারছিলাম না ব্যাপারটা। এই মানুষটার মনে ভদ্রতার লেশমাত্রও নেই নাকি? ‘আরে হাঁদারাম!’ নিজেই নিজেকে তিরস্কার করলাম।

আসলে তিনি তো ভদ্রতা কাকে বলে, ভদ্রতা খায় নাকি মাথায় দেয়, সেটার খবরও রাখেন না! আর আমি কিনা ভাবছি- তার ভদ্রতাও নেই নাকি! বেডরুমে প্রবেশ করার একমাত্র অধিকার আছে আমার প্রাণপ্রিয় স্ত্রীর, সে ছাড়া আমাদের ব্যাক্তিগত রুমে বিনা অনুমতিতে প্রবেশ করার অধিকার আর কারো নেই। এমন কি আমার খুব খুব এবং খুব ঘনিষ্ট বন্ধু-বান্ধবকেও এই অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছি। বেশ কিছুদিন আগে, স্ত্রী দিশাকেও অনেক বকাঝকা করেছিলাম। কারণ, অফিস থেকে ফিরে দেখি, সে তার ঘনিষ্ট বান্ধবী তনিমাকে নিয়ে আমাদের বেডরুমে বসে খোশগল্প করছিলো। এটা কিছুতেই মানতে পারিনি।

আমাদের এই বিরাট বাড়িতে এতোগুলো আলাদা আলাদা রুম থাকতে, সে কেনো বেডরুমে বসে গল্পে মেতেছিলো? ওকে এ ব্যাপারটা নিয়ে অনেক বকেছিলাম সেদিন। সে আমার কাছে ওয়াদা করেছিলো, আর কোনোদিন কাউকে সে বেডরুমে ঢোকাবে না। আর আজ সেখানে কিনা অনাকাক্সিক্ষতভাবে এক অথিতির প্রবেশ! কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিলো না। তবে বাস্তবতাকে বিশ্বাস করতেই হলো। না, যা দেখছি তা একবিন্দুও ভুল নয়।

সঠিক। সম্পূর্ণ সঠিক! তিনি আমার অনুমতি ব্যতিত আমার বেডরুমে প্রবেশ তো করেছেনই, তার ওপর আবার আমার ব্যবহার্য জিনিসপত্রে হাত দিতে শুরু করলেন। আমি তার কাণ্ডকারখানা দেখছিলাম। কিন্তু এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির জন্য তৈরি ছিলাম না। এবং কখনো এই ধরনের পরিস্থিতিতে পড়িওনি।

সুতরাং জানি না, এই মুহূর্তে আমার কী করতে হবে। কেনো জানি গলাটাও শুকিয়ে এসেছে। কণ্ঠটা রোধ হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে, কেউ যেনো সাজোরে আমার গলাটা চেপে ধরেছে। অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও কোনো শব্দ করতে পারছি না।

তবে, আমি কি ভয় পেয়েছি? হ্যাঁ, স্বীকার করতেই হবে, প্রচণ্ড ভয় পেয়েছি। কিন্তু হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলিনি। এখনো মাথাটা ঠিক মতো কাজ করছে। তিনি আমার ব্যবহার্য জিনিসপত্রে হাত দেওয়ার পর, যখন আমার ব্যক্তিগত ওয়্যারড্রোবে হাত দিতে গেলেন, তখন আর নিজেকে সামলাতে পারলাম না। এ ওয়্যারড্রোবে আমার যাবতীয় টাকা-পয়শাও গচ্ছিত আছে।

ড্রয়ার খুলে তিনি যখন টাকা-পয়শা নিয়ে ঝোলায় পুরতে ব্যতিব্যস্ত, তখনই বিধাতার নাম স্মরণ করে ঝাঁপিয়ে পড়লাম লিকলিকে শরীরের অতিথির ওপর। ঝাপটে ধরে আমার সবল হাতের দুটি জোরালো ঘুষি বসিয়ে দিলাম তার চোয়াল বরাবর। অতিথি সাহেব মনে হয়, চোখে সর্ষে ফুল দেখেছেন। মাথাটা ঘুরিয়ে পড়ে গেলেন মেঝেতে। হঠাৎ শব্দ শুনে ঘুম থেকে জেগে উঠলো স্ত্রী দিশা।

দুজন মিলে অতিথি সাহেবকে শক্ত করে দড়ি দিয়ে বাঁধলাম। তারপর রাত শেষের অপেক্ষায় থাকলাম দুজন। সকাল হতেই রাতের অতিথি সাহেবের জ্ঞান ফিরলো। তার কাছ থেকে শুনলাম- তিনি নাকি দারোয়ানকে কী এক নেশা জাতীয় দ্রব্য খাইয়ে, অচেতন করে বাড়িতে প্রবেশ করেছিলেন এক মহৎ উদ্দেশ্যে। আমরা বুঝলাম, তার এ মহৎ উদ্দেশ্যটি ছিলো চুরি! [] > দক্ষিণ কাট্টলী, চট্টগ্রাম-৪২১৯ --------------------------------------------------------------------------- সিনেমার গল্প] অন্তরমহল সাইফুল আমিন সময়টা ঊনিশ শতকের শেষ দিক।

জমিদার মশাই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন- আসন্ন দুর্গা পূজায় দেবীর প্রতিমাকে, রানী ভিক্টোরিয়ার আদলে নির্মাণ করাবেন। কারণ, জমিদার ভুবনেশ্বর চৌধুরী, রায় বাহাদুর খেতাবটা যে করেই হোক এবার বাগাতে চান। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী অন্য জমিদারকে টেক্কা দিতে এ ছাড়া আর কোনো বিকল্পও নেই তাঁর। এ জন্য খবর পাঠিয়ে মৃৎশিল্পী দেহাতী ব্রজ ভূষণকে আনা হলো। এদিকে জমিদার ভুবনেশ্বর চৌধুরীর প্রথম ঘরে কোনো সন্তান নেই।

জমিদার মশাই নিজেকে সক্ষমই ভেবেছেন; সন্তান না হওয়ার দায়ে স্ত্রীকে সরাসরি দায়ী না করলেও, বংশ পরম্পারাকে টিকিয়ে রাখার অভিপ্রায়ে দ্বিতীয় বিয়ে করে বসলেন। ফলে, প্রতিরাতেই ছোটো বউ যশোমতী শারীরিকভাবে জমিদার মশাইয়ের কাছে লাঞ্ছিত হতে থাকেন। বড় বউ যোগমায়া, প্রথমে ছোটো বউয়ের ওপর দারুণ ক্ষ্যাপা থাকেন। ছোটো বউ বাবুর মা হবেন, জমিদারের আরো প্রিয়ভাজন হয়ে যাবেন- এ ঈর্ষা তাঁকে কুরে কুরে জ্বালিয়ে মারে। কিন্তু সময় গড়ানোর তালে তালে, যশোমতীর প্রতি মায়া জন্মায় যোগমায়ার।

টের পান, জমিদার মশাইয়ের শারীরিরক নির্যাতনে, প্রতিরাতেই যশোমতী ক্লান্তিতে হাঁপিয়ে পড়ে। স্বামীর অত্যাচারে ছোটো বউয়ের প্রতি করুণাই হয় বড় বউয়ের। দোষ যে তাঁদের দুজনেরই; তারা নারী, মা হতে পারছেন না! এদিকে দেবীর মুখ রানী ভিক্টোরিয়ার মতোন হবে- রাজ্যের পুরোহিতরা কিছুতেই মেনে নিতে পারেন না। তাঁরা জমিদার মশাইয়ের কাছে এ নিয়ে বিণীত আপত্তি তোলেন। বড় বউ যোগমায়ার কাছে অপমানিত হওয়া এক পুরোহিত, প্রতিশোধের নেশায় অন্য প্ররোহিতদের প্ররোচিত করেন।

তাঁরা সকলেই তখন, জমিদারকে শাস্ত্র মতোন উদ্ধারের নতুন এক কূট-কৌশল বাতলে দেন। অকল্পনীয় সে প্রস্তাব রাজা মেনেও নেন। এদিকে পূজো শুরু হয়ে গেছে। দেবী প্রতিমাকে এবারই প্রথম রানী ভিক্টোরিয়ার আদলে দেখতে পাবে- এই আশায় সবার সম্মুখে দেবীর মুখ উন্মোচন করতে গিয়ে, সবাই তো স্তম্ভিত! এ কী! রানী ভিক্টোরিয়ার বদলে, প্রতিমা দেবীর গায়ে এ কোন মুখ? কথাটা জনে জনের মুখে রটবার আগেই, জমিদার মশাই বন্দুক নিয়ে ছুটলেন ছোটো বউ যশোমতীর ঘরের দিকে। দরোজায়, বড় বউয়ের বাধা ডিঙ্গিয়ে সে দরোজা ভেঙ্গে ভেতরে প্রবেশ করতেই, জমিদার থমকে যান।

তাঁর হাত থেকে বন্দুক খসে পড়ে। কথা ছিলো, মৃৎশিল্পী দেহাতী ব্রজ ভূষণ রানী ভিক্টোরিয়ার মুখের আদলে, প্রতিমা দেবীকে গড়ে দেবেন পূজো শুরু হবার আগেই। কিন্তু, রানী ভিক্টোরিয়ার মুখের বদলে, দেহাতী ব্রজ ভূষণ বানিয়েছেন জমিদার মশাইয়ের ছোটো বউ যশোমতীর মুখ! কলঙ্ক রটবার ভয়ে, রাজার বন্দুকের গুলি খেয়ে মরবার আগেই, যশোমতী আত্মহত্যা করলেন! ০২. তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিমা অবলম্বনে, ঋতুপর্ণ ঘোষ নির্মাণ করেছেন তাঁর আরেকটি অনবদ্য চলচ্চিত্র- অন্তরমহল। সিনেমাটোগ্রাফি চমৎকার। মূর্তি তৈরি করার সময় মৃৎশিল্পী নিজের স্ত্রীকে কল্পনা করার দৃশ্য আকর্ষণীয়।

তবে, এখানে শিল্পীর সঙ্গে ছোটো বউয়ের অদৃশ্য সম্পর্ক তৈরিতে পূর্বের কোনো আবহ রাখেননি পরিচালক। এ কারণে, শেষ মুহূর্তের চমকটা দর্শকের হৃদয়ে বোমা ফাটার প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে। পুরো ছবিতে অত্যাচারী জমিদার নিজের আলোকছটা ছড়িয়েছেন। ছোটো বউয়ের উপস্থিতিও স্নিগ্ধ-অনবদ্য। তবে যে চরিত্রটি পরিচালকের সবচেয়ে বেশি মনোযোগ পেয়েছে, তা হচ্ছে আফিমাসক্ত বড় বউ যোগমায়া।

নানান মাত্রায় তাঁকে পর্দায় উপস্থাপন করা হয়েছে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাঁর উপস্থিতি ছিলো শক্তিশালী। স্বামীর বঞ্চনা, ছোটো বউয়ের প্রতি ঈর্ষা-মমতা, পুরোহিতকে বিভ্রান্ত করা, লাস্যময়ী স্ত্রী, মৃৎশিল্পী ব্রজ ভূষণকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা, মা হবার আকাক্সক্ষা নস্যাৎ হয়ে যাওয়ায় তাঁর যে হাহাকার- সবকিছু অতি দক্ষতায় উপস্থাপিত হয়েছে। পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষের মতে, এই প্রথমবার তিনি কিছু করেছেন- যা শুধুমাত্র সম্পর্ক বা মনস্তাত্ত্বিক রূপান্তর নয়, বরঞ্চ যার মধ্যে রয়েছে দৃঢ় সামাজিক ভিত্তি এবং যাতে তুলে ধরা হয়েছে বিভিন্ন স্তরের ভারতের ইতিহাস। ছবিটি ডিভিডিতে পাওয়া যাচ্ছে।

দেখে নিতে পারেন; ভালোলাগবে। তবে যেহেতু ছবিটি ছোটোদের জন্য নয়, তাই দেখার সময় বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে। এ চলচ্চিত্রটির বড় অর্জন, এটি লাকার্নো ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভেল-এ সেরা অভিনয়ের মনোনয়ন পেয়েছে। অভিনয় করেছেন- জ্যাকি শ্রফ, অভিষেক বচ্চন, রূপা গাঙ্গুলি, সোহা আলি খান, রাইমা সেন। > ---------------------------------------------------------------------------- শোকগাথা] সিরাপিনা, আমাদের ক্ষমা করো; না হয় ঘৃণা! আনিসুজ্জামান মানিক কারো আত্মার কাছে ক্ষমা চাইলেই কি ক্ষমা পাওয়া যায়? যদি তাঁর পবিত্র আত্মা ক্ষমা করে, তবেই কেবল আমাদের ইজ্জত রক্ষা হয়।

আমরা অন্তত বলতে পারবো, আমরা মানুষ ছিলাম। আমরা ক্ষমা চেয়েছি- সিরাপিনা, তুমি আমাদের ক্ষমা করো। আমরা তোমার মতো আর কাউকে মরতে দেবো না। সিরাপিনা বরেন্দ্র অঞ্চলের সাঁওতাল পাড়া ছেড়ে অনেক দূরে চলে গেছে। হাস্যোজ্জ্বল মাটির মেয়েটি কখনো আর ফিরে আসবে না।

সে যাওয়ার সময় এই অসভ্য-নিষ্ঠুর-বর্বর বিবেকহীন পোশাকি মানুষগুলোকে শুধুই ঘৃণা করে গেছে। সে পারতো তথাকথিত সমাজপতিদের মুখে একগাল থুথু ছিটিয়ে দিতে। এই সাহস তাঁর ছিলো। গায়ে আগুন দেওয়ার আগে কেউ যেনো তাঁর কাছে আসতে না পারে, সে জন্য সিরাপিনা হাঁসুয়া নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। যেনো সে চিৎকার করে বলছে- এই অসভ্য মানুষ, তোমরা কেউ আমাকে স্পর্শ কোরো না।

সমস্ত ঘৃণা তোমাদের প্রতি। সে অসভ্য-বর্বর সমাজপতিদের সত্যিকারের হিংস্র রূপ দেখেছে। সিরাপিনা মাত্র ১৪ বছর বয়সে জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হারিয়েছে। সমাজপতিরা এই সম্পদের মূল্য নির্ধারণ করেছে টাকার অংকে। সিরাপিনা তা মেনে নিতে পারেনি।

মৃত্যুর আগে টাকা নিতে নিষেধ করেছিলো। সে বিচার চেয়েছিলো। সে বিচার চায়। হিংস্র দানবদের বিচার চায়। যারা তাকে পালাক্রমে অপমান করেছে, তাদের বিচার চায়।

সিরাপিনা টাকাকে ঘৃণা করলেও; তার দিনমজুর বাবা, স্থানীয় চার্চের ফাদারের নির্দেশের বাইরে যাওয়ার ক্ষমতা রাখেন না। কিন্তু সিরাপিনা রাখে। সে গায়ে আগুন দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, ইজ্জতের চেয়ে, আত্মসম্মানের চেয়ে এই পৃথিবীতে মূল্যবান কোনো ধন নেই। রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ী উপজেলা থেকে মাত্র ২৩ কিলোমিটার দূরে, ঋষিকুল ইউনিয়নের আমতলী গ্রাম। এই গ্রামের সাঁওতালপল্লীর মেয়ে সিরাপিনা মার্ডি।

মাত্র ১৪ বছর বয়সেই সিরাপিনা মার্ডি বিষাক্ত এ পৃথিবীর নগ্নরূপ দেখেছে। একসময় সাঁওতাল অধ্যুষিত ছিলো ঋষিকুল ইউনিয়ন। এখন কয়েকটা ঘর মাত্র। এই ঘরগুলোর একটা সিরাপিনাদের। আমরা যখন সিরাপিনাদের বাড়ি পৌঁছাই, তার আগেই সে এই জগৎ থেকে বিদায় নিয়েছে।

মেয়েকে হারিয়ে সিরাপিনার মা নির্বাক। অনেক চেষ্টা করেও সিরাপিনার মায়ের সঙ্গে কথা বলা যায়নি। অনেক প্রশ্নের জবাবে শূন্য আকাশের দিকে অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে শুধু বলেছেন, ‘মেয়ে কি ফিরে আসবে?’ এর উত্তর আমরা কি করে দেই? সিরাপিনার বাবার সঙ্গে কথা হয়, সিরাপিনা যে স্থানে গায়ে আগুন দিয়েছিলো, তার ঠিক দুই গজ দূরে দাঁড়িয়ে। তিনি জানালেন- তাঁর স্ত্রীও ধর্ষিত হয়েছিলো। হতদরিদ্র হওয়ায় সে বিচার হয়নি।

এ রকম ঘটনা প্রায়ই ঘটে এই সাঁওতালপল্লীতে। এসব নিয়ে উচ্চবাচ্য হয় না। মামলা হয় না। কিন্তু সিরাপিনা রক্তের উত্তরাধিকারকে শ্রদ্ধার সঙ্গে সম্মান করে জানান দিয়েছে, সে রাসমণির বংশধর। ইলা মিত্রের মাটির সন্তান।

চার্চের তথাকথিত মীমাংসাকে মেনে নেয়নি। স্থানীয় চার্চের শাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছে। স্থানীয় চার্চ কর্তৃপক্ষ সিরাপিনাকে সেবাদাসী বানাতে চেয়েছিলো। চার্চে নিয়ে কিছুদিন আটকেও রেখেছিলো। এ নিয়ে চার্চের ফাদারের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলাম গোদাগাড়ী থানার হাজতখানায়।

অন্য আসামিদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হলেও, হাজতখানার মেঝেতে ফাদার ঘুমাচ্ছিলেন। আসামিদের একজন জানালেন- তিনি সালিসের সময় ছিলেন না, টাকা দেওয়ার মধ্যস্থতা করেছেন। সিরাপিনাদের প্রতিবেশী তোফাজ্জল হোসেন জানালেন- বিচার না পেয়ে সিরাপিনা আত্মহত্যা করেছে। রাজশাহী জেলা মহিলা পরিষদ শাখার নেত্রীদের সঙ্গে নিয়ে, আমরা ধর্ষকদের একজনের মায়ের সঙ্গে দেখা করতে যাই। এই ধর্ষকের মায়ের সরল স্বীকারোক্তি- এটা আমাদের ভেতরের ঘটনা, আপনারা কেনো এসেছেন? তিনি আরো জানালেন- টাকা দিয়ে সব মিটমাট করা হয়েছে।

ছেলেকে শাসনও করেছেন। ধর্ষণ করার অপরাধে ছেলেকে কান ধরে দশবার ওঠ-বস করিয়েছেন। ধর্ষক ছেলে স্বীকার করেছে, আর কোনোদিন এসব করবে না! এতেই ধর্ষকের মায়ের সান্ত¡না। সিরাপিনা বাঁচতে চেয়েছিলো। সিরাপিনার ছোট বোনের কাছে সে বলেছিলো- যদি বিয়ে না হয়, তাহলে পড়াশোনা করে চাকরি করবে।

সেটা আর হলো না। > রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী ---------------------------------------------------------------------------- আকাশলীনা বৈশাখ ১৪১৮] এপ্রিল ২০১১] সংখ্যা ১০] বর্ষ ০১] কৃতজ্ঞতা] হিমেল অনার্য সম্পাদক] নোমান ভূঁইয়া শব্দ বিন্যাস ও সমন্বয়] সৈয়দা সুধন্যা প্রচ্ছদ পরিকল্পনা ও পৃষ্ঠাসজ্জা] রঙছুট বিশেষ সহযোগিতায়] শফিক হাসান, মহিবুল হাসান কাউসার সাবরিনা আহমেদ সার্বিক ব্যবস্থাপক] সাইফুল আমিন যোগাযোগ] +88 018 18 731377 [সাইফুল আমিন] মূল্য] ১০ টাকা [স্বপ্নের কোনো মূল্য হয় না। তবু যাঁরা এই স্বপ্ন কিনতে চান, তাঁদের জন্য এই নামমাত্র মূল্য নির্ধারণ] সম্পাদক ও প্রকাশক নোমান ভূঁইয়া কর্তৃক সার্কুলার রোড, ধানমন্ডি, ঢাকা থেকে প্রকাশিত; এবং হাতিরপুল, ধানমন্ডি, ঢাকা- ১২০৫ থেকে মুদ্রিত একটি জয়ী প্রকাশনা ==============================================

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১৫ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।