আব্দুর রউফ খান মিষ্টু : একজন নির্ভীক সমাজসেবকের চিরবিদায়
ফকির ইলিয়াস
===========================================
খুব জরুরী না হলে এমনভাবে আমার মুঠোফোন বাজে না। ফোন বাজতেই কবি তমিজ উদদীন লোদীর কন্ঠ। তার আড়ষ্ট ভারী গলা শোনেই বুঝি , কোনো খারাপ সংবাদ। তিনি বলেন- মিষ্টু ভাই আর নেই !
চমকে উঠি। বলেন কী ? তাঁর শরীর খারাপ ছোল শোনেছি।
কিন্তু এভাবে চলে গেলেন !!
৮ এপ্রিল ২০১১ শুক্রবারের দুপুর এভাবেই একটি চরম দুঃসংবাদ নিয়ে এলো আমার জীবনে। একজন বন্ধু চলে গেলেন। একজন সাংবাদিক- লেখক, একজন স্বজন, একজন সহযোদ্ধা, একজন সমাজসেবক, একজন সংস্কারক, একজন ক্রীড়া সংগঠক, এভাবে অকালে চলে গেলেন!
হায় প্রভু এ তোমার কেমন বিধান ! প্রশ্নটা নিজেকে করতে করতেই লোদী ভাইয়ের সাথে ফোনালাপ শেষ করি।
চলতি সংখ্যা 'ঠিকানা'-য় খবর ছাপা হয়েছিল মিষ্টু ভাই অসুস্থ। ঢাকার একটি ক্লিনিকে চিকিৎসাধীন আছেন।
কিন্তু তিনি এভাবে আমাদের ছেড়ে চলে যাবেন, তা কোনো মতেই ভাবতে পারিনি।
আব্দুর রউফ খান মিষ্টুর সাথে আমার পরিচয় ১৯৮৮ সালে। এই নিউইয়র্কে। অভিবাসী প্রজন্মকে এগিয়ে নিয়ে যাবার প্রত্যয় নিয়ে যে কজন মানুষ প্রথম সারিতে ছিলেন , মিষ্টু ছিলেন তার অন্যতম ব্যক্তিত্ব। সাহিত্য, সাংবাদিকতা, সমাজসেবা,খেলাধুলা, বিতর্ক, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম সবকিছুতেই তিনি ছিলেন আমাদের মধ্যমনি।
আমাদের আরেক তুখোড় সহযোদ্ধা এম এম শাহীনের সম্পাদনায় ১৯৮৯ সালে নিউইয়র্কে যখন 'ঠিকানা ' পত্রিকাটি বের হয় , আব্দুর রউফ খান মিষ্টু ছিলেন এর অন্যতম গাইড লাইনার। কাগজ কেমন হবে, কীভাবে প্রবাসীদের কাজে লাগবে, কীভাবে এখানের-দেশের লেখকদের লেখা যোগাড় হবে ইত্যাদি বিষয়ে তাঁর সুচিন্তিত মতামত ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি কথা বলতেন কম, কাজে বিশ্বাস করতেন বেশি।
মিষ্টু ভাইয়ের সাংবাদিকতা শুরু 'সাপ্তাহিক যুগভেরী' পত্রিকার মাধ্যমে। তিনি বিয়ানী বাজার প্রেস ক্লাবের প্রতিষ্টাতা সম্পাদক ছিলেন।
লিখেছেন জাতীয় দৈনিকে বিভিন্ন সময়ে। বড় ভালোবাসতেন নিজেকে একজন মাঠকর্মী হিসেবে পরিচয় দিতে। বলতেন, আমাদের তো সবাই চেয়ার চায়। আমি না হয় কর্মীই থেকে গেলাম।
দুই
তিনি ছিলেন এমন ব্যক্তিত্ব, এই নিউইয়র্কে অভিবাসীদের যে কোনো সমস্যা, প্রতিকূলতা দেখা দিলে সেখানেই ঝাঁপিয়ে পড়েছেন এসব সমস্যা সমাধান কল্পে।
বলেছেন, আমাদের প্রজন্মের ভবিষ্যত আমাদেরকেই দেখতে হবে।
তিনি ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রস্থ বিয়ানী বাজার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সমিতির সাহিত্য সম্পাদক। বলা দরকার , তার মাধ্যমেই আমি মহান মুক্তিযুদ্ধে বিয়ানীবাজারবাসীর আলোকিত ভূমিকা, জি সি দেব-শহীদ কমর উদ্দীনের স্মৃতি বিজড়িত বিয়ানী বাজারের মুক্তি সংগ্রামের অধ্যায়গুলো জানতে পারি। জানতে পারি, সেই বধ্যভূমি গুলোর কথা, যেখানে ঘুমিয়ে আছেন আমার অনেক বীর পূর্বসূরি। আব্দুর রউফ খান মিষ্টু ছিলেন বাংলাদেশ স্পোর্টস কাউন্সিল অব আমেরিকার সাধারণ সম্পাদক।
তাঁর সময় নিউইয়র্কে ফুটবল লীগ নবতর গতি পায়। এখানের তরুণ প্রজন্মের মাঝে ফুটবল লীগকে জনপ্রিয় করার নেপথ্যে অসীম পরিশ্রমী ছিলেন তিনি।
বাংলাদেশ সোসাইটি অব নিউইয়র্কের মতো বড় একটি সংগঠনের 'সমাজ কল্যাণ সম্পাদক' পদে তিনি সদস্যদের ভোটে বিপুলভাবে বিজয়ী হন।
একজন সমাজ সেবক হিসেবে গোটা উত্তর আমেরিকায় তাঁর জনপ্রিয়তা ছিল রীতিমতো ঈর্ষণীয়। নির্ভীক এই মানুষটি যখন সত্যের পক্ষে কথা বলতেন , তখন কোনো অপশক্তিই তাঁর সামনে দাঁড়াবার সাহস পেতো না।
তাঁর সাথে আমার আরো ঘনিষ্টভাবে কাজ করার সুযোগ হয় যখন যুক্তরাষ্ট্রে আমরা
শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ' একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি' গঠন করি। এই কমিটির সহকারী সদস্য সচিবের দায়িত্বে ছিলাম আমি। আর তিনি ছিলেন অন্যতম সমন্বয়কারী ( কোঅর্ডিনেটর)। মনে পড়ছে , ১৯৯২ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া নিউইয়র্ক সফরে এলে প্লাজা হোটেলের সামনে স্মরণকালের বৃহৎ যে বিক্ষোভটি হয় , সেই বিক্ষোভের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন আব্দুর
রউফ খান মিষ্টু। শূন্য ডিগ্রী তাপমাত্রা আর হাটু অবধি বরফের মধ্য দাঁড়িয়ে তীব্র প্রতিবাদী মিষ্টু বুকে ফেষ্টুন নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন- 'ঘাতক-আলবদর- রাজাকারদের বিচার চাই '।
মনে পড়ছে, এই নিউইয়র্কে একটি সমাবেশে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া যখন বলেছিলেন, '' সিলেট বিভাগ বাস্তবায়নের আদৌ কোনো যৌক্তিকতা নেই''।
তখন সেই সমাবেশে দাঁড়িয়েই - নাজমুল হক হেলাল, সালেহ আহমদ মনিয়া, খসরুজ্জামান খসরু , মিসবাহ আহমদ সহ আরো কজনের সাথে আব্দুর রউফ খান মিষ্টু তীব্র প্রতিবাদী কন্ঠে বলেছিলেন ' বৃহত্তর সিলেটবাসীর দাবী মানতে হবে - মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। ' তিনি ছিলেন গণদাবী পরিষদ- যুক্তরাষ্ট্র শাখার অন্যতম প্রতিষ্টাতা।
তিন
তাঁর সাহসী ভূমিকা কখনওই ভুলা যাবে না। ঢাকায় জঙ্গীবাদী কতিপয় সন্ত্রাসী দ্বারা আক্রান্ত হন আমাদের মহান কবি শামসুর রাহমান।
কবির বাসায় গিয়ে ওরা তাঁর উপর আক্রমণ চালায়। এর প্রতিবাদে গর্জে ওঠে বিশ্ববাঙালি। দেশে-বিদেশে এর কড়া প্রতিবাদ হয়।
আমরা এই প্রবাসেও প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করি। এর নেতৃত্বে ছিলেন আব্দুর রউফ খান মিষ্টু।
আমরা নিউইয়র্কে যে প্রতিবাদ সমাবেশ করি মিষ্টু ভাই এর সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
এছাড়া শামসুর রাহমান যখন চিকিৎসার জন্য আমেরিকায় এসেছিলেন , মিষ্টু ছিলেন এই কার্যক্রমের অন্যতম সমন্বয়ক।
দীর্ঘ প্রায় ১৫ বছর যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী ছিলেন তিনি। এই সময়ে বর্নাঢ্য কর্মকান্ডে ব্যস্ত থেকেছেন সবসময়। আর এর সবই ছিল মানুষের কল্যাণকে ঘিরে।
বছর কয়েক আগে তিনি বাংলাদেশে ফিরে যান। কথা ছিল, আবারও কিছুদেনের মধ্যে আমেরিকায় ফিরে আসবেন। না, তাঁর আর ফিরে আসা হলো না। তিনি চলে গেলেন চিরবিদায় নিয়ে।
গেল বছর ঠিকানা সম্পাদক মুহম্মদ ফজলুর রহমান বাংলাদেশে বেড়াতে গিয়েছিলেন।
এ সময়ে তিনি বিয়ানীবাজারে সপরিবারে বেড়াতে গেলে পরম আত্মীয়তায় বরণ করেছিলেন ঠিকানা সম্পাদককে, মিষ্টু ভাই। ফজলু ভাই নিউইয়র্কে ফিরে আমাকে সে বর্ণনা দিয়েছিলন মুগ্ধ হয়ে।
ফোনে আমি সে কথা মিষ্টু ভাইকে বলেছিলাম। তিনি হেসে বলেছিলেন- 'আপনি কবে দেশে আসবেন বলেন। একসাথে মাছ-ভাত আর কবে খাবো !'
হায়রে মানবসত্তা ! মানুষ এভাবে চিরতরে চলে যায় !
তাঁর আমন্ত্রণেই আমি বিয়ানীবাজার বেড়াতে গিয়েছিলাম ১৯৯২ সালে।
ছোটদেশ গ্রামে সারারাত ভরে আড্ডা আর সাহিত্য আলোচনার কথা কোনোদিই ভুলা যাবে না।
কবি ফজলুল হক ছিলেন সেই আড্ডার অন্যতম সঙ্গী। আজিজুল পারভেজ, আলী আহমদ বেবুল, শাহজাহান কমর সহ আরো কজন আড্ডায় শরীক হয়েছিলেন পরদিন সকালে।
স্বদেশে ফিরে তিনি এলাকার প্রজন্মের কল্যাণে নিজেকে নিবেদিত করেছিলেন। বিয়ানীবাজার তথা গোটা বাংলাদেশের আরেক কৃতি সাংবাদিক মোহাম্মদ আব্দুল বাসিতের গণ সংবর্ধনার অন্যতম আয়োজক ছিলেন তিনি।
'' মোহাম্মদ আব্দুল বাসিত রচনাসমগ্র'' , '' মোহাম্মদ আব্দুল বাসিত স্মারক গ্রন্থ'' সম্পাদনা করেন তিনি।
জীবনের শেষ সময়ে এসে তিনি '' মুক্তিযুদ্ধে বিয়ানীবাজার সংগঠকদের কথা'' নামের একটি মূল্যবান দলিল গ্রন্থ সম্পাদনা করেন।
মৃত্যু পূর্ব পর্যন্ত তিনি ছিলেন বিয়ানীবাজার প্রেস ক্লাবের সভাপতি। তিনি উপজেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সদস্যসহ বিভিন্ন প্রশাসনিক কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
মাত্র ৫৫ বছর বয়স হয়েছিল তাঁর।
খুবই অকালে সব কাজ, সব স্বপ্ন পিছে ফেলে চলে যেতে হলো তাঁকে। এটা কেমন নিয়তি ! এটা কেমন নিষ্টুর বিধির বিধান !
একজন সৎ, মহৎ, প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক মানুষ হিসেবে তিনি আমাদের ধ্রুব হয়ে থাকবেন। তাঁর কর্মপ্রেরণা প্রজন্মের পাথেয় হবে অনন্তকাল। আমাদের চারপাশে চেয়ার দখলের যে নগ্ন প্রতিযোগিতা, এসময়ে সত্যিকার কর্মবীর পাওয়া বড় কঠিন।
ঠিক এমনি সময়ে তাঁর মৃত্যু কোনো মতেই পূরণ হবার নয়।
না , মিষ্টু ভাই আপনাকে নিয়ে আমাকে এই লেখা এমন অকালে লিখতে হবে- তা আমি কখনও ভাবিনি। আপনার ঋণ আমরা যে কোনোদিনই শোধ করতে পারবো না।
আপনি চিরশান্তিতে ঘুমান প্রিয় নেতা আমার, প্রিয় সহযোদ্ধা আমার।
মহান প্রভু আপনাকে পরম শান্তি দান করুন। #
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।