আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কী আছে নারীনীতিতে - মিলু শামস



কী আছে নারীনীতিতে মিলু শামস ########################################## আমিনী কী জানেন জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিতে কি আছে? তিনি পড়েছেন? তিনি এবং তার সহচররা কোরান-সুন্নাহ রক্ষা করতে উঠেপড়ে লেগেছেন; কিন্তু সম্পত্তিতে নারীর উত্তরাধিকার সম্পর্কে কোরান শরিফে যা বলা আছে প্রতিমুহূর্তে তা লঙ্ঘিত হচ্ছে তা নিয়ে তারা কিছু বলেন না কেন, তখন কি কোরান-সুন্নাহর অবমাননা হয় না? নাকি নারীনীতির মতো কোরানের বিধান সম্পর্কেও তারা অজ্ঞ? খাদেমুল-আরমাইন বাদশা ফাহদ কোরআন মুদ্রণ প্রকল্পের নির্দেশ ও পৃষ্ঠপোষকতায় মূল: তফসির মারেফুল ক্বোরআন এর বাংলা অনুবাদে চতুর্থ সূরা আন-নিসায় মাওলানা মুহিউদ্দীন খান বলেছেন, "কোরান পাক কন্যাদেরকে অংশ দেয়ার প্রতি এতটুকু গুরুত্ব আরোপ করেছে যে, কন্যাদের অংশকে আসল ভিত্তি সাব্যস্ত করে এর অনুপাতে পুত্রদের অংশ ব্যক্ত করেছে এবং দুই কন্যার অংশ এক পুত্রের অংশের সমপরিমাণ বলার পরিবর্তে এক পুত্রের অংশ দুই কন্যার অংশের সমপরিমাণ বলে ব্যক্ত করা হয়েছে। অনেকেই বোনদের অংশ দেয়া না এবং বোনরা এ কথা চিন্তা করে অনিচ্ছা সত্ত্বেও চৰু লজ্জার খাতিরে ৰমা করে দেয় যে, পাওয়া যখন যাবেই না, তখন ভাইদের সঙ্গে মন কষাকষির দরকার কি! এরূপ ক্ষমা শরিয়তের আইনে ক্ষমাই নয়; ভাইদের জিম্মায় তাদের হক পাওনা থেকে যায়। যারা এভাবে ওয়ারিসি স্বত্ব আত্মসাত করে, তারা কঠোর গুনাহগার। তাদের মধ্যে কেউ কেউ নাবালেগা কন্যাও থাকে। তাদের অংশ না দেয়া দ্বিগুণ গুনার।

এক গুনাহ শরিয়তসম্মত ওয়ারিশের অংশ আত্মসাত করার এবং দ্বিতীয় গুনাহ এতিমের সম্পত্তি হজম করে ফেলার। এরপর আরও ব্যাখ্যা সহকারে বলা হয়েছে, যদি পুত্র সন্তান না থাকে, শুধু একাধিক কন্যাই থাকে, তবে তারা ত্যাজ্য সম্পত্তির তিন ভাগের দুই ভাগ পাবে। এতে সব কন্যাই সমান সমান অংশীদার হবে। অবশিষ্ট তিন ভাগের এক অন্যান্য ওয়ারিশ যেমন মৃত ব্যক্তির পিতা-মাতা, স্ত্রী অথবা স্বামী প্রমুখ পাবে। কন্যাদের সংখ্যা দুই বা তার বেশি হলে দুই-তৃতীয়াংশের মধ্যে তারা সমান অংশীদার হবে।

..... উত্তরাধিকারের মাধ্যমে ওয়ারিশরা যে মালিকানা লাভ করে তা বাধ্যতামূলক। এতে ওয়ারিশের কবুল করা এবং সম্মত হওয়া জরুরী ও শর্ত নয়, বরং সে যদি মুখে স্পষ্টত বলে যে, সে তার অংশ নেবে না, তবুও আইনত সে নিজের অংশের মালিক হয়ে যায়। এটা ভিন্ন কথা যে মালিক হওয়ার পর শরিয়তের বিধি অনুযায়ী অন্য কাউকে দান, বিক্রি, অথবা বিলি বণ্টন করে দিতে পারবে। .... পুরুষদের যেমন উত্তরাধিকারের হকদার মনে করা হয়, তেমনি নারী ও শিশুদের এ হক থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। কেননা, সনত্মানের সম্পর্ক হোক কিংবা পিতা-মাতার সম্পর্ক হোক অথবা অন্য কোন সম্পর্ক হোক, প্রত্যেকটিতেই সম্পৃক্ততার মর্যাদা ছেলে ও মেয়ের মধ্যে সমান।

ছেলে যেমন পিতা-মাতা থেকে জন্মগ্রহণ করে, তেমনি মেয়েও পিতা-মাতারই সনত্মান। উত্তরাধিকার স্বত্ব সম্পর্কের ওপর নির্ভরশীল। কাজেই ছোট ছেলে কিংবা মেয়েকে বঞ্চিত করার কোনই কারণ থাকতে পারে না। ' আর নারীনীতির যেসব ধারা নিয়ে তারা কোরান-সুন্নাহ অবমাননার জিগির তুলেছে। তা এ রকম_'নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে জরুরী বিষয়াদি যথা-স্বাস্থ্য, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, জীবনব্যাপী শিক্ষা, কারিগরি শিক্ষা, আয়বর্ধক প্রশিক্ষণ, তথ্য ও প্রযুক্তিতে নারীকে পূর্ণ ও সমান সুযোগ প্রদান করা (ধারা ২৫.১)।

২৫.২ অনুচ্ছেদ বলা হয়েছে, উপার্জন উত্তরাধিকার, ঋণ, ভূমি এবং বাজার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অর্জিত সম্পদের ক্ষেত্রে নারীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রদান করা। এ ছাড়া জাতীয় অর্থনীতির সকল কর্মকা-ে নারীর সক্রিয় ও সমঅধিকার নিশ্চিতকরণের ৰেত্রে ২৩.৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, সম্পদ, কর্মসংস্থান, বাজার ও ব্যবসায় নারীকে সমান সুযোগ ও অংশীদারিত্ব দেয়া। ২৩.১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সিদ্ধানত্ম গ্রহণ পর্যায়ে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি এবং নারী-পুরম্নষের মধ্যে বিরাজমান পার্থক্য দূর করা। ২৩.৪ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতির প্রয়োগে বিরূপ প্রতিক্রিয়া প্রতিহত করার লৰ্যে নারীর অনুকূলে সামাজিক নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলা। " এখানে কি এমন বৈপ্লবিক কথা-বার্তা আছে যাতে তারা রনচ-ী রূপ ধরেছে ? নারীনীতিতে কোরান-সুন্নাহর অবমাননা দেখছে কিন্তু সম্পত্তি বিলি-বণ্টনে কোরান বর্ণিত বিধান তো প্রতিমুহূর্তে লঙ্ঘিত হচ্ছে।

বেশিদূর যেতে হবে না, নিজেদের পরিবারে আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে খোঁজ নিলে দেখা যাবে বোনদের প্রাপ্য সম্পত্তি দিতে বেশিরভাগ ভাইয়েরই মুখ ভার হয়। নানা ধরনের টালবাহানা-কূটকৌশল প্রয়োগ থেকে শুরম্ন করে নির্যাতন এমনকি হত্যার সাৰী তো খবরের কাগজ। এতে কি কোরান-সুন্নাহর অবমাননা হয় না? স্পষ্ট উলেস্নখ রয়েছে_'উত্তরাধিকারের মাধ্যমে ওয়ারিশরা যে মালিকানা লাভ করে তা বাধ্যতামূলক। এতে ওয়ারিশরা কবুল করা এবং সম্মত হওয়া জরুরী ও শর্ত নয় বরং সে যদি মুখে স্পষ্টত বলে যে, সে তার অংশ নেবে না, তবুও আইনত সে নিজের অংশের মালিক হয়ে যায়। ' এই মালিকানা প্রতিষ্ঠা করতে আমিনীদের তো কোন তৎপরতা দেখা যায় না।

এও তো ইসলামের বিধান, কোরানের নির্দেশ। এতেও তো কোরান-সুন্নাহ লঙ্ঘন হচ্ছে। তাহলে ডাকুক না তারা আরেকটি হরতাল তাদের বিরম্নদ্ধে। যারা কোরান বর্ণিত নির্দেশ অনুযায়ী প্রাপ্য সম্পত্তি দিচ্ছে না। ধর্মের জন্য এ ধরনের মায়াকান্না বহু পুুরনো।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর যখন বিধবা বিবাহ প্রচলনের আন্দোলনে নেমেছিলেন তখন এই আমিনীদের মতো হিন্দু 'রৰক'রা ধর্মের কাঁদুনী গেয়েছিল। কিন্তু বিধবা বিবাহ আইন প্রণয়ন ঠেকাতে পেরেছিল? পারেনি। কারণ সব কিছুর পরেও সমাজ সামনে এগোয়। আমিনীদের পানদোক্তা চর্চিত নোংরা দাঁত খিঁচানোর ভয়ে সমাজ উল্টো পথে চলবে না। নারীনীতির পূর্বাপর না জেনেই আমিনীরা লাফঝাঁফ করছে।

নারীনীতি যার ওপর দাঁড়িয়ে আছে তার মূল ভিত্তি সিডও সনদ। ১৯৭৯ সালের ১৮ ডিসেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে এ সনদ গৃহীত হয়। সিডও পরিপূর্ণ একজন মানুষ হিসেবে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার দলিল। তিন ধারায় সংরক্ষণ আরোপ করে বাংলাদেশ সরকার ১৯৮৪ সালে সিডও সনদ অনুমোদন করে। পরে ১৯৯৭ সালে দু'টো ধারা থেকে সংরৰণ তুলে নিলেও ধারা-২ এবং ধারা ১৬-১ (গ) থেকে এখনও সংরৰণ তোলেনি।

সরকারী বক্তব্য অনুযায়ী মুসলিম শরিয়া আইন পরিপন্থী বলে এ ধারা অনুমোদন করা হয়নি। অথচ অনেক মুসলিম দেশ সংরক্ষণ ছাড়াই সনদ অনুমোদন করেছে। প্রথম নারীনীতিও প্রণয়ন হয় ১৯৯৭ সালে। এরও পূর্ব ইতিহাস আছে। ১৯৯৫ সালে বেজিং নারী শীর্ষ সম্মেলনে নারী উন্নয়ন কর্মপরিকল্পনায় যে ৰেত্রগুলো চিহ্নিত করা হয়েছিল যা পস্নাটফর্ম ফর এ্যাকশন নামে পরিচিত তার আলোকেই নারী উন্নয়ন নীতি প্রণয়নের পরিকল্পনা নেয়া হয়।

উদ্দেশ্য ছিল নির্যাতিত ও অবহেলিত এ দেশের নারী সমাজের বড় অংশের জীবনমান উন্নত করা। ১৯৯৭ সালের ৮ মার্চ বিশ্ব নারী দিবসে এ নীতি ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সে সময় এ নিয়ে একদফা হৈ চৈ হয়েছিল। ২০০৪-এ বিএনপি সরকার এসে কিছু শব্দ পরিবর্তন করে আবার নারীনীতি ঘোষণা করে। এতেও সামান্য সংশোধনী এনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আবার নারীনীতি ঘোষণা করে।

তখনও বায়তুল মোকাররম এলাকায় এ নিয়ে রক্তারক্তি হয়েছে। অর্থাৎ নীতি যখন নারীদের নিয়ে তখন এর বিরোধিতা করতেই হবে। অথচ নারী নীতি যে ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে সেই সিডও সনদের গুরুত্বপূর্ণ ধারাতেই শরিয়া আইন পরিপন্থী বলে সংরৰণ আরোপ করে রাখা হয়েছে। শরিয়া আইন বলতে সচরাচর মুসলিম পারিবারিক আইনকে বোঝানো হয়। কিন্তু হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধসহ অন্যান্য ধর্মের নারীদের উত্তরাধিকার সম্পর্কে তেমন কিছু বলা হয়নি।

হিন্দু পারিবারিক আইন অনুযায়ী সম্পত্তিতে নারীর কোন অধিকার নেই। খ্রিস্টান নারীদের অবস্থাও প্রায় এক। নীতিতে যেমন উলেস্নখ নেই তেমনি সাধারণেও এ নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য নেই। হিন্দু নারী বঞ্চিতদের মধ্যে বঞ্চিততর। খোঁজ নিলে দেখা যাবে ওই ধর্মের 'রক্ষকরা'ও আমিনীদের সমগোত্রীয়।

মানসিকতায় তারা অভিন্ন। মুশকিল হলো নারী সম্পর্কিত কিছু হলে সবাই ভাবে এ নারীদের বিষয় নারীরাই লড়বে। কিন্তু নারী সমাজ বিচ্ছিন্ন নয়, তার সঙ্গে পুরম্নষ সম্পর্কিত। যে কোন নারী ইসু্য তাই সামাজিক ইসু্য। নারী উন্নয়ন নীতি আসলে কি তা ঠান্ডা মাথায় বিবেচনা করলে সম্পত্তি হারানোর আতঙ্ক যেমন থাকবে না তেমনি কোরান-সুন্নাহ অবমাননার ধোয়া তুলে স্বার্থসিদ্ধির অবকাশও থাকবে না।

নারী ইস্যু বলে পুরুষরা দূরে সরে থাকলে আমিনীদের সাহস দিন দিন বাড়বে। এতে সবার ক্ষতি। হরতাল সফল মনত্মব্য করে তারা পরের কর্মসূচি দিয়েছে সাত বিভাগীয় শহরে। বলেছে, শিক্ষামন্ত্রী নাকি নাস্তিক তাই শিক্ষা নীতি বাদ দিতে হবে। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত হিন্দু তাই সংসদীয় কমিটি থেকে তাকে বাদ দিতে হবে।

এধরনের আস্ফালনে পরিস্কার বোঝা যায় আমিনীদের লক্ষ্য শুধু নারী নীতি বাতিল করা নয়, এর পেছনে বড় ধরনের দুরভিসন্ধি রয়েছে। জনকন্ঠ # ৬ এপ্রিল ২০১১ বুধবার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।