আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মুতাযিলা মতবাদঃ মানুষ কি স্বাধীন না অদৃষ্ঠের হাতে বন্দি প্রশ্নটির উদ্ভব এবং পারস্যে মুক্তচিন্তার বিকাশ

যে মুখ নিয়ত পালায়......। ।

পারস্যের টাইগ্রিস নদীর তীরে সুপ্রসিদ্ধ বসরা নগরীতে বিখ্যাত তাপস হাসান বসরী কে কেন্দ্র করে ধর্মের এক রকম নতুন প্রাণোচ্ছল বিকাশ শুরু হল। ধর্মীয় বিভিন্ন নীতি বিধাসমূহের যুক্তিযুক্ত ব্যাখ্যার জন্য মানুষ ভীড় জমাত হাসান বসরীর কাছে। আলোচনা হত মানুষ কি স্বাধীন? না সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছার অধীন,এ সম্পর্কে ধর্মীয় বিধান, পরকাল ইত্যাদি অনেক কঠিন বিষয় নিয়ে।

একদিন এরজন লোক এসে হসান বসরী কে বলল, হুজুর উম্মীয় খলিফারা ধর্মগর্হীত নৃশংস কাজ করছে আর বলছে সব আল্লার ইচ্ছায়। এর ব্যাখ্যা কি? হাসান বসরী রাগান্বিত হয়ে বললেন, তারা ভূল বলছে। তারা মিথ্যাবাদী। হাসান বসরীর শিষ্যদের মধ্যে একজনের নাম ওয়াসিল বিন আতা। ওয়াসিল সব শুনে প্রতিবাদ করলেন।

ওয়াসিল বললেন, মানুষ তার নিজ কর্মের জন্য দায়ী। এখানে অদৃষ্টের কোন হাত নেই। এসময় আরেকটি সমস্যার উদ্ভব হল। মুসলমানদের মধ্যে দুটো শ্রেনীর সৃষ্টি হলে। এক শ্রেণী বলতেন, কোন মুসলমান যদি ঈমান এনে ধর্ম গর্হিত কোন কাজ করে তাহলে সে কাফির হয়ে যায়।

মানে মুসলমান থাকে না। আরেকদল বলতেন, না। ঈমান যদি থাকে তাহলে পাপ গুরুতর হলেও আল্লাহ ক্ষমা করে দিতে পারেন। অতএব সে ধর্মচ্যুত বা কাফির হয়ে যায় না। কুফার বিখ্যাত ইমাম আবু হানিফা ছিলেন দ্বিতীয় দলে।

এই দল দুটোর মধ্যে প্রথমটিকে বলা হত খারিজী, দ্বিতীয়টিকে মুরাজী। হাসান বসরী ছিলেন খারিজী অর্থাৎ প্রথম দলের। তিনি যে মুসলমান হয়েও ধর্ম গর্হিত কাজ করে তাকে বর্জনের পক্ষপাতি ছিলেন। ওয়াসিল বিন আতা এখানেও বিরোধীতা করলেন। তিনি বললেন, যেহেতু তাদের মনে ঈমান আছে এবং ধর্মগর্হিত কাজ করেছে অতএব তারা মুসলমান ও না অমুসলমান ও না।

মাঝামাঝি কিছু একটা। এই কথা বলার কারণে শিষয় শ্রেণী হতে ওয়াসিলকে বের করে দেয়া হল। তিনি শান্তভাবে চলে গেলেন এবং নিজেই নিজের চিন্তাগুলো প্রকাশ করতে লাগলেন। তিনি বলতেন, মানুষের যদি অদৃষ্টেই সব কিছু লেখা থাকে তাহলে যে ক্ষারাপ কাজ করে তার জন্মের পূর্বেই তার ভাগ্যে এমন কিছু লেখা ছিল এজন্যই সে কু প্রবৃত্তির অধীন হতে বাধ্য হয়। যদি এরকম ব্যবস্থা হয় তাহলে তার তো কোন দোষ নেই।

আর আল্লাহ যেহেতু ন্যায়পরায়ন তাই তিনি এজন্য পরকালে শাস্তি দিতে পারেন না। এখান থেকেই মুতাযিলা মতবাদের উৎপত্তি। মুতাযিলা রা মনে করতেন বুদ্ধির চরম বিকাশ ঘটেছে এরিস্টটল এবং প্লেটোর গ্রন্থে। তারা এদের গ্রন্থকে সঠিক মনে করতেন, আবার কুরআনকেও সঠিক মনে করতেন। তারা চেষ্টা করেছিলেন এই দুইয়ের মধ্যে একটা মিল সৃষ্টি করতে।

কিন্তু এখানে একটি সমস্যা হয়। কুর আনে বলা হয়েছে ,আল্লাহ জগৎ সৃষ্টি করেছেন আর এরিস্টটলের মতে জগৎ অনাদি। এই সমস্যায় মুতাযিলা রা ব্যাখ্যা দিলেন আসলে বস্তু জগৎ সম্ভাব্য সত্তারুপে ছিল অদৃশ্য হয়ে। তখন শুধু অস্তিত্ব ছিল না। সৃষ্টি মানে অনস্তিত্ব হতে অনস্তিত্ব প্রাপ্তি।

এই ব্যাখ্যায় তারা দুটোকে এক করলেন। কিন্তু যারা মূলধারার ছিলেন তারা প্রশ্ন তুললেন, তাহলে তো সৃষ্টি কর্তার পাশাপাশি অদৃশ্যরুপে বস্তজগৎ ছিল। মানে সৃষ্টিকর্তা যেমন অনাদি বস্তু জগৎ ও অনাদি হয়ে পরে। এবং যেহেতু দুটোই অনাদি তাহলে কেউ কারো সৃষ্টিকর্তা হয় কীভাবে? মতাযিলারা এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন নি। এখন প্রশ্ন হতে পারে মুতাযিলারা কি নাস্তি বা নিরিশ্বরবাদী ছিলেন? না।

তারা কট্টর আস্তিক অর্থাৎ ইশ্বরবাদী ছিলেন। মুতাযিলারা আল্লাহর একত্ববাদে এতই কট্টর বিশ্বাসী ছিলেন যে তারা ঘোষনা দিলেন, কুরআন চিরন্তন না। মুলধারা মতে আল্লা যতকাল বিদ্যমান আছেন কুরআন ও ততকাল বিদ্যমান। মানে চিরন্তন। মুতাযিলারা বললেন, যদি কুরআন চিরন্তন হয় তাহলে সেটি আল্লার সাথে বিদ্যমান ছিল।

যেহেতু এটা সৃষ্টবস্ত সেহেতু এটা অনাদিকাল হতে বিস্তৃত একথা সঠিক না। যদি অনাদিকাল হতে আল্লার সাথে কুর আনথাকে তাহলে আল্লার একত্বের উপর আঘাত আসে। মুতাযিলাগন শেষ বিচারের দিন আল্লাহকে মানুষ দেখতে পারবে এটা মানতেন না। তারা বলতেন আল্লাহ নিরাকার। ওয়াসিলের পর তার শিষ্যরা প্রশ্ন তুললেন, কীভাবে মানুষ শেষবিচারের দিন নিজের পূর্বদেহ নিয়ে জেগে উঠবে? মুতাযিলাদের এসব প্রশ্ন তৎকালে এক ধরনের জাগরন সৃষ্টি করেছিল।

মুলধারার পন্ডিত ব্যক্তিরা বিব্রত হচ্ছিলেন বারবার। খলিফা আল মামুন এসব অবস্থা দেখে ৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে ঘোষনা দেন, কুরআনকে যে রচিত গ্রন্থ বলে বিশ্বাস করবে না তার নাগরিক অধিকার হরণ করা হবে। খলিফা স্বাধীন চিন্তার পক্ষে ছিলেন এবং মূলধারার পন্ডিতদের সব বিষয়ে বিশ্লেষণ তাকে কিছুটা ক্ষুব্ধ করেছিল। এসময় মূল ধারার পন্ডিতদের অপর নির্যাতন চলতে থাকে। এদের মধ্যে ইমাম আহমদ বিন হাম্বল অন্যতম।

তাকে কুরআন রচিত গ্রন্থ স্বীকার না করায় এবন এই আইনের বিরোধীতা করায় বেত্রাঘাতের মাধ্যমে শাস্তি দেয়া হয়েছিল। খলিফা মামুন ওই বছরই মারা যান। এরপর নির্যাতন আস্তে আস্তে কমে আসে। এর মাঝে মুতাযিলা এবং মুলধারার মধ্যে মিলনের চেষ্টা ও চলতে থাকে। আবুল হুসায়েন আল আশরী এমনি এক চেষ্টা করেন।

তিনি বলেন, মানুষের কাজ আল্লা ঠিক করে রেখছেন এটা ঠিক, আবার মানুষ ইচ্ছানুযায়ী কাআজ করতে পারে এটাও ঠিক। । আসলে আল্লা একটি সম্ভাবনা ঠিক করে রেখেছেন। সে সম্ভাবনার মধ্যে যেকোন কাজ করা বা না করা মানুষের ইচ্ছার অধীন করে দিয়েছেন। মুতাযিলা মতবাদ ১১২৭ সালে জন্ম নেয়া ইবন রুশদের মাধ্যমে পুনরুজ্জীবন লাভ করে।

ইবন রুশদের কথা ছিল, বিজ্ঞান আর দর্শন আলাদা। ধর্মাশাস্ত্রের ব্যাখ্যায় যেমন দর্শন এর এগিয়ে আসা ঠিক না তেমনি দর্শনের কাজে বিজ্ঞানের হস্তক্ষেপ ঠিক না। তিনি বলেন ধর্ম হচ্ছে বিশ্বাস আর দর্শন ও বিজ্ঞান হচ্ছে মানুষের বুদ্ধির উপর নির্ভর করা বিষয়। বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত বিষয় কেউ না মানতে পারে কিন্তু যুক্তি ও দর্শনের উপর প্রতিষ্ঠিত বিষয় কোন সজ্ঞান মানুষ উপেক্ষা করতে পারে না। দর্শনে ভিতর দিয়ে কোন নতুন ধর্ম বের করা যায় কিনা তার চেষ্টা তিনি করেছিলেন।

মুসলিম দের মধ্যে জ্ঞানের বিকাশে এই মুতাযিলাবাদ অনেক গুরুত্বপুর্ন ভূমিকা পালন করেছে। আগে মুসলমানগন মনে করতেন সমস্ত জ্ঞান কুরআনে আছে। তাই তারা অন্য কোন ধরনের জ্ঞানালোচনা থেকে বিরত থাকতেন। যদিও মুতাযিলাবাদের পরে শেষ হয়ে যায় তবুও তার ফলে জ্ঞান বিজ্ঞান এবং দর্শনের বিকাশ ঘটে মুসলমানদের মধ্যে। তাদের মধ্যে মুক্তচিন্তার বিকাশ ঘটে।

নতুন নতুন চিন্তা এবং বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে ধররামন্ধতার খোলস থেকে বেরিয়ে তারা সঠিক জ্ঞান লাভে উদ্বুদ্ধ হয়। ফলশ্রুতিতে পারস্যে জ্ঞান জগতের অনেক মহামনিষীর আবির্ভাব ঘটে। ইবন সিনা ওমর খৈয়ামের মত মনিষীরা সমৃদ্ধ করেন পৃথিবীর জ্ঞানভান্ডারকে তাদের চিন্তাশক্তির গভীরতা দিয়ে। তথ্যসুত্রঃ পারস্য প্রতিভা মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ উইকিতেও দেখতে পারেন, হাসান বসরী ওয়াসিল বিন আতা মুতাযিলা ইবন রুশদ

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।