আজি হতে শতবর্ষ পরে কে তুমি পড়িছো বসি আমার ব্লগখানি কৌতুহল ভরে
এক
দেশে থাকতে আমার বসের মাসের অন্তত দু'সপ্তাহ কাটতো ওয়াশিংটনে। প্রতিবার দেশে ফিরেই কি করবেন সেটা মোটামুটি মুখস্থ হয়ে গেল । উস্কখুস্ক চুল আর লালাভ চোখ নিয়ে প্রথম মিটিংয়ে বলবেন -- "আমার জেটল্যাগ কাটেনি"। বারবার শুনতে শুনতে জেটল্যাগ খাওয়ার সুপ্ত ইচ্ছা হালকাভাবে মাথাচাড়া দিল।
ডিসিশান নিলাম উচ্চশিক্ষার্থে জেটল্যাগ খাবো ।
মার্কিন মুল্লুকে পাড়ি জমানোর যাত্রাকালটা ছিল ৩০ ঘন্টার । ঢাকা থেকে রওনা হলাম রাত সাড়ে আটটার দিকে । দু'টো ট্রানজিট বাইরাইন আর লন্ডনে , তার মোটামুটি পুরোটাই ব্যস্ততায় কেটে গেল । প্লেনেও ঘুম হল না । ৩০ ঘন্টায় মোটে ঘুম হল ১ কি দেড় ঘন্টা ।
ডালাস এসে পৌছুলাম দুপুর আড়াইটায় । মাঝে যে ৩০ ঘন্টা পেরিয়ে গেছে ঠিক টের পেলাম না , মনে হল আগেরদিন রাতে রওনা হয়ে পরের দিন দুপুরে পৌছেছি । ঘুম হয়নি যখন এত দীর্ঘ সময় , ঘরে গিয়ে আচ্ছামতন একটা জেটল্যাগ খাওয়া তো যাবেই । কিন্তু বিধিবাম , আমার বন্ধুরা এই সেই করে জাগিয়ে রাখল রাত ১২ টা পর্যন্ত । তাদের সাফ কথা , একবার জেটল্যাগের খপ্পরে পড়লে ৭/৮ দিন দফারফা হয়ে যেতে পারে, কাজেই মধ্যরাতের আগে নো ঘুম ।
অনেক শখের জেটল্যাগ খাওয়া হল না আর ।
এখানে আসার পর মনে করে করে দেশের অনেক মানুষকে ফোন করি , দেশে থাকতে যাদেরকে করা হত না , তাদেরকেও । ফোন করা হয় মূলত সন্ধ্যার পরে , বা সকালে । সন্ধ্যার পরে করলে প্রথমবার বেশিরভাগ(মুরুব্বী যারা তারা তো অবশ্যই) অবধারিতভাবেই জিজ্ঞেস করেন:
"ভার্সিটিতে যাও নাই?"
আমি বলি -- "না যাই নাই , এখন রাত"
--ওহহ , কয়টা বাজে তবে?
এরপর যতবারই ফোন করি করি , "কয়টা বাজে?" প্রশ্নটা শুনতেই । উইন্টারে বেশ সুবিধা ছিল ।
বাংলাদেশের সময়ের সাথে এখানকার সময় মিলে যেত বলে কেউ আর কথা বাড়াতো না। কিন্তু সামারে কথা আরও দীর্ঘ হয় ।
আমি বলি : "জ্বী , ১০ টা বাজে"
ওপাশ থেকে --"আমাদের এখানে ৯ টা , তাহলে কতক্ষণ পার্থক্য"
প্রথম প্রথম হিসাবে গোলমাল হয়ে যেত , এখন মুখস্থ বলি -- ১১ ঘন্টা পিছিয়ে আছি।
দুই
খানিক শিবের প্যাঁচাল অবতারণা করি । বুয়েটে ঢোকার পর নানান কিসিমের আতঙ্কে বুয়েটিয়ানদের ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা হয় , ক্লাসটেস্ট , অ্যাসাইনমেন্ট, সেশনাল , টার্ম ফাইনাল বলে শেষ করা দায় ।
অবাক ব্যাপার হল , এসব কিছুই নস্যি হয়ে যায় একটি নামের কাছে -- "সোনালী ব্যাংক" । ব্যাংকের কর্মকর্তা কর্মচারীরা একেকজন মূর্তিমান বিভীষিকা । ঢিমে তেতালা , আঠারো মাসে বছর -- এসব বাগধারা অনেক আগেই তারা গুলে খেয়েছেন । কেউ রাগ করে গলা চড়ালেও তাদের কর্মকর্তা কর্মচারীদের গন্ডারের চামড়া ভেদ করে সেসব কথা পৌছুনোর আগে যে বুয়েটের শিক্ষাজীবন যবনিকাপাত হয় , সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই ।
সোনালী ব্যাংক ফোবিয়ায় আক্রান্ত হয়ে আমি আমার অ্যাকাউন্টের ১৭ হাজার টাকা ফেলেই বিদেশ পাড়ি জমিয়েছি ।
আজ থেকে ৮ বছর কোন সিগনেচার দিয়ে অ্যাকাউন্ট খুলেছিলাম , সে কথা মনে নেই । এখানে আসার পর সেসব কথা রুমমেটকে জানাতেই, আমার রুমমেটের মনে হল , বুয়েটে তারও কিছু টাকা জমা আছে , এবং টাকার পরিমাণটা কত , সেটা তার জানা কর্তব্য । আমার মত গোঁয়ার গোবিন্দও সে না , করিৎকর্মার মত কোথেকে ফোন নম্বরও যোগার করে ফেলল । আমি বললাম , "ফোন করে কিছু জানার কথা ভুলে যা , এখানে এসে তুই দেশের নিয়ম ভুলে গেছিস"। আমার কথার তোয়াক্কা না করে বন্ধিু, এক বিকেলে ক্লাস থেকে ফিরে , হাত পা ছড়িয়ে রিং করল ।
তারপরে কি হয়েছিল , বন্ধুর জবানীতেই শুনুন :
"কেন যেন লোকটার গলা ভারী মনে হল , একবার মনে হল ঠান্ডা লেগেছে । যাই হোক , ওসব চিন্তা বাদ দিয়ে আমি কাজের কথা শুরু করলাম । "আমি এক্স-স্টুডেন্ট , ইউএসএ থেকে বলছি , আমার অ্যাকাউন্ট রিলেটেড ইনফরমেশন দরকার" । ভদ্রলোক বেশ অবাক করে দিয়ে টুকটাক ইনফরমেশন দিলেন । সবশেষে বললাম , আমার অ্যাকাউন্ট নম্বরটা দিই , দেখুন তো কত টাকা আছে।
ভদ্রলোক বললেন , "আপনাকে সকালে জানাই ?"। তড়াক করে ঘড়ির দিকে তাকালাম , "ও মাই গশশ , এখন তো বাংলাদেশে বিকাল ৪ টা না , রাত ৩ টা""
আল্লাহ পাক সোনালী ব্যাঙ্কের এই বিরল মহীয়ানকে উত্তম পুরস্কার দান করুন!!
তিন
দিন বিশেক আগে প্ল্যান করলাম , বন্ধুকে সাথে নিয়ে টেক্সাসের দক্ষিণে স্যান এন্টোনিও ঘুরতে যাবো । বাসের টিকেট করলাম , প্ল্যান করলাম ব্যাগ আগের রাতেই গুছিয়ে ফেলা হবে । সময়মত ব্যাগ গোছাতে না পেরে বাস-ফেইল করার মত সিচুয়েশন তৈরী করার রেকর্ড আমাদের দু'জনারই আছে । কিন্তু কথায় আছে -- "স্বভাব যায়না ধুলে , ইল্লত যায় না মলে" ।
রাত ১ টা বেজে গেছে , কিন্তু কারও ব্যাগ গোছানোর নাম নেই । খানিক পর দোস্তের আব্দার সে ১ ঘন্টা ঘুমোবে , তারপর গোছাবে । বসে বসে ব্রাউজ করছি , এমন সময় বন্ধু ঘুম জড়ানো কন্ঠে সময় জিজ্ঞেস করল , আমি বললাম -- ১:৪২ । মাঝে কতটা সময় গেল জানি না , পরের বার ঘড়িতে চোখ পড়লে দেখলাম তখন ৩:০১ । অবাক হলাম , কেন যেন মনে হচ্ছিল কোথাও কোন ভুল হচ্ছে , মাত্রই তো ১:৪২ দেখলাম ।
মনে মনে ভাবছি -- "নিশ্চয়ই বয়েস হয়ে গেছে মেহরাব , অথবা ইন্টারনেট ব্রাউজিংয়ে এতই মত্ত যে সোয়া একঘন্টা সময় কখন চলে যায় ,
খেয়ালই থাকে না" । বন্ধুর কথা মনে পড়তেই গিয়ে ধমকানো শুরু করলাম "কিরে তুই আর কত ঘুমাবি ? যাওয়ার কি ইচ্ছা-টিচ্ছা আছে?" । ৩:০১ শুনে দোস্তও লাফ দিয়ে উঠে , অপরাধী অপরাধী ভাব করে কাজ করতে শুরু করল
পরের সকালে মোবাইলে ৪ টা অ্যালার্ম সেট করে রেখেছি , দেশ থেকে আসার পর আলসেমি করে ৭ মাস চুল কাটা হয়নি , কিন্তু এবার আলসেমি ঝেঁটিয়ে বিদায় করা ছাড়া গত্যন্তর নেই । স্যান এন্টিনিও তে দু'একজন আঙ্কেলের সাথে দেখা হবে , লম্বা চুল দেখে পাছে ভেবে বসতে পারে যে পাখা গজিয়েছি।
এখানে একটা সেলুনে চাইনিজ মেয়েরা ৭ ডলারে চুল কেটে দেয় , হেঁটে যেতে কমপক্ষে ৩০ মিনিট দরকার ।
কাছাকাছিও সেলুন আছে বটে , কিন্তু ১৫ ডলার খরচ করার বিলাসিত আমার মত গ্রাজুয়েট স্টুডেন্টের সাজে না।
রবিবার সকালে মোটামুটি , খালি রাস্তা ধরে আমি একাই হেঁটে চলেছি , গিয়ে দেখি সেলুন বন্ধ । কেন বন্ধ তারও ব্যাখ্যা পেলাম না । হাতে সময় কম , বসে থাকার উপায় নেই , রাস্তার এপাশ ওপাশ আতিপাতি করে সেলুন খুজলাম , অবাক ব্যাপার হল সবক'টাই বন্ধ ।
মনে মনে নিজেকে বুঝ দিচ্ছি : এরা নিশ্চয়ই রবিবারে কাজ করে না ।
নানান রকমের প্রবাদ প্রবচন জপছি ,আর নিজেকে ধিক্কার দিচ্ছি-- "৭ মাস কি করেছ হে বালক ?" হন্যে হয়ে ঘন্টাখানেক খোঁজাখুজি করার পর হঠাৎ একটা সেলুন খোলা পেলাম । আগ-পাছ না ভেবেই গিয়ে বসে পড়লাম ।
সেলুনের ভিয়েতনামী মেয়ে চুল কাটার যন্ত্রে মোটে সময় নিল ৩ মিনিট , ডলার খসালো ১২ টা , চুল কেমন হয়েছে নাই বলি , দেশ থেকে জানিয়েছে , নাজিমুদ্দিন রোডের সেন্ট্রাল জেল থেকে খালাস পাওয়া জনৈক আসামীর সাথে আমার চেহারা হুবুহু মিলে গেছে ।
আর হ্যাঁ , খানিক পরে বুঝলাম দিনটা ১৩ মার্চ , ডেলাইট সেভিংয়ের জন্য সময় বদলে গেছে রাত ২ টায় । রাতে ২ টা বাজার পরের মিনিটেই রাত ৩:০১ বেজেছিল , আর আমি যখন সকাল ১১ টা ভেবে সেলুন খুঁজছি, তখন ঘড়িতে আসলে ১০ টা ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।