পূর্ববর্তী পর্ব : ইসকনের জৈববিবর্তন পাঠ-১
৪. ১৫৭ পৃষ্ঠায় ‘কিভাবে ভালুক হয়ে উঠল মস্ত তিমি’ অংশে আবারো ম্যানুপুলেশন করা হয়েছে। জীবের বিবর্তন প্রক্রিয়া সম্পর্কে নিজেদের অজ্ঞানতার ভাণ্ডার নিয়ে অনবরত ডারউইন এবং জৈববিবর্তনকে ব্যঙ্গ করা হয়েছে। যার ফলে গোটা লেখাই খেলো হয়ে গেছে। আজকের জৈববিবর্তন তত্ত্ব অনুসারে ‘ভালুক থেকে তিমির বিবর্তনে’র কথা মোটেও বলা হয়নি। সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণী তিমির বিবর্তন সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক তথ্য কেবল ফসিল রেকর্ড থেকে জানা যায়নি, একই সাথে আণবিক জীববিজ্ঞানের বিভিন্ন গবেষণা থেকেও বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে।
তিমির বিবর্তন নিয়ে ১৮৫৯ সালের জ্ঞান দিয়ে ২০১০ সালে এসে সমালোচনা করা হচ্ছে। জীববিজ্ঞানের বৈজ্ঞানিক গবেষণা কি ১৮৫৯ সালেই আটকে আছে? মনে হচ্ছে আপডেটেড ইনফরমেশন লেখকের জানা নেই। একটি প্রশ্ন, আজকের পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণা-জ্ঞান কি নিউটনের যুগে আটকে আছে? নিউটনীয় যুগ পেরিয়ে পদার্থবিজ্ঞান আইনস্টাইনের যুগও পার হয়ে গেছে। এখন কোয়ান্টাম ম্যাকানিক্সের যুগ চলতেছে। তেমনি জীববিজ্ঞান সম্পর্কিত জ্ঞান-তথ্য-উপাত্ত ডারউইনের যুগে আটকে নেই।
এ বিষয়টি স্পষ্টই মাথায় রাখতে হবে। ডারউইনের অনেক বক্তব্যই যে সংশোধিত হয়েছে এ বিষয়টি জীববিজ্ঞানীরা হরহামেশাই স্বীকার করেন। কিন্তু ক্রিয়েশনিস্টরা বারে বারেই দেখা যায়, পুরানো কাসুন্দি ঘেটে ডারউইনের ভুল বের করে চলেন। অসুবিধা নেই। ডারউইন যুগের বংশগতি বা জীববিজ্ঞানের অন্যান্য শাখায় যে তথ্যের দুর্বলতা ছিল তা বিজ্ঞানীরা কখনোই অস্বীকার করেন না।
বরং জোর গলায় প্রচার করেন। যাতে মানুষ বুঝতে পারে, জানতে পারে, শিখতে পারে উনবিংশ শতকের জীববিজ্ঞান আজকের একবিংশ শতকে এসে এসে কী কী আপডেটেড হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে আমি এখানে বলতে পারি বিখ্যাত ইভো-ডেভো সায়েন্টস্টি সন বি. ক্যারলের উপস্থাপনায় What Darwin never Knew ডকুমেন্টারি ফিল্মটির কথা। আগ্রহীরা দেড় ঘণ্টার এ ডকুমেন্টারিটি দেখলেই বুঝতে পারবেন, (কষ্ট করে গাদা গাদা বই পড়ে সময় নষ্ট করতে হবে না!!) ডারউইনের যুগ থেকে জীববিজ্ঞান আজকের একবিংশ শতাব্দীতে কতটুকু এগিয়েছে। কোনো জীববিজ্ঞানীই লুকোচুরি করে দাবি করেন না ‘ডারউইন জীবের বিবর্তন নিয়ে সব জানতেন এবং তার অরিজিন অব স্পিসিজ বইয়ের সকল বক্তব্য একদম সম্পূর্ণরূপে বৈজ্ঞানিক মহলে গৃহীত হয়েছে।
’ মোটেও না। ভুল স্বীকার করতে বিজ্ঞানের জগতে কোনো কার্পণ্য নেই। জীববিজ্ঞান কোনো স্থবির কোনো জ্ঞানের শাখা নয়। বিবর্তনীয় বিকাশমূলক জীববিজ্ঞান আর আণবিক জীববিজ্ঞানের কল্যাণে জৈববিবর্তনকে এখন গবেষণাগারে চাক্ষুস প্রমাণ করা সম্ভব হচ্ছে। আরেকটি কথা।
এই পৃষ্ঠায় ‘ডারউইনের বক্তব্য’ বলে ফুট নোটে কয়েক লাইন ইংরেজি বক্তব্য রয়েছে। যার অনুবাদও দেয়া হয়েছে এই পৃষ্ঠায়। গোবর্দ্ধনগোপালের বই থেকে ইংরেজি অংশটুকু তুলে দিচ্ছি : In North America the black bear was seen by Heame swimming for hours with widely open mouth, thus catching, like a whale, insects in the water. Even in so exteme a case as this, if the supply of insects were constant, and if better adapted competitors did not already exist in the country, I can see no difficulty in a race of bears being rendered by natural selection, more and more acquatic in their structure and habits, with larger and larger mouths, till a creature was produced as monstrous as whale. ডারউইন তার অরিজিন অব স্পিসিজ বইয়ের প্রথম সংস্করণে (২৪ নভেম্বর, ১৮৫৯) এরকম বলেছিলেন, হিয়ামের ভ্রমণকাহিনী থেকে জেনেছেন, ঐ অভিযাত্রী উত্তর আমেরিকায় ভালুককে পানিতে নেমে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে মুখ হাঁ করে শিকার ধরতে দেখেছেন ডারউইন তিমিরও একই ধরনের শিকার ধরার পদ্ধতি লক্ষ্য করেছেন। তিনি এও বললেন, ভালুক জাতীয় কোনো প্রাণী থেকে তিমির বিবর্তন হয়ে থাকে তবে তিনি খুব একটা বিস্মিত হবেন না। অরিজিন অব স্পিসিজ-এ ডারউইনের এ মন্তব্যের কারণে তার বন্ধুমহলে এবং বৈজ্ঞানিকমহলে তীব্র হাস্যরস এবং তীর্যক মন্তব্য করা হয়।
ফলে ডারউইনকে অরিজিন অব স্পিসিজ-এর পরবর্তী সংস্করণগুলোতে এ মন্তব্যটি বাদ দিয়ে দিতে হয়। আণবিক জীবিজ্ঞানের বদৌলতে তিমি-ডলফিনের গ্রোথ হরমোনের জিন সিকুয়েন্স বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণী তিমি-ডলফিনের ডিএনএ সিকুয়েন্সে শতকরা ৯৯ ভাগ সাদৃশ্য রয়েছে। কিন্তু এদের একটা আরেকটার সরাসরি পূর্বপুরুষ নয়। বরং এরা একই পূর্বপুরুষ থেকে বিবর্তনের মাধ্যমে উদ্ভূত। প্রাণীজগতে তিমি-ডলফিনের নিকট আত্মীয় স্তন্যপায়ী প্রাণী হচ্ছে জলহস্তী, যার সাথে তিমি-ডনফিনের ডিএনএ সিকুয়েন্সের মিল শতকরা ৯৭ ভাগ।
জলহস্তীর সাথে তিমির যেমন আণবিক পার্থক্য অত্যন্ত কম তেমনি বাহ্যিক শরীরের আকৃতিতে পার্থক্যের পরিমাণ কম। পূর্বে প্রত্ন-জীববিজ্ঞানী এবং আণবিক জীববিজ্ঞানীদের বক্তব্য ছিল মাংসাশী খুরযুক্ত এক সময়কার স্থলচর স্তন্যপায়ী থেকে তিমির বিবর্তন ঘটেছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ক্রিয়েশনিস্টরা সবসময়ই জৈববিবর্তন-বিজ্ঞানীদের বক্তব্য বিকৃত করে উপস্থাপনে পারঙ্গম। তিল বললেই তালের কথা বুঝে যায়! খুরযুক্ত প্রাণীর কথা বলতেই ক্রিয়েশনিস্টরা প্রচার করা শুরু করলো, ডারউইন একসময় বলেছেন ভালুক থেকে তিমির বিবর্তন ঘটেছে আর এখন বিজ্ঞানীরা আগের অবস্থান থেকে সরে এসে বলছেন গরু থেকে তিমির উদ্ভব হয়েছে!! গোবর্দ্ধনগোপাল বাবুও তার গুরু আইডিওয়ালা ক্রিয়েশনিস্টদের কাছ থেকে ‘গরু থেকে তিমি উদ্ভব’ তথ্যটি ধার করে আনন্দে আত্মহারা হয়ে বগল বাজিয়েছেন একচোট। তিনি বোধহয় জানেন না বা জানার সুযোগ হয়নি গরু যে মাংসাশী প্রাণী নয় এ বিষয়টি তার নিজের গুরু ক্রিয়েশনিস্টরা বেমালুম চেপে গিয়েছিলেন এবং জীববিজ্ঞানীরা কখনোই বলেননি তৃণভোজী গরু থেকে তিমির উদ্ভবের কথা।
আর গরু ছাড়া কি কোনো প্রাণীর পায়ে খুর নেই!! শুকর, জলহস্তি, ঘোড়া, উট ইত্যাদি প্রচুর প্রাণীর পায়েই আঙুলের বদলে খুর রয়েছে। যাইহোক, বর্তমানকালের বেশিরভাগ জীববিজ্ঞানীই মনে করেন প্রাণীজগতে তিমির গ্রুপটি বিবর্তিত হয়েছে জলহস্তী-শুকরের বংশপুরুষ artiodactyls থেকে। (আগ্রহীরা পাঠ করুন ব্রিটিশ বংশগতিবিদ স্টিভ জোন্সের লেখা Darwin’s Ghost: The Origin of Species Updated বই)। এছাড়া গরুর সাথে তুলনা করে তিমির বিশাল আকৃতি নিয়ে গোবর্দ্ধনগোপাল যা যা বলেছেন, তার ব্যাখ্যা বতর্মানকালে বিবর্তনীয় বিকাশমূলক জীববিজ্ঞান (Evolutionary Developmental Biology) খুব পরিস্কার করে দিয়েছে। এ বিষয়েও জানার জন্য বাজারে পর্যাপ্ত বই রয়েছে।
সংক্ষেপে বলা যায়, আমরা মানুষেরা প্রায়শ আমাদের সাপেক্ষে কোনো কিছুর দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-উচ্চতা বিবেচনা করি। এটা আমাদের সাধারণ অভ্যাস। পৃথিবীতে তিমি একমাত্র বিশাল আকৃতির প্রাণী নয়। বিশাল দেহের অনেক প্রাণী যেমন ডায়নোসর, ম্যামথ ইত্যাদি অতীতে ছিল, বর্তমানেও যেমন বিশাল আকৃতির হাতি, জিরাফ আছে আবার অতিক্ষুদ্র অণুজীব ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়া জীব রয়েছে যাদের খালি চোখেও দেখা যায় না। উদ্ভিদের মধ্যে বট গাছের মতো বিশাল দেহের অধিকারী বৃক্ষ যেমন আছে, তাল গাছের মত লম্বা এবং তেমনি আম-জাম-কাঠাল গাছের মতো মাঝারি সাইজের উদ্ভিদও আছে, অতিক্ষুদ্র জলজ শৈবাল রয়েছে যাদের আবার খালি চোখে দেখা যায় না।
অর্থাৎ আমি এটাই বলতে চাচ্ছি জীবের বিশালকার, মাঝারি আকার কিংবা অত্যন্ত ক্ষুদ্রাকার এসবই জীবজগতের বৈশ্বিক বাস্তবতা। ভ্যারিয়েশন। অপ্রাকৃত বা অস্বাভাবিক কিছু নয়। জীববিজ্ঞানীদের মতে কোনো জীব শুধুমাত্র আকৃতির পরিবর্তনের ফলেই বিশাল আকার বা ক্ষুদ্রাকার দেহ লাভ করেনি। প্রাণী বা উদ্ভিদের দৈহিক আকার ব্যাখ্যায় ঐ প্রাণীর জীবনকাল, বিপাকক্রিয়া, খাদ্যাভ্যাস, খাদ্যের পর্যাপ্ততা, ইকোলজি, চলাচলের সমতা ইত্যাদি বিবেচনায় নেয়া হয়।
এ বিষয়ে জানতে আগ্রহীরা পাঠ করুন : John Tyler Bonner এর লেখা Why Size matters: From Bacteria to Blue Whales বইটি।
৫. ১৬১ পৃষ্ঠায় ‘কিভাবে জিরাফ পেল তার ল…….ম্বা…. গলা’ অংশে জৈববিবর্তনের নাম করে ভ্রান্ত বক্তব্য পরিবেশন করা হয়েছে উদ্দেশ্যমূলকভাবে। ডারউইনের নামে এখানে যা বলা হয়েছে, তা ল্যামার্কের বক্তব্য। জীবের বিবর্তন সম্পর্কে ডারউইনের সঙ্গে ল্যামার্কের বক্তব্যের প্রচুর পার্থক্য রয়েছে। এই পার্থক্যের বিষয়টি সম্মানিত লেখক গোবর্দ্ধনগোপাল কি অবগত ছিলেন না? না-কি ইচ্ছেকৃতভাবেই ম্যানুপুলেশন করা হয়েছে।
জিরাফের লম্বা গলা সম্পর্কে ল্যামার্ক-ডারউইনের আলাদা আলাদা দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাখ্যা রয়েছে যুক্তি’র তৃতীয় সংখ্যার (জানুয়ারি, ২০১০) ৫৩-৫৫ পৃষ্ঠায়। তাই এখানে আর পুনরুল্লেখ করলাম না।
৬. ১৬৫ পৃষ্ঠায় ‘কিভাবে মাছ হাঁটতে শুরু করেছিল ডাঙায়’ অংশে আবারো জীবের বিবর্তন প্রক্রিয়া সম্পর্কে অজ্ঞতাই পেয়েছে। জীববিজ্ঞানীরা কখনোই দাবি করেন না, এক বা একাধিক মাছ একদিন বা দুইদিনেই কোনো জলে উঠে উভচর বা সরীসৃপে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। সিলাকান্থ , লাঙফিস , মাডস্কিপার মাছের নাম জানা থাকলে এদের বৈশিষ্ট্য জানার চেষ্টা করুন।
মাছ থেকে উভচর জীবের বিবর্তন প্রক্রিয়া সম্পর্কে অনেক কিছু বুঝতে পারবেন।
৭. ১৬৫ পৃষ্ঠায় ‘কিভাবে উদ্ভব হল পাখির : পেঙ্গুইন পাখা মেলেছিল আকাশে’ অংশে আবারো পূর্বের কথা বলতে হচ্ছে। জৈববিবর্তন তত্ত্ব অনুসারে সরীসৃপ জাতীয় প্রাণী থেকে পাখি এবং স্তন্যপায়ী প্রাণীর উদ্ভব ঘটেছে। আধুনিক গবেষণার মাধ্যমে কোন জাতীয় সরীসৃপ থেকে পাখির উদ্ভব তা অনেকাংশেই নিশ্চিত করা বলা সম্ভব হচ্ছে। ছোট আকারের থেরাপড ডায়ানোসর থেকে পাখির উদ্ভব ঘটেছে।
এ বিষয়ে পর্যাপ্ত জীবাশ্ম প্রমাণ জীববিজ্ঞানীদের কাছে রয়েছে। জীবাশ্ম-প্রমাণ একটি-দুটি নয়। শুধুমাত্র আর্কিওপটেরিক্স প্রজাতির পাখির পূর্বপুরুষের ফসিল ১৮৬০ সাল থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে নয়বারে প্রচুর পরিমাণে ফসিল পাওয়া গেছে। এছাড়া চীনের লায়নিং প্রদেশে ১৯৯৬ সাল থেকে এখন পর্যন্ত বহুবার পাখির পূর্বপুরুষের ফসিল পাওয়া গেছে। এসব ফসিলের অভ্যন্তরীণ গঠন, ডিএনএ টেস্ট, এনাটোমিক্যাল টেস্ট থেকে খুব স্পষ্টভাবে থেরাপড ডায়নোসর থেকে পাখির বিবর্তনের বিষয়টি ফুটে উঠেছে।
কেউ যদি বিজ্ঞানের আধুনিক গবেষণা সম্পর্কে ইচ্ছেকৃতভাবে জানতে না চায়, উটপাখির মতো বালিতে মুখ গুজে বসে থাকতে চায় সে স্বাধীনতা অবশ্যই তার আছে। কিন্তু বিজ্ঞানের কোনো বিষয়ের বিরোধিতা করতে হলে অবশ্যই যাচাই করে নেয়া ভাল, সর্বশেষ গবেষণা থেকে কি জানা গেছে। কারণ বিজ্ঞান স্থির কিছু নয়। বিজ্ঞান কখনো নিজেকে অপৌরষেয় দাবি করে না। এটি পরিবর্তনশীল।
নিত্যনতুন গবেষণার মাধ্যমে বিজ্ঞান নিজেকে ঋদ্ধ করছে।
৮. ১৬৮ পৃষ্ঠায় বর্ণিত ‘এক প্রজাতি রূপান্তরিত হয়ে অন্য প্রজাতি : সত্যি না গল্প’ অংশ পাঠ করে মনে হয়েছে লেখক প্রজাতির সংজ্ঞা সম্পর্কেই অবগত নন। প্রজাতির সংজ্ঞা হচ্ছে, এটি এমন একটি প্রাকৃতিক জীবগোষ্ঠী, যার সদস্যরা নিজেদের মধ্যে প্রজনন সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে, যাদের সকলের আছে সাধারণ জিন ভাণ্ডার এবং অনুরূপ অন্য আরেকটি প্রাকৃতিক জীবগোষ্ঠী থেকে প্রজননের দিক থেকে বিচ্ছিন্ন। এ সংজ্ঞাটি যৌনজননশীল উদ্ভিদ-প্রাণী উভয়েরই ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। বর্তমানে মানুষের যেহেতু অন্য প্রজাতি টিকে নেই, তাই মানুষের উদাহরণ টানলে অনেকেই এ বিষয়টি বুঝতে উঠতে পারেন না।
উদাহরণস্বরূপ ফিঞ্চ পাখির প্রসঙ্গ এখানে নিয়ে আসি। আমরা জানি বর্তমানে ফিঞ্চ পাখির ১৪টি প্রজাতি আছে। এর মধ্যে যে কোনো দুটি প্রজাতির কথা ধরা যাক। Geospiza fortis এবং Geospiza magnirostris । ফিঞ্চ পাখির ১৪টি প্রজাতির সকলের নাম ফিঞ্চ।
কিন্তু এরা প্রজাতিতে ভিন্ন। ভিন্নতা কিসে? ভিন্নতা হচ্ছে Geospiza fortis প্রজাতির ফিঞ্চ পাখিরা নিজেদের মধ্যে প্রজনন সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে। এর ফলে এদের প্রজননে সম বংশধর জন্ম নেয়। এরা আবার একই প্রজাতির অন্য সদস্যদের সাথে যৌনসম্পর্ক স্থাপন করতে পারে। এভাবে Geospiza fortis প্রজাতির জিনের আদান-প্রদান চলতে থাকে।
কিন্তু Geospiza fortis প্রজাতির ফিঞ্চ পাখিরা Geospiza magnirostris প্রজাতির ফিঞ্চদের সাথে যৌনসম্পর্ক স্থাপন করতে পারে না। জিনের বিনিময় হয় না। তাই উভয়েই স্বতন্ত্র প্রজাতি। বর্তমানে পৃথিবীতে বাঘের ৬টি প্রজাতি টিকে আছে। গত শতাব্দী পর্যন্ত নয়টি প্রজাতি ছিল।
যাহোক, বাঘের যে কোন একটি প্রজাতির সাথে অনেক সময় সিংহের কোনো এক প্রজাতির প্রজননের মাধ্যমে লাইগার নামক বাচ্চা জন্ম নেয়। আবার গাধা এবং ঘোড়া থেকে খচ্চর। লাইগার বা খচ্চর কেউই প্রজননে সক্ষম নয়। এরা সংকর জাত। অর্থাৎ তারা যদিও ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতি থেকে যৌন মিলনের ফলে জন্ম নিয়েছে ঠিকই তবে এরা নিজেরা প্রজননে অক্ষম থাকে।
তারা কোনো বংশধর রেখে যেতে পারে না। অর্থাৎ এক প্রজাতি থেকে অন্য প্রজাতিতে প্রজননে বিচ্ছিন্নতাই প্রজাতির সংজ্ঞার বৈশিষ্ট্য। এখন প্রশ্ন দেখা দেয়, প্রজনন-বিচ্ছিন্নতা যদি প্রজাতি থেকে প্রজাতি থাকে তবে তবে এক প্রজাতি থেকে অন্য প্রজাতির উদ্ভব হয় কিভাবে? এটাই জৈববিবর্তনের সেন্ট্রাল অংশ। জীববিজ্ঞানীরা প্রকৃতিতে প্রজাতির উদ্ভবের চারটি পদ্ধতির কথা আমাদের জানিয়েছেন। এগুলো হচ্ছে : Allopatric , Peripatric , Parapatric , Sympatric ।
জানার আগ্রহ থাকলে জীববিজ্ঞানের বই থেকে এ বিষয় সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিতে পারবেন। মনে রাখতে হবে, প্রজনন বিচ্ছিন্নতা জীবজগতে পার্মানেন্টলি কনস্ট্যান্ট নয়। ধ্রব হলে তো নতুন প্রজাতির উদ্ভব হতো না। প্রায়ই বিভিন্ন দেশের জীববিজ্ঞানীরা কৃত্রিম নির্বাচনের মাধ্যমে এক প্রজাতি থেকে অন্য প্রজাতির উদ্ভব ঘটাচ্ছেন। যেমন বাংলাদেশে কৃষিবিজ্ঞানীরা বিরি নামে নতুন প্রজাতির ধান উদ্ভাবন করেছেন, এ খবর সবাই জানেন।
বিরি নতুন প্রজাতির ধান মানে কি? মানে হচ্ছে, কৃষিবিজ্ঞানীরা বিরি নামক প্রজাতির ধান ক্রসব্রিডিং করে অন্য প্রজাতির ধান থেকে উদ্ভাবন করেছেন। ধরে নিচ্ছি এর নাম ইরি-৪৭। এখন ইরি-৪৭ এবং বিরি-৪৬ প্রজাতির ধান গাছের ক্রসব্রিডিং বা সহজ বাংলায় বলা যায় যৌনসম্পর্ক স্থাপন করালে কোনো ফলন হবে না। শুধু নতুন প্রজাতির ধান গাছ নয়, বিভিন্ন ধরনের খাদ্যশষ্য, রবিশষ্য, ফলের নিত্যনতুন প্রজাতি তৈরি করা হচ্ছে দীর্ঘদিন থেকে। এছাড়া মানুষ নিজে কুকুর, বিড়াল, ছাগল, গরু, কবুতর, ফলের মাছি প্রভৃতি জীবের নতুন প্রজাতি উদ্ভাবন করেছে।
তাই এক প্রজাতি থেকে নতুন প্রজাতির উদ্ভব একদম অবাস্তব বা অতিকল্পনা নয়।
৯. ভিতরে প্রতিটি পৃষ্ঠায় প্রচুর ভুল তথ্যে ঠাসা। আমি এতো আলোচনায় আপাতত যাচ্ছি না। এখন দেখা যাক ১৮৫ পৃষ্ঠা। শিরোনাম ‘চান্স ভ্যারিয়েশন ফ্যাক্টরের অদ্ভুত কারসাজি’।
লেখা রয়েছে ‘ডারউইনের মতে প্রজাতির উদ্ভবে ‘চান্স ভ্যারিয়েশন ফ্যাক্টর বা দৈবক্রমে সংঘটিত প্রকরণ তত্ত্ব এক বিশেষ ভূমিকা পালন করে। ’ ভুল বক্তব্য। ইতিহাস সম্পর্কে অজ্ঞতা নাকি ইচ্ছেকৃত চালাকি? ডারউইন কখনোই এমনটা দাবি করেননি। ভ্যারিয়েশনের উদ্ভবের প্রক্রিয়া ‘মিউটেশন’ সম্পর্কে ডারউইন মোটেই জানতেন না। সেখানে দৈবক্রমে বা অদৈবক্রমে আবার কি? ডারউইন সম্পর্কে এমন দাবির পর যা বলা হয়েছে তা প্রাকৃতিক নির্বাচন সম্পর্কে ভুল ব্যাখ্যা আর অজ্ঞতার মিশেল।
জীবের বিবর্তন প্রক্রিয়া সম্পর্কে এমন ভ্রান্ত ধারণা (চান্স ভ্যারিয়েশন ফ্যাক্টর) দাঁড়িয়ে আছে মিউটেশন এবং প্রাকৃতিক নির্বাচনের মধ্যেকার পার্থক্য সম্পর্কে অজ্ঞতার উপর। জৈববিবর্তনের ‘কাঁচামাল’ বিক্ষিপ্ত-আকস্মিকভাবে সংঘটিত মিউটেশন থেকে একক জীবে ভ্যারিয়েশনের উদ্ভব হয় কিন্তু জীবের গোটা বিবর্তন প্রক্রিয়াটি মোটেও চান্স আর র্যান্ডমের কারসাজি নয়। পরিবেশের সাথে অভিযোজনক্ষম ভ্যারিয়েশন বা প্রকরণ প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বংশধরের মাধ্যমে প্রজাতি বা জনগোষ্ঠীতে ছড়িয়ে পড়ে। ছড়িয়ে পড়ার এ বিষয়টি মোটেও র্যান্ডম বা আকস্মিক, বিক্ষিপ্ত কিংবা দৈবক্রমে ঘটা কোনো ঘটনা নয়। এটি চূড়ান্ত (deterministic) একটি প্রক্রিয়া।
পরিবেশের জন্য উপযুক্ত ভ্যারিয়শনসম্পন্ন জীব অধিক হারে বংশধর রেখে যেতে পারে, আর অনুপযুক্ত ভ্যারিয়েশনসম্পন্ন জীবের পরিবর্তিত পরিবেশে টিকে থাকা দায় হয়ে যায়, বিলুপ্তি ঘটতে থাকে ধীরে ধীরে। প্রকৃতিতে জীবজগতে ‘নির্বাচন’ ক্রিয়াশীল থাকে নন-র্যান্ডম, দৃঢ় ক্রমবর্ধমান (cumulatively) পদ্ধতিতে। রোমান সভ্যতা যেমন একদিনে তৈরি হয় নি, উত্তর- দক্ষিণ মেরু অঞ্চলের বরফ যেমন তাৎক্ষণিকভাবে উদ্ভূত হয় নি, তেমনি প্রাকৃতিক নির্বাচন-ও তাৎক্ষণিক কোনো ঘটনার ফল নয়, নয় ইতঃস্তত, বিক্ষিপ্ত চান্সের কোনো খেলা। জীবের বিবর্তন প্রক্রিয়াটি রূপ পায় হাজার থেকে মিলিয়ন মিলিয়ন প্রজন্মের মাধ্যমে।
১০. এরপরও মিথ্যার মিশেল চলমান।
আমাদের এখানের কাস থ্রি-ফোরের বাচ্চারা জানবে রক্তের রঙ লাল কেন? অথচ গোবর্দ্ধনগোপাল ২০৩ পৃষ্ঠায় বলতেছেন ‘হিমোগ্লোবিন বাতাস থেকে প্রাণদায়ী অক্সিজেন ধারণ করে কোষ কলায় পৌঁছে দেয় এর জন্য রক্তের রঙ লাল। ’ লোহিত কোষের মধ্যে রয়েছে হিমোগ্লোবিন, যার মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন অংশে অক্সিজেন পৌঁছে যায়। হিমোগ্লোবিন (haemoglobin) শব্দের হিম লোহার একটি যৌগের নাম আর গ্লোবিন হল এক ধরনের প্রোটিন। লোহার এই যৌগের বিরাট সংখ্যায় উপস্থিতির জন্য রক্তের রঙ লাল দেখায়। আরেকটু বলা যায় রক্তের সাথে লৌহিতকোষের অভিযোজনের বাই-প্রোডাক্ট বা উপজাত হিসেবে রক্তের রঙ লাল।
অর্থাৎ জীবদেহে রক্তের মাধ্যমে অক্সিজেন পৌঁছে যায়, সেটা অন্য ফাংশন।
চলতে পারে...
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।